কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ৭ (শেষ অংশ) || জয়দেব কর

কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ৭ (শেষ অংশ) || জয়দেব কর

শেয়ার করুন:


শিল্প হিশেবে কবিতার স্থান কোথায়, শিল্পবোদ্ধা-কবিতাবোদ্ধাদের নিকট মোটেই অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। কবিতা আদিশিল্প; দেশে-দেশে ভাষায়-ভাষায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের কৌমার্য ধারণ করে আছে এবং তার ভবিষ্যতও স্বমহিমায় উজ্জ্বলতর থাকবে। কবির একান্ত গভীর বোধের শিল্পীত শব্দমালার আত্মপ্রকাশই কবিতা। বহির্জগৎ আর অন্তর্জগতের বৈপরীত্য-সাযুজ্য ছেনে ছেঁকে আপনার মাধুর্য ছড়াতে কবিতার জুড়ি নেই। এ দুই জগতের মধ্যিখানের দরজায় কবি এক উন্নিদ্র পাহারাদার, এবং তার বিচরণ উভয়দিকে। আর তার আপনার অন্তর্লোকে তার ছাড়পত্র ছাড়া তাই প্রবেশাধিকার নেই বাহ্যিকতার। কবি-অস্তিত্বে জগৎসংসারের উপাদানগুলো প্রস্তুত হয়—উপাদানগুলোর প্রস্তুতিপর্ব কবির অভিজ্ঞতার দৃপ্ত অঞ্চল। ব্যঞ্জন রাঁধার পূর্বে শব্জি, তেল, নুন, জল প্রভৃতির ভিন্ন স্বাদ এবং রাঁধার পর সবগুলো মিলে অভিন্ন স্বাদ। শব্দের ভূমিকাও কবিতা নির্মাণে তাই। কবিতা-নির্মাণ-বোধ একটা শব্দ-বাক্যের পাকশালা। এ বিস্ময়কর পাকশালা সবার মস্তিষ্কে নেই বলেই কেউ কেউ কবি।


অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই ব্যক্তির বিকাশ সাধিত হয় বলে যদি ধরে নিই তবে সেই বিকাশ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্নতাই মানুষের স্বতন্ত্র মনোদৈহিক সত্তার পরিচায়ক। একজন কবির বিকাশ বোধকরি শুধুই যাপনকারীর বিকাশসাধন নয় বরং দ্বন্দ্বে নিবিষ্ট চিত্তের জন্য অটল ঋজুপথ হতে সৃষ্টির আনন্দযাপনের লক্ষ্যও বটে। গভীর আত্মভ্রমণ তাঁকে পারিপার্শ্বিক অনুষঙ্গসমূহ দেখার একধরনের বিশেষ দৃষ্টিশক্তির অধিকারী হওয়ার গৌরব প্রদান করে। আর তার এই ভ্রমণের বিশেষ যানটির নাম হলো কল্পনাপ্রতিভা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জ্ঞান আর কল্পনার মিশ্রণে প্রজ্ঞার আধারে জন্ম হয় কবিতার ভ্রূণের। তারপর ধীরে ধীরে লৌকিক শব্দশরীরের পূর্ণবিকাশের লোকোত্তর সত্তা নিয়ে নির্মিত হন কবিতাসুন্দরী।


ভেতর আর বাইরের সঙ্গমে আত্মপরিক্রমার এক বিস্ময়কর পথ জেগে উঠছে—অনুকূল ও প্রতিকূলের নিরন্তর দ্বন্দ্বে। একটা তুমুল দর্শকজীবন পার করে দিতে হচ্ছে একার সুখ-দুঃখ-উপেক্ষায়। তবুও ক্ষয়ের বিস্তারে বেড়ে ওঠা লোকোত্তর দৃষ্টির গর্ভ থেকে শব্দকুসুমের বিকাশ ভালোবাসি, চাই তার অবাধ ঝরনাধারা।

মাতাল ছিলাম, মাতাল আছি, মাতাল থাকব। কবিতাই অনন্য আশ্রয়। আমার মাতৃহৃদয়, আমার প্রেম, আমার সমাজ, আমার বিমুক্তিপুরের নাম কবিতা। তার ভেলা চড়ে, যতটা বিপর্যয় ঠেলে, যতখানি সৌন্দর্য ধরি মুঠোতে, মনে রেখো, ততখানি শিশু জেগে আছি মহাকালের মাতৃক্রোড়ে।

পাঠক! তোমরা আমার আত্মার বন্ধু, যে-আত্মা গড়ে শব্দের সেতু, এপার-ওপার, মিলন এবং মিলন!


ঈশ্বরকে ভালোবাসা ঐচ্ছিক। নিজেকে ভালোবাসা আবশ্যিক। সকল সত্তাকে ভালোবাসা সাধনা।


ঘৃণা ও হিংসারোগে আক্রান্ত দুনিয়া। অস্ত্রের কারখানা বাড়বে বৈ কমবে না। ধর্ম-জাতীয়তা-বর্ণবাদ, কত নামে যে তার বাজার! এ বাজার যারা টিকিয়ে রাখছে তারা কখনওই শান্তি চায় না, চায় শুধু শক্তি। এই শক্তিপূজার ফল একদিন হয়তো গোটা গ্রহটিকে ধূলিস্যাৎ করে দেবে!


ধর্মের সৈনিক সেবা চায়, মানবতার সৈনিক সেবা করে।


মানুষ তো একা মানুষ হয়ে ওঠে না। সেখানে যেমন তার নিজের দায় থাকে, তেমন দায় কিন্তু থাকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। ব্যক্তি বনাম এই সকল প্রতিষ্ঠানের সংযোগ তো শিক্ষা ছাড়া সম্ভব না। আর যেখানে শিক্ষা বিষয়টিই নিহত সেখানে উচ্চ শিক্ষা বা সাধারণ শিক্ষা সে তো শব্দের ব্যায়াম ছাড়া কিছু নয়।


আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ সমাজকে বিনির্মাণ করা। সমাজে প্রচলিত প্রগতিবিরুদ্ধ সকল কর্মকাণ্ডের বিলুপ্তির লক্ষ্যে কাজ করা ও এমন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা, যে-সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার জীবনপদ্ধতি গ্রহণ করবে। সনাতন সমাজব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা নিতে গেলে রাষ্ট্র যেই লাউ সেই কদু হয়ে রয়। হয়েছেও তা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও তা নিশ্চিত করতে আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের সমন্বিত জোরালো কোনও প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। সনাতন পদ্ধতির ক্ষমতা ও ভোগের পথ তারা ছাড়তে চান না। তাই  মতাদর্শ ও জীবনপদ্ধতির ভিন্নতার জন্য হত্যা-লাঞ্ছনা এক স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ বিচারালয়ের বিচারক যখন পোশাক পরার স্বাধীনতাকে “কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার” দিয়ে খারিজ করতে চান, তখন আসলে বুঝতে আর বাকি থাকে না, সংবিধানের সাথে সাংবিধানিক পদধারীদের সম্পর্ক যে কীভাবে জোড়াতালি দিয়ে টিকে আছে!


চাটুকারিতা-স্তাবকতায় মগ্ন মানুষগুলোর জন্য অনেক সময় মায়া হয়। সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়নের সোজা রাস্তা ছেড়ে পথভ্রষ্ট হয়ে ভুল পথে হাঁটতে বাধ্য হয় কী করে তা টেরই পায় না। মোহাচ্ছন্ন মনে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। যেখানে যে দক্ষতা-যোগ্যতা নেই সেখানেও নাক গলায়, অনধিকারচর্চায় রত হয় নিজের আত্মিক টানাপোড়েন ঢাকতে। মিষ্টভাষী স্তাবকদের বিষাক্ত হাওয়ায় পড়ে দূরে ঠেলে দেয় পরম নির্ভরযোগ্য বন্ধুটিকেও। দিনশেষে ওরা বড় একা হয়ে পড়ে। মুখোশ ছাড়া আর কোনও বন্ধু থাকে না ওদের।


অতি কিছুই ভালো নয়। অতি উত্তেজনায় বাপকেও শালা ডেকে ফেলতে পারেন! বাপ যে শালা তা বোঝাতে অতি ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারেন!


কর্মচারী নিযুক্ত করে সাংস্কৃতিক, মানবিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন সম্ভব নয়। কর্মী চেনা, মূল্যায়ন করতে জানা মালিক-শ্রমিক সম্পর্কচর্চা দিয়ে সম্ভব নয়। চেতনার জাগরণ, সম্মিলন ও সৃজনের নেতৃত্ব দিতে হলে তো মানুষকে মানুষ হিসেবে বুঝতে পারার মতো প্রাথমিক সক্ষমতা থাকা চাই!


পবিত্রতা জিনিসটা কী? লালনস্মরণে সাধুসঙ্গ কী করে অপবিত্র হয়? বাউলের কাজ আমলার করা মানে ড্রাইভার বাদ দিয়ে হেল্পার দিয়ে গাড়ি চালানোর মতো কোনও একটা বিষয় । লালন না গোটা বাঙালি সংস্কৃতিই এখন খাদে-পড়া গাড়ির মতো। হায় স্বাধীনতাযুদ্ধ! হায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ!  হায় ধর্মনিরপেক্ষতা!  এক নিদারুণ প্রহসন মাত্র!


ভোগ আর উপভোগের প্রভেদ বুঝতে না দিয়ে প্রেমের বিরোধিতা করা ভোগবাদী প্রথা তোমাকে আটকে রাখতে চাইবেই, আর তুমি? বন্দী থাকতে চাও? বন্দী করতে চাও? যদি মুক্তির সহজ রাস্তার সন্ধানে থাকো তবে তোমাকে প্রেমেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। প্রেমেই বিপ্লব বা মুক্তির মোক্ষ নিহিত। নিজেকে সচেতনে ভালোবাসো, আমিকে আমরাতে রূপান্তর করার জাদুশক্তি নিশ্চয় নিজের মধ্যে খুঁজে পাবে।


কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম পর্বগুলো
জয়দেব কর রচনারাশি
গানপার সদুক্তিনিচয়

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you