আমাদের নিজ নিজ রাজনীতি যেনবা একেকটা মাকান/দোকান। আমরা যার যার দোকানে তার তার রাজনীতির সওদা করি। আমাদের এই সওদাগিরির নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মহতি লক্ষ্য আছে। সে যা-ই হোক, মূল আলাপে আসি।
(বাউল) আবদুল করিমের গানরে গরিবের গান না ভাইবা একে মেইনস্ট্রিম ভাবতে বলছেন কেউ কেউ। এখানে কয়েকটি কথা সবিনয়ে আমি পেশ করতে চাই। আমার কথাগুলো আপনারা আমার একান্ত বোঝাবুঝি হিসেবে দেখলে ভালো হয়। প্রথমত আমাদের সুরের বাজারে অন্য অনেক গানের ভিড়ে খালি লোকগান নিয়েই যদি কথা বলি তাহলে দেখা যাচ্ছে ফোকগানের ক্ষেত্রে কিছু অঘোষিত অথরিটি তৈরি হয়েছে গত কয়েক দশকে বা তারও আগে। সেই অথরিটিদের এলিট, আর পাটুয়াটুলি—এই দুইভাগে প্রধানত ভাগ করা যায়। এরপর তাদের সাবসেক্টরগুলোতে আলোকপাত করা যাবে।
বাংলা ব্যান্ডগানে কিন্তু এই বাজারি আর এলিটের শ্রেণি তৈরি হয় নাই—যদি খেয়াল করেন, দেখবেন। ফোকের এলিট অথরিটির স্পষ্ট প্রকাশ ‘বাংলা ব্যান্ড’ বা এতদসংক্রান্ত গানের দল। এর একটা সুলুক সন্ধান করলে স্যাম মাইলসের ফিউশনঅ্যালবাম আসল চিনির দিকে নজর দিতে হবে। বা নুসরাত ফতেহ আলী খানের ফিউশনধারার দিকেও। যদিও স্যাম মাইলস পবন দাসকে যেভাবে রিপ্রেজেন্ট করল সেই ফর্মটা বাংলাদেশের এলিটদের মধ্যে কিছু ছেলেমেয়েদের বেশ অনুপ্রাণিত করল, তারা সেভাবেই বাংলা ফোক বিশেষত লালন গাইতে চাইল বা গাইতে থাকল। প্যারালালি পাটুয়াটুলি ধারা আমাদের মেইন্সট্রিম ধারা হয়ে উঠল। ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ বা ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। এই গ্রুপটা সবসময় ফোককে বাজারি হিসেবেই ভাবছে এবং বেশি বেশি এই ধারারে গরিবের গান বলে ক্যাম্পেইন করেছে।
মিডলক্লাস ফাঁকতালে এলিটের বাসনা নিয়া ড্রয়িং রুমে বাবুই পাখির বাসার মতো লালনের আমদানি করলেন কারণ ঠাকুর বা কাজীর পুজায় তাদের সেমি সামন্ত আধ্যাত্ম্যবাদ পূর্ণতা পাচ্ছিল না। ধরেন সুধীর চক্রবর্তী থেকে ওয়াহিদুল হক উনারা মনে করতেন গানের একটা বড় স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ঠাকুরের গান। অজেয় চক্রবর্তীদের তাই বুড়া বয়সে ঠাকুর পুজা করতে ‘অজানা খনির নতুন মণি’ খুঁজতে হয়। ফলে মধ্যবিত্ত এক বোরডোম থেকে বেরোনোর জন্য লালন শুনতে শুরু করল।
খেয়াল করেন, বয়াতি শব্দটা সমাজে প্রায় নাই করে দিলো ভদ্রলোকেরা—তারা লোকশিল্পীদের আদর করে বাউল বলতেই ভালোবাসে। অথচ ফোকের কত অজস্র ধারা দর্শন যে আছে তারা নিজ নিজ গুণেই যে আলাদা সেসবের আর খেয়াল করল না এলিট বা মধ্যবিত্ত। আর পাটুয়াটুলি ধারার লোকেরা যা-ই পায় তাকে নগদে বাজারের আইটেম বানাতেই ব্যস্ত।
এই কিসিমের নানামুখী বর্গ আমরা স্পষ্টতই বিদ্যমান দেখতে পাই আমাদের সুরের বাজারে। সেখানে শাহ আবদুল করিম আরেক সংজোযন। প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরী তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন বিধায় তাকে ঢাকায় এনেছিলেন ঢাকার সুরব্যবসায়ীদের সাথে একটা চিনপরিচয় ঘটায়া দেয়া তার লক্ষ্য ছিল। সঞ্জীব চৌধুরী ও আবদুল করিম দুজনেই সিলটি পরম্পরার মানুষ, ফলে একটা পেছনের গল্প হয়তো আছে সেখানে। আবদুল করিমকে ঢাকায় এনে ম্যাগাজিন আনুষ্ঠানে গান গাওয়ানোর কথা শুনেছি। সেটা করেছিলেন স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ। আবদুল করিমের এক তিক্ত স্মৃতির কথাও শুনেছিলাম এ বিষয়ে।
সে যা-ই হোক, শিল্পে একটা সমাজচেতনা থাকে সেটা আমি বিশ্বাস করি। তার নিরিখেই শিল্পচর্চা করে মানুষ। একটা সুস্পষ্ট শ্রেণিবোধ সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। সে আপনি জুতা কিনতে গেলেও লোকে তার নিজস্ব রুচিতেই সবচেয়ে বেশি আস্থা খোঁজে। আমার প্রস্তাবনা হচ্ছে এখানে কোনো মেইনস্ট্রিম ধারা গড়ে ওঠেনি। সেটাকে আমি পাটুয়াটুলি বলতে পারি বড়জোর। যে-কারণে ঠাকুরের গান রিকশাওয়ালার কানে পৌঁছায় না।
সুরের কোনো দেশ নেই কাল নেই এসব কবিতার মতো লাগে পড়তে। দেখেন নাৎসিরা পৃথিবীতে কত কত মিউজিক নিষিদ্ধ করেছে তারও একটা তালিকা চাইলেই খুঁজে পাবেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় কি ফিল্ম কোন মিউজিক মানুষ শুনবে বা দেখবে সেসবের উপরেও চলত নজরদারি। যা-ই হোক, আইডেন্টিটি পলিটিক্সের কথা বললে ঠাকুরের কথা ধার করেই আমি বলব যে আমার লোকায়ত চিন্তাই আমার আত্মপরিচয়। একে গরিব বা বড়লোকের বর্গে ফেললেও এর জাত যায় না আবার একে চিহ্নিত করা না গেলে আল্টিমেটলি বাজারের দাসত্বই আমাদের নিয়তি।
শিবু কুমার শীল রচনারাশি
- টুকটাক সদালাপ ২২ - October 1, 2025
- মেইনস্ট্রিমের গান আর গরিবের গান || শিবু কুমার শীল - September 17, 2025
- ফরিদা পারভীন : মিলনে, বিরহে, সংকটে || শিবু কুমার শীল - September 14, 2025
COMMENTS