লীলাচূর্ণ, স্ফটিকচূড়ার নিচে || আহমদ মিনহাজ

লীলাচূর্ণ, স্ফটিকচূড়ার নিচে || আহমদ মিনহাজ

স্মৃতিকাতর শব্দপুঞ্জের বাহারে কার্যত নিরুদ্দেশকে ফিরিয়ে আনার চল আল মাহমুদের কাবিননামার প্রেরণা দিয়ে রাঙানো হলেও ভাষিক বিবরণ নব্বইয়ের ধাঁচে গড়া। এই ধারায় স্থিত নব্বই প্রকারান্তরে পাঠককে ফেরত নিতে চায় আবহমান বৃত্তে, যেটি পালাবদলের তুঙ্গ স্রোতে তামাদি হতে বসেছে! অতিকল্পনার বিশ্বে নিমজ্জিত নব্বইয়ের পরাভাষায় জোসেফ ক্যাম্পবেলের মিথ বিষয়ক সজ্ঞার সারার্থ অবশ্য কদাচিৎ মিলে। ক্যাম্পবেল শিখিয়েছিলেন মিথকে কী করে পাঠ করতে হয়। অতিকল্পনা কেবল প্রাচীন ইতিহাসের অন্তর্গত নয় বরং সকল যুগ ও দেশকালে প্রবহমান ঘটনাস্রোত তাকে জন্ম দিয়ে যায়। পরিপার্শ্বে প্রতিনিয়ত সক্রিয় চিহ্নসূত্রে মিথের উপাদান সংগুপ্ত থাকে। বাস্তবতার রূঢ় পরিধি সীমায় কাফকার পোকারা যখন-তখন জন্ম নিতে পারে। সিনেপর্দায় র‌্যাম্বোর মতো ক্যারেক্টারগুলো জীবনের চেয়ে বৃহৎ কাণ্ডকীর্তির জোরে একালে মিথের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। সৃষ্টিরহস্যের কিনারা পেতে গলদঘর্ম বিজ্ঞানীর হাইপোথিসিস মিথের জন্ম দেয়। তথ্যপ্রযুক্তির বিচিত্র গতিধারায় সৃষ্ট আজকের রোবট, সাইবর্গ আর হাস্যকর চ্যাটবুটগুলোয় নিহিত ফ্যান্টাসি মিথের আভাসে মহার্ঘ হয়ে ওঠে। কল্পবিজ্ঞানের জগতে মানব ও অ্যালিয়েনের মিলন-সংঘাত মিথের মুহূর্ত তৈরি করায়। অনুজীববিজ্ঞান ও জিনপ্রকৌশলের কারিকুরি জীবাশ্মে পরিণত প্রাণকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার ঘোষণা দিলে দুঃস্বপ্নের মুহূর্তে আকাশে-পাক-খাওয়া ড্রোনকে টেরোডাকটাইলের পিচ্চি সংস্করণ ভেবে কেউ যদি আতংকে চিৎকার দিয়ে ওঠে…মিথ তাৎক্ষণিক জন্ম নেয় সেখানে। ফসলের মাঠে কৃষ্টিদোগলা সবুজের অফুরন্ত সমারোহ এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গুলজার শপিংমল, ক্যাফে কিংবা রেস্তোরাঁয় সুবেশ নারী-পুরুষের হল্লা যেসব কুহকি ঘোর তৈরি করায় অতিকল্পনা সেখানে চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকে। বিগত তিন দশকের বিশ্বে এরকম অজস্র অনুষঙ্গের মিথষ্ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট অতিকল্পনার সঙ্গে বিগত দিনের অতিকল্পনা, ঐতিহ্য ও আবহমানতার সংযোগ বা বৈপরীত্যকে ভাষা দানের কাণ্ড কি নব্বইয়ের কবিতায় সফলভাবে ঘটেছে? প্রশ্নটি তোলা রইল সদুত্তর পাওয়ার আশায়।

নব্বইয়ের এই মিথবহুল তরঙ্গে মজনু শাহ ও মোস্তাক আহমাদ দীনকে ভাসতে-ভাসতে ক্রমশ কিনারায় সরে যেতে দেখি। নব্বই ও পরবর্তী কালপর্বে সপাটে জারি থেকেও তাঁরা যেন দলছুট ফুলের উপমা! ‘লীলাচূর্ণ’ থেকে ‘মধু ও মশলার বনে’ এবং সেখান থেকে ‘জেব্রামাস্টার’ হয়ে ‘বাল্মীকির কুটির’-এ প্রবিষ্ট মজনু শাহর কবিতা স্থানিক অনুষঙ্গে নিজেকে জড়ালেও হারিয়ে-ফেলা জীবনরহস্যের চাবি ফিরে পাওয়ার মনোবাসনা কবিকে বাস্তবাতীত পরাবিশ্বে গমনে বাধ্য করে। ‘গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞাময় সংলাপের দিকে’ ‘স্বপ্নরিক্ত নটরাজনের মতো’ হেঁটে যাওয়া কবি অন্তে এসে স্থানিকতা-অতিরিক্ত দেশকালে নিজেকে বিচরণশীল টের পায় :—

বিদ্যুচ্চমকের মতো সত্যেরা কোথায় পালিয়েছে,
স্বপ্নের, জ্ঞানের, আদিতম বীজ রয়েছে কোথায়…
(লীলাচূর্ণ-৭)

দেখছ শম্বর আর কর্ণ পাশাপাশি ভাসমান
ওদিকে তখন ভিজে যায় মাঠে তোমার বাহন…
প্রেতলোক থেকে কেউ জুম করে দেখে সবকিছু,
কোন্ গান সমাপ্তির মতো ভাসে নয়ন তারায়।
(লীলাচূর্ণ-১০)

এই মহীমণ্ডল, তোমার দেহরূপ,
এক আদি ঘুম-চকলেট।
তোমাকে গিলে খায় যা-কিছু চিরন্তন।
তোমাকে অতিক্রম করে বিশাল কোনো দস্যু মেঘ।
তখন সবকিছু তিমির বলে মনে হয়,
শিউলিগন্ধ-মাখা মাটি ফিরে পাব আর!
পুঁতে চলেছ আতঙ্কের বীজ। তোমার স্বপ্নে ঢুকে
তবু ঘুঙুরে বেড়াবার কাল না ফুরায়,
না ফুরায় হিম, শিশির পতন।
(গহন)

কী চাও এখানে, পান্না-কোকিল?

এই বিধ্বংসী নীরবতায় ঘুম শুষে নিচ্ছে রাবার গাছেরা।
ঘুমোচ্ছে ব্যান্ডবাদকের ছোট বউ, জাগিও না তাকে। যে-জগৎ
গানের, বিপুল অন্তর্ধানের, সেইদিকে তাকিয়ে মাথা আর দুলিও না।
এইবার সভ্যতার সবখানে বসে থাকা প্রেত হও একটু বরং।
(পান্না-কোকিল)

নব্বইয়ের সূচনাদশক থেকে মজনু শাহর বাকবিভূতি পাঠককে আপনা থেকে টেনে নিয়ে যায়! জীবনবীক্ষণের প্রতি পরতে বিরাজিত অনুষঙ্গে তাঁর বিজড়ন এবং প্রকৃতি ও আবহমান বৃত্তে জেনসুলভ নিস্পৃহতায় প্রবেশ ইত্যাদি কারণে কবিতায় গুঞ্জরিত ভাষা স্থানিকতায় জড়ানো অনুভূতিকে স্থিতিস্থাপক তন্তুর মতো মহাকালের সীমানায় সম্প্রসারিত করে। জাগতিক পৃথিবীতে ভ্রামণিক হলেও অনুভূতির সূক্ষ্মতা সেখানে মায়াপৃথিবীর বিভ্রম জাগায়! রূপের খনি এ-জগৎ মজনু শাহর বয়নে অরূপের আবেশ জাগিয়ে তোলে আর ওদিকে কবিসত্তা সেই অরূপ সায়রে ক্ষণে-ক্ষণে ডুবে আর ভাসে। ‘আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়, জেব্রা যেখানে তার শাবকদের নিয়ে খেলা করে।’ (দ্রষ্টব্য : আমার ভাষা; জেব্রামাস্টার) — কাব্যভাষা সম্পর্কে কবির উক্তি বুঝিয়ে দেয় মজনু শাহ পরিপার্শ্বকে কেন্দ্র করে বিরচিত অস্তিত্বের অতলে ভ্রামণিক হতে ইচ্ছুক, যেখানে প্রাচীন ও অলৌকিক থেকে সমকালীন ও লৌকিক চিহ্নসূত্রে যাওয়া-আসার ক্ষণে তাঁর সত্তা সময়হীনতার বোধিবিশ্বেই তলায় :—

বজ্রনির্দেশিত পথ খুলে যাচ্ছে পাপড়ির মতো, নাকি এও কোনো তত্ত্ব অভিনয়!
ঈগলের বাসা খুঁজে, জহরের দানা খেয়ে এ গহন আমিত্ব ফুরায়।
(নভোসংকেত)

যে-কোনো সুদূরকে আজ অপরাহ্ন বলে মনে হয়। যে-কোনো প্রণয়, বল্মীকস্তূপের
প্রায়। অতি শাদা ফুলের রাত্রিসংলাপ ছুটে যায় কার পানে! মনে রেখ ঘাসেদের
বিপুল অভ্যর্থনা, পতঙ্গদের মৃত্যুনাচ। আমার সবুজ অক্ষরগুলো ধুলোয় ঘুমায়।
বাঁকা পথে যেতে যেতে কিছু শশীবাক্য আজ তোমায় শোনাতে হলো। আগামী
কোনো ঝড়ে হাতি, হিতোপদেশ সবই হয়ত একসঙ্গে উড়বে।
(অতি শাদা ফুলের রাত্রিসংলাপ)

… এক অনিশ্চিতের জগৎ অসীম ভ্রমে হেঁটে দেখা। কোনো দারুস্পর্শ মৃত্যু আমাকে সৃষ্টি করে চলে, নষ্ট জানালায় আছড়ে পড়া চাঁদ আজ আমার অপর।
(অপর)

কোনো তত্ত্বনির্ণয় করি নি। শুধু কোনো ক্লাউন যখন গুটিয়ে নেয় তার
পেখম, তার ইশারার ছন্দ, চাবুক, ঝুড়িভর্তি ডুমুর বয়ে নিতে থাকি।
তার অর্ধউচ্চারিত পঙ্ক্তিমালা আমারই, আমাতে বিলীন হতে দেই
তার মৃত্যুরঙিন অবয়ব।
(এই সুফি-রাস্তার ওপর)

কবিতার অর্থস্তরে বহমান সংকেত উদ্ধারে কবি মজনু শাহর ভাষার রূপময় চোরাটান এক বড়ো বাধা! নব্বইয়ের কালপর্বে জীবনের রং বিচিত্র ইহজাগতিক পণ্যের সমাহারে বর্ণিল হলেও ধাঁধা-চমকিত বিভ্রম আর আত্মিক শূন্যতার কারণে রোগাক্রান্তও বটে। কবির চেতনসত্তা এইসব রঙে নিজেকে রঙিন রাখে এবং উৎফুল্ল ভ্রমরের মতো সেখানে উড়তে চায়, অন্যদিকে অবেচেতন সত্তা থেকে উঠে আসা সন্তভাবনার প্রভাবে তাঁর সত্তা অচিহ্নিত সর্বনামে পরিণত হয়, যে কিনা উপসংহারে পৌঁছে চিরকালের অমায় হারায়। সময়ের বিবিধ ছিদ্রে গমন করলেও মজনু শাহর পঙক্তিমালা বিস্মরণের দেশে খেই হারানোর মাঝে স্বস্তি খুঁজে মরে! বিগত তিন দশকের মানববিশ্বে সক্রিয় বাস্তবতার ঘোলাটে গর্ভ থেকে এই পরাভাষার জন্ম হলেও বায়বীয় বাস্তবতায় তার নিষ্ক্রমণ সন্তসুলভ নিস্পৃহতা সহকারেই ঘটেছে। জাগতিক অস্তিত্ব মহাজাগতিক ফেনায় নির্বাপিত হওয়ার কারণে মানবসংসারে বিদ্যমান রূপ-রস-গন্ধ শোষণের পালা সাঙ্গ হলে সময়হীন মহাকালের কিনারায় কবিকে একা দাঁড়িয়ে পড়তে হয়;—মজনু শাহর বাকপ্রতিমায় বিচ্ছুরিত এই বার্তাটি জলতরঙ্গ হয়ে অবিরত বেজে চলে। তাঁর কবিতায় মিথ, ঐতিহ্য ও আবহমানের নবীকরণ তাই সতীর্থদের থেকে একেবারেই পৃথক। ভাষা ও অর্থস্তরে যত মর্ম সেখানে ফোটে সেগুলোর আত্তীকরণ অন্য কবির পক্ষে সত্যি কঠিন।

তুলনায় মোস্তাক আহমাদ দীনকে অনেকে নিজস্ব ছকে ধার করেছেন। মোস্তাকের প্রভাব তাঁর নিজ দশকের চেয়ে শূন্যের ওপর অধিক দৃষ্ট ছিল, যদিও উক্ত কবিবর্গ সে-প্রভাব কাটিয়ে নিজ চারিত্র্যে স্থিতু হওয়ার দৌড়ে অনেকখানি অগ্রসর হয়েছেন। ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’ মোস্তাককে তার দশকে স্বতন্ত্র মাত্রা প্রদান করেছিল। নব্বই ও পরবর্তী দুই দশকে স্বকীয়তার যেসব ইশারা ক্রমশ স্বচ্ছ আকার ধারণ করেছে তার পরিশ্রুত নির্মিতি ‘ভিখারিও রাজস্থানে যায়’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় ধরা পড়ে। মোস্তাক এই কবিতাপর্বে এসে অন্তর্গূঢ় জীবনবেদে শামিল হলেন, যাকে ছাড়া স্বকালের স্রোতে কবির জার্নি পরিপূর্ণতা লভে না। আপাত সর্বশেষ ‘স্ফটিকচূড়ার নিচে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় নব্বইয়ের সহজাত প্রকৃতিলগ্নতা ও স্মৃতিকাতর বিষাদে জিরান লাভের বাসনায় ফেরত গেলেও এর বয়নভঙ্গি মোস্তাককে তাঁর সতীর্থদের থেকে যথারীতি স্বতন্ত্রই রাখে :—

আজ একই পাত্রে যখন আমাদের
দুজনেরই পান করবার কথা ইঁদারার সবটুকু জল
তখনো বুঝতে পারছি না এই গহিন  রাজ্যে
জলই কি সত্য
না কি এই জলপানই শেষ সত্য হয়ে আছে …
(স্ফটিকচূড়ার নিচে-২)

দেখি একা বসে রয়েছে ইউসুফ, যার পায়ে নক্ষত্রপতন
(স্ফটিকচূড়ার নিচে-৪)

ভোরের আলোয় রাঙা ওই সহজ রাস্তার মুখে
আমি একা বসে বসে ভাবি,
হজরে আসওয়াদের চেয়েও কালো
ওই লম্বা ঘাড়ে কীভাবে চুম্বন করব আমি
আর কীভাবে পার হবো এই দীর্ঘ লাল মরুভূমি…
(স্ফটিকচূড়ার নিচে-৫)

মেঘে মেঘে চলে যাচ্ছে বেলা
চেরাপুঞ্জিতে তবু বৃষ্টি কিংবা কোনোকিছুই ঝরছে না।
(স্ফটিকচূড়ার নিচে-৬)

হুয়ারা গাছটি ধরে জারিদীর্ঘ বারোমাসি
গেয়ে ওঠে বাগানের প্রহরী ও মালী
যেন সারাটি বছরজুড়ে
খরাদাহ-স্মৃতি নিয়ে রয়ে যাবে এই গ্রীষ্মকাল।
(গ্রীষ্ম)

মজনু শাহ ও মোস্তাক আহমাদ দীনের সংবেদি ভাষাবয়ানে স্বকীয়তা থাকলেও এ-কথা স্মরণ রাখা চাই অর্থস্তর নির্মাণের যেসব প্রবণতা বাংলাদেশে নব্বইয়ের কবিতায় তরঙ্গ বহায় তাঁরা সে-প্রভাববলয়ে অবস্থান করেই স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। সামগ্রিকভাবে নব্বই যেসব চিহ্নসূত্র ধরে অগ্রসর হয় ও ক্রমশ নিজের স্থিতি বুঝে নেয় সেটি সময়ের অবদান। গত তিন দশকের সময়বৃত্তে প্রকটিত লক্ষণ নব্বইয়ের কবিদলকে নিকট বা সুদূর অতীতে ফেরত নিয়ে যায়, আবার বর্তমানে ফিরে আসতে বাধ্য করে। তাঁরা একসঙ্গে দুটি ভাষাবিশ্ব যাপন করেন। একটি বিশ্বে ভাষা সভ্যতার ধারাবাহিক বিবর্তনে সৃষ্ট অভ্যাস এবং মানুষ এই অভ্যাসকে যাপন করতে বাধ্য। অন্য বিশ্বে ভাষা পুরাতত্ত্বে পরিণত স্মৃতির অবশেষরূপে কবিহৃদয়ে ঢেউ তোলে। উভয়ের সন্ধি ও বিচ্ছেদ নব্বইয়ের কবিতায় ভাষার উৎসকে অবারিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই।


রিলেটেড রচনারা
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
গানপারে মজনু শাহ
গানপারে মোস্তাক আহমাদ দীন
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: