প্রায় দুই যুগ আগে লোকগান সংগ্রহ করতে গিয়ে সাধককবি মনির উদ্দিন নূরী ওরফে মনির নূরীর সঙ্গে আমার পরিচয়; সুনামগঞ্জের ছাতকের একটি গ্রামে, আমার বন্ধু মাহবুবুর রহমান লায়েকের মাধ্যমে। আমি তখন সিলেট অঞ্চলের বয়োবৃদ্ধ নারীদের মুখ থেকে সিলেটি বিয়ের গীত সংগ্রহ করছিলাম। লায়েক কবিকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং কবি আমাকে নিজের লেখা কিছু গান শোনান। আমি তাঁর গানের ভাব আর সুরে এতটাই মুগ্ধ হই যে পরে যখনই ছাতকে যেতাম কবির সান্নিধ্য নিতাম; তাঁর গান শুনতাম, কথা বলতাম। এভাবে কবির সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কয়েক বছর বাদে আমি কবিকে জনসমক্ষে তুলে ধরি পত্রিকার পাতায় একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। কয়েক দিনের আলাপচারিতায় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম আমি টেপ-রেকর্ডারে। শ্রুতি লিখনে পরে আমাকে সাহায্য করেন লায়েক। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলে এলাকায় এবং এলাকার বাইরে তাঁর কবি-পরিচিতি খানিক বাড়ে। যদিও তখন পর্যন্ত নিজেকে আড়াল করে রাখতেন তিনি। তারপর আমি তাঁর গানের একটি সংকলন করতে মনস্থ করি। কবির হাতে লেখা কয়েকটি পুরোনো খাতা নিয়ে আসি, সেটাও এক যুগ আগে। তারপর পর আমার ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে তা আর বই আকারে প্রকাশ হয়ে ওঠে না। এর মধ্যে আমার সিলেটের বিয়ের গীত (২০১৩) প্রকাশিত হয় এবং আমি ঘাটুগান সংগ্রহের কাজে মনোযোগী হই কয়েক বছর। এক্ষেত্রে আমি কবির সাহায্যও পাই এবং ঘাটুগান সংক্রান্ত দীর্ঘ একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি তাঁর। ২০২২ সালে প্রকাশিত ঘাটুগান ঘাটু সংস্কৃতি বইয়ে সাক্ষাৎকারটি পরিশিষ্ট আকারে স্থান দিই। অন্যদিকে কবির কোনো বই এর মধ্যে প্রকাশিত হয়নি বলেও জানতে পারি। সেদিন হঠাৎ তাঁর একটি গান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে এলে ছায়ালিপি করা খাতাগুলো থেকে ১৭২টি গান বাছাই করে টাইপ করতে দিই। মনির নূরীর গানের একাধিক খাতা থেকে সংকলিত ও সম্পাদিত গান নিয়ে বই ভাবতরঙ্গ বইটি প্রকাশ করতে দিই প্রকাশনা সংস্থা নাগরীকে। কবি পরে নিশ্চয়ই আরও অনেক গান লিখেছেন, আরও গানের খাতা তাঁর আছে এমন ধারণা স্বাভাবিক। তবে ভাবতরঙ্গ কবির অর্বাচীন কালের গানে সংকলন নয়, সেটা একযুগ আগের খাতার বিভিন্ন সময়ে লিখিত গানের সংকলন। তাহলেও এখানে মনির নূরীর জীবনচিন্তা ও জীবনসাধনার পুরো পরিচয় ধরা পড়ে।
সুনামগঞ্জ অঞ্চলে লোকসংগীত সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল গোটা সুনামগঞ্জের মধ্যে ছাতক অঞ্চলটি লোকগানের সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র। এই অঞ্চলে গত কয়েকশ বছর ধরে অসংখ্য লোককবির জন্ম হয়েছে। দুর্বিন শাহ, আফজল শাহ, সৈয়দ শাহনূর, আসদ উল্লাহ, আমির উদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন আহমদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কবি ও সাধক এখানকার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর একটি প্রভাব গোটা অঞ্চলে জনমানসে রয়েছে; এখানকার সাধারণ নারী-পুরুষদের মনেও মরমি ভাব ও গানের প্রতি অনুরাগ বিস্ময়কর। তাই এমন জায়গায় জন্মগ্রহণকারী মনির নূরীর জীবনে মরমি-সাধনা ও গান যে আরাধ্য হয়ে উঠবে তা স্বাভাবিক। তাঁর জন্ম ১৯৫২ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক থানার শিবনগর গ্রামে। ঘাটুগান ও খেয়াল গানের মাধ্যমে ছেলেবেলায় গানের তালিম হলেও পরবর্তীকালে ভক্ত-সাধকের জীবনে তিনি নিজেকে জড়িয়ে নেন। বাউলপন্থী হয়েও তিনি হয়ে ওঠেন একজন সুফিবাদী ভাবুক ও মরমি কবি। ব্যক্তিগত জীবনে খুব দরিদ্র ও নিরহংকার মনির নূরী নিজেকে সর্বদা গুটিয়ে রাখেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। যাপন করেন একটি নিরীহ ও সাদামাটা জীবন।
মরমি কবি আসদ উল্লাহকে গানের জগতে নিয়ে এসেছিলেন। আসদ উল্লাহ্র মৃত্যুর পরে তিনি আফজল শাহের মাজারে আশ্রয় নেন, আফজল শাহ অসাধারণ এক মরমি সাধক ও ভাবুক ছিলেন। গৃহী হওয়ার পরেও আফজল শাহের মাজার ছাড়েননি মনির, এটাই তাঁর ভাবজগতের মূল জায়গা হয়ে ওঠে। তরুণ বয়সে আফজল শাহের মাজারে কবির রিসালায়ে মারিফত পাঠের পর মনির নূরীর চিন্তার জগতে পরিবর্তন আসে। বইটি সুফিতত্ত্ব ও মারিফতি তরিকার ওপর রচিত। সৈয়দ শাহনূর ও শিতালং শাহও তাঁর চিন্তায় প্রভাব ফেলেন। ফলে তাঁর জীবনসাধনা ও গানরচনায় এঁদের ছায়া দেখা যায়।
সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেট অঞ্চলের লোকগানের যে-ঐতিহ্য তার সঙ্গে ছোটোবেলা থেকেই মনির নূরীর সম্পর্ক ছিল। ঘাটুগান, ধামাইল, বাউলগান, মারফতি, মুর্শিদি, কীর্তন সহ সুফিবাদী ঘরানার গানের ভাব, বাণী, উপাদান প্রভৃতি তাঁর মুখে ও অন্তরে বিদ্যমান থাকায় গান রচনা মনির নূরীর পক্ষে সহজ হয়। বিভিন্ন বাউল-সুফি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি বাজনা ও গাওয়া আয়ত্ত করেন। সে হিসেবে ভাবসাধনার সঙ্গে গান-রচনা ও গাওয়া তাঁর জীবনের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। নিজে বাবুর্চি জীবন যাপন করলেও অন্তরে বাইরে মনির নূরী একজন ভক্ত ও কবি। বিভিন্ন মাজার দর্শন ও কবিদের সংস্পর্শ তাঁকে ভাবসাধনায় নানাভাবে উজ্জীবিত করে। একদিকে মরমি কবি গিয়াসউদ্দিন আহমদ তাঁর আত্মীয় ও চাচাতো ভাই, অন্যদিকে দুর্বিন শাহ, কামাল উদ্দিন, সফর আলী পীর, শাহ আবদুল করিমের সান্নিধ্যও পেয়েছেন তিনি। রুহি ঠাকুর, রনেশ ঠাকুর, শফিকুন্নুর, অন্নদারঞ্জন দাসের মতো কবি ও শিল্পীদের সঙ্গে চলাফেরা ও উঠাবসা করেছেন একসময়।
কবি ও সাধক আসদ উল্লাহ শাহ মনির নূরীর পথপ্রদর্শক হলেও তাঁর মুরশিদ ছিলেন লিয়াকত আলী শাহ। যৌবনে তিনি লিয়াকত আলী শাহের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। এঁদের কাছেই তিনি তত্ত্বজ্ঞান পান, এবং জীবন ও জগৎ সম্পর্কে স্বতন্ত্র দৃষ্টি লাভ করেন। কিন্তু গানের মাধ্যমে তত্ত্বজ্ঞানের প্রকাশ করতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম কিংবা কারি আমির উদ্দিনের মতো তিনিও বাধার সম্মুখীন হন। মনির নূরীকে গ্রামবাসী একসময় একঘরে করে ফেলে। এতে তিনি খুব দুঃখ পান, কিন্তু গান ছাড়েন না। তিনি মনে করতেন গান আত্মশুদ্ধির একটা মাধ্যম, এতে খারাপের কিছু নেই। গানে ধর্ম ও জীবনের তত্ত্ব রয়েছে, তাই গান মানুষের জীবনে দরকারি জিনিস। গানের তত্ত্বের ভিতর দিয়ে মনির নূরী যেভাবে নিজ ও দেহকে জানেন, তেমনই জানেন স্রষ্টাকেও।

মনির নূরী বিভিন্ন ধরনের গান যেমন বাউল, জারি, সারি, আধ্যাত্মিক, ভক্তিমূলক, পারঘাটা সব ধরনের গান রচনা করেছেন। দেহতত্ত্ব, ফকিরি, কামতত্ত্বের গানও তাঁর আছে। তাঁর গানের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ভাষা ও ভাবের সরলতা। জীবন ও পরিপার্শ্ব থেকে উপাদান নিয়ে সহজ-সরল ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে তিনি পারদর্শী। আত্মজৈবনিকতা তাঁর গানের আরেক বৈশিষ্ট্য। জন্ম, শৈশব, বড়ো হওয়া, গুরুর দেখা পাওয়া, সাধনায় আত্মনিয়োগ, পরিবার, পারিবারিক জীবন, সংসার জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাত, মানুষের ক্রোধ লোভ হিংসা কাম বাসনা, নিজের চিন্তাচেতনার রূপান্তর, ইহকালের চিন্তা, পরকালের চিন্তা, প্রেম, গৃহধর্ম, বৈরাগ্য ইত্যাদি মনির নূরীর গানের বিষয়-আশয়। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে বাউল, সুফি, বৈষ্ণব, মারিফতি প্রভৃতি তত্ত্ব তাঁর গানে উঠে এসেছে। একটি গানে কবি নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে যে—
জন্ম আমার হয়েছিল গরিব পরিবারে
কত কিছু করি আমি কয় পাগল মনিরে॥
বটের খালের পাড়ে আমার ভাঙা একখান ঘর॥
গরিব পরিবারেই জন্ম হয়েছিল মনির নূরীর। যে ভাঙা ঘরের কথা তিনি গানে লিখেছেন আদপেও ভাঙা তাঁর ঘর। এরকম নিরাভরণ ও নিরলংকার সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করে জীবনের নানা বাঁকের কথা তিনি গানে নিয়ে এসেছেন। আরেকটি গানে নিজের জীবনের সত্য প্রকাশ করেছেন এভাবে—
আমিও ছিলাম একদিন বড়ো নিশাকুর
কেহ কেহ বলে ডাকাত কেহ বলে চোর॥
না বুঝিয়া না চিনিয়া কত কি যে যাই করিয়া
এখন দেখিলাম ভাবিয়া হারায়েছি নুর॥

এভাবে জীবনের বিভিন্ন পরিপার্শ্ব কীভাবে মনির নূরীকে ভাবসাধনার জগতে নিয়ে যায় তারও কথা গানে লেখেন—
আফজলাবাদ দরগায় যাইয়া নূর নছিহত পরিচয় পাইয়া
লিয়াকত আলী আমার মুর্শিদ দয়ার ঠাকুর॥
…
মনিরে কয় নুরের ঝলক দেখাও হুজুর॥
এই নুরের ঝলক দেখতে ও স্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে একটা ভাবের জগতে প্রবেশ ও বিচরণ করেন মনির নূরী। গানের ভাষায় জীবনজুড়ে তাঁর সন্ধানের নমুনা হচ্ছে—
দয়াল গুরু দয়া করো সাধন শক্তি নাই
নিজ গুণে দয়া করো দয়ার ভিক্ষা চাই॥
আমি ছিন্ন জ্ঞানহীন বারে বারে চাই যে ফানা
আমার মতো নাই কমিনা ব্রহ্মাণ্ডে না পাই॥
কেমনে তোমাকে পাব কে ওই নাম শিখাব
এমন কে সু-হৃদয় হইব ওহে দয়ার সাঁই॥
মনিরে কয় হইলাম পাপী আর কারো না চরণ সেবি
কেমনে পাইব পাপী আর তো লক্ষ্য নাই॥
এই পথ ধরে মনির নূরী জেনেছেন পৃথিবীর সব মানুষ সমান এবং সবার মূলে ওই এক স্রষ্টা। কেউ ডাকে ভিন্ন নামে, কেউ আরাধনা করে ভিন্ন উপায়ে। সবাই মূলত চায় তাঁর দিদার এবং জীবনের মহামুক্তি। তাই তাঁর মতে, মনুষ্যত্বের সাধনার প্রথম উপায় মানুষের মাঝেই পরমের সন্ধান, মানুষকেই ভালোবাসা। মনির নূরী গানে বলেছেনÑ‘মনির কয় হিংসা ছেড়ে ভালোবাসো মানুষেরে’। নিজের সাধনার পথে মনির নূরী গুরু ধরেন; এই গুরুরা পির ও ফকির। স্রষ্টাকে পাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে তারাই, সাধারণ মানুষ হচ্ছে আশিকান। পির-ফকিরের মাজার এই আশিকানদের তীর্থস্থান। হজরত শাহজালালও এরকম এক পির ও আউলিয়া, যার সান্নিধ্যে গেলে নানা উপায়ে মুক্তির পথ মিলে। মনির লিখেছেন—
জালাল বাবার ভাবের মেলা আসেন সব জালালি চেলা
কেউ জিকিরে ফানা ফিল্লা কেহ করে ধ্যান॥

আবার সাধনায় মুক্তির পথকে তিনি প্রেমের পথ হিসেবে দেখেছেন। প্রেমের মূলে স্রষ্টা হলেও মানবপ্রেমের ভিতর দিয়েই স্রষ্টার প্রেম লাভ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। প্রেমে আছে নানা বাধা ও বিপত্তি, মনির নূরী মনে করেন মাসুককে পেতে হলে আশিককে সেই পরীক্ষায় পাশ দিয়ে তবে পেতে হবে। সুফিবাদের এই তত্ত্বের সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদী জীবাত্মা ও পরমাত্মার নিত্যপ্রেম নিত্যবিরহও তাঁর গানে বারবার এসেছে—
আমি যাওয়ার আগে সই লো বলিয়ে গেলাম
সকলেরই মুখে তোরা নিও কৃষ্ণনাম সইবে॥
ওই নাম শুনাইয়া কর্ণমূলে বলি বিনয় বচনে
পাড়ি দিব সেই নামে এই সে ভব ধাম॥
একই ভাবে বাউল অঙ্গের গানে দেহতাত্ত্বিক নানা বিষয়-আশয়ও তার ভাবসাধনাকে মূর্ত করে তুলেছে—
হুশেতে ঘর বানাইলা অচিন কামেলায়
দুইটি তনি এক কামানি বত্রিশ রোয়ায়॥
তিনটি তালা আছে ঘরে নয়টি দরজায়
সকল উপরে থাইকা ইশারায় চালায়॥
মনির নূরী তাঁর সাধনা ও গানে সবসময়ে চান জীবনের জরা থেকে মুক্তি; আত্মার সমুন্নতি। লালন, হাসন ও করিমের ভাবাদর্শও মনির নূরীর গানে দেখা যায়। তাঁর গানে সমাজের উন্নত রূপ, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা ও সুশিক্ষার কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। জালালুদ্দিন রুমি, মনসুর হাল্লাজের ভাবের কথাও তিনি গুরুর মাধ্যমে জানতেন। দেহশুদ্ধি ও আত্মার অমরত্ব সাধনাকে তিনি জনমের সাধনা হিসেবে দেখেন। এমন সাধনার সাধক হওয়াই মানবজন্মের উদ্দেশ্য বলে মনে করেন তিনি। এমন সাধনার কথা মনির নূরীকে গানে রূপ দিতে দেখি।
জফির সেতু রচনারাশি
- আমাদের গ্রামের নাম আমাদের নদীর || কাজল দাস - November 19, 2025
- লোককবি মনির নূরী ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 19, 2025
- উপন্যাসে শহুরে জীবনের ক্লান্তি ও বিপন্নতার বোধ || হারুন আহমেদ - November 16, 2025

COMMENTS