আমাদের লাইফের আর্লি দিনগুলায় প্রিয়-হয়ে-ওঠা গানগুলা বাকি জীবনভর স্বকর্ণে সেভাবে আর না-শুনেও গুনগুনায়া যাই আমরা হাজার হাজার বার। নয়া নয়া গান শুনি না তা নয়, শুনি, কিন্তু পুরানা গানগুলাই আমাদেরে নিত্য চালিত করে দেখতে পাই। ইন-ফ্যাক্ট, ২০০৬ অক্টোবর থেকে সেই-অর্থে গান শোনা হয় না আমার আর। অক্টোবর মনে রাখতে পেরেছি কারণ ওইবছর ওইমাসে আমাদের স্কুলফ্রেন্ড রূপক মারা যায়। অল অফ অ্যা সাডেন। কোনো পূর্ববিজ্ঞপ্তি না-দিয়া। আমার যদ্দুর মনে পড়ে রূপকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন-পর্যন্ত আমার যারা বান্ধবপর্ষদ তাদের প্রায় সকলের। যা-হোক। মরেছে ফুরিয়েছে। ল্যাঠা গেছে চুকে। ‘যা গেছে তা যাক’। সলিল চৌধুরীর সুর ও গান। এখন গান শোনা হয় ওই খবরকাগজের নিউজহেডিং চোখ বোলানোর মতো করে। আজকাল প্রায়ই মনে হয়, ফেরা আর হবে না আমাদের সুরে, ভেসে যাবে আদরের নৌকো, চলে যাবে স্টেশন ছেড়ে এ-জন্মের রেলগাড়িরা, হায়, শোনা আর হবেনাকো চন্দ্রবিন্দুর গান … “বন্ধু তোমায় এ-গান শোনাব বিকেলবেলায় / আরেকবার যদি তোমাদের দলে নাও খেলায়” … কিন্তু গান শুনতে না-পারার কম্পেন্সেশন/কন্সোলেশন হিশেবে মেমোরিচারণের পরিমাণ ও মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে এই টাইমটায়। আমি বলছি আমার লাইফের কথা। ভাবনার বিষয় যেইটা হচ্ছে যে এই স্মৃতিরোমন্থন ভালো না মন্দ। প্রথমত, পুরাকালে আমাদের প্রপিতামাতামহের আমলে হাতের কব্জি ডুবায়া দুধভাত খাওয়া হতো কি হতো না তা জানি না, তবে ব্যাপারটা গালগল্প হয়ে উঠেছে তখন থেকেই যখন কিনা আমাদের ঘরগিরস্তালিতে গোশালা হাপিশ হয়ে গিয়েছে, আমাদের ডোমেস্টিক লাইফ থেকে যখন গোয়ালঘর অনুপস্থিত হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, দুধভাতের গল্পগুজব প্রমাণ করে বৈকি যে আমরা জাতিগতভাবে দুধভাত পছন্দ করি। অ্যাফোর্ড করতে পারি না এখন আর। গানের বেলাতেও তো তা-ই। জীবনযাত্রা ইত্যাদি বিবিধ হ্যাপায় এখন গান ওইভাবে শোনা হয় না, হবেও না আগের মতো করে। মেমোরি দিয়া, কাজেই, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। অল্পবিস্তর রোমন্থনের ক্ষিদেতেষ্টা মানুষের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য। বল্গাহারা হলে পরে সেইটা আশঙ্কার। আমার অবস্থা আশঙ্কাজনক। অতিরিক্ত রোমন্থনপ্রবণতা প্রমাণ করে যে রোমন্থনকারী জীবদ্দশার উপান্তে এসে ঠেকেছে। সে বেঁচে আছে ঠিকই, কিন্তু অতীতের বিবরে এই বেঁচে থাকা ন্যাক্কারজনক ভারি। সভ্যতাগতির জন্য আদৌ যা ভালো খবর নয়কো। সবাই যদি এইধারা রোমন্থনরাক্ষস হয়ে ওঠে, তাইলে তো সমূহ বিপদ। উহ্য থাক অন্যান্য আপদের বর্ণনা। আশার কথা এ-ই যে হেন আপদগোত্রীয় লোক এখনও অল্পসংখ্যক। সবাই ডেইলি-নিউজপেপারের, যাকে বলে প্রাত্যহিকপত্রের, সমকালকেলেঙ্কারী নির্মাণে ব্যস্ত ও ব্রতী। কিন্তু সে-যা-হোক, বছর-কয়েক আগে দেশে যখন প্রথম এফএম রেডিয়ো চালু হয়েছিল, গান শোনার হ্যাবিট ফিরবে মনে করে বেশ আশান্বিত হয়েছিলাম। গুড়ে বালি। তিন-চারমাস আপিশযাত্রাপথে যেতে-ফিরতে কানে লতা লাগায়ে বেশ প্রচুরসংখ্যক গান শোনাও হয়েছিল, পরে সেইটা আর কন্টিনিউ করা যায় নাই। কিন্তু তখন বুঝতে পেরেছিলাম বেশ যে একটা আলাদা আওয়াজ তৈরি হতেছে বাংলাদেশের গানে। এমনিতে আমি মনে করি পিছিয়ে পড়েছি গান-অভিজ্ঞতার দিক থেকে একদশক কম-সে-কম। গত দশবছরে যেসব ব্যান্ড এসেছে বাংলায়, এমনকি যারা ভালো করছে মর্মে নামডাক শুনেছি লোকমুখে, একটাও তো শোনা হয় নাই। কৃষ্ণকলি আর অর্ণব বা ধরো ‘জলের গান’ বা সায়ানের গান বা ওয়াকিল আহমেদ বাদ দিলে এই গোটা দশকের ভেতর থেকে সেভাবে কারোর গানই আদ্যোপান্ত শোনা হয়েছে আমার এমনটা দাবি কোনোভাবেই করতে পারব না। আমি নিশ্চিত যে এইসময়ে এন্তার বিচিত্র সংগীতসৃজন হয়েছে। কাজেই পিছিয়ে যে পড়েছি এতে কোনো সন্দেহ নাই এবং এহেন পশ্চাৎপদত্ব অপূরণীয়। অথচ একটা সময় পর্যন্ত বাংলার ক্যাসেটদোকানে ব্যান্ড-হিন্দিফিল্মি-ইংরিজি-রবীন্দ্রনজরুলমিউজিক-আধুনিক যা-কিছু সুলভ ছিল তা-কিছু সমস্তই আমাদের কান না-ছুঁয়ে ব্ল্যাকহোলে যেতে পারে নাই, এইটা দাবি করলে তো কমই দাবি করা হবে, তাই না? কাজেই স্মৃতি তুমি বেদনার মার্কা জিন্দিগি জিনে-কে লিয়ে এইসব ছাইভস্মধূলি-সিকিআধুলি নিবন্ধনোটের চোটপাট ছাড়া আর-কিইবা ক্ষ্যামতা আছে আমার-তোমার করার! তবে আজকাল মনে হয় যে এইটাও মন্দ হয় না যদি ঠিকঠাক নিজের সময়ের গানগল্পগুলো টুকে রেখে যাওয়া যায় পৃথিবীর বৃষ্টিবিমূঢ় অঞ্চলের একটা-কোনো কর্নারে। এতে প্রোফিট হবে নিজেরই, জগতের কুচ পরোয়া নেহি, নিজে একটু রসেবশে থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রার্থনাবাক্যের মর্ম অনুধাবন করে বিদেয় হওয়া যাবে। ঠাকুর তো ছিলেন কালীসাধক। তার ভক্ত-আশেকানদিগেরে নানাবিধ দোয়া মাসলামাসায়েল