ঝগড়ার আওয়াজ আসছে অদূরের গৃহগুচ্ছ থেকে। গৃহগুচ্ছ বলতেসি ইচ্ছে করে, সচেতনভাবে, একটি ইংরেজি ওয়ার্ড অ্যাভোয়েড করতে যেয়ে। শব্দটা আমরা প্রায়শ উচ্চারণ করি, ভাড়াবাড়িতে বসবাসরত মানুষদের ডুয়েলিং বোঝাতে, কলোনি।
কাজের সূত্রে বা ভিটাবাড়ি নাই এমন মানুষজন পরের জায়গা পরের জমিতে থাকেন, দিনগুজরান করেন, মাসচুক্তি ভাড়াতে; সেই মানুষগুলারে আমরা সাধারণত বলি কলোনির লোক। উপনিবেশের মানুষ!
আক্ষরিক অর্থে ব্যাপার হয়তো অতটা আপত্তিকর মনে হবে না। কারণ কলোনিতে যারা থাকেন তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এইটা আপাত নিবাস। তাদের শেকড় থাকে অন্যত্র, সচরাচর, দূর কোনো গ্রামদেশে বা শহরতলিতে। একটা-কোনো কর্মসূত্রে তারা আপাতবাস্তু কলোনিতে ডেরা বাঁধেন। অতএব এইটা তাদের উপনিবেশ, বটে, কেন্দ্রনিবেশ নয়। আপত্তিকর এই অভিব্যক্তির পেছনে বিরাজমান সচেতন ও অবচেতন একটা রাজনীতি।
মিঞা, ধুর, এইখানটায় আবার রাজনীতি আসে কোত্থেকে! বেশি বেশি বাড়ায়া ভাবা হয়ে গেল না! না, মোটেও নয়। কিছুই রাজনীতিনিরপেক্ষ নয়, ভায়া! কথাটায় একটু পরে আসছি, কিন্তু তার আগে কলোনি শব্দের ভ্রান্ত প্রয়োগ প্রমাণ করি।
নিজদেশে পরবাসী — কথাটা আমরা কাব্যিক অলঙ্কারের ন্যায় ব্যবহার করি নিতিকার কথালাপে, যেমন রাহমানের কবিতাবইয়ের নাম ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’, কিন্তু আইডিয়্যালি কী নিজভূমে ট্রেসপাসার হতে পারে কেউ! উপনিবেশকারী কী করে হয় একজন অথবা একদল লোক তার বা তাদের নিজেরই জন্মদেশে!
উপনিবেশ বা কলোনি স্থাপন করসিলো যারা, হিস্ট্রিতে যারা জগজ্জোড়া কলোনির পত্তনিকার, তাদের চরিত্র তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তাদের কর্মকাণ্ড আমরা নিশ্চয় পাশরিয়া যাই নাই। ইন দ্যাট সেন্স আলোচ্য ক্ষেত্রে কলোনি শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ মনোভঙ্গির প্রকাশ করে চলেছি আমরা। তা, যে-কোনো সালিশেই, আঞ্চলিক সংকীর্ণতা। আরেকদিক থেকে দেখলে, এইটা ঔপনিবেশিক মনোজগতের শাব্দিক প্রকাশ। কলোনিয়াল বিহেইভিয়্যর।
এবার আসা যাক রাজনীতির জায়গায়। আজকাল লক্ষ করা যাবে, শহরে বিশেষ করে, নানাবিত্তীয় ধনাঢ্য লোকেদের ভাড়ায়-বসবাসের আকাশচুম্বী ইমারতগুলোকে কলোনি বলা হয় না। ওগুলোকে বলি আমরা ফ্ল্যাটবাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টহাউস। লক্ষণীয়, বলি না কেউ ‘কলোনিতে ফিরতেসি’, বলি ‘ফ্ল্যাটে ফিরতেসি, তুই চলে আয় আমার এখানে, আড্ডা মারা যাবে’। কলোনি বলা হয় অল্প-উপার্জনের লোকজন যেই জায়গাটায় মাসোহারা ভাড়া চুকিয়ে বসবাস করে, সেই আবাসন ব্যবস্থা ও স্থলটিকে। যেমন বলা হয়, ‘ওই একটা কলোনিতে থাকে ওরা, অবস্থা বেশি ভালো না ওদের’; বলে, ‘ওইসব কলোনির পোলাপানদের সঙ্গে মিশে উচ্ছন্নে যাচ্ছে ছেলেটা’। মানে এইসব বাসস্থানের/কলোনির লোকজন স্বাগত-সম্ভাষিত নয় সমাজের কাছে। এবং বিশেষ একটা শ্রেণির কাছে তারা অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ, অনাহূত অনুপ্রবেশকারী হিশেবে বিবেচিত।
ফ্ল্যাটবাড়ি আর কলোনির ওই বিভাজন একেবারে সাম্প্রতিক গড়ে-ওঠা সামাজিক অসমতা আর বিদঘুটে বৈষম্যের উদাহরণ। এটি আগে ঠিক এই ভল্যুমে এবং এই ফর্মে ছিল না। আগে বড়জোর স্থানীয় লোকজন ওইরকম জনস্থানে সাময়িক বসবাসকারী অন্যস্থানের লোকজনের আবাসস্থলকে কলোনি বলত। এখন অঞ্চলভিত্তিক আইডেন্টিফিকেশনের দিক থেকে লোক্যাল তথা স্থানীয় লোকগোষ্ঠী সব জায়গাতেই কমে আসছে। ঠাঁইনাড়া হচ্ছে লোকজন জীবিকাতাগিদ ও জীবনরক্ষার প্রয়োজনে। স্রেফ টিকিয়া থাকার জন্য স্থানচ্যুত হতে হচ্ছে মানুষকে। স্টেইট বা রাষ্ট্র মদত যোগাইতেসে স্থানচ্যুতকরণে। পিতৃভিটে বেচেবুচে অভিবাসিত হচ্ছে লোকে স্বদেশেরই ভিতরে। এইটা খারাপও নয়, বরং ভালো, সমাজের চলার লক্ষণ, চলিষ্ণু সমাজের নমুনা। যদিও বিত্তের ভিত্তিতে এইভাবে বিভাজিতকরণ, সমাজের সবচেয়ে বড় অংশটাকে এইভাবে প্রান্তিকায়িত করে রাখা, সমাজেরই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এইটা হচ্ছে, এইধারা প্রান্তিকায়ন, হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় অংশটাকেই বানিয়ে ফেলা হয়েছে বহিরাগত, অনাকাঙ্ক্ষিত, আউটসাইডার।
মোট কথা, সারসংক্ষেপ এ-ই যে, ভাষা ব্যাপারটা তাৎপর্যবহ। ভাষা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ, কোনোকিছু ছড়াতে, কোনোকিছু রুখতে। ভাষা দিয়াই সভ্যতা, ভাষায় শোষণ, ভাষাযোগে ফ্যাসিবাদের শাসন-সমর্থন।
জাহেদ আহমদ ২০১৩
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS