আত্মজৈবনিক আলাপচারিতায় মঈনুস সুলতান

আত্মজৈবনিক আলাপচারিতায় মঈনুস সুলতান

পেশাগত প্রয়োজনে গেল দুই দশক ধরে দেশের বাইরে থাকেন মঈনুস সুলতান। ছুটিছাটায় বা কাজেরই ওসিলায় দেশে আসেন কালেভদ্রে। বাংলা সাহিত্যের এই ভ্রমণগৌতম কবি ও কথাশিল্পীর সাক্ষাৎ পাওয়া খানিকটা আকস্মিকতারই ঘটনা। আমাদের আকস্মিকতার বরাতজোর মন্দ নয়। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট জুটে গেল। গত বছর, ২০১৭, অক্টোবরের প্রথম দিনে এক ট্যাক্সিভাসা বাদলিবৃষ্টির দুপুরে যেয়ে হাজির হই সুলতানের বাড়ি। সিলেট শহর থেকে পাঁচকিলোমিটার তফাতে খাদিমনগর, টিলা আর চা-বাগানের ঝুম সবুজের সিঁথিকাটা রাস্তা, তাতাভেজা হয়ে যেয়ে পৌঁছাই মঈনুস সুলতানের দহলিজে। একটানা চারঘণ্টা আমরা অন-রেকর্ড আলাপ শুনি তার। এইখানে সেই আলাপের পয়লা কিস্তি। ট্র্যানস্ক্রিপ্ট করতে যেয়ে যেটুকু টাইম লাগে, ন্যাজেগোবরে রোজগারের হ্যাপা সামলে সেই টাইমটা অ্যাফোর্ড করতে পারলে একটানা আগামী তিনটা পার্টে এই আলাপচারিতার পুরাটা আমরা আপ্লোড করতে পারব।

কথা বলতে গেছি প্রিপারেশন ছাড়াই। কিংবা যা-কিছু পণ্ডিতি প্রশ্ন ছকিয়ে গেছিলাম, সুলতানের সম্মোহনী কথামালার সুবাসে বেমালুম ভুলে গেছি সবই। দিনশেষে যা হাতে পেয়েছি, অনবদ্য, কৃতিত্ব সবটুকুই এককভাবে মঈনুস সুলতানের। ট্র্যানস্ক্রিপ্টকালে একদম অবিকল সুলতানের মুখের কথাগুলো বসায়ে যেতে পেরেছি কিছু প্রয়োজনীয় সম্পাদনাযোগে।  এই আলাপকালে মঈনুস সুলতানের মুখোমুখি ছিলাম আমরা : আলফ্রেড আমিন, শোভন সরকার ও জাহেদ আহমদ। ভূমিকা বা প্রিফেইসের দরকার খুব-একটা নাই বোধহয়, ইন্টার্ভিয়্যুয়ের কথামুখ হিশেবে আমরা রেকর্ডার থেকে ট্রেনের মতো লম্বাচওড়া আমাদের গৌরচন্দ্রিকাটা আনকাট রেখে দিয়েছি। চলুন, পড়া যাক আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকারে মঈনুস সুলতান প্রথম কিস্তি।

