বাংলা কবিতার বিভূতিতে মামুন খান || সরোজ মোস্তফা

বাংলা কবিতার বিভূতিতে মামুন খান || সরোজ মোস্তফা

শেয়ার করুন:

পেছন ফিরে মানুষ নিজের সময়কেই দেখে। সময়ের ধারাপাতে নিজের দিকে তাকিয়ে আজ বিস্মিত হচ্ছি। সমসাময়িক কালে (কাব্যসংকলনে যাকে শূন্যের দশক বলা হয়) আমরা যারা লিখতে এসেছি, তাদেরও বিশ-পঁচিশ বছর চলে গেল। জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করতে করতে ভাষা ও কল্পনার প্রাকৃত খাতায় অনেকেই বসিয়ে দিয়েছেন নিজস্বতার মোহরছাপ। থামতে থামতে অনেকেই থেমে গেছেন, সময় কিংবা জীবিকার গুরুগম্ভীরতায় নেমে গেছেন। সকালের দাঁড়িকমা  রেখে আপন মাহমুদের মতো কয়েকজন চলে গেছেন অচিন সায়াহ্নে। এইসব লুপ্ত-বিলুপ্ত ফুরিয়ে যাওয়া দিবসের দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব মগ্নতায় পৃথিবীর বালুকণায় নিজের সাধনাকেই মুদ্রিত করছেন মামুন খান। কবিতার নীলনলিনীর খোঁজে জাগ্রত রেখেছেন অন্তর্গত ভাবুকতা। তাঁর কাব্যে প্রকৃতি ও মানুষ যেমন স্পষ্ট, তেমনি সময়ের সাথে ধাবমান মানুষের  ছল-করা প্রকৃতিও স্পষ্ট। দরদ ও সজ্ঞানে মামুন খান এমন করে কবিতা বলেন যে কবিতার সুরাসুর ও অর্ঘ্য সর্বজনকেই স্পর্শ করে।  প্রাণ ও প্রণয়, মাটি ও নদীর স্বর, সময়ের অনিবার্যতায় মানুষের আত্মা কীভাবে কাঁদে—সবকিছু গাছের রসের মতো প্রবাহিত হয় মামুন খানের কবিতায়। গহীন চোখের মধ্যে, ধমনিতে ডুবে থাকা জীবনের চলমানতাই তাঁর কাব্যধর্ম।

আসুন একটি কবিতা পড়ে নিই। ‘জলসায়রের পলি’ কাব্যগ্রন্থের এই নামকবিতাটির ভেতরে কবির আত্মাটাই যেন হু হু উড়ছে। হৃদয়ের প্রাকৃত সীমায় বহমান মাটির কাছে মাটি পেতে চাইছে। জীবন ও প্রকৃতিকে এক রঙে দেখার সুন্দর সুযোগ মামুন খানের কবিতা।

জলা তলা শনি চনতারা ডিঙ্গাপুতা
জালিয়ার হাওরের নামে
কৈজানি কংশ বালৈ বয়রালা ঘোড়াউত্রা ও ধনু গাঙের নামে
বৈচাজুড়ি খালের নামে ভেঁওরি বিলের নামে
বাইরাগ ও বাড়িপিছ ভাঙা আফালের নামে
আগাম জলে পচে যাওয়া
ফল ফসল ও ফসালির নামে
মজে যাওয়া গলই ও আলকাতরারঙা ধীমান ধীবরের নামে
কুডুরা মেড়া বরুণ ও হিজলের নামে
আদিগন্ত সবুজরঙা ফাল্গুনমাঠের নামে
উকিল জালাল শরৎ রশিদ ও রাধারমণের নামে তোমাকে বন্দনা করছি, জলসায়র

তোমার লক্ষ লক্ষ পলি ও পললের ভাঁজে
এই সামান্য জীবাশ্মের জন্য একবিন্দু রাখিয়ো ঠাঁই। তুমি না দিলে ঠাঁই
এই ব্ৰহ্মাণ্ডে কে আছে, আমাকে নেবার!