শিখাইতেন দিবারাত্র, অমৃতবচন দিতেন দারুণ সমস্ত গল্পকথাচ্ছলে, একদা আশেকানদের প্রাসঙ্গিক এক সওয়ালের জবাবে রামকৃষ্ণ উবাচ, নিজের জন্য তিনি কালীনিকটে একটাই এবং একমেবাদ্বিতীয়ম প্রার্থনাবাক্য জপ করেন সারাবেলা : রাখিস মা রসেবশে! সেইটাই। রসেবশে থাকা। গান শুনে হোক অথবা গান না-শুনে স্রেফ গানরোমন্থনে। রসেবশে থাকা নিয়াই তো কথা। মারামারি-ক্লিকবাজির বীর হইবার মুরদ তো আল্লা আমরারে দেন নাই দুনিয়ায়। কিন্তু একটা লাভ হয়তো হতেও পারে, সেইটা এ-ই যে, ধরো আমাদের নাতনি বা তার ইয়ারদোস্তোরা মিলে যে-একটা ব্যান্ডট্রুপ বানাবে, সেইখানে কম্পোজ়িশনের সময় এইসব তোমার-আমার গানশ্রবণস্মৃতি দিয়া তারা খানিকটা প্রাচীনকালিক সুরের মন্তাজ পেতে পারে। আমার সময়ের গান নিয়ে মেমোরিচারণ যতই পার্সোন্যাল হোক, শেষপর্যন্ত সেইটা তো ওই সময়েরই নিসর্গ-জলবায়ু অপটু হাতে হলেও ধরে রাখবে। ওই সময়টার জনরুচি-রাজনীতি-সংস্কৃতি হ্যানত্যান নানাকিছু। দর্শনটাও। অলমিতি বিস্তরেণ।
ভূমিকার পরিবর্তে একটা পাদটীকার ন্যায় ভাষ্য যুক্ত করিয়া রাখতে চাইছি নিবন্ধপ্রবাহ ‘মুখস্থ মুজরো’ প্রত্যেকটা পার্টের সঙ্গে। বেঁটেখাটো কৈফিয়ত গোছের একটা ভাষ্য। পুনরাবৃত্তাকারে এইটা অ্যাটাচ করা থাকবে এর এপিসোড প্রত্যেকটার লগে। কেবল ইয়াদ রাখতে হবে এই নিবন্ধপ্রবাহ সংগীতবিষয়ক কোনো কড়া আলোচনা নয়। আদৌ সংগীতগদ্য নয় এই রচনা। নামের মধ্যে একটা নাচাগানাবাজানার আভাস থাকলেও মোদ্দায় এইটা গালগপ্পো। অনুষঙ্গ-উপানুষঙ্গ-অনুপান হিশেবে এইখানে শ্রবণাভিজ্ঞতাগুলা আসবে এবং চলেও যাবে। সে-অর্থে এইখানে রেফ্রেন্সের খোঁজপাত্তা খামাখা। আদতে এইখানে রেফ্রেন্সেস নাই বিধায় রেফ্রেন্স চেকের পরিশ্রম করতে যাওয়াটাই বৃথা। ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ধাঁচের রচনা, ব্যক্তিগতিকতায় ভরা বা আবোলতাবোল, আবার অতটা ধারাফারা মান্য করবার বাঁধিধরা নাই কিছু। অনিয়মিত, সবিরত, কখনও সময়ে-সুযোগে একনাগাড় নিয়মিতও হতে পারে। একেকটা পার্টে একটামাত্র অনুচ্ছেদ, অথবা চাইর-পাঁচটা মাত্র, পরিকল্পনা আপাতত অতটুকুই। মিউজিক-লতানো গল্পগুলা, গান গাইবার বা গানের সমুজদারিতার গল্পও নয়, গানশোনার আবছা আলাপচারি। স্মৃতিরই রোমন্থন, মুখস্থ মুজরো, সুরাশ্রিত অটোবায়োগ্র্যাফিকতা। — জা.আ.
মুখস্থ মুজরো, পূর্ববর্তী কিস্তিগুলা
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS