সাহিত্যের ইতিহাসে এক-একটা সময় আসে, যখন নতুন সাহিত্যভাষার প্রয়োজন হয়। ইউরোপে এই প্রয়োজন এসেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য সময়ে, তখনই সিম্বলিস্ট আন্দোলনের জন্ম হয়! ওখানে এটাই শেষ বড় আন্দোলন এবং আজ পর্যন্ত সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্দোলন, এত বড় যে, পরে নানা কবিসাহিত্যিকের মধ্যে এর প্রকার-ভেদ ঘটলেও, মৌলিকভাবে এর চেয়ে গুরুতর সাহিত্যচিন্তা আর কী হতে পারে, তা ধারণা করা যায় না। অতএব সাহিত্যে আধুনিকতা একশ বছরেরও কিছু বেশি পুরনো ব্যাপার।
তিরিশের যুগে বাঙলা কবিতা সেই কাব্যভাষা পায়, যা রবীন্দ্রনাথের পর নতুন, যখন থেকে তা আধুনিক কবিতা বলে চিহ্নিত হয়। বিশেষত জীবনানন্দ দাশ বাঙলা কাব্যের পক্ষে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাষায় কবিতা রচনা করেন। আজ আধুনিক কাব্যভাষা ছাড়া, পুরনো কাব্য-ভাষায় কবিতা রচনা করা যায় কি? যায় না বলেই কবিশেখরেরা আর কবিতা লিখতে পারেন না, পদ্য লিখে থাকেন।
‘জীবনদেবতা’, ‘দেবতার গ্রাস’ বা ‘বিরহানন্দ’, ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত…কালি মধু যামিনীতে জ্যোৎস্না নিশীথে…পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে—এইসব কবিতা অন্য লোকের নামে আবার ছাপা হচ্ছে, একথা কোনো কবি বা কাব্যপিপাসু আর ভাবতে পারেন না। ন্যারেটিভ কবিতার দিন আর নেই, ওই সবের ভিতর আধুনিক অর্থে কোনো কাব্যমূল্যও আর নেই, কিন্তু ‘শেষ বসন্ত’-এর মতো অসামান্য কবিতাও কি আমরা সদ্যপ্রকাশিত অবস্থায় দেখতে প্রস্তুত। আশা করি, না। কারণ ওর আধুনিক কাব্যভাষা নেই, ওটা আধুনিক কবিতা নয়। অজর ডক্টর অমুক বা অমর অধ্যাপক তমুকের খারাপ লাগতে পারে, মনে হতে পারে এসব সাক্রিলিজ, (কারণ রবীন্দ্রনাথ যতদিন জগন্নাথ তারাও ততদিন পাণ্ডা) কিন্তু কথাগুলি সত্য।
কিন্তু সে যাই হোক, যে অর্থে রবীন্দ্রনাথের পর এখন কবিতার অধীশ্বরের মত এক আধুনিক কাব্যভাষা আছে সেই অর্থে আমাদের পূর্ববর্তী গদ্যসাহিত্যের অর্থাৎ গল্প ও উপন্যাসের—বঙ্কিমচন্দ্রের পর কোনো আধুনিক সাহিত্য-ভাষা আছে কি? তিরিশের যুগের অগ্রজ লেখকরা যাঁরা শারীরিকভাবে বেঁচে আছেন বলেই আজও লিখে যাচ্ছেন; বস্তুত আজ আমরা সকলেই জেনে গেছি মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এঁরা লিখবেন ও কিছুতেই অন্য কোনো ব্যবসা ধরবেন না—এঁদের কোনো একজনেরও সমগ্র রচনায় আধুনিক সাহিত্যভাষা আছে কি? তিরিশের যুগের বিদ্বান কবিদের জন্য আজ যেমন আধুনিক কবিতা বললেই বুঝতে পারা যায় কী বলা হচ্ছে, আধুনিক গল্প বা আধুনিক উপন্যাস বললে তেমন কিছুই বোঝায় না। কোনো নতুন ট্রেন্ড এখনো গড়ে ওঠে নি। যদিও কাব্যে জীবনানন্দ দাশের মতই একই সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙলা সাহিত্যের পক্ষে সম্পূর্ণ নতুন ভাষায় গল্প উপন্যাস লিখতে থাকেন। ইউরোপে আধুনিক সাহিত্য শুরু হয়ে যাবার প্রায় একশ বছর পরে বাঙলা সাহিত্যের গদ্য ও পদ্যে অবশেষে যখন সেই পুরনো আধুনিকতা এল, ঐতিহ্যবিরোধী ও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দুটি আধুনিক সাহিত্যভাষার লেখক একই সময়ে কাব্য ও গদ্যসাহিত্য রচনাও শুরু করলেন—এই আশ্চর্যতম যোগাযোগ সত্ত্বেও দুঃখের বিষয়, সমকালীন অন্যান্য সচেতন কবিদের জন্য কবিতা যেমন তারপর থেকে আধুনিক কবিতা বলে তার পুরনো জাত ও ধর্ম ত্যাগ করল, উলটো কারণে, অর্থাৎ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারিপাশে শরৎচন্দ্র ভায়া কল্লোলযুগ ধরে এসে ভিড় করে রইল শিল্পচৈতন্যহীন অশিক্ষিত গদ্যলেখকের দল—ইউরোপে আধুনিকতা আসার একশ বছর পরেও বাঙলা গল্প-উপন্যাসের তাই জাত বদল হল না। পঞ্চাশের দশক থেকে ইমাজিনেটিভ সাহিত্যের লক্ষণ আবার দেখা গেল : জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী গল্প লিখলেন, অসীম রায় লিখলেন উপন্যাস। কিন্তু ভিড় করে রইল সেই শিল্প সম্পর্কে অসচেতন লেখকবৃন্দ। সন ১৯৫৯-এ এক অখ্যাত পত্রিকার পূজাসংখ্যায় কমলকুমার মজুমদার তাঁর ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ নামক ক্ষুদ্র উপন্যাস লেখেন যা আজও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল না—কারণ ভিড় সরে গেল না। তাই আমরা অমুকের কবিতা কি তমুকের কাব্যনাট্য বলি, বললেই বলা হয় ওগুলি আধুনিক কবিতা, অমুকের গল্প বা তমুকের উপন্যাস বললে তাই আধুনিকতার কোনো শিল্পশরীর ফুটে ওঠে না।
কখন নতুন সাহিত্যভাষার প্রয়োজন হয় একথা বলা শক্ত, এ সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যদবাণী করা যায় না, এর বর্তমানকেও নিশ্চিন্ত বা সুপরিষ্কার ভাবে নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। কারণ পাঁজি দেখে কোনো সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয় না, একই জাতের লেখকরাও আগে-পরে আসেন। দূর-কাছের বিচিত্র সব কারণ থাকে। যেমন একটা কারণ এই দেখা যায় যে, বিজ্ঞান যখনই মানুষকে ছোট করে দেখাতে চায়, মানুষের ব্যক্তিত্ব তখনই শিল্প-সাহিত্যকে আশ্রয় করে, বলতে চায় যে, মানুষের সবটাই রহস্যময় ও ব্যাখ্যার অতীত। সপ্তদশ শতাব্দীতে মেকানিজম্ প্রবল হয়ে ওঠে, পরের শতকে রোমান্টিকরা বিদ্রোহীর ভূমিকা নেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য সময়ে বিজ্ঞান আবার মানুষকে খর্ব করে, এবার আঘাত আসে বায়োলজির দিক থেকে। থিওরি অব্ ইভোলিউশন মানুষকে অত্যন্ত সামান্য করে ফেলে। মনস্তত্ত্বও মানুষকে ব্যাখ্যা করে ফেলতে চায়। তখনই এই কথা বলার প্রয়োজন হয় যে, এমন কোনো থিওরি হয় না যা মানুষকে ব্যাখ্যা করতে পারে, এমন কোনো মনস্তত্ত্ব হয় না যা মানুষের মানসিকতার কাছে পরাস্ত না হয়। তখন সিম্বলিস্ট আন্দোলনের জন্ম।
অবশ্য এইসব আবিষ্কার সাহিত্য ও শিল্প-সমালোচকদের, এগুলি এমপিরিকাল সত্য ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তুত সাহিত্যের ইতিহাস সমালোচকদেরই সৃষ্টি, এক-একটি যুগের প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য দিনক্ষণ দেখে এক-একটি লেখকগোষ্ঠী আবির্ভূত হন না, অনেক সময়, খুব আশ্চর্যের বিষয়, হনও। অন্তত এলিয়টের আগে পর্যন্ত ইংলন্ডের সাহিত্য-ইতিহাস পড়লে মনে হয়, বুঝি-বা পাঁজি দেখেই ওই দেশের সাহিত্যে নতুন নতুন যুগ শুরু হয়েছে। অপরপক্ষে বহু লেখক এইসব যুগের আগে-পরে লেখেন, যেমন উইলিয়াম ব্লেক। যেমন, ডস্টয়েভস্কি। যেমন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা সবাই নতুন যুগ শুরু হবার আগে তার প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের ধারাবাহিক ঐতিহ্য অনুসরণ ও তার শৃঙ্খলা আধুনিককালে টিএস এলিয়ট এবং তার গুরুতুল্য এজরা পাউন্ডের হাতে ভেঙে যেতে দেখা গেল। এলিয়ট দেশীয় ঐতিহ্য থেকে সৃষ্ট হননি। এলিয়ট ইংলন্ডের কবি নন, আবার আমেরিকার নিউ ইংলন্ডের কবিও তাঁকে বলা যাবে না।
সাহিত্যে আন্দোলন অ্যাকাডেমিক অর্থে পুরোপুরি দেশীয় ঐতিহ্য থেকে কখনোই সৃষ্টি হয় না, বরং অনেক সময় সকল অর্থে বিদেশি ঐতিহ্য থেকে এর জন্ম হয়। এগুলি একদেশে উৎপন্ন হয়ে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

ইংরেজ রোমান্টিকরা ক্লাসিসিজমের বিরোধীগোষ্ঠী ছিলেন। ফ্রান্সের সিম্বলিস্টদের নিশ্চয়ই ভলতেয়ারের রোমান্টিকতা বিরক্ত করেনি; জোলা, ফ্লবেয়ার বা আনাতোল ফ্রাঁসের ন্যাচারালিজমকে বিধ্বস্ত করতেও অতবড় শিল্পবোধের প্রয়োজন ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ইংলন্ডের রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। টেনিসন ব্রাউনিঙের নিও ক্লাসিসিজম রোমান্টিকদের প্রভুত্ব নষ্ট করতে পারেনি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ শেলী কীটসের বিরুদ্ধে তাঁরা কোনো নতুন সাহিত্যভাষা দাঁড় করাতে পারেনি। সিম্বলিস্ট আন্দোলন তা পেরেছিল, ফ্রান্সের ওই আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল ইংরেজি সাহিত্যের ঐতিহ্য থেকে, ফরাসি ঐতিহ্য থেকে হয়নি।
কিন্তু এই আন্দোলন যখন ইংলন্ডে না জন্মে ফ্রান্সে জন্মাল কী দ্রুত ও কত সহজে তা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল এইজন্য যে দেশভেদে সেখানে হাওয়ার যাতায়াতের কোনো বাধা ছিল না। মালার্মে ছিলেন সিম্বলিস্টদের গুরু, তিনি ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। ভের্লেন ইংলন্ডে বসবাস করেছিলেন, ইংরেজি জানাতেন ভালই। ১৮৫২ সালেই বদলেয়র এডগার এলান পোর কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। অপর দিকে জয়েস দেশের বাইরে বাইরেই কাটিয়েছেন বেশি, ফরাসি সাহিত্য যার মাতৃভাষার মত, সেই এলিয়ট আমেরিকা থেকে এলেন ইংলন্ডে, ইয়েটস ইংলন্ডে বসে ‘একমাত্র আন্দোলন’ বলে সিম্বলিস্টদের অভ্যর্থনা করলেন। নারীর মত রূপবান, আয়তচক্ষু মার্লামের মঙ্গলবারের আড্ডায় রু-দ্য রোমের পাঁচতলার বৈঠকখানায় তাই জিদ, দেগা, লাফার্গ, ভালেরি ইত্যাদিদের সঙ্গে অস্কার ওয়াইল্ড, জর্জ মূর ও উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসকেও উপস্থিত থাকতে দেখা যেত।
অতি-আধুনিক লেখক-সম্প্রদায় কোন সাহিত্য ঐতিহ্য বহন করবেন ? তাঁদের ত অতি-আধুনিক কবিদের মত তিরিশের যুগের অনুসরণযোগ্য কাব্য আন্দোলন নেই, তাঁদের যাঁরা অগ্রজ, তাঁরা কল্লোল কালের ফসল। বর্তমান কলেজ স্ট্রিটের প্রায় সকল লেখকের সাহিত্য-শিক্ষা বলে কিছু নেই, এমন নিম্ন শ্রেণীর সাহিত্য আর কোনো দেশে এত দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে কি না সন্দেহ, আমাদের বাংলাদেশে কখনো ছিল না। এই অবস্থা কতদিন চলবে? চলবে বহুদিন, চলবে চিরকাল, কারণ হাজারে হাজারে ম্যাট্রিকুলেটের সংখ্যা বাড়ছে, ভিলাই-রাউরকেল্লা-দুর্গাপুরের লিটারেট শ্রমিকদের অবধূত, অচিন্ত্যকুমার, নীহার গুপ্ত, শংকর, বিমল মিত্র, এবং অনুল্লিখিত আরো অনেকের দরকার আছে, কিছু কাল আগে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, পরে সুবোধ ঘোষ তাদের প্রিয় ছিলেন। এইসব লেখকের কাছে যে-কেউ কালিপুজোর চাঁদা চাইতে যেতে পারে। পপুলার ও ইমাজিনেটিভ এই দুই জাতে সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্যও চিহ্নিত হয়ে আছে।
কথাগুলির প্রসঙ্গক্রম এই যে, বাংলাদেশের অতি আধুনিক সাহিত্যও কি ইউরোপের ঐতিহ্য থেকে জন্মাতে পারে না, যেমন ফ্রান্সের সিম্বলিস্ট আন্দোলন জন্মেছিল ইংলন্ডের ঐতিহ্য থেকে, যেমন ফ্রান্সের সিম্বলিস্ট সাহিত্য থেকে শুধু ইংলন্ডের ইয়েটস, জয়েস বা এলিয়ট নয়, সমস্ত ইউরোপেই আধুনিক সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে এখনই অন্তত আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়, কিন্তু এটা ত আমরা জানি যে জীবনানন্দের কাব্যভাষা এদেশের ছিল না। আর বাংলাদেশের কোন ঐতিহ্য থেকেই-বা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র মত অস্তিত্ববাদী উপন্যাস লেখা সম্ভব হয়েছিল? কল্পনাতীত হলেও একথা সত্য, কমলকুমার মজুমদার একজন বাঙালি লেখক, এবং তিনি আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে লিখছেন! ইয়েটস-এর মত আইরিশও আর কেউ ছিল না, জীবনানন্দ ছিলেন রূপসী বাংলারই কবি।
* ‘সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ ১৯৬২ সালে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ১৫ নম্বর সংখ্যায় পাব্লিশ হয়েছিল। ও, উল্লেখ্য, প্রচ্ছদে ব্যবহৃত প্রতিকৃতিচিত্রী শুভেন্দু সরকার।—গানপার
গানপারে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
- আজ বাজার মে পা-বা-জৌলন চল / ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ || তর্জমা / নাফিস সবুর - December 27, 2025
- লোককবি অন্নদারঞ্জন দাস ও তাঁর গান || জফির সেতু - December 27, 2025
- লোককবি তাজউদ্দিন ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 25, 2025

COMMENTS