(জলসায়রের পলি / পৃষ্ঠা ৯)

চিরায়ত বাংলা কবিতার ঢঙে লেখা কবিতাটিতে কবি যেন নিজের কবিজীবনকে নিয়ে বন্দনায় নেমেছেন। পুরো জনপদকে বন্দনা করে এই মাটিতে, নদীতে হিজল-বরুণের পাতায় পাতায় নিজের সাধকজীবনকে ঠাঁই দেয়ার জন্য জলসায়রের পলি অনুরোধ করছেন।  ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“সফল কাব্যই কবির প্রকৃত জীবনী। সেই জীবনীর বিষয়ীভূত ব্যক্তিটিকে কাব্যরচয়িতার জীবনের সাধারণ ঘটনাবলির মধ্যে ধরিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা।” তাই বলা যায়, ‘জল ও জলপাই’ কিংবা ‘জলসায়রের পলি’-র ভেতরেই আছে কবির প্রকৃত ও প্রাকৃত অনুভব। যে-জীবন দেখা যায় সে-জীবনের চেয়ে সত্য ও স্বপ্নময় এই পঙক্তিমালা। এই কবিতাগুলো বাংলার মাটির কবিতার আধুনিক রূপ।

সময়ের হালহকিকতকে, অভিজ্ঞানকে আত্মদৃষ্টির প্রাচুর্য দিয়েই তিনি কবিতায় রেখে দিয়েছেন। আত্মপ্রকাশের প্রথম দিন থেকেই নিরীক্ষাপ্রবণতাকে খুব আমলে নেননি কবি। যাপিত জীবনে দেখা না-দেখার ঐশ্বর্যকে  আবহমান বাংলার মাটির মতো নরম-উর্বর  রঙে সাদা পৃষ্ঠায় উঠিয়ে এনেছেন।  তাঁর কবিতার খাতায় তাকালেই বোঝা যায় একটা সহজ মায়াময় দরদী পৃথিবী তিনি প্রকাশ করতে চান। কিন্তু সত্যটাকে এড়িয়ে নয়। সত্যটাকে সাথে নিয়ে চলমানতাকে দেখিয়ে দেয়াই তার কবিধর্ম।

‘জল ও জলপাই’, ‘বাইরে দুপুর ভেতরে ভৈরবী’—আত্মপ্রকাশপর্বের এই দুটি কাব্যগ্রন্থে রোমান্টিকতায় ধাবিত মামুন খানকেও সময় ও সমাজের বিপন্ন নিশ্চুপ পরিস্থিতিগুলোকে নিয়ে তীক্ষ্ণ, চোখা স্বরে ব্যঙ্গ করতে দেখা যায়। ঐতিহ্যকে সামনে রেখে কবিতাকে নবতর করা, নতুনভাবে বলার বিচিত্রতর বিন্যাস তিনি আয়ত্ত করেছেন। তার সমুদয় কবিতায় লেপ্টে আছে প্রান্তজন; জল-নদী-বৃক্ষ-মাটির ফোয়ারা। জীবনকে, সময়কে ঐতিহ্যকে, সমাজকে দরদ ও  সুরক্ষা করাও তার কাব্যদায়িত্ব।

শিল্পের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অবলম্বন কিংবা অলঙ্কার হচ্ছে সরলতা। মামুন খান বাংলা কবিতার সরল ধারাটিকেই এই সময়ের দার্শনিকতায় প্রকাশ করেছেন। কবিতায় সরলতার ধারণাটি নতুন কিছু না। মৈয়মনসিংহ গীতিকা, বৈষ্ণবকবিতা, কাহিনিকবিতায় সরলতার এই ধারাই বর্তমান। কবিতার এই সরলতার ধারণাই আমরা মামুন খানের কবিতায় দেখি। এই সরলতার ভেতরে তিনি যুক্ত করেছেন সমকালের জটিল জিজ্ঞাসা, স্যাটায়ার ও বাস্তবতা।

আমরা আমাদের জীবনটাকেই লিখি। নিত্যনৈমিত্তিক ঘোরে পরাবাস্তবতার ভেতরে থাকলেও বাস্তবতাকে লিখি। ঘরে ফিরি, নৈরাশ্যে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি, আবার বেঁচে থাকার পথেই ধাবিত হই। প্রকৃতির ভেতরে থাকলে প্রকৃতির মতোই হতে হয়, মৌসুমী বায়ুর সাথে উড়ে যেতে হয়। মামুন খানের কবিতা পাঠের পর আমাদের মন প্রকৃতির দিকেই ধাবিত হয়। সমাজ সত্যের প্রসঙ্গগুলোতে মন জাগ্রত হয়।

আমাদের প্রত্যেকের শেকড় হচ্ছে গ্রামে। গ্রাম হচ্ছে মা-বাবার মতো। গ্রাম হচ্ছে আমাদের শস্যভাণ্ডার। মা-বাবার পরিচয়ই আমাদের আত্মপরিচয়। অথচ নগরমুখি হয়েই আমরা বিরাটের বিরাট হয়ে যাই। আমরা আমাদের পরিচয়কে ভুলে যাই।  আমাদের আত্মপরিচয়ের সারাৎসার আর মানসিক প্রবণতার এক অপূর্ব স্মারক উঠে এসেছে ‘বিরাটের বিরাট’ কবিতায়।

বাবা মানে বারবার চেইন পড়ে যাওয়া
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন বাইসাইকেল।
চেইন তুলে নতুন উদ্যমে প্যাডেল মারার নামই বাবা।

মা হচ্ছেন চিরকালের আলগোনা, রসুইঘর।
কালি ও কালিমা, বাসি ও গান্ধা
নিজের জন্য রেখে
শরতের সব শুভ্রতা দিগন্তের দিকে ছড়িয়ে দেয়া
নাজুক নতমুখীর নাম মা।

মাঝখানে আমারা হচ্ছি ফটোগ্রাফার।
ভাবুক। চিন্তক। কবি। নারীবাদ। বিপ্লব।
আমরা বিরাটের বিরাট।

(বিরাটের বিরাট, বরুণতলার বাওয়ানী)

আধুনিক কবিতা কিংবা কবিসমাজ নিয়ে এই সময়ের পাঠক, চিন্তক কিংবা অনুরাগীদের মধ্যেও এক ধরনের অনীহা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবণতা আছে। সেই প্রবণতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই মন্তব্যকারীরা কেউ হয়তো কবিতার বই-ই উল্টান না কিন্তু মন্তব্য করেন। তাদের জন্য কবি মামুন খানের নিচের কবিতাটি অনেক উপকারে আসবে বলে মনে হয় :

তুমি আমার চেয়ে আধুনিক
কারণ, তুমি কবিতা লিখ না।
তোমার চেয়ে সে আরো আধুনিক
কারণ, সে কবিতা বোঝে না।
তোমাদের চেয়ে তারা আরো আধুনিক
কারণ, তারা কবিতাই পড়ে না।

তাদের চেয়ে তাহারা আরো, চরম আধুনিক
যাহারা—চোখ উল্টান, কবিতা!
এখনো কেউ লিখে!

(জটিল জেনারেশন, বরুণতলার বাওয়ানী)

মেঘ আমার ছায়া।
মেঘ জল হয়ে গেলে আমি ভিজি।
ভিজে আমার কায়া।
আমি হাওর। জলজ সন্তান।
নাম আমার মামুন খান।

জলজ মাটির বিভূতিতে মামুন খানের কবিতা চিরসুন্দরকেই স্পর্শ করে। হাওরমৃত্তিকাই তার পরিচয়। জন্মজন্মান্তর ধরে পুরুষপরিক্রমায় মাটির সহজাত সংস্কৃতিকেই তিনি ধারণ করেন। কবিতা মূলত সংস্কৃতির প্রতিরূপ। তার কবিতায় লেগে থাকে নদী ও হাওরের গন্ধ। তার কবিতায় উচ্চারিত বক্তব্য ও চিত্রায়নে স্যাটায়ার আছে, ইঙ্গিত আছে, বক্রোক্তি আছে। সবচেয়ে বেশি আছে আমি। পূর্ব-ময়মনসিংহের হাওর বাংলার আমি। এই আমির কোনো অহম নেই। এই আমি উদার, সহজেই সত্য বলা আধুনিক বাউল।


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে মামুন খান

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you