নেপোলির মারাদোনা || আহমদ মিনহাজ

নেপোলির মারাদোনা || আহমদ মিনহাজ

ইতালির নেপলস শহরে ভিডিও ব্লগার শেহওয়ার ও মারিয়া দম্পতির সংক্ষিপ্ত সফর দেখতে বসে দ্য হ্যান্ড অব গড ছবিটির কথা মনে পড়ছিল। বছর দুই আগে রিলিজ দিয়েছে। ছবির নির্মাতা পাওলো সোরেনতিনো এই শহরের ছেলে। শহরটির আলো-হাওয়া গায়ে মেখে সিনেমায় হাত পাকিয়েছেন। দ্য ডাস্ট অব নেপলস, অস্কারজয়ী দ্য গ্রেট বিউটি কিংবা ফ্যামেলি ফ্রেন্ড-র মতো ছবি তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। বিশ্ব চলচ্চিত্রে সুবিদিত ছবিগুলোয় জন্মশহর নেপলসকে নানা ছুতোয় প্রাসঙ্গিক করতে দেখেছি তাঁকে। দ্য হ্যান্ড অব গড-এ সেটা রিপিট করেছেন আরেকবার। ছবিটি মনে পড়ার কারণ এক আর্জেন্টাইন, দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা নামে বিশ্ব তাঁকে একনামে চেনে। নেপলস শহরের অলিগলিতে যাঁর উপস্থিতি বাংলাদেশের ছেলে শেহওয়ার ও রোমানিয়ার মেয়ে মারিয়ার চোখ এড়ায়নি। দর্শককে তাঁরা সেটা দেখিয়েছেন। ইতালি এবং আরো স্পষ্ট করে বললে নেপলস ঘটনাচক্রে মারাদোনার সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় নিবাসে পরিণত হয়েছিল। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ছবির বয়ানে সোরেনতিনো এইবেলা তাঁকে সঙ্গী করেছেন।

দ্য হ্যান্ড অব গড ছবির কাহিনি যে-সুতো ধরে এগিয়েছে তার সাথে আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। শিরোনামের কথা বাদ দিলে মারাদোনার উপস্থিতি ছবিতে মুখ্য নয়। হোমেজ সিনের আদলে পরিচালক তাঁকে সেখানে ব্যবহার করেছেন মাত্র। ঘটনাটি সেই সময় ঘটছে যখন নেপোলিকে লিগ শিরোপা পাইয়ে দিতে মারাদোনা শহরে পা রাখেন। তাঁকে নিয়ে নেপলসবাসীর উত্তেজনা ও শিহরন তুঙ্গে পৌঁছায়। সোরেনতিনো স্বয়ং সে-উত্তেজনায় শামিল ছিলেন। এরকম এক সময়ে তাঁর কপালে দুর্ভোগ নেমে আসে। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বাবা-মা দুজনকে হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়েন সোরেনতিনো। জীবনের গতিপথকে তখন প্রশ্নবোধক অনিশ্চয়তায় মোড় নিতে দেখেছেন। লম্বা সময় ধরে এই দুর্ভোগের ভার তাঁকে বহন করতে হয়েছিল। এর নাগপাশ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন। ছবি বানানোর ভাবনা তখন মাথায় আসে। ভাগ্যবিড়ম্বিত মারাদোনা এই সুবাদে তাঁর ঘাড়ে চেপে বসেন। নেপোলির হয়ে খেলতে আসা আলবিসেলেস্তের অমর উক্তি দ্য হ্যান্ড অব গড তাঁকে তখন তাড়া করে ফিরছে। উক্তিমাঝারে মানজীবনের গতি-পরিণতি ও ভবিতব্য যেন খোদাই করে গিয়েছেন এই আর্জেন্টাইন। কাঁচা বয়সে সংঘটিত ঘটনার সাথে যার সংযোগ টের পাচ্ছিলেন সোরেনতিনো। আকাশিনীল জার্সি পরে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো খেলোয়াড়কে অগত্যা ছবিতে প্রসঙ্গ করলেন তিনি। নেপলস শহরে মারাদোনা হচ্ছেন এমন এক ভিনদেশি যাঁকে বাদ দিয়ে নিছক ব্যক্তিগত বিবরণে গমনের কথা লোকে ভাবতে পারে না। শহরবাসীর কারো পক্ষে সেটা আজো অচিন্ত্যনীয় বটে!

এমির কুস্তুরিসা বা পাওলো সোরেনতিনোর মতো যেসব চলচ্চিত্রকার মারাদোনার সময়টায় বেড়ে উঠেছেন তাঁদের পক্ষে তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। ফুটবল স্কিল দিয়ে দুনিয়া মাতানোর পাশাপাশি রকমারি কাণ্ড বাঁধাতে ওস্তাদ এই লোকের নন্দিত-নিন্দিত হওয়ার ঘটনাগুলো তাঁরা নিজ চোখে দেখেছেন। মারাদোনা তো কেবল এক ফুটবলশিল্পীর নাম নয়, চামড়া দিয়ে বাঁধানো গোলকটির বাইরে অতিকায় যে-গোলকে আমরা বাস করি সেখানে বিচরণের সুবাদে কত কাণ্ডই না সে জন্ম দিয়েছে! আপাত উদ্ভট কাণ্ডগুলো অর্থহীন স্মৃতির আবর্জনায় তলিয়ে যায়নি। অজস্র মিনিং তারা সেই সময় পয়দা করেছিল। বতর্মানে করছে। দূর ভবিষ্যতেও করবে মনে হয়।

বলকানের জল-হাওয়ায় মানুষ কুস্তুরিসা হয়তো ওসব ভেবেটেবে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। মনে রাখা ভালো, বলকান তথা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় মারাদোনার সম্মোহন লম্বা সময় ধরে টিকে ছিল। তাঁর ফুটবল স্কিলের প্রতি বলকানদের ভালোবাসা সেখানে বড়ো কারণ। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল একাত্মবোধ। লোকটি লাতিন কিংবা স্প্যানিশভাষী হলেও এই প্রথম একজন খেলোয়াড়কে সকলে দেখতে পাচ্ছিল যে কিনা নিছক ফুটবল পিচে নিজেকে বন্দি রাখেনি। নিপীড়িত ও নিপীড়কে সয়লাব বিশ্বে শোষিতের পক্ষ নিয়ে সে কথা বলে। ক্ষমতামাফিয়াকে ধুয়ে দিতে কারো পরোয়া করে না। সেকালের সমাজতান্ত্রিক শিবির আর পিছিয়ে থাকা দেশগুলোয় মারাদোনাকে নিয়ে উচ্ছাস-সহানুভূতির মাত্রাটি তাই বেশ চড়া ছিল। একাত্মবোধের অনুভূতি অন্যদিকে ইউরোপীয় ফুটবলের পাওয়ার হাউজ নামে খ্যাত দেশগুলোয় গভীর প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফুটবল পায়ে মারাদোনার ভেলকি অস্বীকার করা সম্ভব নয়, কাজেই এটুকু সমীহ তারা তাঁকে করেছে। এর বাইরে আলাদা সমাদার কপালে জোটেনি। পুঁজিবাদী ব্লকের বাসিন্দারা তাঁকে মোটের ওপর নেতিবাচক চরিত্র ঠাউরে নিয়েছিল। মাঠের বাইরে মারাদোনার বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে। আবেগপ্রবণ ও উচ্ছন্নে যাওয়া বেপরোয়া লোকটিকে নিয়ে গণ্যমাধ্যমের আতিশয্যকে বরং নাকউঁচু ইংরেজ ও বাদবাকিরা বাঁকা চোখে দেখেছে তখন।

বখাটে এই মারাদোনাকে আসিফ কাপাডিয়া সম্প্রতি ধারণ করেছেন ক্যামেরায়। তাঁর বানানো তথ্যচিত্রের সাথে কুস্তুরিসার ফারাক আসমান-জমিন। আমজনতার ওপর আবেগপ্রবণ মারাদোনার ফুটবলশৈলীর প্রভাব বলকান পরিচালককে ভাবিয়েছে। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে তিনি ভেবেছেন। মাঠে এবং মাঠের বাইরে বিতর্কিত সব ঘটনার জন্ম দিতে ওস্তাদ মারাদোনার কাণ্ডকারখানা কীভাবে বহুকৌণিক অর্থ পয়দা করে, ক্যামেরায় সেটা ধারণ করতে আগ্রহী ছিলেন এই বলকান। তাঁর তথ্যচিত্রে মারাদোনাকে যে-কারণে ইতিবাচক লাগে দেখে। ইউরোপের গণমাধ্যম ভড়ংসর্বস্ব ফুটবল জিনিয়াসের তকমায় মারাদোনাকে হাজির করতে সদা তৎপর থেকেছে। কুস্তুরিসার ন্যারেটিভ সেদিক থেকে ভিন্ন ছিল। স্বতঃস্ফূর্ততায় ভরপুর আমুদে, হুল্লোড়প্রিয়, আবেগী ও মাটিলগ্ন এক সত্তাকে দেখার আবেশ তথ্যচিত্রে তিনি জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন।

আসিফ কাপাডিয়া সে-পথ মাড়াননি। তাঁর তথ্যচিত্রে দিয়েগোর মানবিক সত্তা নেতিবাচক উপকরণে ঠাসা। মাদকাসাক্ত, নারীপীড়ক, মদ্যপ ও খামখেয়ালি এক খ্যাপাটে সত্তাকে চটকদার মোড়কে পুরে দর্শক সমুখে হাজির করেছেন নির্মাতা। শাপশাপান্ত করার খায়েশে মানুষ যাকে নেটফ্লিক্সে ক্ষণিক চাখবে। এই প্রজন্মের ছেলেপিলেরা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল করার জন্য মারাদোনাকে জোচ্চর বলে ডাকতে দুবার ভাবে না। কাপাডিয়ার বয়ান তাতে আরেকটু ঘি ঢালে মাত্র। মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে মারাদোনার বিচিত্র সব কুকীর্তির কার্যকারণ অনুসন্ধানের তাগিদ তাঁর তথ্যচিত্রে চোখে পড়ে না। এমন কোনো ন্যারেটিভের দেখা পাওয়া দায় হয় যেটি কিনা ফুটবল ইতিহাসে ব্যতিক্রম নায়কের পাপী সত্তায় বহমান স্ববিরোধিতাকে বুঝতে সাহায্য করবে। সোরেনতিনোর ছবিটি সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মারাদোনা সেখানে নিয়তিটানে বিড়ম্বিত এক সত্তার সুহৃদ। তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স হিসেবে যাঁকে ছবিতে হোমেজ দিচ্ছেন পরিচালক। ছিয়াশির বিশ্বকাপ মাতিয়ে রাখা আকাশনীল জার্সিতে দুরন্ত মাঠদানবের নেপলস শহরে আগমন ফুটনোটের মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। ছবিতে মারাদোনার গৌণই থাকে কিন্তু দর্শকের মনে গৌণটাই অধিক ছাপ রেখে যায়!

সাত-আট বছর আগে বানানো ইয়ুথ-এ তারুণ্য ও বার্ধক্যের সাথে শিল্প ও জীবনবেদের সমীকরণ মিলাতে বসেছিলেন সোরেনতিনো। স্থূলকায় মারাদোনাকে সেখানেও ইয়াদ করতে দেখা যায়। ছবির মূল কাহিনিতে তাঁর ভূমিকা যথারীতি গৌণ। না আনলেও চলত টাইপের মনে হয়, তবু তাঁকে ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করেন সোরেনতিনো। মেদবহুল দিয়েগোর ভূমিকায় রোলি সেরানোকে স্থূলতা ও শ্বাসকষ্টের চাপ সামলে টেনিস বল পিটাতে দেখে দর্শক। কেন এই হোমেজ? প্রশ্নের উত্তর ছবিতে তালাশ করলে পাওয়া যায়, যেখানে এই সত্যটি বড়ো হয়ে ওঠে,—মারাদোনার সময়বিশ্বে বেড়ে ওঠা কারো পক্ষে তাঁকে ভুলে থাকা মুশকিল। এক ছদ্মবেশী বহুরূপী, যাঁর জীবনের চড়াই-উৎরাই সবটাই দ্বান্দ্বিক। বিচিত্র সব ফ্রেমে ঢুকিয়ে যাঁকে দেখা সম্ভব। সোরেনতিনো সেই কাজটিই করছেন এইবেলা।

মানুষের জীবনে এমন ঘটনা থাকে যা সে আগাম অনুমান করতে পারে না। অনুমানের অতীত ঘটনা তার জীবনকে তছনছ করে যায়। একে এখন কী দিয়ে বুঝবে সে? দৈব বলে ভাববে অথবা অন্যকিছু? এমন কিছু যার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা সম্ভব নয়। এরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা হয়তো সে চিন্তাও করেনি। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে ঈশ্বরের মতো বায়বীয় কোনো শক্তি এই ট্রাজেডির নিয়ামক! মর্মান্তিক সে-বিপত্তির কাহিনিকে শিরোনামবিন্দ করার ভাবনা মারাদোনায় ফেরত যেতে তাঁকে বাধ্য করেছিল। ছবির শিরোনাম ঠিক করতে যেয়ে ফুটবল জাদুকরের বিতর্কিত উক্তি দ্য হ্যান্ড অব গডকে সেক্ষেত্রে বেছে নিয়েছিলেন সোরেনতিনো।

সকলের জানা, দ্য হ্যান্ড অব গড  বচনটি মারাদোনার কল্যাণে অমরত্ব লাভ করেছে। ৮৬-র বিশ্বকাপকে চিরস্মরণীয় করে তোলা ফুটবল জাদুকরের স্মৃতিকে এটি ফেরত আনতে বাধ্য করে। তার সাথে ফকল্যান্ড দ্বীপকে ফেরত আনে। লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচারের ইংল্যান্ড দ্বীপটিকে তখন গায়ের জোরে আর্জেন্টিনার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। মারাদোনার বদলৌতে এভাবে চে গেভারা ও ফিডেল ক্যাস্ট্রোরা ফেরত আসতে থাকেন। ফেরত আসেন ফিফাকে দুর্নীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট ভাগাড়ে পরিণত করা সেপ ব্লাটার। ইতালিতে অনুষ্ঠিত নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতিটাও সে ফেরত আনে বৈকি। ছিয়াশিতে যে-জার্মানিকে হারিয়ে দিয়েগো বিশ্বকাপ জিতলেন, নব্বইয়ের ফাইনালে ওই জার্মানির সাথে ফের লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল। উড়তে থাকা জার্মানদের বিপক্ষে আলবিসেলেস্তেরা ছিল বেতো ঘোড়া। প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের কাছে হেরে বসে। রজার মিলাকে ওই সুবাদে চিনেছিল গোটা বিশ্ব। প্রথম ম্যাচে হারার বাতিক আর্জেন্টাইনদের পুরানো। মেসিরা যেমন সৌদি আরবের কাছে হার দিয়ে দুইহাজার বাইশে যাত্রা শুরু করে। বাকিটা এখন ইতিহাস। মহাকাব্যিক এই বিশ্বকাপ নিয়ে দূর ভবিষ্যতে কেউ হয়তো জমিয়ে লিখবেন।

ফাউল আর কাউন্টার অ্যটাকে নাজেহাল মারাদোনার জন্য নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ছিয়াশির মতো ঝলমলে হয়নি। বিশ্বকাপের ইতিহাস বিচারে বেশ ফিকে ছিল নব্বই। গোল কেন কম হচ্ছে সেটা নিয়ে পেলে থেকে শুরু করে তাবড় ফুটবল বিশ্লেষকরা সোরগোল আর তর্কে মেতেছিলেন। রাইট উইংয়ে দারুণ খেলতে থাকা ক্যানিজিয়াকে নিয়ে মারাদোনার প্যাশোনেট লড়াই অবশ্য নজরকাড়া ছিল! ফাইনালে ওঠার পথে টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করলেও ভাগ্যদেবী তাঁকে বিমুখ করেননি। গোলকিপারভাগ্য আর্জেন্টাইনদের অনেক কঠিন ম্যাচ জিতিয়েছে। গোয়কচিয়া ছিল নব্বইয়ের এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। ইতালির বিপক্ষে পেনাল্টি ঠেকিয়ে দলকে ফাইনালে তোলে। দেশের হয়ে তৃতীয় আর নিজের ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় শিরোপা হাতে নেওয়ার লড়াইয়ে হার মানতে হয়েছিল দিয়েগোকে। ন্যাড়া মাথার রেফারি এদগার্দো কোডসালের দেওয়া অনায্য পেনাল্টিতে জার্মানরা জিতে যায়। মারাদোনা তখন শিশুর মতো কাঁদছেন।

এভাবে কান্না করার ক্ষমতা, ক্রমশ যান্ত্রিক ও নিখুঁত হয়ে ওঠা ফুটবল ময়দানে সকলের থাকে না। ইউরোপে বিকশিত ফুটবল ঘরানার সাথে লাতিন ফুটবলের পার্থক্য এখনো মোটামুটি অটুট। ব্যক্তিপ্রতিভা আজো সেখানে মৌচাক বলে গণ্য করে লোকজন। তাকে ঘিরে বাকিরা নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করতে খাটে। এর ওপর বাজি ধরে কাপ জিততে চায়। জিতেও। তো এই ক্ষমতাকে সেদিন ফতুর হতে দেখার হাহাকার ছিল মারাদোনার কান্নায়।

গাণিতিক ছকে নিখুঁত জার্মানির গতি, স্কিল ও দলগত সংহতি সেদিনতক অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছে। ইউরোপের ফুটবল ঐতিহ্যে বেড়ে ওঠা দেশগুলোর জন্য সহজাত হলেও ওই পথে হাঁটতে গিয়ে উজ্জ্বল হলুদে চোবানো সেলেসাওরা বহুবার পথ হারিয়েছে। দারুণ সব প্রতিভার সমাবেশে ভরপুর ব্রাজিল যে-কারণে জুলে রিমের পরে ফিফা বেশি জিততে পারেনি। একুনে দুবার কাপ ঘরে তুলেছে তারা। গতি, স্কিল আর গাণিতিক ছকে অবিশ্বাস্য নিখুঁত ইউরোপকে ব্রাজিলের ছন্দনির্ভর ফুটবল ঐতিহ্যে একীভূত করার কসরত সেলেসাওদের বিস্তর ভুগিয়েছে।

দুটি ঘরানা নিজের জায়গা থেকে শৈল্পিক হলেও তাদের মধ্যে বড়ো ফারাক হচ্ছে ফুটবল সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীভূত জীবনবেদ। লাতিন ও ইউরোপকে এটি পৃথক ভাবতে সদা বাধ্য করে। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ডুঙ্গাকে একবার কোচ করা হয়েছিল। ব্রাজিলকে ফের কাপ পাইয়ে দেওয়ার মিশনে নেমে পার্থক্যটি তুলে দিতে মরিয়া হলেন তিনি। সেলেসাওদের চিরাচরিত খেলার ধরনে ইউরোপের হিসাবি গতিনির্ভর ফুটবল শৈলীকে একীভূত করার কসরত কাজে দেয়নি। ছন্দহীন জড়ভরত এক ব্রাজিলকে দেখেছিল বিশ্ব আর ডুঙ্গাকে খলনায়কের বদনাম মাথায় নিয়ে কোচিং থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল।

ইউরোপ ফুটবলটা মস্তিষ্ক দিয়ে খেলে আর লাতিনরা হৃদয়;—বহুপ্রজ উক্তিটি সময়ের সাথে আবেদন হারালেও এর সারার্থ মিথ্যে নয়। লাতিন কোনো দলের প্রাণভোমরা খেলোয়াড়টির মধ্যে সেই প্যাশন থাকা জরুরি যাকে ঘিরে বাকিরা নিজের সেরাটা মাঠে ঢেলে দিতে তৎপর থাকবে। হতাশা ও নিন্দার ঝড় সামলে গত বিশ্বকাপে মেসি সেটি অবশেষে করে দেখিয়েছে। নিজের ভিতরে ঘুমন্ত লাতিনসত্তাকে দুইহাজার বাইশে এসে সে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল। দেশকে বড়ো কিছু উপহার দেওয়ার ক্ষুধা সিংহের গর্জন তুলছিল তাঁর দেহে। এতদিন সে সিংহ ছিল না। একলা একটা বাঘ হয়ে মাঠে জাদু দেখিয়েছে। ক্লাব ফুটবলে বার্সেলোনার হয়ে বাঘের মতো একলা শিকার করেছে প্রতিপক্ষ। সিংহের স্বভাব ভুলে তাঁর এই একলা শিকার ধরা বিশ্বকাপের ময়দানে কাজে লাগেনি। স্কলানির মতো কোচের দরকার ছিল, যাঁর ছোঁয়ায় বাঘ থেকে সিংহে মেসিকে ফেরত যেতে দেখেছে গোটা বিশ্ব। রাজকীয় এই সিংহের ভিতরে আগ্রাসী খিদে। সে এখন সিংহরাজ। রাজার পেছনে তৎপর বাকি সিংহরা। তৎপর পুরো দল, —শিকার ধরার ক্ষুধায়।

আলবিসেলেস্তেরা বাইশে যেটা করে দেখালো, সেলেসাওরা কি পারত না? নিশ্চয় পারত। ওই ক্ষমতা নিয়ে তারা ময়দানে হাজির থাকে। তবু পারেনি! কারণ একটাই, দারুণ সব প্রতিভায় বোঝাই ব্রাজিল অনেকদিন ধরে একটা দল হয়ে উঠতে পারছে না। মাঠে গোল দিয়ে বেবেতোর পিতা হওয়ার সংবাদ মাঠেই উদযাপন করার মধ্যে যে লাতিন জীবনবেদ সেটি তারা ভুলতে বসেছে। সাম্বার সুরলয়তাল কেটে গেছে। সেলেসাওরা, আজ বহুদিন হয়ে গেল একটা মেসি বা মারাদোনার খরায় ভুগছে, যার পেছনে সারিবদ্ধ পল্টুনের মতো দাঁড়িয়ে যাবে পুরো দল।

নব্বইয়ের গোয়কচিয়া মারাদোনার জন্য পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাইশে মার্তিনেজ স্রেফ মেসির জন্য নিজেকে ঢালে পরিণত করে। ফাইনাল ম্যাচটি একবার রিকল করা যাক। গতিদানব কিলিয়ান এমবাপের দুরন্ত কারিশমায় খেলা টাইব্রেকারে গড়ানোর আগেই কাপ ফ্রান্সের হাতে উঠত। তৃতীয়বার কাপ হাতে নেওয়ার সুখ ফরাসিরা উদাপন করতে পারত সাড়ম্বর। মার্তিনেজের কারণে সেটা হয়নি। খেলার আদিঅস্তক কী ভীষণ তৎপর ছিল সে! শেষ বাঁশি বাজার প্রাক ক্ষণে তার ওই সেভটা ছিল জীয়নকাঠি। ফরাসিদের মনোবল সেখানেই আর্ধেক টুটাফাটা হয়ে গিয়েছিল। লাতিন ফুটবলের ক্ষেত্রে কথাটি অমোঘ,—ভাগ্যদেবী সেই লাতিন বীরের প্রতি প্রসন্ন থাকেন যে তার দেশের জন্য, তার দলনায়কের জন্য জীবন বাজি রেখে খেলে। দেশকে বড়ো কিছু দিতে চায়। আকাশিনীলরা এবার সেটা করে দেখিয়েছে। সেলেসাওদের মধ্যে করে দেখানোর ক্ষুধা, দুইহাজার দুইয়ের পর থেকে নিখোঁজ।

ফুটবল ইতিহাসে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ছাড়াও চারজন ফোর আর-এর (Four R) কথা বিশ্ব জানে। সেদিন অবধি তারা মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। চারজনই সেলেসাও। উজ্জ্বল হলুদ জার্সিতে অনন্য ব্রাজিলিয়ান। রোনালদো, রোনালদিনহো, রবার্তো কার্লোস ও রিভালদো মিলে দুইহাজার দুইয়ের বিশ্বকাপে অতুল সংহতি জন্ম নিয়েছিল। এই মৌচাকের পেছনে জমাট ছিল বাকিরা। সেলেসাওদের ঘরে পেলের জামানা মনে হচ্ছিল আরেকবার ফেরত এসেছে। পেলে-গারিঞ্চারা মিলে তো এভাবেই জুলে রিমেটা তিনবার জিতেছিলেন। ফুটবলমত্ত ব্রাজিলকে ফোর আর সেই সুখ উপহার দিয়েছিল। তাদের ম্যাজিক খতম হওয়ার দিন থেকে জামানাটি ফের নিখোঁজ। কেন নিখোঁজ তার ইশারা হয়তো মারাদোনার অবুঝ ক্রন্দনে নিহিত ছিল। মেসি অদ্য সেটা পড়তে পারলেও সেলেসাওরা পারছে না। খেলার মাঠে তাদের চিরশত্রু আলবিসেলেস্তার কান্নাটি সেদিন নিছক কান্না ছিল না। নিয়তি সেখানে গূঢ় অর্থ লিখে রাখছিল। এক যুগনায়কের নিজের পতন দেখতে পাওয়ার বেদনা লেখা ছিল সে-কান্নায়। মনে-মনে ভাবছিল, আলবিসেলেস্তেরা হয়তো আর কখনোই কাপটা জিততে পারবে না! পত্রিকায় নজরকাড়া শিরোনাম ছিল পরের দিন,—কোডসালের বাঁশিতে মারাদোনার স্বপ্নভঙ্গ!

রেফারি সত্যি কতটা দায়ী ছিলেন সেটি পৃথক প্রসঙ্গ। তবে মারাদোনা মানেই তো ফিফার সঙ্গে অঘোষিত লড়াই। কাগজওয়ালাদের জন্য যা ছিল মুখরোচক। বিশ্ব জুড়ে চলমান ক্ষমতা রাজনীতিকে যেটি সামনে এনেছিল। প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বে দুনিয়াকে মেরুকরণে সিদ্ধহস্ত ক্ষমতা রাজনীতির বহু অনুষঙ্গ এভাবে তাঁর কারণে বারবার ফেরত এসেছে। চুরানব্বইয়ে জীবনীশক্তির তলানিতে পৌঁছে যাওয়া মারাদোনার ওপর ভর দিয়ে মার্কিন দেশে আয়োজিত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা মাঠে নামে। আরেকটা কুখ্যাত বিশ্বকাপ। আত্মঘাতি গোল করার অপরাধে কলাম্বিয়ার হয়ে খেলতে নামা আন্দ্রেস এস্কোবারকে গুলিতে ঝাঁঝরা করেছিল কেউ। মাফিয়া ও মাদকের ত্রাস বাকি সব আলোচনাকে গৌণ করে তুলছিল। কলাম্বিয়ার হয়ে ভালদেরামা ও হিগুইতাকে খেলতে দেখাটা ছিল বিনোদন ও একমাত্র সান্ত্বনা। ওদিকে ডোপ টেস্টে ধরা খেলেন ফুটবল জাদুকর। তাঁকে বহিষ্কার হতে হলো টুর্নামেন্ট থেকে। যাকে ঘিরে মৌচাক সে নেই। পরের দিন নাইজেরিয়ার সাথে নামবে আকাশিনীল। বাজে খেলে হেরেছিল দিশেহারা দলটি। লোকে তখন এর পেছনে ক্ষমতা রাজনীতির হাতে বোনা ষড়যন্ত্রকে দুষেছিল বিস্তর। অবিশ্বাস্য সহানুভূতি মারাদোনা আদায় করে নিতে পেরেছিল। শিশুর মতো অবুঝ ক্রন্দন, ভণিতাহীন উল্লাস আর ক্ষমতা রাজনীতিকে সপাটে প্রশ্ন করতে পারার গুণ ছিল যার বড়ো কারণ।

মারাদোনা ফুটবল ইতিহাসের ব্যতিক্রম নায়ক। মাদকাসক্ত ও মিসোজিনিক পাপী সন্তকে সে বারবার ফেরত আনে। টলস্টয়ের মহাকাব্যিক আখ্যানের নায়ক হওয়ার উপযুক্ত যে! বোর্হেস ফুটবল খেলাটা বিশেষ পছন্দ করতেন না কিন্তু মারাদোনা তাঁর গোলকধাঁধাতুল্য প্যারাবোলার নায়ক হওয়ার গুণধারী বটে! সে হলো বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুম। দস্তয়েভস্কির পাপী সন্ত। পাপপুণ্য দুটোকেই নিজদেহে দাপটের সাথে যাপন করতে যে কখনো পিছপা হয়নি। জীবনমদিরার পেয়ালা থেকে বিষ ও অমৃত দুটোই পান করেছে মরে যাওয়ার অন্তিম ক্ষণ অবধি।

দর্শকঠাসা স্টেডিয়ামে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে UEFA কাপের ম্যাচ খেলতে নেমেছিল। ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে ওয়ার্ম আপে তাঁকে ডেডিকেট করা বেঁচে থাকাই জীবন (Live is life) গানটা তখন বাজছে। তাঁর পায়ে চামড়ার গোলক। হুয়ান ভিলারো নিজের বইয়ের শিরোনাম বাছতে যেয়ে গোলকটিকে ঈশ্বর নাম দিয়েছেন। তো এই ঈশ্বর সেদিন মারাদোনার পোষা বিড়াল হয়ে দর্শককে আনন্দ দিচ্ছিল। গানের ছন্দে তাল দিয়ে দক্ষ বাজিকর বল নিয়ে ছেলেখেলায় মেতেছে আর ওদিকে দর্শক বোবা বিস্ময়ে দেখছে তাঁর ফুটবল স্কিল। পেলে-গারিঞ্চাকে যারা দেখেনি, জর্জ বেস্ট-পুসকাস এবং এরকম অনেক, তাঁরা সেদিন মারাদোনার মধ্য দিয়ে ফুটবলের আলৌকিক আনন্দ শুষে নিয়েছিল। মিশেল প্লাতিনি হয়তো সে-কারণে উক্তিটি করেছিলেন, ‘জিদান এখন বল দিয়ে যেটা করে, দিয়েগোর জন্য কমলালেবুই যথেষ্ট ছিল।’ একালে যেমন মেসি-রোনালদো-এমবাপেকে দেখে লোকে শিহরিত হয়, বল পায়ে নিজের স্কিল দেখানোর খেলায় মারাদোনা ছিল তাঁর সময়ের সাক্ষাৎ ঈশ্বর।

ব্যাপার সেখানে নয়। ব্যাপার হচ্ছে দর্শকসমুখে বলের জাদু দেখাতে মগ্ন খেলোয়াড়টির জীবনে অমোঘ সত্য হয়ে ওঠা গানের চরণগুলো। খ্যাপাটে প্রতিভাকে লক্ষ করেই বুঝি গায়ক গাইছিলেন : ‘When we all give the power/ We all give the best/ Every minute of an hour/ Don’t think about a rest.’ মারাদোনা সেরকম বটে! মরণের আগে অবধি জীবনকে উদযাপন করতে বল্গাহারা মাতাল তরণী। মাদকে বল্গাহারা, সাংবাদিককে এয়ারগান দিয়ে গুলি ছুঁড়তে বল্গাহারা, ফিফার মুখের ওপর ঝামা ঘঁষে দিতে বল্গাহারা, শিশুর মতো কেঁদে ভাসাতে কিংবা কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরতে বল্গাহারা। তাঁর এড্রিন্যালে বোধ করি আতিশয্য উপচে পড়ত। একে শাসনে রাখা স্বয়ং সে কিংবা তাঁর প্রিয়জন কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এর থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক অতিকথা;—মারাদোনা তাঁর নাম।

বিল ময়ার্সের সাথে বাতচিতে জোসেফ ক্যাম্পবেল বলেছিলেন মিথ কেবল পৌরাণিক বা ধূসর অতীতে ঘটতে থাকা ঘটনার অতিরঞ্জন নয়, মিথ প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে। র‌্যাম্বো সিনেমায় সে যেমন জন্ম নিচ্ছে, ঘর থেকে বের হওয়ার আগে লোকে এখনো এমন কিছু হয়তো করে যাকে যুক্তি দিয়ে মাপা হাস্যকর মনে হয় এবং সেটি মিথের জন্ম দিয়ে যায়। মারাদোনাকে এই যে সোরেনতিনো ফেরত আনলেন ছবিতে, সেটা ওই মিথ হয়ে ওঠা বচনের গুণে। হাত দিয়ে গোল করার চালিয়াতি ধরা পড়ে যাবার পর ক্ষুব্ধ ইংরেজ সায়েবদের মুখের ওপর সেদিন বলেছিল, ‘ওই হাত ঈশ্বরের ছিল, আমার নয়।’ ঈশ্বর যদি ফকল্যান্ডকে রানীর হাওলা করে দিতে সহায়তা করে থাকেন, এইবেলা ইংরেজদের সবক দিতে তিনি মারাদোনার হাতে ভর করেছিলেন। ফকল্যাণ্ড দ্বীপকে তারা প্রতারণা করে ছিনিয়ে নিয়েছিল। খেলার ময়দানে মারাদোনার হয়ে ঈশ্বর এই জবরদখলের জবাব দিচ্ছেন। ফুটবল কেবল স্কিলের পরাকাষ্ঠা নয়, ওটা পলিটিক্যাল, আর মারাদোনা এই রাজনীতির এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বর্ণাঢ্য চরিত্র। তাঁকে ঘৃণা বা অপছন্দ করা যেতেই পারে কিন্তু উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

সে যাকগে, সোরেনতিনোর ছবিতে ফেরত যাই। গল্পের পটভূমি যদি নেপোলি হয় তাহলে মারাদোনা সেখানে অবধারিত। শহরটির খেটে খাওয়া মানুষ লোকটাকে রীতিমতো যাপন করত। ইতালির জাতীয় লিগে ঠাট্টা-উপহাসের পাত্র নেপোলিকে সেই তো প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুখ দিয়েছিল। একবার নয়, পরপর দুবার। তাঁর হাত ধরে UEFA কাপ জিতেছিল নেপোলি। তারপর দীর্ঘ খরা। কাকতালীয় মানতে হয়, আর্জেন্টিনার হয়ে ৮৬-র বিশ্বকাপ জেতার ছত্রিশ বছর বাদে মেসি ফের জেতালেন বিশ্বকাপ। নেপোলিও, মারাদোনা চলে যাওয়ার পর রং হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল। ভালো খেলোয়াড়ের কমতি ছিল এমন নয় কিন্তু লিগ বা কোনো কাপ এই কালপর্বে তারা জিততে পারেনি। ম্যারাডোনার হাত ধরে তাদের রূপকথার শুরু আর তিনিই শেষ নায়ক। এতদিন পর নেপোলির ভাগ্যে চাঁদ উঠেছে। আলবিসেলেস্তেদের মতো তারাও চলতি বছরের গোড়ায় লিগ শিরোপা জিতেছে। উৎসবের বন্যায় ভেসেছিল গোটা শহর। মারাদোনা সেখানে যথাবিহিত মধ্যমণি।

নেপলস হচ্ছে এমন এক শহর যেখানে শ্রমজীবীরা সংখ্যাধিক। মাদক, মাফিয়া আর শত কিসিমের ক্রাইম হরহামেশা ঘটতে থাকে। দেয়ালজোড়া গ্রাফিতি, ফুটপাত ও সড়ক জুড়ে সস্তা খাবার আর রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসা ক্রেতা-বিক্রেতার শোরগোল সঙ্গী করে শহরটি তবু বেঁচে থাকে। প্রতিটি দেয়াল, গলির মোড়, রেস্তোরাঁ…মোদ্দা কথা শহরের আনাচ-কানাচে মারাদোনার উপস্থিতি চোখে পড়ে। আর্জেন্টিনার খেটে খাওয়া হতভাগারা যেখানে গাদাগাদি করে থাকে সেখান থেকে এক বিস্ময়বালকের উত্থান ঘটেছিল। বল তাঁর পায়ে চুম্বকের মতো আটকে থাকত। ছুটত ঘোড়ার বেগে। খাটো দেহের গাট্টাগোট্টা লোকটি তারপর সাময়িক চলে এলো নেপলস। রোম, মিলান তো ছিলই, ইতালির অন্য শহরগুলোর শানদার কোনো ক্লাবে অনায়াস যেতে পারত, কিন্তু নেপোলিকে বেছে নিয়েছিল সে। হতশ্রী, ভিড়ে ভিড়াক্কার, অপরিসর শহরের লোকজনের প্রাণের প্রতীক এই ক্লাব। মাত্র এক পয়েন্ট খোয়ালে রেলিগেশনের খাড়ায় পড়বে। রেলিগেশন থেকে বাঁচতে নেপোলি আকুল হয়ে বিশ্ব মাতানো ফুটবলারকে ডেকেছিল। মেসির বার্সেলোনা যেমন তাঁকে ডেকেছিল পরে। অভিজাত্যে মোড়ানো রিয়াল মাদ্রিদের সাথে টক্কর লড়ার ক্ষমতা সে-আমলে বার্সেলোনার ছিল না। জাতে উঠতে মারাদোনাকে ভাড়া করেছিল ক্লাবটি। নেপোলি তারচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। গরিবের ক্লাব পাগলা মারাদোনার মধ্যে নিজের উদ্ধার দেখতে পাচ্ছিল। শহরের লোকজন রোমাঞ্চিত ছিল ভেবে, অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। জগৎসেরা আলবিসেলেস্তে পা রাখছেন শহরে। এই রোমাঞ্চকে ছবিতে মোক্ষমভাবে ব্যবহার করেছেন সোরেনতিনো। নতুন রূপকথার জন্ম দিতে নেপোলি তাঁকে হাতছানি দিচ্ছিল। ফুটবলমত্ত শহরে রূপকথাটি জন্ম নিলো। এর সাথে জন্ম হলো কোকেনআসক্ত পাগলাটে খ্যাপার।

মারাদোনা, তাঁর ক্যারিয়ার জুড়ে আউট অব বক্স  চরিত্র। পেলে কিংবা মেসির মতো সুশৃঙ্খল প্রতিভা দিয়ে লোকের মন কাড়েনি। সে উন্মত্ত। অবুঝ শিশুর মতো আবেগপ্রবণ। ঠোঁটকাটা। বাহুতে খোদাই করা চে গেভারের উল্কিতে চুরুটঠাসা বিপ্লবী। অন্যদিকে আমোদে ভরপুর পাগলা জগাই। শোভনতার পরোয়া করে না। মাঠে যেমন একের-পর-এক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বল নিয়ে ছোটার ক্ষণে কিংবা ডিফেন্সচেরা পাস দিতে আউট অব বক্স, মাঠের বাইরেও তাই ছিল। মারাদোনা কিংবা ম্যারাডোনা, যে-নামে ডাকি, তাঁকে ভুলে থাকা কঠিন। নেপোলি আজো ভুলতে পারেনি। মেসিউত্থানের পর নিজদেশ আর্জেন্টিনায় তাঁর প্রভাব অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। ফুটবলঈশ্বরের উপাসনায় গড়ে ওঠা চার্চে আগের মতো লোকসমাগম হয় না, নতুন প্রজন্মের কাছে সে হয়তো বিস্মৃত কিংবদন্তি, কিন্তু দূর ইতালির ছন্নছাড়া শহর নেপোলির অলিগলিতে আজো বিস্ময়করভাবে জীবিত। দেখে বোঝার উপায় নেই, লোকটি আর বেঁচে নেই! এই তো সেদিন, করোনা মহামারি চলছে, তার মধ্যেই তাঁর চিরঘুমের দেশে গমনের খবর এসেছিল।

মারাদোনা নেই সংবাদটি হুয়ান ভিলারোকে বিরক্ত করেছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল, এরপর থেকে পৃথিবীটা নিরস ঘটনাশূন্য হয়ে উঠবে। ঘটনা সকলেই কমবেশি ঘটায় কিন্তু মেরিলিন মনরো, এলভিস প্রেসলি, মাইকেল জ্যাকসন, মোহাম্মদ আলী বা মারাদোনার মতো ঘটানোর এলেম থাকে না। সময় যত গড়ায় তাঁদের হাতে সৃষ্ট ঘটনায় বিচিত্র রং লাগতে থাকে। মিনিং পয়দা হয় অবিরত। খ্যাপাটে মারাদোনাকে নিয়ে ভিলারো তাই লিখছেন :

তিনটি ঘটনা পৃথিবীর গতিপথ বদলানোর হ্যাডম রাখে। চীনের প্রাচীরকে ব্যক্তিমালিকানায় জিম্মা করা হয়েছে, ভূমিকম্পে মেক্সিকো শহরটা দেবে গিয়েছে, আর, মারাদোনা ধরায় বেঁচে নেই! বেঁচে থাকার জন্য যারা লড়াই করছে তাদের অনুতাপ ও বেদনায় শরিক থেকেই কথাগুলো লিখছি। চাঁদ থেকে নিঃসঙ্গ যে-ভবনকে দেখা যায় সেটি থিম পার্কে পালটে গেছে, যে-শহরে আমি জন্ম নিয়েছিলাম সেটি এখন গোলকধাঁধা, রাস্তার কুকুরগুলো সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়টি বলে শেষবার লাথি মারছেন। [God is roud by Juan Villoro; Translation: Thomas Bunstead, 2016; Online Source: ভাষান্তর : লেখক; অনলাইন উৎস : zoboko.com; বাংলা ভাষান্তর : লেখক]

হুয়ান ভিলারোর কাছে মারাদোনা এক ফিনিক্স পাখি। পাখিকে নিবেদিত চ্যাপ্টারটি লিখতে যেয়ে টলস্টয়ের আদলে তাঁকে শিরোনাম সাজাতে হয়। মারাদোনা টলস্টয়ের আখ্যানে ঘূর্ণি তোলা চরিত্রের মতোই মহাকব্যিক। গ্রিক মহাবীর একিলিসের সাথে তাঁর তুলনা ভালো মানায়। ওর মতো শক্তিমান ও ভঙ্গুর। ভিলারো জানাচ্ছেন, ফিটনেস ধরে রাখতে খেলোয়াড়ি জীবনে নিয়মমাফিক অনুশীলনের পরোয়া বড়ো একটা করেনি। স্প্যাগেটি ও ওয়াইনে উদরপূর্তির সময় তাঁর মনেই থাকত না কালকে ম্যাচ আছে। কিন্তু মাঠে নামার আগে তাঁকে দেখে মনে হতো সিনাটা ফুলে উঠেছে আর বল পায়ে আসা মাত্র ওটাকে খুন করবে সে।

মরণ এই লোকটির জন্য নিছক নাম্বার ছিল। ক্যারিয়ারের চূড়ায় ওঠার ক্ষণ থেকে পতন অবধি বহুবার সে মরণকে দোড়গোড়ায় দেখেছে এবং ফিনিক্স পাখির মতো ফের জীবনে ফেরত যাওয়ার উল্লাসে মেতে উঠতে দেরি করেনি। এরকম এক চরিত্রকে জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনের গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকা পাখি ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কঠিন। কথাটি তাই মিথ্যে নয়, মারাদোনার দেহ বেঁচে নেই কিন্তু সে জীবিত। নেপলসের অলিগলিতে জীবিত। সে জীবিত সেইসব মানুষের কাছে যারা তাঁকে এই ধরণিতে গাট্টাগোট্টা শরীর দুলিয়ে ঘোড়ার বেগে মাঠে ছুটতে দেখেছেন। জোসেফ ক্যাম্পবেলের কথার সারার্থকে সত্য প্রমাণ করতে সে জীবিত। মিথ শেষ হয় না, যতক্ষণ মারাদোনার মতো চরিত্ররা ধরণিতে জটলা পাকায়।

নেসেসারি লিঙ্কস :
১. ম্যারাডোনার শহর ন্যাপোলি : শেহওয়ার ও মারিয়া
২. Opus – Live Is Life – Maradona 1989 
৩. Remembering Bebeto’s iconic celebration | 1994 FIFA World Cup
৪. A Tribute to Emiliano Martínez – Sia Unstoppable 


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
গানপারে মারাদোনা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you