ভ্রমণগল্পের আঙ্গিকটা আপনার হাতে এত পুষ্ট হয়েছে যে বাংলা সাহিত্যের যারা রেগ্যুলার পাঠক তারা এরই মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলী এবং মঈনুস সুলতান নামদুইটা পাশাপাশি রেখে একনিঃশ্বাসে বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আজকে আমরা আপনার সঙ্গে লেখালেখিনির্ভর কথাবার্তা বা ট্র্যাডিশন্যালি যেই জিনিশগুলারে আমরা সাহিত্য বলি সেইসব নিয়া আলাপ করব না জানিয়েই এসেছি। আপনি রাজি হয়েছেন, সময় দিতে সম্মত হয়েছেন, শুরুতে সেইজন্যে থ্যাঙ্কসটা এবং কৃতজ্ঞতাটা জানাই। কিন্তু কথা আমরা যা-ই বলব তা তো সাহিত্যের বাইরের কিছু নয়, চাইছি মিউজিক বা আপনার অভিজ্ঞতায় আওয়াজের আবহ ইত্যাদি নিয়া আপনার মুখ থেকে শুনতে, সেইটা গানবাজনা হতে পারে এবং চিৎকারচিল্লাপাল্লা বা জিকিরাজগার কিচিরমিচির সমস্তই। ঠিক এইভাবে আপনার সঙ্গে কথা বলবার আইডিয়াটা আপনার লেখাপত্র পড়তে যেয়েই আমাদের মাথায় এসেছে। এইখানে যে-তিনজন আপনার সঙ্গে আড্ডা দিতে এসেছি, তিনজনেই আমরা আপনার লেখাপত্রের সঙ্গে ‍বেশ অনেকদিন ধরেই পরিচিত। দূরের পাঠক হিশেবে। সেইটা বই আকারেই হোক বা সাপ্তাহিক/দৈনিক সাময়িকীগুলোর মাধ্যমে। খেয়াল করেছি যে মিউজিকের ব্যাপারটা আপনার লেখায় ফিরে ফিরে আসে। সেন্স অফ সাউন্ড আপনার লেখায় একটা বড়সড় জায়গা জুড়িয়া রাখে। যে-সারাউন্ডিঙের বর্ণনা আপনি দিচ্ছেন হামেশা আপনার লেখায়, যে-কামরার বা বাজারের ছবি আপনি আঁকছেন, যে-মানুষের মুখগুলো দেখাচ্ছেন, দৃশ্যাবলি পিকচারাইজ করার পাশাপাশি ইক্যুয়্যাল গুরুত্ব দিয়া শব্দাবলি পিকচারাইজ করতে দেখছি আপনাকে। ডেপিক্ট করছেন সাউন্ডটাকে। ব্যাপারটা পার্ফেক্টলি পিক্টোরিয়্যাল হয়ে উঠছে লেখায় ঢুকে। একটা সাউন্ডস্কেইপ। পরিব্যাপ্ত শব্দচিত্র। সরাসরি মিউজিকের মুজরো ইত্যাদির প্রচুর বর্ণনা-ব্যবহার আপনার লেখায় দেখতে পাই। কিন্তু আমরা চাইব অটোবায়োগ্র্যাফিক একটা আড্ডা দিতে। লেখাপত্র নিয়া আলাপটা আবার কখনো সুযোগ পেলে ম্যে-বি হতে পারে। অ্যানিওয়ে। রোজকার তুচ্ছাতিতুচ্ছ আওয়াজের ব্যাপারটাই মিউজিক হিশেবে ধরে এই মিউজিক্যাল ট্যক-শো … (সমবেত হাসির আওয়াজ) … তো, শুরু করার জন্য যদি এইভাবে আপনার কাছে যাই যে, ধরেন, যদি ভাবি যে অরিয়েন্টাল একটা দিক আর অক্সিডেন্টাল আরেকটা দিক, তাইলে এই দুই দিকের আওয়াজের/শব্দদৃশ্যের মিল-বেমিলগুলো আপনার চোখে যেভাবে ধরা পড়ে, কেননা আপনি দীর্ঘ দুই দশক ধরে নানান দেশে যাচ্ছেন থাকছেন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, পেশাগত এবং প্যাশনগত লিপ্ততায় … তা, আপনার যে-জায়গাটাতে জন্ম এবং বেড়ে-ওঠা, বাংলাদেশের যে-জায়গাটাতে, সেই জায়গার সাউন্ডস্কেইপ আর আপনি এখন যেসব জায়গায় ট্র্যাভেল করছেন বা থাকছেন কাজের সুবাদে একটা সার্টেইন পিরিয়ড অফ টাইম, ভ্রমণগল্পগুলোতে সেসব জায়গার বর্ণনা আমরা পাই, কিন্তু লেখায় তো অনেক বেশি নির্বাচিত অভিজ্ঞতা রাখতে হয় ন্যাচারালি, ঠিক সেই জায়গাগুলোর সাউন্ডস্কেইপটা আপনি যদি নিজের জন্মদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন, তাইলে কোন জিনিশটা কমন পাওয়া যায় আর কোনটা যায় না, কোন জিনিশগুলা আজ হারিয়েই গিয়েছে মনে হয় আপনার … হাটের হৈহল্লা মানুষের হাঁকডাক পাখপাখালি-গাছগাছালি-নিসর্গ-গাড়িঘোড়া বা রেডিয়ো-টিভির আওয়াজ … এবং অবিয়াস্লি গীতগল্পগাছা-গানবাজনা … আপনি কি কখনো কম্পেয়ার করে দেখেন জিনিশগুলা? আপনার অব্জার্ভেশন ওভারঅল …
মি জানি না কিভাবে এর শুরু করব। আচ্ছা, আমি যখন বেড়ে উঠছিলাম, সেইসময় যেসব শব্দ ‍আমার চারপাশে শুনতাম প্রতিনিয়ত, শুরু করি সেইসব দিয়ে। হ্যাঁ, শব্দের সাথে সংগীতের যোগাযোগ আছে। সেইসময়ের ওই আওয়াজ ওই শব্দ এখন সবসময় যেমন শুনতে পাই না, আবার হঠাৎ মাঝেমধ্যে ফিরে আসে। যেমন আমি যখন বেড়ে উঠছি, আমার এক চাচা ছিলেন, অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন তিনি, লেখাপড়া করতেন, বইটই পড়তেন সবসময়। কাজকর্ম আমাদের যুগে তাকে কখনোই করতে দেখি নাই। খুব ভালো জামাকাপড় পরতেন। একদম মাড়-দেয়া পাঞ্জাবি, স্টার্চ, ইস্ত্রি-করা, ধড়াচুড়া পরেই তিনি ইজিচেয়ারে বসে থাকতেন। পানের বাটা থাকত সুগন্ধি জর্দা ইত্যাদি সহ। তো উনি সারাদিনই বসে থাকতেন বৈঠকখানায়, গ্রামের লোকজন আসত, ওরা কেউ দাঁড়ায়ে থাকত, কেউ মাটিতে বসতো, কেউ আবার বেঞ্চে বসতো। আমি অনেক যুগ আগের কথা বলতেছি। এইগুলা এখন বদলে গেছে সমাজে। তো উনি গল্প বলতেছেন, নানা দেশের গল্প বলতেছেন এবং গল্পে উনি ইতিহাসটাকে নিয়ে আসতেন। তারপর যেসব বইপত্র উনি পড়তেন, সেইসব বইয়ে-পড়া গল্প-ঘটনাও উনার কথাবার্তার বিষয়বস্তু হতো। এইটা ছিল তার সময় কাটানের একটা প্রক্রিয়া। তো এই গল্পবলার সাথে যে-শব্দগুলা আসত, এইগুলা আমার স্মৃতিতে এখনো আছে। যেমন আমাদের বাড়িতে নূরপুতি বলে এক লোক ছিলেন, উনি আমাদের একদম কাছেরই আত্মীয়স্বজনের মতো, পরিবারে অনেক বছর ধরে কাজ করতেছেন, উনার স্প্যাসিফিক কোনো ডিউটি ছিল না। তো একসময় উনার একটা ডিউটি ছিল, চাচার পাঙ্খাটানা। তা, সেইসময় পাঙ্খা বলে একটা বস্তু ছিল, ছাদ থেকে ঝুলত, …

হ্যাঁ, নাটকে দেখেছি, টেলিভিশননাটকে …
… নাটকে দেখেছেন, আচ্ছা, আর এজলাসে থাকত, সাবরেজিস্টারের অফিসে থাকত, আর আমার চাচার মাথার ওপরে থাকত, এছাড়া অন্য কোথাও আমি দেখি নাই, নিশ্চয় ছিল অন্য কোথাও। তো, ঐ পাঙ্খাটা টানা, পাঙ্খাটানার ফলে এক ধরনের শব্দ, এই শব্দের মধ্যে একটা রিদম ছিল, তো এই রিদমটা এখনো আমার স্মৃতিতে আছে। এই রিদমের শব্দটা আজ আর পাওয়া যায় না। তবে আরো কিছু কিছু শব্দ যেগুলো সংগীতের একেকটা উপাদান, ঠিক পিয়্যুর অর্থে এগুলো সংগীত না কিন্তু এইগুলা ব্যবহৃত হতে পারে, সংগীত তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে। যেমন খুব ভোরে আমি ঘুম থেকে উঠে ভেতরবাড়ির পুকুরপাড়ে যেতাম; আমাদের বাড়িতে এখনো আছে, একটা বাইরের দিকে এবং একটা বাড়ির ভিতরে, বাইরেরটা বেশ বড়সড় পুকুর, বাইরের পুকুর। একসময় ওইটাকে দিঘী বলা হতো, তো পরে মজেটজে গেছে, মেরামতির সময় অনেক ছোট করে কাটানো হইছে, এরপরও এখনো বেশ বড় পুকুর। ভিতরের দিকে একটা না অবশ্য, কয়েকটা পুকুর আছে। এই ভিতরের পুকুরগুলাকে আমরা বলি লপুকুর, সিলেটি বুলিতে লপুকুর মানে হচ্ছে মহলের পুকুর। ঐ যে দিদিরা যেখানে থাকতেন, মহিলারা থাকতেন, এইটা মহল, অন্দরমহল। মহলে যে-পুকুর, মহলপুকুর, কথার টানে লপুকুর। তো ম’লপুকুরে, সকালে উঠে ম’লপুকুরে দাঁত মাজার জন্য যেতাম, ম’লপুকুরে যেয়ে বসে থাকতাম, ম’লপুকুরটা ছিল চতুর্দিকে বাঁশঝাড়, লিচুগাছ, হেন গাছ নাই যা ম’লপুকুরপাড় ঘিরে ছিল না, নানান জাতের প্রচুর গাছ এবং বাঁশের ঝাড় দিয়ে ঘেরা। আজকের যুগে এইসব জিনিশ লোকজনের কাছে ইকোরিসোর্ট বলে চালানো যাবে। এর যে স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, কোথাও কোনো শব্দ নেই, অনেক ইন্টিরিয়রে আমাদের বাড়ির ভিতরের মহল ছাওয়া। বাইরে ধানের জমিতে যারা চাষ করতেছে, সেখান থেকে এক ধরনের আওয়াজ আসতেছে, এই আওয়াজ অবশ্য অতদূর পর্যন্ত পৌঁছাত না। কাছাকাছি গেলে পাওয়া যেত আওয়াজটা। তা,  আমি সকালবেলায় দাঁত মাজতে পুকুরপাড়ে গেলাম, ঘাটে বসে থাকলাম, তো বারবার কাজের ঝি এসে বলতেছে যে, ‍তুমি ফিরে যাও, নাস্তা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আমি যাচ্ছি না। এই-যে মাছরাঙাগুলো, আরো অনেকগুলো পাখি, কালেনপাখি বলে একটা পাখি ছিল, নীলাভ, উজ্জ্বল নীল বর্ণের, মাঝে মাঝে কেমন একটু ঝলসানো দাগ, শব্দের সাথে কিন্তু বর্ণ মিশে যায়, কালেনপাখির আওয়াজ এবং ঐ-যে উড়ে যাওয়ার সময় তার গায়ের বর্ণের যে দ্যোতনা, মাছরাঙাতে তো ছিলই, বর্ণের ব্যাপারটা, মাছরাঙার শব্দটা, কিন্তু মাছরাঙা তো গান করত না, ছোবল মেরে যখন পানিতে ঢুকত তখন একটা শব্দ হতো, তারপর মাছের ঘাই; আর আরো যে-ব্যাপারটা আমাকে সম্মোহিত করে রাখত, আমার কোনো কোনো লেখায় এক/দু’বার এসেছে, মনে হয় আবার লেখা উচিত, ঐখানে বসলাম, মনে হলো পুরা আকাশটা জলের নিচে। মানে ঐ-যে তাকায়ে আছি, পুরা আকাশ দেখা যাচ্ছে, মেঘ ভেসে যাচ্ছে, চিল উড়ে যাচ্ছে। তো চিল উড়ে যেত বা কাক, ঐখানে আবার অনেক ব্যাপার হতো, কাক আবার কোকিলের ডিম চুরি করত, বা এই ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটত যে কাককে আবার ছোট ছোট পাখিগুলো চেইজ করে নিয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের দ্বন্ধ-সংঘাতের শব্দগুলাও শোনা যেত। তো এই শব্দগুলার কিছু কিছু এখনো পাই, কিছু কিছু এখন আর কোথাও পাই না। এই যে কাহিনিটা আমি বললাম, …

