নৃপতি নিরো ও নগরভস্ম

নৃপতি নিরো ও নগরভস্ম

শেয়ার করুন:

রোমান সভ্যতা সম্পর্কে গড়পরতা বাঙালি যথেষ্ট তথ্যাভিজ্ঞ সন্দেহ নাই। ইশকুললাইফ থেকেই বাঙালির ভেতর রোমপ্রেম ও রোম্যান্স গ্রো করতে দেখা যাবে সেকেলে ক্যাচমা কাচ্চাবাচ্চাদের মধ্যে। একেলে ছানাপোনাদের খবরান্তর সম্পর্কে এই নিবন্ধকারের আরেকটু তত্ত্বতালাশ করে পরে বলা লাগবে। এক্ষণে সেই দিগন্তে না-তাকাই। কিন্তু রোমপ্রীতির প্রমাণ তো দেনা লাগেগা সেকেলে সিভিলিয়ানদিগের ভিতর থেকে। একটা হলো ডিটাচড সেন্টেন্সের ট্র্যান্সল্যাশন : রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে; আরেকটা বাংলা প্রায়-বাগধারা, ম্যাক্সিম/অ্যাফোরিজম পর্যায়ের অ্যানেকডোট্যাল : রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। প্রথমোক্তিটা সাক্ষর-অনক্ষর নির্বিশেষেই ইন্সপিরেশন এবং বড় লক্ষ্যের কাজ ক্রমে সমাধা করতে হয় সময় নিয়ে — এই শিক্ষার একটা দৃষ্টান্তমূলক প্রেরণাবাক্য হিশেবে মনে রাখে পাবন্দ থেকে পামর সক্কল বাঙালি। দ্বিতীয়োক্তিটি ঠিক পজিটিভ মিনিং এক্সটেন্ড করে না; কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ, নিরো ফিডলস্ হোয়াইল রোম বার্নস্, ছোটবেলায় ইশকুলে এই ছিন্ন বাক্য মুখস্থ করেছি; দ্বিতীয় স্থলে রোমান জাতির বিশেষ বিপর্যয়লগ্নে সম্রাট নিরোর আর্টকালচার প্রভৃতির প্রতি আশনাই রীতিমতো দায়ী বিবেচনা করা হয়। বেচারা আর্টিস্ট হলে রেহাই মিলত কি না আবহমান এহেন দোষারোপ থেকে, এইটা আজ হলফ করে বলা দুষ্কর। একই দোষে অভিযুক্ত মুঘল সালতানাতের লাস্ট এম্পিরর বাহাদুর শাহ জাফর। অ্যানিওয়ে। এই নিবন্ধনোটে এরচেয়ে বেশি হিস্ট্রি কপচানো দরকার মনে হচ্ছে না আপাতত।

বর্তমানে হ্যাপা আরও অধিক হারে জেঁকে বসেছে এ-বাবতে। একের-পরে-এক অকারেন্স সংঘটিত হবে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে, এইটাই চলিষ্ণু রৌদ্রঝঞ্ঝাময় পৃথিবীপৃষ্ঠের স্বাভাবিকতা বা নিয়তি। চিরকালই তা-ই হয়েছে। এখন শুধু খবরটা আপনার কানের চারিপাশে আপনার চোখের চারিপাশে আপনার নির্জন কুটিরের চারিপাশে আছড়ে পড়ছে ইমিডিয়েট আফটার দ্য অকারেন্স হ্যাপেনিং। পক্ষ-বিপক্ষ ভোট দিতে আপনাকে প্রথমে আহ্বান, পরে গর্দান ধাক্কা এবং তবুও ভোটদানে আপনি বিরত থাকলে আপনাকে মাতান্ত-বাপান্ত গালিগালাজ করে কর্নার্ড করে ফেলার সমস্ত কর্মসূচি সফলভাবে সাঙ্গ করা হয়ে যাচ্ছে ঘটনা সংঘটনের তিন থেকে তেইশ ঘণ্টারও কম সময়ের আল্টিমেটামে। সেল্যুকাস নয়, এইটাই রিয়্যালিটি এখন। বিচিত্র নয়, বাস্তব।

ধরা যাক আপনি বাঁশি বাজাতে বেশ পারদর্শী, প্যাশনেইট বংশীবাদক আপনি, কিন্তু জগতে সেকেন্ডে সেকেন্ডে দেবালয়-মেনকালয়-নিরোক্যাসল পোড়ানো হচ্ছে। এমনকি আপনার একান্ত গুহাকন্দরের মুখাগ্নিও তো সংঘটিত করছে এই রিলোডিং রিয়্যালিটি আনুবীক্ষণিক প্রত্যেক পল-দণ্ড-মুহূর্তে। আপনি নিজেও জানেন না যে-মুহূর্তে আপনি মিয়া-কি-মালহারের একটা তান বিস্তারের রাস্তাটা হাতড়ে পেয়েছেন, সে-মুহূর্তে বামিয়ানে বা ভিয়েতনামে গুজরাটে বা দিল্লিতে একটা-কোনো সংঘটনা সাধন করে ফেলল কোনো ক্রুসেডার বা জেহাদি কি হিন্দুত্ববাদী। এখন করণীয় কোনটা আপনি নির্ধারণ করবেন? বাঁশি চিরতরে ত্যাজিবেন, না আগুনাগ্নি নিয়া গালিবিপ্লবী হবেন? মুহূর্ত মনে করুন না এমন যে আপনি আপনার আরাধ্য কম্মটি সমাধা করার একটা রাস্তা পেয়ে একমনে একাগ্রচিত্তে একুশঘণ্টা বাজনা না-বাজায়ে দেবনাগরী কিংবা শকটচালকের বুলিতে লিরিক্স লিখতে মশগুল। একুশঘণ্টা বাদে উইন্ডো ওপেন করেই উইন্ডশিল্ডে দেখলেন আপনারই নাকে-সিঁকনি-ন্যাজেগোবরে পাড়াপ্রতিবেশীরা আপনার ব্যাপারে রায় দিয়ে ফেলেছে যে একুশঘণ্টা আপনি সভ্যতাবিরোধী ক্রিয়াকাণ্ড করায় লিপ্ততৎপর ছিলেন ইহাতে লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকিতে পারে না। কারণ একুশঘণ্টা উইন্ডোক্লোজড কোনো মনুষ্যপ্রজাতি ইউনিভার্সে বসবাসের হক/অধিকার/এখতিয়ার রাখে না।

আপনি পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। একুশঘণ্টা বাঁশি বাজানোর একটা গিল্টি ফিলিং তো রয়েছেই আপনার ভেতরে ভেতরে, যতই চুপ করে থাকুন বা আমতা আমতা করুন মুখ দিয়া, এর উপর যুক্ত হলো প্রতিবেশীদের উটগ্রীবা-বাড়ানো উদ্ভট দায়দাবির পাশাপাশি ডিক্রি-জারিপূর্বক কৈফিয়ৎ তলব। মন যদি আপনার চায় বাঁশিটিই বাজাইতে, রঙের ঘোড়া দৌড়াইতে, তো বাজাইবেন, তো দৌড়াইবেন, কারো মামুর বাড়িতে নিশ্চয় থাকেন না আপনি, নিজের বাড়িতেই থাকেন, বড়জোর বাপের বাড়িতে, কাজেই মামুর বাড়ির আব্দারে না-পাতিবেন কান।

ঘটনাটা হলো, দুনিয়ার হাউকাউ তো চলতেই থাকবে, থামবে না। আপনাকেও চলতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত সহিসালামতে, থামলে চলবে না। আরাধ্য করাকরি থেকে একটু ছুটি/বিরতি লইবার মওকা আপনার আরও কম। আস্তিক ও নাস্তিক দুই ভায়রাভাই চিরকাল বাঁচিবে, উহারা দুই গোত্রই একগোত্র, বুলন্দ আয়ু নিয়া তারা ‘আইসাছে এই দুনিয়ায়’। কিন্তু আপনার তো রিটার্ন টিকেট, আপনি জানেন নিশ্চয় যে ‘টাইম হইলে যাইতে হইবে / যাওয়া ছাড়া নাই উপায়’, ডিপার্চারের ভেঁপুও উঠিল বাজিয়া প্রায়। এরই মধ্যে চৌরাসিয়া বা পান্নালালের বাদনবিন্দুর পরের একটা বিন্দু যদি আপনি না-আঁকিয়া যাইতে পারেন, তো মরিয়া কান্দিলে তো হবেনানে। হ্যাভেনে যান আর নরকে, হাবিয়ায় কি ফির্দাউসে, সেইখানে যেয়ে তো হট্টগোলওয়ালা কেউই আপনার পক্ষে অ্যাডভোকেইসি করবে না। বাঁশিই ছাড়পত্র আপনার।

খুব হাউকাউ করে গেলেন আপনি, কিন্তু মরার পরে একটাকিছু সলিড লইয়া আপনার উত্তর-নরনারী নিজেদের সম্পত্তি-সম্ভাবনা খানিক আগাইয়া নিতে চাইবে; এই হাউকাউ লইয়া তারা কি করিবে, ভেবেচিন্তে দেখিয়া হাউকাউ করুন।

আজ রাতে আমি অপঘাতে মরে গেলে আগে আমার জানাজায় শরিক হউন, অথবা আমার শ্রাদ্ধ্যকৃত্যে, ফিউনেরালে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। একান্ত অপারগ হলে বড়জোর আফসোস করুন দূর থেকে। কিন্তু মাসির দরদ দেখাইতে যেয়ে দেশসুদ্ধু লোকেরে এহেন হুমকিধামকি দিবার কোনো রাইট আপনার নাই যে এই নিহত নোটক-নিবন্ধকের জন্য সমবেদনা না-দেখাইয়া ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামিয়া প্রমাণ করিতে হইব যে এই নিবন্ধনোটককে আপনি কতল করেন নাই। জগতে রাতারাতি কিচ্ছুটিই হয় না বাপধন, রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে, যারা রাতারাতিবাদী তাদেরে কেন সন্দেহ করা যাবে না তা নাইবা জিগাই। কিন্তু আমার সাক্ষাৎ খুনির পরিবারবর্গও যেন প্রথমত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শামিল হয়, এইখানে আপনি বিপ্লবের বাপঠাকুর্দা বনিয়া বাধা দিবেন না। কারণ সহমর্মিতা যতই প্রাগৈতিহাসিক হোক, মরার পরে ওইটা আমার মুর্দার ও আমার বাঁচিয়া-যাওয়া পরিজনের জন্য জরুর দরকার। আর আমার খুনের বদলা আমি আপনারে নিতে বলি নাই। আপনি আপনার আগাম খুনের বদলা আগাম হাউকাউ দিয়া লইয়া লইতে চাইলে লইয়া জরুর লইবেন, দোহাই আমারে জড়াইবেন না। আপনে আপনার বাপেরে জিগান, খুব কম বয়স হলে জিগান আপনার ঠাকুর্দারে, একটাকিছু বদলা নিতে গেলে কতদিন লাগে মিনিমাম আর কেমন স্ট্র্যাটেজি নিয়া আগাইতে হয়, বর্ণিত দুই প্রজন্মের মধ্যে কেউ-না-কেউ জরুর ওইরকম কিছু বৃহত্তর স্বার্থের কাজ যার যার অবস্থান থেকে এককালে করেছেন। মার্ক জুকার্বার্গ তো আপনার কাজটা সমাধা করে দিয়া যাবে না আব্বু! হঠকারী হইলে তোমার তো হিরোগিরি কনফার্ম, লেকিন তুমি বাদেও যে-দুনিয়া তারে একটা ফাঁপড়ে ফেলে দিয়া যাইবার হক তোমারে কে দিলো?

তুমি কি করতে পারো তবে? এনগেইজড থাকাটা তো সক্কলে যে-ফর্মে এনগেইজড থাকছে সে-ফর্মেই থাকতে হবে তা না। সারাক্ষণ থাকছ এবং সর্বত্র থাকছ — বস্তুত কোথাও থাকছ না। প্রাকৃতিক রীতিবিরুদ্ধ সর্বত্র সর্বক্ষণ সমভাবে থাকা। কাব্যিক শোনালেও অবাস্তব-অবৈজ্ঞানিক অতন্দ্র প্রহরী জিন্দেগিভর। সম্ভবই না। আর এনগেইজড থাকার এই বিকট স্ট্যাটাস সিম্বল থেকে বেরোতে না-পারলে কেমনে তুমি নাকের সিঁকনি চোখের কেতুরি ইরেইজ করবা তা-ও তো মালুম হয়নাকো। তুমি যা করছ, তা-ই করতে থাকো। সবাই যা করছে তা তোমারে নতুন করে না-করলেও চলবে। স্ট্যাটাস আপডেট এক্সপ্রেসের লোলজিহ্বা খানিক কন্ট্রোল করো, ওতেই দেখবা রাজনৈতিকভাবে তুমি ভালো সিগ্নিফিক্যান্স কন্ট্রিবিউট করতে পারছ। অতি-তৎপরতা মানেই হলো তুমি একটা রামপাঁঠা। এনগেইজড থাকা আর থাকানোর এই স্পোর্টসগ্রাউন্ডে এ-বিশ্ব লয়ে হে বিরাট শিশু তুমি না-বুঝেই খেলিছ অযথা হাউকাউমনে। বেফায়দা। বারোটা বাজাচ্ছ যা হতে পারত তোমার হৈদরি-হাঁক ছাড়া আপনাআপনি মানুষের স্যলিডারিটি থেকে। তোমার হিরোপনা মানুষগুলোর — দুঃস্থদুর্গতগুলোর — কোনো আমড়া কাজে তো লাগছেই না, গ্রামবাসীরে তুমি আঁখিয়াল বাঁশদণ্ডের আগায় গেঁথে রেখে যাইছ পদে পদে।

এখন একবার মনে করে দেখো তো ওই টাইট্যানিক  ম্যুভিটার কথা। ফাজিলের ফাজিল, ওইটা না, জ্যাক যখন সোফায় রোজ বেগমকে বেদম আঁকছিল ওই সিনের কথা বলছি না, বা ওই জিপের ভিতর আশ্লেষে নিঃশ্বাসকুয়াশার মধুর মেদুর ঋতুরঙিন শিল্পপ্রয়াস ওইটাও নয় রে হতচ্ছাড়া! ভায়োলিনবাদকদলটির দৃশ্য ও ভূমিকার কথা মনে করাতে চাইছি। কিংবা নয় কেন নিরোর ভূমিকা? রাজকার্য নিরো সুচারু সম্পাদন করতে পারত না, বাঁশিকার্য দুর্ধর্ষভাবেই তো পারত, নিরোর বাঁশি যেভাবেই হোক আজও তো মানুষের কাজে লাগছে, নেতি তুলনা হলেও কাজে লাগছে তো! ধরো তুমি যে এখন সবাই যদি জাহাজ চালাইতে লেগে যায়, বেহালাওয়ালা সেও, কবরীর প্রেমে অন্ধকার সক্কলে যদি সারেং হইতে নামে, কী ম্যাস্যাকারটাই-না ঘটে! সেইটাই ঘটছে। কিচ্ছু করার নাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর আল্লা আল্লা করা ছাড়া। টাইট্যানিক  ডোবানো হয়তো বন্ধ করা যায় নাই, কিন্তু বেহালাবাজিয়েরা যদি নিজেদের হাতিয়ার ফেলে বেলচা মেরে কয়লা ফালাইতে যেত অথবা যাইত হুইলের হাতলে ঝুলে থেকে কাপ্তেন হইতে, বিপর্যয় কী কম হতো না বেশি?

নিরোবংশী নিগৃহীত কেন মনুষ্য সভ্যতায়, এর সঙ্গে একটা কাণ্ড রিলেট করে ভাবা যায় হয়তো। পরে আসছি আবার এইদিকটায়।

 

নিরোবংশী, হিস্টোরি, রিউম্যর ও অন্যান্য

নগর পুড়ানোর অপকর্মটির সঙ্গে খোদ নিরোর যোগসাজশ রয়েছে কি না, তা নিয়া আজও পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিবিভক্তি বিদ্যমান। অগ্নিসংযোগ নিরো স্বহস্তেই স্বীয় সিদ্ধান্তেই করেছিলেন, এই মর্মে যেমন যথেষ্ট ঐতিহাসিক কথাবার্তা-চাপানউতর-গল্পগাছা আছে, তেমনি নিরোর অর্ডারেই একদল লোক আগুনটা লাগায়েছিল এবং দমকলকর্মের পরিবর্তে সেই রাজার সেপাই লোকেদেরে দেখা গেছে ইয়াব্বড় পাখা দিয়া হাওয়া চাগায়া আগুন তাতাতে। কেন করছে এমন অদ্ভুত কাণ্ড, নগরবাসীদের হেন প্রশ্নের উত্তরে তারা ধাতব গলায় কেবল বলেছে যে তাদের ওপর হুকুম রয়েছে এবং তারা তা তামিল করছে। এইসব যেমন আছে ইতিহাসের আখ্যানভাগে, তেমনি ইন্টার্প্রিটেশন আছে একেবারেই ভিন্নমতের। এতদবিষয়ে পরে আসা যাক।

ছয়দিন সাতরাত ধরে একটানা দাউদাউ পুড়েছে নগর। ঘটনাকাল সিক্সটিফোর অ্যাডি। নির্বাপিত হবার পরে দেখা গেল সত্তর শতাংশ অফ দি সিটি হ্যাড বিন ডেস্ট্রোয়েড। রোম নগরীতে জেলা ছিল চোদ্দটা, তার থেকে চারটি ডিস্ট্রিক্ট মোটামুটি ইন্ট্যাক্ট রইল, ভূমিস্যাৎ হয়ে গেল গোটা তিন। সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। অন্য সাতটা ধ্বংসস্তূপের দূঃস্বপ্ন নিয়া আগুনগন্ধী নিঃশ্বাসপাত করছিল নগরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত। তখনকার শুমারি অনুযায়ী মিলিয়ন পপুলেশনের নগরীটির অর্ধেক লোক বাস্তুহারা হয়ে পড়ে এর ইমিডিয়েট অ্যাডভার্স এফেক্ট হিশেবে।

এহেন ভয়াবহতার পরে অ্যানশিয়েন্ট নগরীটির বিপুলসংখ্যক লোকে প্যারানোইয়্যাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সন্দেহ-দোষারোপন প্রভৃতি বিচিত্রবীর্যা বাতিক গ্রো করে লোকেদের মধ্যে। এত বড় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক বলে মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভবও হচ্ছিল না। তাদের পক্ষে তাই স্বাভাবিক ছিল দোষী নিয়া জল্পনা চালানো। বহুদিন জল্পনা চলেছে, প্যারানোইয়্যার জের বহুদিন বজায় থেকেছে, এমনকি আজও বস্তুনিষ্ঠ সুরাহা হয়নি জল্পনাকল্পনার। আজ এদ্দুর এসে ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং ফলানুবর্তন সম্ভবও না।

আমাদের এখানকার এবং বিশেষভাবে এখনকার পরিস্থিতি কতকটা তা-ই। কিচ্ছুটি ন্যাচারাল বিবেচনা করা আমাদের পক্ষে যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছে দিন-কে-দিন। সবকিছুতে, এমনকি নিরীহ স্বভাবসত্যটাও, যেন সন্দেহ করা আজিকার একমাত্র কথা এবং কিছুতেই কিছু আমরা মানতে চাইছি না বা পারাও যাচ্ছে না মান্য করা। ন্যাচারাল ডেথটাও সন্দেহের চোখে দেখছি আমরা। বাধ্য হচ্ছি সন্দেহনয়নে দুনিয়া দর্শিতে। এক-বাদে-এক আমাদের এথিক্স উবে যাচ্ছে, সেন্টার ফর এক্সিলেন্সগুলো ভস্মীভূত, থিংস ফলিং অ্যাপার্ট। কাজেই কিছু করার থাকছে না আক্রোশ-আস্ফালন আর সন্দেহফর্দ বর্ধিতকরণ ছাড়া। প্যারানোইয়্যাক্রান্ত না-হবার তো কোনো বৈজ্ঞানিক গ্রাউন্ড দেখি না। আর সন্দেহের অ্যারো সবসময় ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার স্বজন-পরিজনের দিকে যেমনটা ধাবিত হয়, জনসমষ্টি তার সন্দেহ সবসময় রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের দিকেই তাক করবে ন্যাচারালি। সবসময় এইটা আদৌ ফেলনা সাস্পিশন নয়। অ্যাসাঞ্জ বা তার উইকিলিক্স তো ওই নিরোযুগে ছিল না, থাকলে জনসমষ্টির জল্পনাকল্পনা এভিডেন্স পেয়ে যেত অচিরে। রোমডুয়েলার সিটিজেন্স ব্লেইমড দ্যায়ার এম্পিরর নিরো। অথেন্টিক্যালিই, আই সাপোজ।

অনেকদিন ধরেই নিরো পরিকল্পনা শানাচ্ছিলেন নগরীটা আপন নন্দনকল্পিত পৌরসজ্জায় রিবিল্ডাপ করবেন। নিউ স্টাইল, একেবারেই নিউ আর্কিটেকচার এস্তেমাল করবেন নবকলেবর রোম গঠনকালে। কেবল একটা কারণে এইটা বাধা পাচ্ছিল, কারণটা দ্য সিটি রোম হারসেল্ফ। শক্তপোক্ত শহরস্থাপত্য সহসা ভাঙবেও না, রাজার ড্রিম ম্যাটেরিয়্যালাইজ করা ব্যাহত হতেই থাকবে। এত তর কেন সইবে নিরোর! অতএব দে নগরীর পাছায় আগুন ধরায়ে লেলিহান, সম্রাটের স্বপ্ন হোক সত্যি! ইন দ্য লাস্ট সেঞ্চুরি ডিক্টেটর এরশাদ এই কীর্তিটাই করেছিলেন গগলস পরার শখ মেটাতে যেয়ে নির্বিচারে রাস্তাগাছগুলো কেটে উপাড়ি নিয়ে  খেজুর প্রোজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট করতে দ্রুত। পরবর্তীকালে, কালান্তরে, এরশাদ-বাৎলানো পথে এবং পন্থায় দেশ দূষিত হয়েছে দফায় দফায় ভিন্ন ভিন্ন ক্যুয়িন ও কোর্টজেস্টারদের হাতে, হয়েছে দেশ ও দশজনায় বিদীর্ণ।

তো, নিরো ওই কীর্তিখানা করে থাকতে পারেন বৈকি, অ্যাজ অ্যান এক্সকিউজ ফর নিউ কন্সট্রাকশন। খুবই সম্ভব, মোটেই বিচিত্র নয় নিরো ক্যারেক্টারের পক্ষে। নিরো ওয়াজ আনকোয়েশ্চন্যাবলি ক্রুয়েল। নিরোর ন্যায় একদম ম্যাড টাইরান্ট শাসকের পক্ষে এইটা আনবিলিভ্যাবল কোনো বিহেইভিয়্যর না। আদৌ সত্যি হোক অথবা মিথ্যা, আগুনপর্বের পরে যে-ঘটনাগুলো ঘটে সেগুলো তো অসত্য নয়। সেইসব ক্রুয়েল্টি হিস্টোরি বিস্মৃত হয় নাই। রিউম্যরতাড়িত সম্রাট অভিযোগের তর্জনী থেকে রেহাই পেতে স্কেইপগোট সার্চ করতে থাকেন মরিয়া হয়ে। এবং ঝাপ্টা যায় সে-যাত্রা ক্রিশ্চিয়ানদের উপর দিয়া। পার্সিকিউট করেন তিনি ক্রিশ্চিয়ানদেরকে রুথলেসলি, এক্সিকিউট করেন বিচিত্র বীভৎস দণ্ড, টর্চার চালানো হয় বিকট সমস্ত তরিকায়। এতকিছু করেও প্রজার সন্দেহভ্রুকূটি রিমেইন আনচেইঞ্জড, হায়! প্রজাপটানো শত কসরতের পরেও নিরো স্টিল ফাউন্ড হিমসেল্ফ ব্লেইমড ফর দ্য ফায়ার।

পক্ষ-বিপক্ষ ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ-প্রতর্কের পরেও অপরিবর্তিত রয়ে যায় এই চিন্তাটা পাব্লিকের মনে ইভেন টু দিজ ডেইজ যে বেহালা বাজাচ্ছিলেন নিরো যখন কিনা তার আপন রাষ্ট্রের নগরসমূহ ও দেবালয় বেবাক পুড়ছিল লকলকে লেলিহান ছয়দিন সাতরাত ধরে একটানা বিরতিবিহীন। পাব্লিকের মন থেকে এই ইমেইজ/আইডিয়া/ধারণাটা ইরেইজ করা আজও সম্ভব হলো না তো! হোয়াই?

 

বেহালাবাদক নিরো ও অন্যান্য অর্ধপ্রসঙ্গ

বাংলায় বেহালা না, বাঁশি বাদ্যযন্ত্রটি নিরোপ্রবচনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বেহালা আছে ইংরেজি লিখিত ইতিহাসপৃষ্ঠায়, ফ্ল্যুট কিংবা বাঁশি নয়, ফিডল তথা বাংলায় বেহালা। আমাদের মনে পড়ে যাবে সেই মিউজিক্যাল অপেরা ম্যুভিটির অনবদ্য আখ্যান ও গান ও দুর্দান্ত সব দৃশ্যমালা, ম্যুভিটির নাম ফিডলার অন দ্য রুফ । বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার কন্টেক্সট দেখানো হয়েছে সিনেমায়, ইম্পেরিয়্যাল রুশ ব্যাকগ্রাউন্ড দেখানো হয়েছে সিনেমার সেটিংস হিশেবে, একদম বিশ-শতকের গোড়ার দিকটায় এর কাহিনি আবর্তিত। ব্রডওয়ে অপেরা প্রোডাকশন হিশেবে এটি সিক্সটিজের শুরুতে স্টেজে ওঠানো হয়, সিনেমা হয় আরও অনেক পরে যেয়ে। এত সুন্দর ম্যুভি কমই দেখা যাবে যা কিনা অপেরা ফর্ম বেইস করে বানানো হলেও সোজাসাপ্টা আখ্যানবর্ণনার ক্ষেত্রে একশভাগ সিনেম্যাটিক। আমাদের যেমনটি গীতিনৃত্যনাট্য, অনেকটা সেই-রকম গানে গানে গল্প আগায়েছে। এখানে বেহালা, মানে বেহালা বাজায়া গান গাওয়া, আগাগোড়া সিনেমাটাকে পেইস দিয়েছে। অ্যানিওয়ে। সিনেমার কথা হচ্ছে না এইখানে, কথা হচ্ছে নিরোর, কথা হচ্ছে ক্রান্তিকালে লিডারের, বেহালা প্রসঙ্গে এটুকু শুধু উৎক্ষেপ-কথা। আর এই সিনেমার সঙ্গে নিরোর কোনো যোগসূত্র নাই, না কাহিনিগত সাদৃশ্য, না ইতিহাসব্যঞ্জনাগত দূর-সংযোগ।

কথা হচ্ছে, বেহালার স্থলে কেমন করে বাঁশি যন্ত্রটা চালু হলো ওই প্রবাদপ্রতিম লোকোক্তিটির সঙ্গে? একটা কারণ হতে পারে যে, বাংলায় বেহালার চেয়ে বাঁশিটাই বেশি ব্যবহৃত লোকবাদ্যযন্ত্র এবং সহুজে। একটা আরেক কারণ, মনে হয় এইটাই কারণ, বাংলায় বাহিত হবার কালে বেহালার স্থলে বাঁশিই ছন্দসুগম হয়েছে এবং মাত্রাগত সৌসাম্য পেয়েছে। রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল — কথাটা বাংলায় এ-ই। কিন্তু যদি বলা হতো : রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিল — কথাটা কেমন গদ্যমতো শোনাত। মনে হয় এসব। তবে এই ডিসপ্লেইসমেন্ট, বেহালাস্থলে বাঁশি রিপ্লেইসমেন্ট, ইন্ট্রেস্টিং। ভুল অনুবাদ, ভুল ভাষান্তর, নট নেসেসারিলি এভাবে দেখতে হবে। একটা তথ্যচ্যুতি নিশ্চয়।

নিরোর রাজত্বকালে এক ঐতিহাসিক যার নাম টেইসিটাস, যিনি ওই অগ্নিবিপর্যয়কালে ছিলেন বছর-দশের বালক, তারই বয়ানে সেই-সময়ের বিবরণী লিপিধৃত হয়েছে ইতিহাসে পরবর্তীকালে। অগ্নিকাণ্ডকালে বালক টেইসিটাস রোম নগরীতেই ছিলেন। অগ্নিকাণ্ড স্বচক্ষে দেখেছেন। টেইসিটাস নিজেও দ্বৈধ দেখায়েছেন সরাসরি নিরোর যুক্ততার ব্যাপারে। অ্যান্টিয়ামে নিজের প্যালেসে ছিলেন নিরো, অগ্নিসংবাদ পেয়ে ইমিডিয়েইটলি রিলিফ পাঠায়েছেন হিউজ অ্যামাউন্ট অফ, নিজে কালবিলম্ব না-করে গেছেন ছুটে অকুস্থল পরিদর্শনে। এইসব জানিয়েছেন টেইসিটাস। কিন্তু লোকদেখানো দরদও হতে পারে এসব। কুম্ভীরাশ্রু হওয়া আদৌ বিচিত্র নয়। ক্যালিগুলা বা নিরো প্রভৃতি বিটকেলে রাজাদের যেই নিষ্ঠুরতা আর ক্রূর কৌটিল্যের পরিচয় আমরা জানি, তাতে এরা মাছের মায়ের কান্না ছাড়া আর-কিছু জানত বলে ভরসা রাখা যাবে অল্পই।

নিরোর সময়ে বেহালা বাদ্যযন্ত্রটা আদতে ছিলই না মানবসভ্যতায়। এইটা হিস্টোরিক্যাল ফ্যাক্ট। কিন্তু নিরো একটা বাদ্য খুব বাজাতেন বটে, সেইটা তারযন্ত্রই, স্ট্রিংবহুল একটা ইনস্ট্রুমেন্ট, অনুমান করা যায় বেহালারই প্রিমিটিভ ভার্শন। যন্ত্রটার নাম জানা যাচ্ছে সিথ্যারা। টেইসিটাস ছাড়াও সমস্ত রোম্যান হিস্টোরিয়্যান জানাচ্ছেন যে নিরোর ছিল সিথ্যারার প্রতি রীতিমতো প্যাশন। নতুন কোনো রাজ্য অধিকৃত করার অব্যবহিত পরেই নিরো প্রতিযোগ আহ্বান করতেন সেই নবাধিকৃত ভূখণ্ডে সিথ্যারা বাজাবার। সেইসব ফেস্টিভ ইভেন্ট চলাকালীন নিরো ইমোশন্যালি ভীষণ ইনভলভড থাকতেন সিথ্যারা বাজানোর সঙ্গে। তিনি মনে মনে এইটা চাইতেন যে সকলে ধন্য ধন্য রব তুলুক দিকে দিকে তার বাজনার। এইটা আমরা আধুনিক যুগের খতরনক শাসকদের মধ্যেও দেখতে পাবো যে এরা সাংস্কৃতিক কোনো-না-কোনো কর্মকাণ্ডে শ্রেষ্ঠতা কামনা করছে মনে মনে। এরশাদের কবিতাপ্রীতি, ক্লিন্টনের স্যাক্সোফোনপ্রণয় কিংবা বুশের পেইন্টিং এক্সিবিশন ইত্যাদি উদাহরণ টানা যায়। অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন। মিউজিক্যাল কম্পিটিশনের প্রতি নিরোর আদেখলামো তার পার্ষদ-রাইভ্যালদের মধ্যে বিরক্তিবিতৃষ্ণা জাগায়েছিল সংগত কারণেই।

আরেকটা ইন্টার্প্রিটেশন আছে এ-সম্পর্কিত। বলা হচ্ছে, এইটা মেটাফর হতে পারে নিরোর রাজ্যশাসনজনিত কদর্যতা আর ব্যর্থতার। নিরোর অপদার্থতা, যেমন অপদার্থ দেখা যাবে ক্যালিগুলাকেও, তার প্রতিপক্ষকে এই রিউম্যর ছড়াতে ক্রিয়াশীল করিয়া থাকতে পারে বলে মনে করা যায়। ইউজলেস বা মিসগাইডেড ফালতু ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা বুঝাইতে যেয়ে বাঁশি বা বেহালা রূপকার্থে এসে থাকতে পারে এখানে। অগ্নিকাণ্ডকালে যা করার তা না-করে আকাম্মা কাজে ক্ষেপণ করেছেন সময় ভুল মন্ত্রণায় কিংবা স্বকপোলকল্পিত পরিকল্পনায়। এটি নিরোর মতন সম্রাটের ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। সত্যি সত্যি ফিজিক্যালি ওই সময়টায় বেহালা/বাঁশি/বাদ্যরসে নিরো মশগুল না-ও থাকতে পারেন। তো, এই ইন্টার্প্রিটেশন সত্যি হলে একটা ব্যাপার পরিস্কার হয় অন দ্য কন্ট্র্যারি যে প্রোপ্যাগ্যান্ডার শক্তি কী বিভীষণ! দুইহাজার বছরেরও অধিক কাল ধরে একটা প্রোপ্যাগ্যান্ডা কাজ করে যায় একটা মানবসভ্যতায়!

নিরোর জন্য যদি বিষয়টা প্রোপ্যাগ্যান্ডাও হয়, তবু স্যরি ফিল করার কিছু নাই। নিরো হ্যাজ অ্যা ওয়েল-ডক্যুমেন্টেড হিস্টোরি অফ ব্রুট্যালিটি। নিরোর মা তার পিতৃব্যকে হত্যা করেন সিংহাসনলোভে এবং মসনদে আরোহন করেন স্বয়ং নিরো সম্রাট হিশেবে। এরপর সিংহাসন গ্রহণ করেই নিরো আপন মাকেও কতল করেন। অসংখ্য অবর্ণনীয় হত্যা আর নৃশংসতার ঘটনায় আবিল নিরোর গোটা শাসনকাল। বলা হয়ে থাকে যে নিজের মর্জিমাফিক পৌরপরিকল্পনায় নগর গড়ে তোলার বিলাসী আকাঙ্ক্ষায় নিরো রোম পুড়িয়েছিলেন। কতশত উদ্ভট হিংসাকাণ্ড! অগ্নিকাণ্ড তন্মধ্যে একটা মাত্র। আল্টিমেইটলি এই অগ্নিকাণ্ডঘটনাই নিরোকে গদিচ্যুত করার কাজটায় স্পিড সঞ্চার ঘটায়। নিজের সেনাসামন্তরাই বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে মহামহিম সম্রাটের। হি ওয়াজ ডিক্লেয়ার্ড অ্যা পাব্লিক এনিমি বাই দি সিনেট। স্বহস্তে স্বীয় কণ্ঠনালিতে ড্যাগার ঢুকিয়ে সেই অগ্নিকাণ্ডের চার-বছরের মাথায় বিচারকার্য চলাকালে নিরো আত্মজীবনের ইতি টানেন।

সংক্ষেপে এইটুকু অপ্রসঙ্গের ইতিহাস। এইবার প্রসঙ্গে ফেরা যাবে কি? লেট’স্ সি। কিংবা, আরেকটু আগায়া, ইফ নেসেসারি টু, আমরা হয়তো অপ্রসঙ্গালাপ পুনরায় ফেঁদে উঠতেও পারি।

 

নিরোকাহিনি, নিত্যবৃত্ত বর্তমান ও তদানুষঙ্গিক

সেই-যে এক রাখালের গল্প যেখানে চাতুরি করে সে লোকেরে ডেকে বলত যে বাঘ ওই আসছে তেড়ে এবং তারে খেয়ে ফেলতে উদ্যত, লোকে তাদের সাতকাজ ফেলে একবার দুইবার তিনবার সহমর্মিতা জানায়া তার পাশে এসে দাঁড়ায় হেল্প করতে এবং ফাইন্যালি সকলেই বুঝে ফেলে এই সবটাই রাখালের মিথ্যাচার, তারপর সত্যি সত্যি তারে খেয়ে ফেলে একদিন বাস্তবের বাঘে। এই স্টোরি জানে না বাংলায় হেন জনগণ নাই। গল্পের মোরাল বা বোধি এইখানেই যে সবকিছু নিয়া ফাইজলামি করতে নেই। বৃত্তের ভেতরে, চেনাজানা ইয়ার-বখশির ভেতরে, ফাইজলামি চালানো চলতে পারে এন্ডলেস। কিন্তু সর্বসমক্ষে ফাইজলামি বিপজ্জনক। কথাটা নীতিবাগিশ শোনালেও ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন এর বেদন। নিরো রাজপাট সামলানোর ডিউটিতে বসে বেহালা হোক আর সিথ্যারা হোক অথবা বাঁশি বাজাচ্ছিলেন বেদম, অগ্নিকাণ্ডটি তিনি নিজে সংঘটন করুন অথবা অন্যে যে-ই করুক ব্যাপারটা সংঘটিত হয়েছিল তাতে একরত্তি মিথ্যা নাই। মিথ্যাচার এইখানেই তিনি করেছিলেন, অথবা অভিনয়, বাজনা তার কাজ ছিল না বাজানো তবু ক্ষমতারাঙানি দিয়াই তিনি ফিডলার বা শখিনদার বাদক হইতে চেয়েছেন। রাজপাটের, প্রজাকল্যাণের, বারোটা-বাজানো বাজনদার হয়েছেনও বটে। এই ব্যাপারটা নিয়া খানিক ভাবা যাক।

প্রথমে প্লেটোর কথাটা মাথায় রাখব প্রসঙ্গত। কবি-বিতাড়নের একটা বদনাম নিয়ে প্লেটো মোটামুটি হাজার বছরের ফেরারি। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে একটা আদর্শ রাষ্ট্রে যেন কবিকে না-রাখা হয়। এরা বারোটা বাজায় রাজকার্যের। এ-ই ছিল উপরিতল থেকে দেখতে গেলে প্লেটোপ্রস্তাবে একটা শর্ত অফ অ্যান আইডিয়্যাল রিপাব্লিক। ঘটনা হলো, আক্ষরিক অর্থে না-দেখে প্লেটোকথাটাকে একটু রূপক হিশেবে দেখলে এর একটা প্রাসঙ্গিকতা এখানে প্রতিপন্ন করা যাবে। এরশাদ বা নিরো বা ক্লিন্টনফ্লিন্টন বুশফুশ হিটলারফিটলার সম্রাট হয়েছে বলে একটু সঙ সাজতে পারবে না তা তো নয়। নিশ্চয় পারবে, পারা মানবিক কারণেই উচিত। ভূমিকাটা পাল্টে নিতে হবে শুধু। কবিতাকার্যে থেকে একজন কোনোভাবেই রাজকার্য পরিচালনা করতে পারবে না, অ্যাট দ্য সেইম টাইম রাজকার্যরত কেউ কবিতাকার্যের বোকামো/দুঃসাহস না-করে যেন। সবই তখন ন্যাজেগোবরে হবেই হবে। এই জিনিশটাই ইদানীং লক্ষ না-করলেও গোচরীভূত হবে আমাদের সোশ্যাল প্রকাশপরিসরগুলোতে। হেঁয়ালি করতে গেলেও তো হিম্মৎ লাগে। এইটা একটা অ্যাডভ্যান্সড লেভেলের ওয়ে অফ এক্সপ্রেশন। যোগি জিন্দেগির পয়লা তাঁতযন্ত্রে বসেই শিক্ষা নাই দীক্ষা নাই কিন্তু জামদানি বুনতে লেগে গেলেন। সম্ভব? রক্তে নাই জোলাগিরির ছিঁটেফোঁটা, আপনি নিজেরে তাঁতি সম্প্রদায়ের তালেবর ভেবে বগল বাজাইতে লাগলেন, স্ট্যাটাসে-স্ট্যাটাসে তাঁতিদুঃখে অতিশয় কাতর বিদ্যাপতির পদাবলি ঝরাইতে লাগলেন অঝোর উলুবনে — এইটা ন্যায্য হইল? জোলাদের জীবন এমনিতেই কোনাঘেঁষা, আরও কোণঠাসা করে দিলেন বেচারাদিগেরে, আপনি নিজেই জামদানিমিস্ত্রী হয়ে বয়নশিল্পের দফারফা করে পেরেক ঠুকে চলেছেন একের-পরে-এক। এর এফেক্ট, সাইড এফেক্ট এবং ফ্রন্ট এফেক্ট, মোদ্দা কথায় অ্যাডভার্স এফেক্ট, সাংঘাতিক সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে আমাদিগেরে।

ধরা যাক আপনি মোটের ওপর পলিটিক্স-ওরিয়েন্টেড একটা মানুষ। অর্গ্যানাইজ করতে পারেন, মোবিলাইজ করতে পারেন, ইশ্যু ইত্যাদির মেরিট বুঝে প্রম্পট ডিসিশন মেইক করতে আপনি সিদ্ধহস্ত। হঠাৎ কুক্ষণে আপনার মনে হলো, জনপ্রিয় হতে গেলে কাগের-ঠ্যাং বগের-ঠ্যাং যা-হোক কিছু লিখে পোস্ট দিলেই তো মশহুর। সেলেব্রিটি হওয়াটা মাস্ট — কয়েক সেকেন্ড এমনকি ক্ষেত্রনির্বিশেষে কয়েক দিনের জন্য হলেও। ওয়েল, দৃশ্যত সুনীল সত্য বটে, প্রকৃত প্রস্তাবে একটি বিনয়ী কুহক রয়েছে এইখানে। সেইটা আরেকটু সময় নিয়ে এলিয়ে-ছড়িয়ে চেষ্টা করা যাবে বলার। ব্যাপারটা তো কোডব্রেকিং অনেকটা। যে-কোনোকিছু বোঝা এবং বুঝে বা এমনকি না-বুঝে লেখার ব্যাপারটা। ডিসাইফার তো হরেদরে বেকুবগিরি ক্রিয়াকাণ্ড করার প্রত্যয় না। সঙ্কেতায়ন আর বিসঙ্কেতায়নের অনিঃশেষ ক্রীড়াশৃঙ্খল হচ্ছে এই লিখালিখি-শিল্পানুশীলন। কোডেড দুনিয়াটা আপনি ডিকোড করবেন, এবং ভাইস-ভার্সা, ডিকোডেড জগতেরে একটা কোডে গেঁথে তুলবেন। এই ডিউটি এবং রেস্পোন্সিবিলিটি আপনি যদি মনে রাখেন, তো সুবিধে-যে কেমন, তা বলছি একটু পরে। এই ডিউটি বিস্মৃত হলে মহাভারতের কোন পরিচ্ছেদটায় কি কি বিভ্রাট ঘটে সেসবও বলতে একবার উদ্যত হওয়া যাবে। একটু পরে। নেক্সট কোনো অনুচ্ছেদে।

 

নিরোস্টোরি রিলোডেড

অনুমান করতে পারি জীবনানন্দ রূপসী বাংলা  কাব্যের অসমপঙক্তিক অত্যাশ্চর্য সনেটগুলো রচিয়া না-ছাপায়ে কেন কুলুঙ্গিতে লুকায়ে রেখেছিলেন। শুধু-যে লুকায়েই রেখেছিলেন তা তো নয়, সেগুলো  নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্যও করেন নাই বলিয়া আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু সঙ্গে এ-ও জানি, এবং অত্যন্ত তাৎপর্যবহ এই অবগতি, তিনি কবিতামালাটার ধারক খাতার মলাটপাতায় লিখে রেখেছিলেন এর সম্ভাব্য অন্য-একটা নাম : বাংলার ত্রস্ত নীলিমা ! ছেপে যদি বেরোত তখন, অনেকেই মনে করেন, তবে বাংলা ল্যাবগ্যাবে কবিতার চেহারাসুরত ও গমনপথ হয়তো অনেক আগে থেকেই ভিন্ন অভাবিত উদ্দেশ এদ্দিনে পেত। মন্দ নয় নিশ্চয় এতাবধি বাংলা কাব্যসমুদ্রিকা, তা ভালোই চিত্রল-কল্পিল, বাংলার ত্রস্ত নীলিমা  বা  রূপসী বাংলা   ট্রাঙ্কে-লুকানো না থেকে ঠিক ইমিডিয়েইট রচনান্তেই প্রকাশিত হলে আরেকটু অগ্রভাগে এর তথা আধুনিক বাংলা কাব্যের সংগতি মিলিত। অন্তত সমগ্রত সহজিয়ানা যারা আরাধ্য বলিয়া ভাবেন, তারা খানিক দাঁড়াদিশা লাভ করতেন পূর্বাহ্নেই। নিরোবংশী নিরস্ত করেছে বেচারি জীবনদাশেরে, এইটা আন্দাজ সম্পূর্ণত। অমূলক মনে হবে না কারো কারো কাছে, এটুকু আশা করাই তো যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তৎপূর্ব-তদুত্তর মন্দা, দাঙ্গা, মন্বন্তর, ভূখণ্ডভাগাভাগি, হিংসাবাতাস, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি ছিল তখন তুঙ্গ; আমরা জানি, ইতিহাস পড়ে জানি, না-পড়ে রক্তের ভেতরে এক অনির্দেশ্য ইশারার বদৌলতে ঢের বেশি জানি। জীবনানন্দ ওই সময়ের জাতক। ফ্রাস্ট্রেশন ছিল চতুর্দিকে রোদ্দুরের মতন উঠোন-ছড়ানো, পরিপ্লাবিত হতাশার নির্জীবন-নৈস্তেজ পরিব্যাপ্ত চতুর্ধারে। সেন্সেশনই ছিল, অন্তত ওই তিরিশিদের, অনেকটা ফ্রাস্ট্রেশন উপজীব্য করে লেখালেখি। মিছিল ছিল, ভূখা বা উদরভরন্ত মনুষ্যমিছিল, অদ্যকার ন্যায় ছিল তখনও নিখিল নাস্তি নিয়া কাব্যচর্চা। আলাদা ছিল বলা যাবে না আজকের তুলনায় সেদিনের পরিস্থিতি। ছিল বুদ্ধি ঠেঁসে কবিতানুশীলন। ছিল বিশুষ্ক বিদ্যাজাহাজ ভরিয়া বাগ্মিতার আর পিড্যান্ট্রির পরিচর্যা কাব্য ও অন্যান্য সাহিত্যানুশীলনে। তেমন কম অনর্থ ছিল না আজকের সঙ্গে তুল্যমূল্য করে দেখলে।

সেই-সময় বেলা অবেলা কালবেলা  লিখছেন জীবনানন্দ, প্রতিবেদিত হচ্ছে তারই হাত দিয়া সাতটি তারার তিমির, মহাপৃথিবীর বয়ান হাজির করছেন আমাদের সামনে। এরই পাশাপাশি লিখছেন রূপসী বাংলা  কাব্যস্তোত্রগুলো, অথচ প্রকাশ করতে নিস্পৃহ রইছেন এই কবিতারাজ্য ও অগ্রন্থিত-তখনোবধি সিমিলার ধারার অজস্র অবিরল কবিতা। বনলতা সেন  অন্তর্ভূত কবিতারাজি তখন-তখনই রিলিজ হচ্ছে; এইসব রোম্যান্তিক কবিতা ছাপছেন কিন্তু রূপসী বাংলা  নয়, কেন? এই খটকা জ্ঞাপন ও উত্তর খোঁজার ভেতরেই নিহিত তখনকার সৃজনজগতে এখনকারই ন্যায় কিছু অচলায়তন অনড় হয়ে থেকেছিল চৈতন্যচিন্তারাজ্যে। নিরোবংশীর, শুদ্ধ অর্থে বেহালার, শাসন-ডমিনেশনজাত অচলতা।

বা, তার কথাসাহিত্যের বিপুল বিস্তারের কথাটাই ভাবা যাক। ছাপতে দেয়া তো দূর, ঘুণাক্ষরে এমনকি নিকটজনকেও বুঝতে দেননি যে তিনি ‘গল্পটল্প’/‘উপন্যাসটুপন্যাস’ প্রভৃতিও সমহস্তে সিদ্ধ চর্যায় লেখেন। ধরা পড়ে অকালমৃত্যুর পরে। এমন অনেক সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, বাঘা বাঘা যারা তাদের মধ্যে উল্লেখ্য সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যারা মনে করতেন জীবনানন্দের গল্পোপন্যাস সময়মতো প্রকাশিত হতো যদি তো গত ষাট-সত্তর বছর ধরে বাংলা কথা/কবিতাসাহিত্যের উচ্চতা আরেকটু পূর্ণায়ত পোক্ত হয়ে যেত। সন্দীপনের গদ্যে এমনটা আক্ষেপ ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। বিশেষত সন্দীপনের আনএডিটেড-আনকাট ডায়েরিটি খুঁজে এ-কথার সমর্থনে একের-পরে-এক এন্ট্রি বের করে দেখানো যাবে।

