কবিকে বিদায় জানিয়ে এসেছি। এসেছিলেন শহরের কবি, সংস্কৃতিকর্মী, আত্মীয়, প্রতিবেশী, সহচর, ধীমান সুধীজন। জানাজার পরে পৌরগোরস্থানের খেজুরগাছের নিচে কবি ঘুমাতে গেলেন। একটি খেজুরগাছের নিচে পাশাপাশি দুই বন্ধুর কবর। কবি হাসান কামরুল এবং কবি মাসুম পারভেজ। শেষের কবি বিদায় নিলেন সদ্য।
ছয় মাস ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস করছিলেন। আজকে সকালে চিরনিদ্রায় গেলেন। শহরের ’৮১ ব্যাচের বন্ধুরা এসেছিলেন। নেত্রকোণা প্রত্যাশা সাহিত্য গোষ্ঠীর তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সেই আশির শেষাংশ থেকে শুরু করে পুরো নব্বই দশকে প্রত্যাশা সাহিত্য গোষ্ঠী নেত্রকোনার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। কী দেয়ালপত্রিকা, কী ভাঁজপত্র, কী ছোটকাগজ, কী অনুষ্ঠান নির্মাণ—সবকিছুরই অগ্রভাগে ছিল মাসুম পারভেজের নির্মাণ ও নির্দেশনা। সে-সময়ের লেখকেরা শৈল্পিক হাতের লেখায়ও কয়েক কপি করে কাগজ বের করতেন। মাসুমভাইয়ের হাতের লেখা ছিল দুর্দান্ত। তাঁর নেতৃত্বেই এসব কর্মযজ্ঞ হতো। ছিলেন কলেজ সংসদের নির্বাচিত সাহিত্য-ও-সাংস্কৃতিক সম্পাদক। সবকিছু ছাপিয়ে ব্যক্তিত্বের সর্বাংশে ছিল উদার, সহিষ্ণু, নান্দনিক কবিরূপ।
প্রকৃত কবিরা খুব সরল হন। মাসুমভাই এমনটাই ছিলেন। ঈর্ষা-প্রতিষ্ঠার আশেপাশেই ছিলেন না। চাওয়া-পাওয়া একেবারেই ছিল না। বিখ্যাত-হতে-হবে এই বাসনা মোটেও ছিল না। লিখেছেন অনেক। কিন্তু কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেননি। কেন করেননি? জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, করব। মনে হয় পাণ্ডুলিপি গুছিয়েও ছিলেন। কিন্তু আর করা হলো না। নিজের কবিতার বই আর নিজহাতে করবেন না তিনি। কাব্যগ্রন্থ হয়তো বের হবে। কোনো সুধীজন হয়তো বের করবেন। সেই বই তিনি আর দেখবেন না।
নেত্রকোনার প্রায় সব কবির সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল। অন্তরতম আত্মীয়তা ছিল। মগরাকে রেখে ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন। ঢাকাতেই ছিলেন। ছাপাছাপির ব্যবসা করতেন। নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজের অনেক কাজ তিনি করে দিয়েছেন। কার্ড ছাপাতে হবে, সুভিনিয়র-ম্যাগাজিন ছাপাতে হবে—সবাই চোখ বন্ধ করে মাসুমভাইকে ফোন করেছে। মাসুমভাই নিজের কাজ মনে করে সেসব করে দিয়েছেন।
উদার ছিলেন খুব। শিশুর মতো হাসতেন। শীতঋতু এবং হিমেল প্রকৃতি কবিকে কিছুটা আচ্ছন্ন করত। এছাড়া হাওরের মুক্ত মাঠের মতো তিনি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিলেন। বড় থেকে ছোট সবার সান্নিধ্যে ছিলেন। তার ছোটবোন চুমকি আমার সতীর্থ। কিন্তু সেই সূত্রে কবির সাথে আমার আত্মীয়তা হয়নি। তাদের বাসার সামনে আকমলডাক্তারের পুকুরে গোসল করতে করতে আমি কবিকে চিনেছি। সেই চেনা দীর্ঘ থেকে অন্তরতর হয়েছে। এখন শুধু স্মৃতিটুকু আছে।
যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে মানুষ আর স্মৃতিকে ধরে রাখতে চাইছে না। অথচ আমার কাছে স্মৃতি হচ্ছে গ্রামনিশানার তালগাছ। অথচ আমার কাছে স্মৃতি হচ্ছে দূরের সে-পথ যেখানে আমি পৌঁছাব। স্মৃতি হচ্ছে জন্ম থেকে মৃত্যুর সীমান্তরেখা। আমিও তাই স্মৃতিকে দুই চোখে, বুকের হিমেল ফ্রিজে ভরে রাখি।
জীবিতের কাছে মৃত মানুষও স্মৃতি। মৃতেরা অলীক জগতে থাকেন। মৃতেরা জীবিতকে না-রাখলেও, জীবিতেরা মৃতকে ধরে রাখে। জীবিতরাই স্মৃতিকে বহন করে কিংবা যারা স্মৃতিকে বহন করে তারাই জীবিত। আজকের সরল সকালে কবি পরলোকে গেছেন। কবি আব্দুর রাজ্জাকের ফেসবুকস্ট্যাটাসে এই সংবাদ দেখে স্তব্ধ হয়েছি। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে রাজ্জাককেই জিজ্ঞাসা করেছি, কখন কীভাবে গেলেন।
খুব সাদামাটা ছিলেন কবি মাসুম পারভেজ। বিদায়টাও খুব সাদামাটা হলো। কবিকে বিদায় দিতে এসে মনে হলো, এর চেয়ে নীরব-সুন্দর প্রস্থান আর হতে পারে না। কবির বোনেরা খুব কাঁদছিলেন। প্রত্যাশার সহচরেরা গোরস্থানের খেজুরগাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। রেললাইনের পাশে কলোনির থেকে সাউন্ড আসছিল গানের। কবরটাকে খুব সুন্দর লাগছিল। মনে হচ্ছিল কবির কবর সুন্দর না-হয়ে পারে না।
কাব্যগ্রন্থহীন কবির এই বিদায়যাত্রায় পাঠ করি তাঁর চার কবিতার সমাহারে একটি নিটোল অখণ্ড নৈরব্য। — স. মো. / ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
স্বরচিত কবিতা চতুষ্টয় || মাসুম পারভেজ
দ্রষ্টব্য
আকাশকে শুধালাম, প্রেম কি?
বলল : রামধনু রঙ, মেঘের মেলা
কদমফোটা শ্রাবণ
রাতনিবিড়ে তিমির তারা
জ্যোৎস্নাপ্লাবন।
বয়সী বৃক্ষকে বিনীত প্রশ্ন করলাম
বলল : পাতার পরশ, পাখিদের আলিঙ্গন
সারাক্ষণ সমীরণ শিহরণ।
জমিনের কাছে জানতে চাইলে
বলল : মানুষের পদচিহ্ন, ঘাসের জায়নামাজ
লাঙলের ফলায় আঁকা কৃষকের কারুকাজ।
আমার এত আর্তি কেন?
তারে না-পাওয়ার হাহাকার—
বালকবেলার প্রিয় পাঠ বলে দেয়
পৃথিবীতে কে কার?
.
আমি কেউ না
আমি তো কেউ না
জানি না আমি কে
সারাক্ষণ খুঁজিয়া বেড়াই
আমি আমাকে।
জানি না কোন দিকে
কোন দিগন্তে আমার ঠিকানা
আমার কাছে আমি খুব অচেনা।
জলের ঢেউ সেও তো খেলা করে
মাছ ও জলপোকা সাথে
আমি তো জলের মানুষ জ্বলি
দিনে ও রাতে।
.
তাবিজ
আশাবাদী বালক আমি
কথার পেখম আঁকি
ময়ূর মনে রঙধনু হয়ে
হৃদনিবিড়ে তারে যতনে রাখি।
না, ক্ষরণ নাই স্মরণে অবিরল
রাঙা ভোর সে আমার
নিটোল নির্মল।
গোধূলির আবির সে
কোহিনুর ম্লান
প্রতিক্ষণ প্রতিপল শোণিতে বহমান।
যুগল জীবন যেন অটুট থাকে
বাহুতে বেঁধেছি সোনালি তাবিজ
বিরহ-বেদনাও যেন সইতে পারি
যেমন, কষ্টের দরিয়া—
হেলাল হাফিজ।
.
মৃত্যুমুখর
মরণের পাশাপাশি বসবাস করে সকল মানুষ।
আগামীর সড়কে পা ফেলে ফেলে
মৃত্যুকে ভালোবেসে অতি সন্তর্পণে
এগিয়ে যায় সে-পথে
প্রতিটি মানুষ।
সে অনেকদিন আগের কথা—
প্রতিদিন পায়ে পায়ে পথ হেঁটে
তোমার পথের সাথি হলাম।
হলদে নরম রোদও হলো আমাদের সাথি।
স্বপ্নীল কবিতার পৃথিবীতে
আমি নতুন; অঙ্কুর।
তুমি ছায়া দিলে, সিঞ্চন করলে জল
বড় মমতা আর সোহাগে
জীবন দিলে তুমি, আমি সবুজাভ হলাম।
এখন আমার চৌপাশ ঘিরে কেবলই দহন
ফুলে ফুলে সুন্দর না-হতেই
আমাকে ছেড়ে ভালোবাসলে তুমি
ভালোবাসলে থৈহীন রাত নিঠুর মরণ।
কাঁদে নদী, জল, ঢেউ; সব সুন্দর
পত্র, পল্লব, ঘাস ও শিকড়
প্রার্থনায় প্রোথিত ধ্যান ভাঙে ঋষির
দেবতা যেন আজ মৃত্যুমুখর।
কবি মাসুম পারভেজ শোকস্তম্ভ ও কবির স্বরচিত কবিতা
কবিতাবাছাই ও মুখবন্ধ : সরোজ মোস্তফা
গানপার ২০২৫
* কবিবন্ধুদের সঙ্গে স্মৃতির অ্যালবামে কবি মাসুম পারভেজ; ছবিসৌজন্য : সরোজ মোস্তফা
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
COMMENTS