নগরবাউল ও জেমস্ || জুয়েল ঠাকুর

নগরবাউল ও জেমস্ || জুয়েল ঠাকুর

জেমস্, গুরু, বস্, দেবতা, নগরবাউল ইত্যাদি যে-যা-ই বলুক, আমি বলব অসাধারণ এক বন্ধু। বন্ধু বলার একমাত্র কারণ হলো, আমার মনে হয় এই পৃথিবীর মধ্যে ওই একজনই আছেন যার মধ্যে বন্ধুত্ব করার এক অসাধারণ ক্ষমতা বিদ্যমান। বন্ধুত্বের জন্য তিনি পৃথিবীর সবটাকে আলাদা করে দেন তার সৃষ্টিশীল মস্তিষ্ক থেকে।

হয়তো ঝাঁকড়া চুল, অগোছালো চলাফেরা ইত্যাদির জন্য জেমস্ অনেকের কাছে পাগল হিসেবে পরিচিত। আর বাকিদের কাছে গুরু, দেবতা ইত্যাদি হিসেবে মাথার সিঁদুরের মতো। কিন্তু ওই যারা তাকে পাগল বলে ডাকে তাদের কাছেই তিনি তার গলার জন্য হয়ে ওঠেন অসাধারণ। অর্থাৎ চলাফেরা অগোছালো হলে কি হবে, লোকটার গলা কিন্তু বেশ। সৃষ্টিকর্তার নিজের হাতে গড়া। একপক্ষ পাগল আর ভক্তের কাছে গুরু-দেবতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে জেমস্ হয়ে উঠেছেন এই দেশের অনন্তকালের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

জেমসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেলে। কিন্তু তার শেষ কোথায় আমরা জানি না। ‘স্টেশন রোড’, ‘অনন্যা’ ইত্যাদির মাধ্যমে সংগীতজগতে প্রবেশ করলেও ‘জেল থেকে বলছি’ দিয়ে জেমস্ স্থান করে নেন সংগীতপিপাসুদের মস্তিষ্কে। কিন্তু জেমস্ তার আগমনী বার্তা শুনিয়েছিলেন ‘নগরবাউল’ অ্যালবামে। সেই থেকে তার অগোছালো ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রাম-গঞ্জ-শহরের আনাচেকানাচে স্থান করে নেয় জেমসের গান সংগীতপিপাসুদের মস্তিষ্কের ১,০০০ কোটি নিউরনে। বন্ধু হয়ে ওঠে জেমস্ ছন্নছাড়া মানুষের।

সেদিন আমার সাথে প্রথমবার দেখাতে জেমস্ আমার বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন কষ্ট আছে এই বুকে। তখন থেকে আমার শরীরের প্রতিটি অনুভূতিতে স্থান করে নেন জেমস্। শুরু হয় জেমসম্যানিয়া। বিয়ের হলুদে যেতে থাকি পাঞ্জাবি, জিন্স ও ব্যুট পরে। যারা জেমসের গান পছন্দ করে না তাদেরকে ভক্ত বানাই। পরিচিতি পেতে থাকি নিজেও জেমস্ হিসেবে। জেমসভাইয়ের কাছে আমি ঠাকুর হিসেবে আর সরাইলে আমার এলাকার মানুষদের কাছে জেমস্ হিসেবে আমার পরিচয় গড়ে ওঠে। এইসব ভাবতে ভালোই লাগে।

মাঝে মাঝে মনে হয় একজন মানুষ কীভাবে এত বন্ধুভাবাপন্ন ও সৃষ্টিশীল হতে পারেন! যে-ব্যক্তিটা কখনো আসেন স্টেশন রোডের জীবনধারার কথা জানাতে, আবার নগরবাউল হয়ে এই যান্ত্রিক নগরে লক্ষকোটি প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসাকে তারায় তারায় রটিয়ে দিতে। কখনো ঝাঁঝালো, কখনো কোমল যে-কোনোভাবেই নিজেকে উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। যখন তিনি বাংলার লাঠিয়াল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন তখন মনে হয় তার পূর্বপুরুষের কেউ হয়তো লাঠিয়াল ছিলেন। কিন্তু সত্যি বলতে, জেমসের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ লাঠিয়ালও ছিলেন না বা সংগীতের সাথে জড়িতও ছিলেন না। তার গানে সবসময় থাকে গ্রামবাংলার কথা, প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথা, মায়ের কথা, মান্নান মিয়াদের কথা। নিজেকে কেবলই নিজের জন্য বলে জেমস্ কখনো মনে করেন না। সবসময়ই নিজেকে অন্যের বলে মনে করেন। তিনি মানুষের ভালোবাসার মাঝে থাকতে পছন্দ করেন। তার প্রতিদিনের কথা, আল্লাহই জানেন কাল কি হবে। তরুণ-তরুণীদের প্রতি উপদেশ তার একটাই, “ভালোবাসো, ভালোবেসে যাও।”

তার যুদ্ধটা আসলে মঞ্চে। মঞ্চে গান গাইতেই তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। তার কথা হলো, বাংলাদেশের মাঠেঘাটে গান গাইতে চাই। আমার লক্ষ্য ওই একদিকেই স্থির। বাংলাদেশের মাঠ আর বাংলাদেশের ঘাট। এমটিভি বা চ্যানেল-ভি ইত্যাদির কোনো শখ নেই।

যখন তিনি দুইহাত ওপরে তুলে প্রার্থনার ভঙ্গিতে মঞ্চে ওঠেন, তখন দর্শকদের মাঝে তার অস্তিত্বকে বিলিয়ে দেন। প্রাণের সঞ্চার হয় মঞ্চে। দীর্ঘক্ষণ-অপেক্ষায়-জমে-থাকা বিরক্তিভাবটা নিমেষেই কেটে যায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের। তরুণ-তরুণীরা মেতে ওঠে অদ্ভুত উন্মাদনায়। চারিদিকে আকাশে-বাতাসে মাতম ওঠে। দর্শকেরা হয়ে ওঠে উথালপাথাল, হারিয়ে ফেলে নিজেকে, কল্পনা করতে থাকে নিজের অস্তিত্ব গানের সাথে মিলিয়ে।

আউলাবাউলা চুলের বাবরি-দোলানো জেমসও যেন একাকার হয়ে যান তাদের সাথে। মনে হয় পৃথিবীর ওই একজন জেমস্ আর তার একটা গান, এছাড়া আর কিছুই কল্পনা করার ক্ষমতা কারোর থাকে না। কারণ তখন ১,০০০ কোটি নিউরনের মস্তিষ্কের পুরোটাই দখল করেন জেমস্।


লেখক-তথ্য
জুয়েল ঠাকুর / গ্রাম : বড় দেওয়ানপাড়া / ডাক ও থানা : সরাইল / জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রথম-প্রকাশতথ্য
ঈদসংখ্যা আনন্দভুবন / বর্ষ ৪ সংখ্যা ১৬ / জানুয়ারি ২০০০ ঢাকা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you