কাব্যচর্চায় মোস্তাক আহমাদ দীন কখনোই দুর্বোধ্য/বাহুল্য/যুক্তিহীন শব্দপুঞ্জের বিন্যাসে আচ্ছন্ন থাকেননি। মানবিক প্রয়াসের স্নিগ্ধতর রূপে তাঁর কবিতা চিরায়ত সৌন্দর্যের ক্যানভাস। তাঁর কবিতা সুরমা নদীর মতো গভীর ও স্বচ্ছতোয়া। পরিমিত শব্দসংগীতে তাঁর কবিতা নতুন ঘাসের ছোট ছোট ফুল; চিন্তার জাগ্রত তাজা পথ । নব্বই দশকের আয়তনিক কবিসমাজে বিচরণ করলেও গোষ্ঠীবাদের প্রচ্ছন্ন-আচ্ছন্ন মৌচাকে তিনি নেই। তিনি থাকেন সিলেটে। বাংলার প্রাকৃতিক নিসর্গে সিলেট যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত — এ-কথা কে অস্বীকার করবে। মাটি ও প্রকৃতির বিপুলতায় না থাকলে মানুষও উদার-বৃহৎ চোখে জগতকে স্পর্শ করতে পারে না। সংকীর্ণ কল্লোলে কবিতা হয় রুগ্ণ, সীমায়িত, সংরক্ষিত। জীবনের আভা নিয়ে দীনের কবিতা স্পর্শ করে কবিতা পড়ার জন্য কাব্যপঙক্তিতে যিনি উঁকি দেন তিনিও সন্তর্পণে নিজেকে দেখেন। জীবনের কি মাপজোক হয়? হয় না। জীবন বহমান। কবিতাও বহমান জীবনের মোহরছাপ। শাস্ত্রীয় নির্দেশ, সমাজনির্দেশ, জাহের-বাতুন প্রভৃতি পরিমাপ থেকে দূরে কবিতা আত্মার বীক্ষণ। কবিতা নিজের রুচিতে বানানো নিজের মানস।
সময়ে থাকতে থাকতে, দিনগণনায় থাকতে থাকতে আমরা আমাদেরকেই ভুলে যাই। কবিতা আমাদেরকে নিজের দৃষ্টিতে, নিজের রুচিতে ফিরিয়ে আনে। দীনের কবিতা মায়ের গায়ের গন্ধের মতো আপন। কবিতা পড়লে বোঝা যায় নিজেদের হাড়ের বেদনা। কবির স্বতন্ত্র প্রজ্ঞার জগৎ পাঠককে শান্ত ও সুন্দর করে। নব্বইয়ের কাব্যজগতে বিচরণ করেও সহচরদের থেকে দৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও বয়নে তিনি নতুন কবি। নতুন দিনের কবি। কেন? আসুন কবির কাব্যভাষার স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করি :
১. সহজ একটা অনুভব দিয়ে কবিতা শুরু করেন। শুরুর পঙক্তিটাই নাটকীয়, রহস্যময়, সুর নিংড়ানো। কেমন যেন টানতে থাকে। সুন্দরচাঞ্চল্যে ঘ্রাণে শুভ্র দোলনচাঁপার মতো এগোতে থাকে। সন্তর্পণে শব্দের আলোতে কবিতাও প্রেরণা দিতে থাকে। সব মানুষের জীবনের ছকে, অভিজ্ঞতার পরিসরে হাঁটাতে থাকে।
২. দীনের কবিতা একেবারে নতুনরকম লাগে। ঘোর ও ভাবনা তৈরি করে। ছোট ছোট পঙক্তি যেন চিন্তার ছোট ছোট সাঁকো। সহজ, গতিময় ও চমৎকার তাঁর ভাষাশৈলী, শব্দবুনন ও নির্মাণ।
৩. সবদিক থেকেই ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’ কাব্যগ্রন্থ নতুন মগ্নতার উচ্চারণ নিয়ে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়েছে। নতুন কবিতার ভাষা ও চিন্তায় একটা আলো থাকে। গ্রন্থপাঠে সেই আভা ও দার্শনিকতা টের পাওয়া যায়। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে এই কাব্যগ্রন্থের ভাষাভঙ্গিটিও নতুন এবং অবিচল — যা বাংলা কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন। চিরপরিচিত শব্দও চিন্তার দ্যুতিতে জীবন্ত হয়ে আছে। কাব্যগ্রন্থে পুরনো-অপরিচিত শব্দ, আঞ্চলিক শব্দ, মরমি শব্দের শৈল্পিক এবং সফল ব্যবহার হয়েছে। শব্দগুলোর উৎস ও দার্শনিক জগতও আমাদের স্পর্শ করে।
৪. ভূমির যাপিত নিসর্গ ও দার্শনিকতা নিয়েই তিনি কবিতা রচনা করেছেন। বিদেশি কবিতার নবায়ন নয়; কবিতা লেখার কালপর্বে নিজের ভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজের ইচ্ছেকেই বুঝতে চেয়েছেন।
৫. তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামের মধ্যেও স্বাতন্ত্র্য আছে। এটা হয়তো সচেতনভাবেই অর্জিত হয়েছে। কবিতা কখনোই চেষ্টা করে হয় না। কবিতা এসে যায়। মনে হয় দীনের কবিতার জগৎটাও এমন সহজতর। ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’, ‘জল ও ত্রিকালদর্শী’, ‘জল ও শ্রীমতী’, ‘ভিখিরিও রাজস্থানে যায়’, ‘বানপ্রস্থের আগে’ ও ‘স্ফটিকচূড়ার নিচে’ — কাব্যগ্রন্থগুলোর ভাষাবুনন এবং চিন্তার মধ্যে যেমন একটা ঐকতান আছে আবার দূরত্বও আছে। সামগ্রিকভাবে কবির বীজতলাকেই চেনা যায়।
৬. জন্মস্থানের মাটি ও নিসর্গ যে-কোনো কবিকে আলাদা করে। ‘দেশ’ ও ‘দেশ’-এর দার্শনিকতা বড় একটি ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হয় কবিতায়। সিলেটের ভূমি, হাওরাঞ্চলের সহজতা, বৈষ্ণবীয় বোধ ও মরমি উদারতা তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
৭. দীনের কবিতা মাত্রই অসাম্প্রদায়িক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
৮. তাঁর কবিতা বলার ভাষা গড়পরতা বাচনের সাথে মেলে না। যে-কোনো কবিতা প্রথম পাঠে মনে হয় যেন সহজতর; যেন বুঝতে পারলাম। কিন্তু পরক্ষণেই নতুন ভাবনা এসে হাজির হচ্ছে। পঙক্তি সহজ কিন্তু সেই সহজতার ভেতরেও রহস্যের একটা অতলতা আছে। শান্ত চলাচলের একটা নিঃশব্দ দ্যোতনা আছে।
দুই
দীনের কবিতার অর্থময়তায় একটা বোঝা না-বোঝা কাজ করে। প্রতিটি পাঠেই মগ্নতা তৈরি হয়। প্রসারিত আলোছায়ায় সময়-পরিস্থিতির একটা স্পন্দন তৈরি হয়। অর্থের চেয়ে সময়-পরিপার্শ্বের চিত্রময় তরঙ্গ তৈরি হয়। একেক পাঠে একেক রকম অর্থ এসে মনকে স্পর্শ করে। একেকজন একেকরকম বোধ নিয়ে কবিতাটি পড়বেন।
এত বিষ দেহকাণ্ডে, দেহে
আজ আমি সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
সকলেই একথা বোঝে আমি কভু ডুবি নাই জহরের জলে
দেহকাণ্ডে তবু এত বিষ, ভাবি তাই
প্রাণের মধ্যে কোন সর্প ঢুকে গেছে ঘুমে?
এ সন্দেহ মুক্ত হতে বংশকাহিনি যারা পাঠ করে গেল
তারা দেখে, পিতা বা প্রপিতামহ আলস্য করেনি কেউ
. মনসাপূজায়
তবে আমি অভিশপ্ত কাহার সন্তান?
দেহকাণ্ডে যত বিষ, তার মর্মে নীল হয়ে যাবে বলে
সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
অথচ দূরবর্তী বন্ধুও বোঝে
গোপন ইচ্ছের জোরে সংলগ্নজনের মনে
. কত বেশি মগ্ন হতে চাই
(বিষ, কথা ও হাড়ের বেদনা, মোস্তাক আহমাদ দীন)
আধুনিক বাংলা কবিতার উত্তরাধিকারে, পরিবেশন ও গীতলতায় কবিতাটি সংবেদী ও নতুন। ভাষা-শৈলী-উপলব্ধির প্রাচুর্যে, ভাষাপ্রতীকের নিজস্বতায় বাংলা কবিতায় নতুনত্বের সঞ্চার করেছেন। ‘এত বিষ দেহকাণ্ডে’ বলে চিন্তাকে যেভাবে কল্পনার নৌকায় বসিয়ে দিয়েছেন, ভাষার সে-নৌকা এত গীতল ও গতিমান যে কবিতার প্রাচীন রেওয়াজকে এখানে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকায়ত ধ্বনিপ্রবাহের শান্তিতে কবিতাটি খুব মৃদুভাষী ও সংবেদী। আঞ্চলিক শব্দও প্রয়োগের প্রাচুর্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
একজন কবিকে নিজের ভাষায় কথা বলবার হিম্মত অর্জন করতে হয়। এই হিম্মত জোরাজুরি করে হয় না। নতুনকে দেখার অভ্যাসে বলার একটা শক্তি তৈরি হয়। যেখানে অন্যেরা প্রবেশই করতে পারেন না, সেখানে কবি কল্পনাকে, ভাষাকে দ্যুতিময় প্রকাশ করতে থাকেন যাপিতজীবন।
তিন
একজন কবি একটা ঝোঁক নিয়ে কবিতা লিখতে আসেন। কবিতা তাঁর সাধনা; জগৎ দেখার অবলম্বন। মোস্তাক আহমাদ দীনের ঝোঁকটা কি? তিনি আধুনিক কবিতার নামে বিগত শতকের পরদেশী কবিতা লিখেননি। তিনি যে-মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন সে-মাটির ভাষা ও ঐতিহ্যের সাথে নাগরিক সংস্কৃতির একটা সাঁকো তৈরি করতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায় গ্রামযাপনের প্রচীনতা নেই; আছে এই ভূমির নিসর্গ আর জীবনের সত্যরূপ। বহুকালের সঞ্চিত ভাষা ও ঐতিহ্যকে কাব্যে জীবন্ত করেছেন তিনি। মাটির এমন একটা শিক্ষা ও ঐতিহ্য নিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি যে-শিক্ষা তাঁকে উদার, সহিষ্ণু, গীতল, ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক ও মানবিক হতে বলে, যে-শিক্ষা তাঁকে ভূমির, প্রকৃতির ও মানুষের কবিতা লিখতে বলে। নিজের কবিজীবনের উৎস ও বিকাশ সম্পর্কেও সচেতন তিনি। কবি বলেছেন :
‘আমার মামা ছিলেন একজন লোকগবেষক। আমার মাও আমাদের অঞ্চলের লোকগান, শ্লোক, লোকপ্রবাদ ইত্যাদি তাঁর খাতায় লিখে রাখতেন। রাধারমণের নিকট-প্রতিবেশী বলে আমাদের কিশোরী-যুবতী বোন-ভাগনিদের দিনের যে-কোনো সময়ে কারণে-অকারণে ধামাইল গানে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। বাবা দেওবন্দি সিলসিলার আলেম হওয়া সত্ত্বেও ছোটবেলায় মাকে সৈয়দ শাহনুর ও রাধারমণের গান শুনতে ও গাইতে দেখেছি। এইসব স্মৃতি নিয়ে প্রথমে স্কুলে এরপর মাদ্রাসায়, তারপর কলেজে গিয়েছি। মাদ্রাসায় পড়বার সময় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের সঙ্গে আমাদের লোকশব্দগুলোর আশ্চর্য মিল দেখে প্রথমে অবাক হয়েছি, এরপর এদের শক্তি ও ধ্বনিব্যঞ্জনা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়েছি। আরবি-ফারসি-উর্দু মাধ্যমে লেখাপড়া করার কারণে মাদ্রাসায়-পড়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন তখন তাদের কথাবার্তায় সেইসব ভাষার শব্দের প্রাধান্য থাকে। প্রথমে আমাকেও সেই গোত্রের একজন বলে ভাবতে পারো। এই প্রভাব, এবং তারপর ঘরের/অঞ্চলের প্রভাব, তারও পরে আমার বাউলফকির-সঙ্গ — এইসব নিয়েই গড়ে উঠেছে আমার শব্দের জগৎ। কবিতা লিখতে এসে আমার পক্ষে তো এর বাইরে যাওয়া সম্ভব না। আমি যখন লিখেছি ‘তোমার ঠোঁটে আয়াতুল কুরসির গন্ধ’, তখন আয়াতুল কুরসি আর কোনো মুসলিম কিশোরীর স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের সঙ্গে পাঠকের যোগ-অযোগ দু-রকম অভিজ্ঞতা হতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে আমি এ-পর্যন্ত যেসব পাঠক-প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতে হতাশ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি।’ |
সামাজ আর সংসার ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। একেকটি কাব্যগ্রন্থে দীনের কবিতার রূপ ও ধরনও পাল্টেছে। সামগ্রিক ভাবনায় মাখামাখি হয়ে দীনের কাব্যচিত্রণও অন্যতর হয়েছে। কিন্তু দীন যে-বীজতলার কবি সে-বীজতলাকে কবি ভুলে যাননি। ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’-য় ‘জন্মলজ্জা’ কবিতাটি দিয়ে শুরু হয়েছিল দীনের কাব্যযাত্রা। আসুন দীনের কাব্যশৈলী ও মানসজগতকে আবারও পাঠ করি :
এ বিধি লাগে না ভালো : জন্মলজ্জা ফেলে দিতে
. কাঁদিবার কথা
এ বড় রহস্যকথা সান্দ্রকথা আমি তার বুঝি না তো সার
আমার সঙ্গীরা বলো
কাহার গলায় ধরে বলি আজ জননী জননী
এত যে ঘুরেছি ভূমি তবু আমি জীবন চিনি না
অথচ সে যুবক নই
দিবসে দাঁড়ালে যে সূর্যকণা খেয়ে নিত রাতের দাঁতেরা
আমার নিয়তি ওহো
বারবার ভুলে যাই জন্মদাত্রী আমারই মায়ের মুখ, স্তন
অথচ গ্রহণপ্রশ্নে যমজ বোনেরে ক্রমে ঠেলিয়াছি দূরে
আজ বিস্মরণের দিন আজ এংকা পথে ঘুরিতেছি
আনত দু-হাত নিয়ে
জন্মলজ্জা ফেলে দিতে শূন্যে শূন্যে খুঁজিতেছি গলা
(জন্মলজ্জা, কথা ও হাড়ের বেদনা, মোস্তাক আহমাদ দীন)
কবিতা পড়ে যাচ্ছি আর দেখছি কথার বুননে নষ্ট-ভ্রষ্ট সময়চিহ্নে কবি ঢেলে দিচ্ছেন নিজের জীবন। টুকরো টুকরো কথা, দৃশ্য ও চেহারায় কবি ঢেলে দিয়েছেন কালের পরিস্থিতি। বিচিত্রানুভবের এই দৃশ্যকল্প মনে হয় সার্বজনীন।
আমি যে-কথাটি বলতে চেয়েছি, সে-কথাটি বলতে না-পেরেই হয়তো লেখা শেষ করছি। সবকিছু শেষ হয় কিন্তু কবির কবিতার আবেদন শেষ হয় না। দীন হাওরাঞ্চলের উর্বর মাটিতে জন্মেছেন। সে-মাটির পাখাপাখালি-গাছগাছালির মতোই মায়াময় দীনের কবিতা। একটা দ্যুতিময় ভাষায় সমাজ-সংসার, স্বপ্ন-আশা-হতাশা স্মৃতি ও মর্মরিত অনুভূতিগুলোই দীনের কবিতার শক্তি।
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
গানপারে মোস্তাক আহমাদ দীন
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
COMMENTS