আছে তোমার বাবার ইমারতের কারখানা আর শহর গড়ার কল
আমার তাপ্পি-মারা জিন্স আমার ভাঙা গিটার আমার সম্বল
ভ্যেরি মাচ প্যসিব্যল্, খুবই সম্ভব ব্যাপারটা, প্যপ্যুলার মিউজিকের লিরিক্স ধরে ধরে সোশ্যাল্ অ্যাডভ্যান্সমেন্ট নিরূপণ করা। সামাজিক রূপান্তর বলি কিংবা সামাজিক উন্নয়ন, অথবা উল্টাটা, — সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামূহিক অনুন্নয়নের গতিধারা — গানের লিরিক্স থেকে এঁটে ওঠানো সম্ভব। সোশ্যাল্ ডিন্যামিক্স, সোশিয়োকালচারাল ডিন্যামিক্স, জনপ্রিয় সংগীতকীর্তিকলাপ থেকে যেভাবে তুলে আনা সম্ভব, কবিতা বা আর-সমস্ত শৈল্পিক প্রয়োগকাঠামো ভর করে সেভাবে এত সহজে তুলিয়া আনা সম্ভবপর নয়। কেন নয়, ইজি অনুমেয় হলেও বলা যাক একটু।
প্রথমত, কবিতা বা চিত্রকলা ইত্যাদিতে অ্যাবস্ট্র্যাকশন যে-রেশিয়ো ও রকম-রেলায় থাকে, গানে ব্যাপারটা আলগ অনেকটাই। কিন্তু ঘটনাটা এমন নয় যে গানে অ্যাবস্ট্র্যাকশন থাকে না; থাকে, গানে অ্যাবস্ট্র্যাকশন থাকে মেইনলি টিউন লতিয়ে; গানের অ্যাবস্ট্র্যাকশন অধিকতর রাহসিক, রাজসিকও, ট্রুলি স্পিকিং, সুরের ভিতর দিয়া গানের এই তীব্র রহস্যঘোর রাজসিকতা। বাণীর ভিতর দিয়া গানের উড়াল অল্পই ঘটে। এইদিক থেকে গানের অ্যাবস্ট্র্যাকশন অনেক বেশি ফ্রি, অনেক বেশি ফ্লাইটফ্যুল্, অনেক বেশি ডিলাইটফ্যুল্। সুরের পাখায় চেপে অ্যাবস্ট্র্যাকশন গানের।
কবিতায় যেহেতু শব্দ ছাড়া আর-কোনো দুয়ারে উঁকিবুকির তোয়াক্কা নাই, শব্দ দিয়াই নির্মিত কবিতার বাকি চিত্রবৈচিত্র্য সমস্তকিছু, ফ্রিডম অনেক বেশি তাই। নিরাপোস থাকতে পারে সে অন্যান্য সৃজনকলার তুলনায় এবং অল্প বিনিয়োগে রেজাল্টগ্র্যাফ কবিতার অনেক ঋদ্ধ। গোল বাঁধে কম্যুনিকেশনের বেলায়। কেবল শব্দ ছাড়া রাস্তা নাই যেহেতু কবিতার, অন্য কোনো উপাদান যথা গানের ক্ষেত্রে সুর-কণ্ঠ-বাদ্য সহযোগ থাকে তেমন কোনো সাপোর্ট কবিতার থাকে না, শব্দ দিয়াই কবিতারে কাজ সারতে হয়। পাঠকের কাছে কবিতা আর-দশ প্রকাশাঙ্গিকের চেয়ে এই কারণেই বোধহয় জটিল ও অপেক্ষাকৃত দুর্বোধ মনে হয়।
এবং এই কারণেই কবিতায় কালের কাকলি ও করাল সমস্ত চিহ্ন ডক্যুমেন্টেড থাকা সত্ত্বেও কোডগুলি ডিকোড করতে পাঠকেরে গলদঘর্ম হতে হয়। এইজন্যই কবিতায় থাকা সমাজবাস্তবতা তালাশ করতে রীতিমতো গোয়েন্দা বা কাব্যালোচনাকারী ক্রিটিকের দ্বারস্থ হতে হয় পাঠকেরে প্রায়শ। তবে সব কবিতার ক্ষেত্রে একই কথা খাটে না নিশ্চয়। গানের চেয়েও স্বচ্ছ ও সুগম অথচ সুবেদী কবিতাও অনেক সময় এক্সপেরিয়েন্স করি আমরা।
গানের গতরে সমাজবাস্তবতা বা কালচিহ্ন যা থাকে তা অপেক্ষাকৃত অনায়াসেই দৃষ্টিগোচর হয়। গ্রামীণ গানকর্তা বা বাউল-ফকির মহাজনদের গানে এর এভিডেন্স সহজলভ্য। সোজাসাপ্টা শাহ আবদুল করিমের যে-কোনো একটা গান হাতে নিলেই জিনিশটা রিয়্যালাইজ করা যাবে। “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম / গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান / মিলিয়া বাউলাগান আর ঘাটুগান গাইতাম” — বহুলভাবেই গীত এই গানটায় খেয়াল করব তৎকালীন সমাজের গড়ন ও বিন্যাস। হাওরের সনাতন ধর্মাবলম্বী হাউজহোল্ডগুলায় কালচারাল যেসব পার্ফোর্ম্যান্স হতো মুসলমান প্রতিবেশীরা তাতে নেমন্তন্ন পেত ও সহাবস্থানের ভিত্তিটা ছিল মজবুত। তথ্যটা গানেই শুধু-যে পেয়েছি তা নয়, করিমের গানের ভিতর অঙ্কিত সমাজটা আমরা অনেকেই নিজের চোখে দেখেছি।
কিন্তু কথা হচ্ছিল অক্ষরকেন্দ্রী ‘শিক্ষিত শহুরে’ মানুষদের হাতে গড়ে-ওঠা গান নিয়া। ‘আধুনিক বাংলা গান’ বলি আমরা যা-কিছুরে, সেসবের শরীরে কী সমাজ থাকে না? আলবৎ, থাকে তো অবশ্যই। ‘জীবনমুখী গান’ ট্যাগটা কালক্রমে অ্যাবান্ডোন্ড হয়ে গেলেও ওই ট্যাগের আওতায় যেসব গান হয়েছে সেসবের ভিতর সমসাময়িকতার সমস্ত চিহ্নই ধৃত। সুমন, অঞ্জন, নচিকেতা, মৌসুমী, চন্দ্রবিন্দু ছাড়াও অসংখ্য সংগীতদল ও সংগীতশিল্পী ওই সময়ের আঁচড় তাদের গানে রেখেছেন। সবার কাছেই ক্লিয়ার মেমোরি আছে যেহেতু, উৎকলনে না-যাই আর।
উৎকলনে না-গেলেও উপরে যে-এপিগ্র্যাফটা দেখা যাচ্ছে সেইটার ব্যাপারে একটু বলি। বিশেষ ভেবেচিন্তে এই পঙক্তিদ্বয় চয়ন করা হয়েছে এমন নয়। এইটা অঞ্জন দত্তের একটা গানের পঙক্তিগুচ্ছ। প্রণয়িনীর সঙ্গে সেপারেশনের প্রাক্কালে উভয়ের মধ্যকার শ্রেণিফারাক দেখিয়ে প্রেমিক কথাগুলো বলতেসে গানে গানে। এই গানটার জন্মকাল আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি বিগত শতকের আশির দশকের শেষভাগ থেকে নব্বইয়ের মধ্যভাগ বা তার আশপাশ। তখন যেমন বাংলাদেশে তেমনি ইন্ডিয়ায় রিয়্যাল এস্টেট বিজনেসের রমরমা না-হলেও হুজুগ শুরু হয়ে গেছে। বেবাকে মিলে চারিদিকে খালি ইমারতই তুলতেসে। এই ছবিটা গানের ওই দুইটা লাইনের পয়লাটায় আঁকা রইল। পরের লাইনে আরেকটা ছবি। হিপি প্রজন্মের শেষাংশ ওই সময়টায় দেখা যেত শহরে-শহরতলিতে। তাপ্পি-মারা জিন্স ইত্যাদি দিয়া আঁকা হয়েছে সেই হিপিটাইমের ছবি। ঠিক এই গানটারই অন্যান্য পঙক্তিতে আরও-আরও ছবি পাওয়া যায় যা ওই বিশেষ সময়ের সোশ্যাল-কালচারাল নোশনগুলা গায়ে ধরে রেখেছে।
একইভাবে বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে আশি-নব্বইয়ের ঢাকা ছাড়াও গোটা বাংলার এবড়োখেবড়ো শহর ও শহরতলির খবরটা পাওয়া যায়। এই কথাটাও কবুল করে রাখা দরকার যে বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে ভেবেচিন্তে লিরিক লেখা কালেভদ্রেই হয়েছে। ব্যান্ডগানের উন্মাদনাটা আরও অন্যান্য অনেক দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হলেও কথাকৃতি হিশেবে এর উল্লেখযোগ্যতা বলতে হবে নগণ্যই। ঠিক নগরমানুষের জটিল মনোজগৎ ব্যান্ডগানে সেভাবে পাওয়া যায় না। তারপরও মাকসুদুল হক, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস্, নকিব খান প্রমুখের গানে নব্বইয়ের নগরনিসর্গ অল্পবিস্তর যা আছে তা ফেলনা নয়।
এইখানেই জিৎ পপুলার গানবাজনার, যেইটাকে ‘লঘু সংগীত’ বলেন বাংলার অবাক-করা গানপণ্ডিতেরা। সাংগীতিক বিবেচনায় লঘু-গুরু দিয়া মাপামাপির যেই রিডিকিউলাস রুসম, এইটা আমাদের অঞ্চলে এখনও দৈত্যাকারেই বিরাজিত। অথচ ধ্রুপদে বা যারে আমরা গাল ফুলায়া বলি ‘হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক’ সেইসবের মধ্যে কেউ সমাজসভ্যতা বা সাময়িকতা খুঁজতে গেলে একছটাকও পাবে না। কালোয়াতি জিনিশপত্র অবশ্য কথানির্ভর নয়, কাজেই তাতে কেউ খুঁজতেও যাবে না কালচারাল বা অন্য কোনো ডিন্যামিক্স।
মনে হয় এই নিরিখে একটু খোঁজপতা-আলাপচাকা চালানো দরকার। কতকিছুই তো করা বাকি এখনও। গতের অনুগত হয়া গানবাজনা নিয়া আলাপালোচনা আর কতকাল চালানো হবে, কে দেবে এই শিকোয়ার জোয়াব?
লেখা : জাহেদ আহমদ
ভূমিকার পরিবর্তে একটা পাদটীকার ন্যায় ভাষ্য যুক্ত করিয়া রাখতে চাইছি নিবন্ধপ্রবাহ ‘মুখস্থ মুজরো’ প্রত্যেকটা পার্টের সঙ্গে। বেঁটেখাটো কৈফিয়ত গোছের একটা ভাষ্য। পুনরাবৃত্তাকারে এইটা অ্যাটাচ করা থাকবে এর এপিসোড প্রত্যেকটার লগে। কেবল ইয়াদ রাখতে হবে এই নিবন্ধপ্রবাহ সংগীতবিষয়ক কোনো কড়া আলোচনা নয়। আদৌ সংগীতগদ্য নয় এই রচনা। নামের মধ্যে একটা নাচাগানাবাজানার আভাস থাকলেও মোদ্দায় এইটা গালগপ্পো। অনুষঙ্গ-উপানুষঙ্গ-অনুপান হিশেবে এইখানে শ্রবণাভিজ্ঞতাগুলা আসবে এবং চলেও যাবে। সে-অর্থে এইখানে রেফ্রেন্সের খোঁজপাত্তা খামাখা। আদতে এইখানে রেফ্রেন্সেস নাই বিধায় রেফ্রেন্স চেকের পরিশ্রম করতে যাওয়াটাই বৃথা। ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ধাঁচের রচনা, ব্যক্তিগতিকতায় ভরা বা আবোলতাবোল, আবার অতটা ধারাফারা মান্য করবার বাঁধিধরা নাই কিছু। অনিয়মিত, সবিরত, কখনও সময়ে-সুযোগে একনাগাড় নিয়মিতও হতে পারে। একেকটা পার্টে একটামাত্র অনুচ্ছেদ, অথবা চাইর-পাঁচটা মাত্র, পরিকল্পনা আপাতত অতটুকুই। মিউজিক-লতানো গল্পগুলা, গান গাইবার বা গানের সমুজদারিতার গল্পও নয়, গানশোনার আবছা আলাপচারি। স্মৃতিরই রোমন্থন, মুখস্থ মুজরো, সুরাশ্রিত অটোবায়োগ্র্যাফিকতা। — জা.আ.
মুখস্থ মুজরো ১
মুখস্থ মুজরো ২
মুখস্থ মুজরো ৩
মুখস্থ মুজরো ৪
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS