একবার পিট সিগার শোনা শুরু করলাম। সে কী মধুসুধা তার কণ্ঠে! আমি তো অবাক। বাংলায় এমন মধুকণ্ঠ শুধুই কবীর সুমনের। এমনকি মাঝে মাঝে যে-কথাগুলো বলে সুমন, তার ঢংও কিন্তু আমার মনে হয় পিট সিগারের মতো। মনে হয়, দুইটা একই মানুষ। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন মহাদেশে ভিন্ন সময়ে বেঁচে ছিলেন বা আছেন। মেবি এটাই পরম্পরা শিল্পের। পাশাপাশি হাত ধরে চলা অবিরাম।
মনে পড়ে, টেক্সাসের লাবাকের মাহন লাইব্রেরি থেকে যেদিন ‘পিট সিগার : ইন হিজ ঔন ওয়ার্ডস’ নামের ঢাউস বইটা কিনছিলাম। বইটা প্যাক করে দেওয়ার সময়, বৃদ্ধা মিষ্টি করে হাসলেন। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বললেন, হি ইজ দ্য স্টার অফ আউয়ার টাইম। আমি বললাম, মা উনি চিরকালের।
ও হ্যাঁ, কবীর সুমনের একটা চমৎকার ভিডিও-ইন্টারভিউ আছে অঞ্জনের নেওয়া। সেখানে সুমন জানাচ্ছেন, তার সাথে ফ্রান্সে পিট সিগারের সাক্ষাৎ হয়েছিল। আহা সুর এজন্যই অসাধারণ। এত বিশাল সুরের প্রাণ! সারা পৃথিবীকে বেঁধে ফেলতে পারে একসাথে। ভাষা এখানে সীমানাদেয়াল (ট্রাম্প-ওয়াল) বসাতে পারে না। যে-কারণে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘জালালি কইতর’ গানও শোনা যায় একই সাথে। অভিবাসী মানুষ-জীবনের বেদনাবোধ, কাতরতা আর যন্ত্রণার অঙ্ক হেমাঙ্গের চেয়ে আর বেশি কোথাও আমি পাইনি। হেমাঙ্গ বলেন…
হবিগঞ্জের জালালি কইতর, সুনামগঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাংচিল আমি
শূন্যে দিলাম ওড়া।
শূন্যে দিলাম ওড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি
কইলকাতার ওপর…তোমরা আমায় চিনো নি।
শুধু দেশ ভাগ হলেই দেশভাগের ঘা তৈরি হয় না। বিচ্ছেদেও দেশভাগের অনুভূতি হতে পারে। অন্যদেশে মানুষের যে হিজরত, সেখানেও এই গান ভয়ানক প্রাসঙ্গিক। এই মুহূর্তে কালিকাপ্রসাদের কথা মনে পড়ে। আহা শাহ আবদুল করিমের গান কালিকার চেয়ে দরদ দিয়ে আর কেউ গায়নি।
ভাটি অঞ্চলের করিম বলতেন, ‘তন্ত্রমন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই’। কেন বলতেন? দূর সুনামগঞ্জের এই বড়োমানুষ। তিনি রহস্যের উত্তর জানতেন, তাই বলেছেন, ‘ভক্তের অধীন হও চিরদিন থাকো ভক্তের অন্তরে’। কী অদ্ভুত! সবাই বলে, গুরুর অধীন হতে। মোক্ষ লাভের লক্ষ্যে। অথচ করিম কী না বলে, ভক্তের অধীন হতে!
মানুষের জীবন মূলত ঝিলমিল ঝিলমিল করতে থাকা ময়ূরপঙ্খি নাও। মাথার উপর অতিকায় সূর্য টেনে টেনে হাওরবাওরের উপর দিয়ে শুধুই বয়ে যাওয়ার। মাঝেসাঝে কিছু স্টপেজ। তারপর একদিন অনন্ত যাত্রায়…
- ১১ হাইকু মাৎসু বাশো || বিজয় আহমেদ - July 21, 2025
- গুলবাহারের ক্বাসিদা || বিজয় আহমেদ - July 11, 2025
- শহীদ কাদরীর দেশে || বিজয় আহমেদ - April 13, 2025
COMMENTS