লালন সাঁই উচ্চস্তরের সুফি সাধক ছিলেন — এই কথাটা নানাভাবে নানাস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া একদল সক্রিয় আধুনিক উদ্যমের অংশ। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের তৎকালীন মন্ত্রী শাহ্ আজিজুর রহমান এক বক্তৃতায় বলেন, লালন শাহ এক উঁচুদরের সুফি সাধক ছিলেন এবং পবিত্র কোরানের ভাষায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। তাঁর এ বক্তব্যের পরে কুষ্টিয়ার এ.এইচ.এম ইমামউদ্দীন এর প্রতিবাদ ছাপেন। এর আগে ১৯৬৯ সালে ইমামউদ্দীন তাঁর ‘বাউল মতবাদ ও ইসলাম’ বইতে জেড.এ তোফায়েল ও আনোয়ারুল করীমের বক্তব্য খারিজ করেছিলেন। তোফায়েল তাঁর ‘History of Kustiya’ বইতে লালন ফকির সম্পর্কে লিখেছিলেন, “He was greatly influenced by the best tenets of Sufism and Vaishnabism, which enriched Bauliana.” আনোয়ারুল করীম তাঁর ‘বাউল কবি লালন শাহ’ বইতে লিখেছিলেন, “লালন ফকিরের গানে যেমন আমরা ইসলাম ও নবী প্রীতির পরিচয় পাই, তেমনি বাউল ও বৈষ্ণব সহজিয়ার সাধনমার্গের কথাও শুনতে পাই, লালন ফকিরের সাধনায় দুই ধর্মেরই যোগ ছিল। এই দুইজনের বক্তব্যই অস্বীকার করেন ইমামউদ্দীন।”
আসলে মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ-ইসলাম ধর্ম এবং সংস্কৃতির নানারকম গূঢ় বিমিশ্রণ ঘটেছিল মানুষের মধ্যে। বহুক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্মের নির্দেশ বা শাস্ত্র ধারণা সম্বন্ধে সাধারণত মানুষ খুব বিচারশীল বা নিষ্ঠাশীল হয় না। কারণ, ধর্ম বা শাস্ত্র সম্বন্ধে প্রকৃত পথ বা নির্দেশ তাদের কাছে পৌঁছায় না। তারা অশিক্ষিত তাই সংস্কৃত কিংবা আরবিতে লেখা শাস্ত্র তারা পড়তে পারে না। নিজেরা তাই নিজের মতো করে সব বানিয়ে নেয়। শাস্ত্রবিশ্বাস আর আচরণবাদকে বড় করে না দেখে, ভাবালুতা ও আবেগকে তারা বড় ভাবে। এরাই একসময়ে সত্যনারায়ণের সঙ্গে পিরবাদকে মিশিয়ে সত্যপির দেবতার কল্পনা করেছিল, যেখানে হিন্দু-মুসলিম ভক্তের ভেদাভেদ ছিল না, আজও নেই। মধ্যযুগ থেকেই বাংলার বাউল-ফকিরেরা সমন্বয়বাদী গান করতেন।
মা আয়শা পাগল হলেন নবিপ্রেমে মদিনায়,
বাঁশির সুরে পাগল হয়ে রাধা চলে যমুনায়।
একই মায়ের দুটি সন্তান হিন্দু আর মুসলমান,
একই কুলে জন্ম মোদের একই বুকে দুগ্ধপান।
দেখে আয় ভাই হিন্দু-মুসলিম মদিনা আর মথুরায়,
দুই রাখালে যুক্তি করে গরু-বকরি চরায়।
কিন্তু প্রান্তবাদীরা এমন সমন্বয়বাদী জীবনস্পর্শী গানে ইসলামের ব্যর্থতা বা পতনের চিহ্ন দেখেন, খেদ ঝাড়েন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ আকরাম খাঁ রচিত ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ বইতে তিনি সমন্বয়বাদের সামাজিক সাহিত্যকে ধিক্কার জানান। আকরাম খাঁর ধারণা, ব্রাহ্মণের অত্যাচারে বিপন্ন বৌদ্ধরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, একই কারণে হিন্দুরা নেন ইসলামের ছায়াতল। তিনি মনে করতেন, মধ্যযুগের মুসলমান কবিরা হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আদর্শ হিসেবে নেওয়ার ফলে কেবল তা সাহিত্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং তা সঞ্চারিত ও প্রসারিত হয়েছে সামাজিক ও ধর্মীয় ভাবে। এটা প্রথম যুগ। এনামুল হক ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতো জহুরি সমালোচক যখন পুঁথিকাব্যের সমন্বয়বাদ লক্ষ করে তার প্রশংসা করেছেন তখন আকরাম খাঁ তার সমালোচনা করেছেন। প্রবীণ লেখক আহমদ শরীফের মনে হয়েছে, বৌদ্ধ সহজিয়া ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের ফলে দুটি আলাদা পথ তৈরি হয়। বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যে যারা বামাচারী ছিলেন না তারা হয়েছিল শৈব নাথযোগী, আর যারা বামাচারী তারা হয়েছিল বৈষ্ণব সহজিয়া।
একেই বলে স্বচ্ছ চোখে সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। পাশাপাশি একসঙ্গে বহুদিন বসবাসের ফলে মুসলমান যদি হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির কথা জানে, বোঝে কিংবা রূপক-প্রতীক ব্যবহার করে তাতে সমস্যা কোথায়? তেমনি হিন্দু লোকগীতিকারের রচনায় যদি আসে ইসলামকথন কিংবা ইসলামী শাস্ত্রচেতনা তখন আশ্চর্যের কী আছে? বাউল মতবাদ মূলত বিমিশ্রণধর্মী। তাই সাম্প্রদায়িকতাহীন, পরমতসহিষ্ণু এই লোকধর্ম বহু বছর আমাদের নিম্নবর্গের সমাজস্তরের একটি স্বস্তিকর মিলনভূমি রচনা করেছে। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-জাতিহীন মানুষ তাদের উপাস্য। তাদের আবির্ভাব ও বিকাশে বৈষ্ণব ও সুফি প্রভাব অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বাউলদের বিপুল জনপ্রিয়তা ও সংখ্যাবৃদ্ধি বিশ শতকে মধ্য ও নিম্নবঙ্গে অনেকের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। লালনের তিরোধানের পর এদেশে ষাট-সত্তর লক্ষ বাউল ছিল, — এমন বিবরণ পাওয়া যায়। লালনের জীবনধারা ও গানের মর্মবাণী বহু হিন্দু-মুসলিমকে বাউলপন্থায় আকৃষ্ট করেছিল। সেটা কট্টরপন্থীদের ভালো লাগেনি। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত বই “বাউল ধ্বংস ফতওয়া” বই থেকে জানা যায় যে, — নদীয়া, পাবনা, যশোর, রংপুর, বরিশাল ও মুর্শিদাবাদের ১৯৪ জন আলেম মুসলমান বাউলদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন এমনকি তাদের জীবনযাপন ধরন দর্শন নিয়ে নানা কটূক্তি ও প্রশ্ন তুলেছেন। এই বইতে লালনকে ‘মুরতাদ’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ পাকিস্তান আমলে ফকিরকে মুসলমান বংশজাত প্রমাণের হিড়িক পড়ে যায়। সেই প্রয়াসের সম্প্রসারণে তাঁকে সুফি সাধক ও তাঁর গানকে ‘সুফি সামা’ গানরূপে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। মুহম্মদ আবু তালিব “লালন চরিতের উপাদান : তথ্য ও সত্য” নিবন্ধে লালন সাঁই ধারাকে চিশতী-নিজামী তরিকার অন্তর্ভূক্ত করা সহ লালন সাঁইকে নিজামউদ্দীন আউলিয়ার সুফি খানদান হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। তিনি বলেন, — লালন সাঁইকে কেন্দ্র করে যে সংগীতাদর্শ বা ঘরানার সৃষ্টি হয়েছে তা মূলত ইসলামী সুফি জীবনাদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ইসলামের দিক থেকে বিচার করলে তা বিখ্যাত চিশতিয়া তরিকার নিজামীয় শাখার উত্তরাধিকার। এখন প্রশ্ন হলো, লালন শাহী ঘরানা কি সুরের নাকি ভাবের? যদি সুর বা বন্দিশের হয়, তবে জিজ্ঞাসা থেকে যায় — লালনগীতি কি তার ভাবমূল্য ও বস্তসত্যেই কালজয়ী হয়নি? তবে ঘরানার প্রশ্ন ওঠে কী করে? এককালে বাউলরা নিজেরাই সম্ভবত মুসলমান সমাজকে প্রভাবিত করার জন্য নিজেদের সুফি খানদানের সিজরানামাভুক্ত করে একটা সামাজিক ভিত্তি তৈরি করেছিল। উক্ত বইতে তার নিন্দা জানানো হয়। আবু তালিব লালনকে বাউল না বলে সুফি খানদানের অন্তর্ভূক্ত করে সন্মান দেখিয়েছেন, যদিও লালনের গান শুনতে পাননি।
লালন ফকির সদর্থে সুফিও নন, কেননা সারাদেশের বাউলধারণার সঙ্গে লালনমতের কিছু কিছু মিল থাকলেও লালনীয় মতবাদ একটু আলাদা পথচারী। তবে লালনপরবর্তী মৌলানা-মৌলভী এবং নৈষ্ঠিক হিন্দুবর্গ তাঁকে বাউল শ্রেণীভুক্ত করেছেন। তার একটা বড় কারণ হলো, দুই বাংলার বাউল ফকিররা লালনের গান বেশি গেয়ে থাকেন, সুরের অনুসরণ করেন, এতে ভাবাশ্রিত হতে পছন্দ করেন। লালনের গানে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠা করার মতো অনেক যুক্তি ও তত্ত্বের ভিত্তি খুঁজে পান। খুব নির্মোহ ইতিহাসের বিচারে লালনের কোনো গুরুপরম্পরা পাওয়া যায় না। সিরাজ সাঁই প্রাথমিক পর্বে লালনের কায়কর্মের দীক্ষা ও শিক্ষাগুরু ছিলেন। সেই দেহত্ত্বের চিরায়ত পথে লালন ক্রমশ নিজস্ব এক সাধনা ও উপলব্ধির ধরন নিয়ে এগিয়েছেন। যত এগিয়েছেন, তত নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন। ক্রমেই খসে পড়েছে প্রচলিত ধর্ম-আচার-মন্ত্র-শাস্ত্র আর প্রতিষ্ঠানের বর্ম। লালনের মৃত্যুর দীর্ঘকাল পর পর্যন্ত তাঁর গান ও সুরের ভুবন অনাবিষ্কৃত ছিল। তৎসময়ে তাঁর গানের সমঝদার লোক সমাজে কম ছিল। তারা বৈরাগ্যের গান ভালোবাসত। লালনের নিগূঢ় উচ্চারণ ও শব্দবন্ধ সাধারণ মানের গায়ক ও শ্রোতারা অনুধাবন করতে পারেননি। তাঁর “যখন নিঃশব্দ শব্দেরে খাবে”, “শব্দের ঘর নিঃশব্দের কুঁড়ে” কিংবা “আমার ঘরের চাবি পরের হাতে” … এ-জাতীয় এপিগ্রামের গভীরতা ক’জনই-বা বুঝেছিল? মুহম্মদ আব্দুল হাই বলেছিলেন, — লালন শাহ্-এর নাম কেউ জানত না, আর তিনি তো বেশরা ফকির ছিলেন এবং বাংলা ভাষায় বলতেন-লিখতেন। ওই সময়ের আরবি ও লালন সাঁইয়ের কথা শিক্ষিত মহল গ্রাহ্য করেননি। তিনি ছিলেন দরিদ্র, দরিদ্র ব্রাহ্মণ দ্বারা লালিতপালিত। লালন সাঁইয়ের কথা শিক্ষিত মহল গ্রাহ্য করেননি, আদৌ মনোযোগ দেননি এবং আমাদের ভদ্রলোকেরা চিরকালই তাঁকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করেছেন।