আপনার যে চাচার কথা বলছিলেন, উনার পুরা নামটা একটু জেনে রাখি …
লহাজ্জ তজম্মুল আলী চৌধুরী। তো যে-কাহিনিটা আমি বললাম, এই কাহিনিটা আমার স্মৃতিতে ছিল, স্মৃতিতে মাঝে মাঝে যে-রকম আপনারা ডিপফ্রিজে মাছ বা কোনো ফল রেখে দিলেন, অনেকদিন পর বের করলেন, তো ঐ ধরনের একটা ঘটনা ঘটল, ঐটা কয়বছর আগে, ২০১০ কিংবা ’১১তে আমি একবার নিকারাগুয়াতে ‍ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা দ্বীপে গেলাম, একটা নির্জন দ্বীপে গেলাম। ঐগুলো কিন্তু এখনও আমার লেখায় আসে নাই, নেক্সট কোনো লেখায় আসবে আর-কি। এখন যেইটা বলতেছি এইটা অলরেডি লেখা হয়ে গেছে, প্রকাশ হয় নাই। নিকারাগুয়ায় একটা নির্জন দ্বীপে গেলাম, গিয়ে সকালবেলাটায় হাঁটতেছি, একটা খাঁড়ি ঢুকে গেছে দ্বীপের ভিতরে, তারপর ঐটা তৈরি করেছে একটা নোনা জলের দহ — ঠিক দহ না — একটা বডি অফ ওয়াটার। তো ঐখানে আমি গিয়ে বসলাম, কিছু কিছু গাছ আছে, ম্যানগ্রোভ গাছ, ঐগুলার ছায়া পড়তেছে, আকাশটা পুরো প্রতিবিম্বিত হচ্ছে, আকাশের কাছাকাছি একটা আগ্নেয়গিরি, ঐখান থেকে ধোয়া উড়তেছে, ঐটারও প্রতিবিম্ব যৎসামান্য দেখা যাচ্ছে। ঐ যে ভোরবেলা, ভোরবেলায় রিফ্লেকশনটা হয় চমৎকার, সাউন্ডটাও আসে। তো তখন আমি সাউন্ড শুনতেছিলাম, তো আবার ফিরে এল ওই যে পুকুরপাড়ে বসে শোনা সাউন্ডের দৃশ্যটা।

এই যে-সময়টার স্মৃতি আপনি বলছিলেন, তখন আপনার বয়স কত হতে পারে আন্দাজ? কোন সময়টা, এবং ঘটনাগুলো কোথায়, মানে, আপনাদের বাড়ি তো কুলাউড়ায় না?
কুলাউড়ার লংলা। পৃথ্বীমপাশা অঞ্চলের গণিপুর গ্রাম, টু বি স্পেসিফিক। আচ্ছা, তো ঐখানে আরো কিছু কিছু ব্যাপার ছিল, আমাদের গ্রামের বাড়িতে কেউ চাকরিজীবী মানে ওই আপিশকাচারিতে যেত না, এক ধরনের সচ্ছল কৃষিভিত্তিক বাড়িঘরের সমাজ, কেউ কিন্তু অফিসে যাচ্ছে না আমাদের বাড়ি থেকে। কাজেই সকালবেলা মোটরগাড়িতে উঠে কোথাও যাওয়ার কোনো তাড়া নেই, মানে অনেক বেলা করে হয়তো সংবাদপত্রিকাটা আসলো, সংবাদপত্রিকাটা তখন নিষিদ্ধ ছিল, বামপন্থী সম্পৃক্তির কারণে, তারপরও ঐটা আসত, তো ঐ দিনের আধখানা পার করে পত্রিকা পড়া, বাসি পত্রিকা পড়া বৈঠকখানায়। তারপর আরেকটা ব্যাপার ছিল, আমাদের বাড়ির পাশে একটা খালিবাড়ি ছিল, খালিবাড়ি বলতে একসময় ঐখানে — আগের যুগে বলা হতো প্রজা — রায়তও বলা হতো, ওদের মানে রায়তদের বসবাস ছিল, পরে ঐগুলা তো উঠে যায়, রায়তব্যবস্থা উঠে গেলে, রায়তরা উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র চলে গেছে, বাড়িটা খালি ছিল, এইখানে প্রচুর আমের গাছ ছিল। তো ঐটা ছিল শব্দ, বর্ণ এবং গন্ধের মানে সুগন্ধের  একটা সমাহার, ঐ গোটা খালিবাড়ি জায়গাটা। আমগাছের সংখ্যা কত ছিল বলতে পারব না, আমার হিসাব ভুল হবে, বিশ-ত্রিশটা তো ছিল আমিই দেখেছি আমার যুগে, এখন কয়টা আছে জানি না, আমের গাছগুলোর বেশিরভাগেরই আবার নাম ছিল আলাদা একটা করে; যেমন ধরেন একটার নাম আন্ধাইরমানিক, এইটা বাইরে থেকে কালো দেখা যায়, কাটলে ভিতরটা সোনালি। আন্ধাইরমানিক আম চিনেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।
তাহলে আপনি চিনেন। তারপর আরেকটা আম — আমরা বলতাম পরফুলিআম। … ঐটা খেতে ঐরকমই ছিল। প্রফুল্ল বোধহয় ব্যাপারটা। প্রফুল্ল থেকেই পরফুলি কি না জানি না। তারপর লিচুআম ছিল, লিচুআমের গাছ, লিচুর মতো খুব সিঁদুরে লাল হয়ে যেত; তারপর আরো কি কি যেন, আমরোলা ছিল; সূর্য‌্যমুখি আমগাছটা ছিল, একদিকটা সূর্য‌্যমুখি ফুলের মতো একদম হলুদ-সোনালি হয়ে যেত; তারপর বাখরি আমগাছ, যেইটা কাটলে বাখরের গন্ধটা পাওয়া যেত, এই হচ্ছে গন্ধের ব্যাপার। আমগাছগুলোতে আমকুড়োলির ফুল বলে এক ধরনের ফুল ধরত, এটা নিশ্চয় এখনও ধরে। এটা হচ্ছে অর্কিড। বেইসিক্যালি অর্কিড। তারপর ঐখানে, মানে আমগাছে বাস করত পেঁচা, আরও রাজ্যের পাখি। তো এই স্মৃতিদৃশ্যগুলো তো শব্দহীন নয়। স্মৃতির সঙ্গে যেমন দৃশ্যের তেমনি শব্দের একটা ব্যাপার আছে। তারপর আমের বাগানের একটা সৌরভের ব্যাপার আছে। সবসময় কিন্তু এই সৌরভটা আমি অ্যাসোসিয়েইট করি। কারণ কোনো-না-কোনো সময় আমের বৌল আসতেছে, বাতাস তখন বৌলের গন্ধটা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চোখকানের পাশ দিয়ে, এ ব্যাপারগুলো কিন্তু ঐখানে আছে। স্মৃতির ভিতরে। আরেকটা ব্যাপার ছিল কি, ঐ বাড়িতে, — এখন উনার নাম তো ভুলে গেছি, উনার নাম ছিল সম্ভবত মোবাপতি, — বৃদ্ধ এক লোক বসবাস করতেন, উনার এক ছেলেসন্তান, যেহেতু উনার ছেলেসন্তানকে আমি দেখেছি, ছেলেসন্তান মানে বড়, বয়স্ক লোক। বাপ-বেটা ‍দুইজনে একটা কুঁড়েঘরে বসবাস করতেন। ছেলে যখন ছিল নিশ্চয় কোনোকালে উনার স্ত্রী ছিলেন, এটা আমি দেখি নাই আর-কি আমাদের যুগে। ভদ্রলোক ঐখানে ছিলেন, উনার ছেলে বাইরে ঘুরে বেড়াত ভবঘুরের মতো, ওর নাম ছিল জলিল, মোবাপতি আবার বাড়িতে বসে — উনি ধুতি পরতেন, — আমাদের যুগেও দু-চারজন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান গোষ্ঠীর লোককে আমি ধুতি পরতে দেখেছি — ধুতিটা কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সবার একটা কমন পোশাক ছিল, নিশ্চয় জানেন, পরবর্তীতে কেন-জানি হিন্দুসমাজ এইটা মেইন্টেইন করল, মুসলমান সমাজ বার্মিজ লুঙ্গি কিনতে শুরু করল। এখন তো লুঙ্গি ক্রিশ্চিয়ান-বৌদ্ধ সবাই পরে। তো তখন গুটিকয়েক লোক ধুতি পরতেন, ধুতি পরলেও উনারা হিন্দু ছিলেন না। মোবাপতি সবসময় ধুতিই পরতেন। গায়ে ফতোয়ামতোয়া কিছু থাকত না, লম্বা দাড়িওয়ালা লোক, বসে বসে বেতের বাস্কেট তৈরি করতেন। বেতের বাস্কেট আমি বলতেছি কারণ এইটার বাংলা — বাস্কেটের যে বাংলা ঝুড়ি — ঝুড়ি শব্দটা দিয়ে আমি যে-বাস্কেট দেখাতে চাইছি সেইটা বোঝানো হয় না। বাস্কেটের এই জাতটাকে আমাদের এলাকায় বলত ধুছইন। উনি বসে বসে সারাদিন ধুছইন বানাইতেন। ধুছইন বোঝেন? ধুছইন বানাইতেন, খালুই বানাইতেন। আমরা বলি খলই। বাংলায় কি বলে? শান্তিপুরের বাংলায় কি বলে?

খালুই বলে। বা, ধুচুনি।
চ্ছা যা-ই হোক, তারপর মাঝে মাঝে ঐগুলা ঐ যে ‘এছো’, আরেকটা কি ছিল, এইরকম একটা বাকশের মতো একটা জিনিশ যেইটাতে মাছ ঢুকে গেলে ভিতেরে আটকা পড়ত, …

ডরি, কোকা, কুইন …
রাইট। যা-ই হোক, সবই উনি বানাতে জানতেন। বেত দিয়ে। ধুচুনিটা প্রচুর পরিমাণে উনি তৈরি করতেন। খলইও তৈরি করতেন। এইটাই বোধহয় উনার পেশা ছিল। তৈরি করতেছেন আর গান করতেছেন। একের পর এক গান করতেছেন, উনার শ্রোতা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। বা শ্রোতারা কেউ উনার গান শুনতে তো আসত না, আসত আমের বাগানে, রাখালরা আসত, গ্রামের লোকজন আমবাগানের পাশের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, আমের বাগানে একটু হয়তো ঢুকল, আম হয়তো পড়তেছে, বা দুই-চারটা আম পেড়ে খেলে আমাদের ফ্যামিলির এমন কোনো কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা ব্যাপার ছিল না, কেউ দুইটা আম পেড়ে খাচ্ছে বা নিয়ে যাচ্ছে, ঐটা নিয়ন্ত্রণ করার কিছু ছিল না। তারপর আমরা আম বিক্রিও করতাম না, আমরা ভদ্র্রসন্তান (হেসে) আমরা তো অন্য ব্যবসাবাণিজ্য করি। আম নিয়া আমি করবই-বা কি। প্রচুর আমের এমনিই হার্ভেস্ট হচ্ছে, মানে নিচে পড়ে থাকত, তো লোকজন আসতেন, এসে আমটা সংগ্রহ করলেন, সংগ্রহ করে ঐখানে গেলেন মোবাপতির কাছে, উনি একটা খাটে, খুব ছোট একটা খাটের টুকরাতে বসে, তারপর কাটাইল দিয়ে বাঁশের বেত তৈরি করতেছেন, বাঁশের বেতি দিয়ে উনি ধুচুনি তৈরি করে যাচ্ছেন। আমটা তো কেটে খেতে হবে, তো উনার কাছ থেকে লোকজন আবার কাটাইল চেয়ে নিলো, উনার আবার বিভিন্ন ধরনের কাটাইল ছিল, নানা মাত্রার শার্পনেস কাটাইলগুলোর, তো ঐগুলা নিয়ে আমটাম কাটলেন, কেটে আমটাম খাইলেন, আবার বসে কিছুক্ষণ গান শুনলেন। তো কখনোসখনো মোবাপতির গানের গলা প্রলম্বিত হলে লোকজন অনেকক্ষণ বসতো, উনি আবার গুনগুনিয়ে গান করলে একপর্যায়ে লোকজন উৎসাহ হারিয়ে ফেলত। বা অন্য কাজকর্ম আছে তো, অন্যদিকে চলে যেত। তো এইটা ছিল একটা কন্টিনিউয়াস ব্যাপার, মানে গানের ব্যাপারটা আরকি। প্রতিদিনই ঘটতেছে। সন্ধ্যার পরে আমরা বাইরেটাইরে তেমন যেতাম না, আমি তো অনেক ছোট, সন্ধ্যার পরে তো শব্দের আরেক ধরনের রাজ্য — প্রচুর শেয়াল ছিল, — তারপর জোনাকি — ঐ বাড়িতে লক্ষ লক্ষ জোনাকি … ঐ খালিবাড়িতে, — তো মাঝে মাঝে হয়তো উঁকিঝুঁকি দিয়েছি, মাঝে মাঝে মোবাপতির গানের স্বর ভেসে আসতো। তো এখন তো ঐগুলা, ঐ শব্দ বা গানের চরণ, বা কিছুই মনে নাই। কিন্তু তারপরও একটা জিনিশ স্মৃতিতে থেকে গেছে আর-কি। মানে গানের যে-ব্যাপারটা আর-কি।

ঐ সময়টায় আপনি ঐখানকার স্কুলে পড়তেছেন না স্কুলে ভর্তি হন নাই?
স্কুল নিয়ে আমার — মানে — কি বলব, বলা মুশকিল। স্কুলে দু-একবার আমি ভর্তি হয়েছি, কন্টিনিয়্যু করি নাই, ঐখানে গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বাড়িতে প্রাইভেট শিক্ষকরা আসতেন, তাদের কাছে লেখাপড়া কিছু করেছি, তারপর মাসের পর মাস কিছুই পড়ি নাই, এমনি বইটই পড়ছি। গোয়েন্দা বই, দস্যু বাহরামটাহরাম পড়ছি। তারপর অনেক বড় হয়েও আমার বন্ধুবান্ধবরা যখন কমলকুমার মজুমদার পড়তেছে আমি তখনও বনহুর-বাহরাম এইগুলা পড়তেছি (হেসে)। আপনারা পড়েন নাই?

হ্যাঁ, পড়েছি।
বাহরাম এখনো বেঁচে আছে?

হ্যাঁ, পাওয়া যায়। বাহরাম-বনহুর অমনিবাসে বেঁচে আছে। কমপ্লিট কালেকশনের মোটা আকারে পাওয়া যায়।
চ্ছা। তারপর মাঝে মাঝে, বছরের একটা বড় সময়, আমরা ঐখানে থাকতাম না। ঐখানে মানে পৃথ্বীমপাশায়। আমাদের মামার বাড়ি হচ্ছে ফুলবাড়িতে। গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়িতে। সেখানে চলে যেতাম। তো, ঐখানে এক-দুইবার স্কুলে ভর্তি হবার চেষ্টা করেছি, ঐগুলা কিছুই সাস্টেইনেবল হয়নি। দীর্ঘমেয়াদীভাবে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করেছি তারও অনেক পরের একটা সময়ে।

ঐ সময়টায় আপনি ভিতরবাড়িতে মা-চাচিমা-খালা-ফুপুদের সঙ্গে বেশিটাই থাকছেন নিশ্চয়। যেহেতু ছোট মানুষ, যাবেনই-বা কই? মহিলামহলে একধরনের আলাদা গান কিন্তু হয়, সেইসময় এইটা মহিলাদের পার্টিসিপেইটরি বিনোদন, সিলেট অঞ্চলে গীত বলি আমরা। এই গীতের সাউন্ডটা কি আপনার মনে আছে?
নে আছে, খুব ভালো করে মনে আছে। এখন আপনি যদি বলেন লাইন বলতে, তাহলে ফ্যাসাদে পড়ব। উদ্ধৃতি দিতে পারব না। মনে আছে বলতে, ফুলবাড়ি গ্রামের একটা ব্যাপার ছিল, পৃথ্বীমপাশা গণিপুর গ্রামে আমরা যখন বেড়ে উঠি, ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল না কিন্তু পর্দাপ্রথাটা ছিল আমাদের পরিবারে, সব পরিবারে না, কয়েকটা পরিবারে। তো আমাদের পরিবারে পর্দাটা ছিল। আম্মারা বাইরে গেলে, আমি পালকির যুগ দেখেছি এবং পালকিতে আরোহন করেছি। তো, বেঁচে-থাকা বাঙালি লেখকদের মধ্যে বোধহয় আমিই একজন যিনি পালকি চড়েছি। এইটা আমার মনে আছে। এক-দুইবার। খুব বেশি না। তারপর পালকিটা ইয়ে হয়ে, শেষ হয়ে, রিকশার যুগ চলে আসলো। আর পালকিটা পড়েই ছিল আর-কি আমাদের বাড়িতে অনেকদিন। বাইরে বৈঠকখানার বেড়ার পাশে। বৈঠকখানা তো বলতাম না, আমরা বলতাম টঙ্গিঘর। বাংলোঘরও বলেন অনেকে। ঐখানে পালকিটা ছিল অনেকদিন। আমরা লুকোচুরি খেলতাম। পালকিতে রঙিন কাচের জানলাটানলা ছিল। তো আমি যেটা বলতেছিলাম, ঐ সময় ফুলবাড়ি গ্রামে, ফুলবাড়ি গ্রাম ঐটা হচ্ছে আমার মামারবাড়ি, মামারবাড়ি তো না, নানিরবাড়ি, মানে নানার মৃত্যু হয়েছে (সৈয়দ আব্দুল ওয়াসেহ আমার নানার নাম) অনেক বছর আগে, নানি ছিলেন। জায়গাজমি প্রচুর।

কোন ফুলবাড়ি? সিলেটের গোলাপগঞ্জের?
হ্যাঁ, গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়িই। তো ঐখানে কিন্তু মহিলাদের গানবাজনার যে-ব্যাপারটা, ঐ যে, ধামাইল দিয়ে গান, তো উনার ঐখানে লোকজন আসত, ঐখানে কিন্তু পর্দার ব্যাপারটা ছিল না মেয়েদের মধ্যে। পৃথ্বীমপাশা এলাকার গণিপুর গ্রামে পর্দার ব্যাপারটা ছিল, ফর্মালিটি ছিল, শ্রেণিটা প্রখর ছিল, ফুলবাড়িতে অত ছিল না, গ্রামের লোকজন আসতো আমার নানির ঐখানে, এসে সমানে ধামাইল দিতেছে মেয়েরা, তারপর ঐ যে ধান কাটা হতো, আমার নানি গিয়ে বাইরে বসতেন, উনার প্রচুর ধানের জমি। তো ধান কেটে আনতেছে, রাতের বেলা ফেলতেছে, মাড়া দিতেছে, ঐ একটা উৎসবের মতো ব্যাপার। লোকজন আসা-যাওয়া করতেছে, প্রচুর পরিমাণে চা জ্বাল দেয়া হচ্ছে, হুক্কাটা চলতেছে, ঐ যে চাষীরা হুক্কা খাচ্ছেন, তারপর মহিলারা ধান মাড়াইয়ের কাজ করে তো, ধানমাড়াইটা কিন্তু শুধু পুরুষ করে না, মহিলারা প্রচুর কাজ করে, এই কাজ করতে করতে বিরক্তি এলে বা ঝিমুনি পেলে ওরা আবার ধামাইল দিয়ে গানের ব্যাপারটা চালায়। নানিবাড়িতে পেয়েছি এই জিনিশগুলা। তারপর ফুলবাড়িতে বিয়ের গান প্রচুর শুনেছি। বিয়েটিয়ে হলে আমার নানির কাছে সবাই আসতো, বাটা তৈরি করে দেওয়ার জন্য। আজকাল যেইরকম কেইক তৈরি করে, তখন বাটা তৈরি করার একটা প্রচলন ছিল, হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই। বাটা তো ছোটখাটো নয়, অনেক বিশাল বিশাল বাটা, এইগুলা কোথায় গেল জানি না। অনেক ধরনেরর বাটা এবং উনার সংগ্রহে অনেকগুলো বাটা ছিল, কেউ কেউ — ধরেন একটু দরিদ্ররা — বাটা আবার ধার চেয়ে নিয়ে যেত।

বাটা-সাজানো বলে একটা আলাদা প্রোগ্রামই আছে বিয়েতে। এখনও আছে একটু পরিবর্তিত ফর্মে।
বং বাটা সাজানোর সময় আমার মনে হয় উনি, আমার নানি, যৌবনে খুব দক্ষ বাটা সাজানোর লোক ছিলেন। আমাদের যুগে উনি নিজে তেমন সাজাতেন না। ঐ যে গ্রামের তরুণী মেয়েরা আসতেছে, সাজাচ্ছে, উনি খাটের উপর বসে ধমকাতেন, এইটা এইরকম হয়েছে কেন, আচ্ছা দাও আমি কেটে দেই, তারপর ঐ যে জগজগা কাগজ দিয়ে ফুল-পাতা বানানোর এই ব্যাপারগুলা। তারপর ঐটা — আমার মাকেও দেখেছি এইটা করতে — সেইসময় বিয়েশাদিতে সাগরানা বলে একটা জিনিসের প্রচলন ছিল, ঐ যে বরের সামনে বিশেষভাবে যে রোস্টটা দেওয়া হয়, তারপর মিষ্টিকুমড়া সেদ্ধ দিয়ে ওইটাকে প্লেইট-কাপ তারপর পাখি ইত্যাদি শেইপ দেয়া, তো এইগুলা উনি তৈরি করে দিতেন। বেশিরভাগ সময় উনি বলতেন, যে-মেয়েগুলো পরবর্তীতে বিবাহিত হবে, বড় হয়ে যাচ্ছে, তাদের বলতেন যে শিখে নাও। না শিখলে সমস্যা হবে। তো এটা হচ্ছে এইখানে একটা ইন্টারজেনারেশনের লার্নিঙের ব্যাপার ছিল। উনি কি গান গাইতেন, উনি কি গীত করতেন, এই বাবতে আমার কোনো স্মৃতি নাই। কিন্তু উনি তো মনে হয় অনেকটা প্যাট্রনের মতো ভূমিকায় থাকতেন। যারা গীত করত, যারা ধামাইল দিত, এদের খাবারদাবারের একটা ব্যাপার ছিল তো। লাড্ডু আনা হতো প্রচুর পরিমাণে। মেয়েরা লাড্ডু খাচ্ছে, তারপর চাটার খই, চাটার খইটা চিনেন? গুড়ের চাটা, গোলাকার, এইটা প্রচুর পরিমাণে আনা হতো, তারপর হুগলি বিস্কুট বলে একটা জিনিশ ছিল, ঐটা বোধহয় এখন আর নেই।

সেইটা হুগলি থেকে আসত?
হুগলি থেকে আসত না। এইটা পাওয়া যেত ফুলবাড়িতে। আমি অত কিছু জানি না। ফুলবাড়িতে সামেদের দোকান বলে একটা জায়গা ছিল। তো বাড়িতে ঐ যে গীতের আসরটাসর বসলে আমরা সামেদের দোকানে গিয়ে হুগলি বিস্কুট চাইলে সে দিয়ে দিত। পরে ঐটা পেমেন্ট করা হতো। পয়সা দিয়ে পেমেন্ট করা হতো না ধান দিয়ে, এইটা সঠিকভাবে আমি তথ্য দিতে পারব না। ঐ যুগে ধান দিয়ে পেমেন্ট করারও একটা ব্যাপার ছিল। হুগলি বিস্কুটটা হচ্ছে এইরকম, একটার সাথে একটা লাগানো, ফোল্ড করে, একসঙ্গে অনেকগুলো বিস্কুট, গোটা তিরিশেক বিস্কুট থাকত, আপনি ভেঙে ভেঙে তিনটা-চারটা করে নিয়ে নিলেন, চায়ের মধ্যে চুবিয়ে খেলেন। তো এইখানে এই গানের ব্যাপারটা ছিল। আচ্ছা। আবার ফিরে যাই গণিপুর গ্রামে, আমাদের পৈতৃক গ্রামে। ঐখানে আবার মর্সিয়াটা ছিল, মহরমের মর্সিয়া। জারি-সারি ঐগুলা প্রচুর ছিল, সর্বত্র ছিল। মানে, আমাদের বাড়ির উঠানে হয়েছে কি না, এইভাবে না বলে, আব্বাসদের বাড়ি, এখন যেটা নওয়াববাড়ি হিশেবে পরিচিত, ঐটা সাহেববাড়ি — পৃথ্বীমপাশার, — ঐখানে প্রচুর সারি-জারি-মর্সিয়া এইগুলা হতো। আমরা যেতাম, আমরা ঐ সমাজের মানে সামাজিকতার মধ্যেই ছিলাম। মহরমের সময় — মানে আজকের দিনটা (সাক্ষাতের দিনটায় ছিল মহরমের পরব, মহরমের দশ তারিখ, মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই দিনটা পালিত হয় নানান কৃত্যাদির মাধ্যমে) — ঐখানে পুরো দিনটা কেটে যেত। তো ঐখানে এগুলা শুনতাম, গ্রামের অন্যান্য বাড়িতেও এইগুলা হতো। মাঝে মাঝে তো এইগুলা শুনতে পেতাম। তো এই গানগুলা তো ছিল। প্রচণ্ডভাবে আমাদের এনভায়রনমেন্টে ছিল।

(চলবে)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you