লক্ষণীয় যে রবীন্দ্রনাথ এমনকি গগন হরকরার দুটি সুরে নিজের গান বেঁধেছিলেন, কিন্তু লালানগীতির সুরে নিজে প্রভাবিত হননি, কোনো স্বাক্ষর রাখেননি। অথচ, অনেক প্রমাণ মেলে যে, থিমেটিক দিক থেকে লালনের গান তাঁর ভালো লেগেছিল ,ভালোবেসেছিলেন লালনের অন্তর্বাণীর লাবণ্য ও মরমিয়া ভাবালুতা। মনে হয় বাউলদের ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের ভাবালুতা তাঁকে এককালে যতটা উদ্বোধিত করেছিল পরে তাদের জীবনযাপনের মুক্ত ধরন, বস্তুবাদ ও তর্কমুখী তাত্ত্বিকতা তাঁকে ততটা টানেনি। রবীন্দ্রনাথের মতে বাউল মতবাদ একটা parallel tradition, নতুন যুক্তিকাঠামো দিয়ে বাউলরা চান একটা নতুন জীবনবোধ গড়তে। তাদের সাধনার পথ নিঃসঙ্গ নির্জন এবং অবশ্যই গোপনতায় প্রচ্ছন্ন। শাস্ত্রের যে ভগবান ধর্মকর্মের ব্যবহারে লাগেন, তিনি সনাতনপন্থী ধার্মিক লোকের ভগবান, তাকে নিয়ে শ্লোক চলে মন্ত্র-তন্ত্র হয়। আর যে স্রষ্টা কিংবা ভগবানকে নিজের আত্মার মধ্যে ভক্তি দিয়েছেন, সত্য করে রেখেছেন, তিনি আনন্দের ভগবান, তাঁকে নিয়ে গান গাওয়া যায়। তবু প্রশ্ন থাকে, বাউলের ‘মনের মানুষ’ তো ভগবান নয়। লালনের গানের অভিপ্রায় আর রবীন্দ্রনাথের আস্বাদনের মাঝে ফারাক আছে বিস্তর। বাউলদের সম্পর্কে প্রকৃত বাস্তব দৃষ্টিকোণ এখনো আমাদের মাঝে তৈরি হয়নি। সেই জন্য লালনদর্শন ও তাঁর গানের অন্তঃশায়ী মর্মবাণী না বুঝে আমরা কেবল মানুষটাকে নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি।
লালন প্রকৃতপক্ষে হিন্দু নন, মুসলমান নন, সুফিও নন — এই কথা মেনে এবারে বুঝতে হবে যে, বাউলধারা তাঁর সাধনায় ও মননে এক সমতা আর ব্যক্তিক গভীরতা পেয়েছে। এই ব্যক্তিক গভীর অনুভূতি রূপ পেয়েছে তাঁর গীত সুর ও বাণীতে। সেই জন্যই তা আমাদের মনে ভাব জাগায়, অনুভূতির ঢেউ তোলে, আমরা ভাবাশ্রিত হই; অন্তরে সুর বাঁধি, সুরের যত্ন নেই, ছায়া আর কায়ার মায়ায় নিজেকে মগ্ন রাখি।
তথ্যসূত্র :
১) ব্রাত্য লোকায়ত লালন, সুধীর চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা।
২) লালন শাহ্, আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৩) মরমি কবি লালন শাহ্ : জীবন ও সংগীত, ড. খোন্দকার রিয়াজুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৪) লালন শাহ্ : জীবন ও গান, এস এম লুৎফর রহমান, বিকাশ মুদ্রণ, ঢাকা।
৫) মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, ঢাকা।
৬) বাংলাদেশের বাউল : সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত, ডক্টর আনোয়ারুল করীম, বর্ণায়ন, ঢাকা।
… …
- লালন সাঁই : সুফি সাধক, ফকির নাকি বাউল? || রুবেল সাইদুল আলম - August 10, 2018
COMMENTS