কেন এই দোলাচল, দ্বৈধ অমনধারা, হোয়াই? কি ছিল রূপসী বাংলায়, কি ছিল গল্পোপন্যাসগুলোতে, যে-কারণে এত অস্বস্তি বোধ করেছেন প্রকাশিতে? এর সঙ্গে নিরোবংশী কিংবা বাঁশিসঞ্জাত অগ্নিস্মৃতির বদনামজনিত ভয়ের/লোকশাসনলজ্জার যোগসাজশ কীভাবে দেখাবে শেষে এই নিবন্ধক? ক্রমশ প্রকাশ্য।

 

নিরো, প্রলয়, শিঙা, বাঁশি ইত্যাদি

ইন্সার্জেন্সির সময় বেহালা বা বাঁশি বাজানো গর্হিত কম্ম কোনো? ধরা যাক যুদ্ধ চলছে যেখানে, বেশ অনেকদিন ধরে যুদ্ধজঙ্গ চলছে, সেখানকার লোকেরা কি পিরিতি-প্রেম ইত্যাদি করবে না? আর যদি করে, বা সুযোগের অভাবে যদি না-ও করে, একাধটু প্রণয়গীতি-প্রেমকাব্যি কি লিখবে না তারা? প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাবার পরে যাবতীয় জবরদস্তিও অংশ হয়ে যায় জীবনযাপনের। সেইটেকে তখন আর-দশটা প্রাত্যহিকতার সমতলে রেখে দেখাটা স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। হ্যাঁ, যেইটা হতে পারে তা এ-ই যে একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রণয়গান বা প্রেমকবিতা আর একটা টার্মোয়েল সিচ্যুয়েশনের প্রেমসাহিত্য অভিন্ন প্রকাশভঙ্গির হবে না। ভিন্নতা থাকবেই। ভিন্নতর মাত্রা তাতে যুক্ত হবেই। কিন্তু যুদ্ধসঙ্কুল সময়ে খালি অরিবধকাব্য লেখা, বাধ্য করা নানাবিধ নৈতিকতাশাসন দিয়া সক্কলেরে শত্রুবধস্লোগ্যান লিখিবারে, এইটা আরেক বদ্ধতা। কারণ এমনকি যুদ্ধজঙ্গ প্রভৃতি বিষয়াদিও অযৌন-অজৈব মামলা তো না আদৌ। সবকিছু অতীব জৈবিক তথা জৈবনিক। জীবনেরই অংশ। যৌনতারও, অথবা কামনাবাসনার, বলা বাহুল্য। জবরদস্তি জীবনের সমস্তকিছুতেই গর্হিত। জোরারোপন, কোনোকিছু জোরপূর্বক আরোপন, জীবনের শর্ত লঙ্ঘন করে।

যেইটা বলছিলাম। একটা এক্সাম্পল খোঁজা যাক। দশকাধিক কাল ধরে যেসব ভূখণ্ড যুদ্ধসঙ্গিন, সেসব অঞ্চলে কেমনধারা সাহিত্য হয়, এর একটা সার্চ করে দেখলেই হয়। যেমন ফিলিস্তিনি লিট্রেচার আমরা কমবেশ পড়েছি সবাই। কিংবা, আন্দালুসিয়ার কবিতা। লাতিন কবিতা বা অ্যারাবিক কবিতা। মামুদ দার্বিশ, আদুনিস, লোর্কা বা নেরুদা বা নাজিম হিকমত প্রমুখ কবি কি খালি রাজনৈতিক অভাব-অন্বয় নিয়াই লিখেছেন কবিতা? খালি প্যাট্রিয়োটিক পোয়েট্রি? নিজের একান্ত গোপন প্রেমের কবিতা লেখেন নাই? নিছক যৌন অথবা যাপনজৈবনিক আততি নিয়া আশ্চর্য কবিতাবলি? কিংবা এককালের সোশ্যালিস্ট ল্যান্ডগুলো পলিটিক্যাল টার্মোয়েলের ভেতর দিয়ে বেলা কাটায়েছে বছরের-পর-বছর। ওই সিচ্যুয়েশনে মায়াকোফস্কি কিংবা পুশকিন কি খালি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর সমবায়ের মাধ্যমে গরিবি হটানোর গানই গেয়েছেন? উভয়ের প্রেমের কবিতা পড়ে তো আজও প্লুত হয় পাঠক, বিপ্লব পড়ে সেভাবে হয় না। বা আমাদের নজরুলের কথাই ধরা যাক। ‘বিদ্রোহী’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ধূমকেতু’ প্রভৃতি লিখেছেন যেমন, ‘চক্রবাক’ প্রভৃতি পিউর প্রেমের কবিতা আর অজস্র গান তো লিখতে কসুর করেন নাই। নিশ্চয় তারা দেশপ্রেমে একটুও ঢিলা না-দিয়াই নিজেদের রক্তপ্রেম-মাংশপ্রেম-প্রেমিকাপ্রেম প্রকাশিতে পেরেছেন। তো, ঘটনাটা কি ঘটল? মানে, কি দাঁড়ায় শেষমেশ? রোসো, বলছি।

ইন্সার্জেন্সি পিরিয়ডের লেখাপত্রে একটা ছাপ তো থাকবেই সময়ের। কিন্তু বায়নাক্কা থাকলে চলবে না যে ছাপ থাকতেই হবে। লেখাই ঠিক করে দেবে কি থাকবে আর কি থাকবে না। বাইরের আব্দার করা বারণ, বাইরের আব্দার শোনা আরও গর্হিত। ধরা যাক দার্বিশের প্রেমের কবিতায় দেশহীনতার উন্মুল অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই উঁকি দেয়। যেমন ইরানের ম্যুভিতে উঁকি দেয় নানাবিধ দমন, অবদমন দমচাপা, ফাঁক গলিয়ে প্রেমটাও অপরিস্ফুট তো থাকে না উপভোক্তার কাছে। ইন্সার্জেন্সির ইতরপনার সময় আপনি যদি লিখে ফেলেন, উদাহরণ দিচ্ছি : ‘খুল্লামখুল্লা প্যেয়ার কারেগা হাম দুনো’ প্রভৃতি লাইনঘাট আপনার লেখায়, তাইলে কি আপনারে খেয়ে ফেলবে ক্রিটিক টাইগার? খেয়ে ফেলতে তো উদ্যত হবেই, কিন্তু ঘটনা নির্ভর করছে আপনার উপর, যিনি লিখছেন তারই স্বীয় মগজে এবং কাগজের পাতায়, আপনি ঠিক করবেন খুল্লামখুল্লা লাভমেইকিং সত্ত্বেও আপনার অবরুদ্ধ সময়ের আলোবাতাস কীভাবে মুকাবিলা করবেন নিজের শিল্পকাজটায়। আচ্ছা। খানিক বিরতির পরেই ফির মিলেঙ্গে।

 

নিরো দ্য ফিডলার

সম্পর্কের অসারতা, দাম্পত্য মিথ্যা, ব্যক্তিগত অবসাদ, সমষ্টির শঠতা, আপতিক সফলতা আর আবহমান নিস্ফলতা, সারসত্যের মিথ ও নৈতিকতার প্রহসন — জীবনানন্দের কথাসাহিত্যে এইগুলোই ফিরে ফিরে এসেছে। এইগুলোই পৌনপুনিক উপাদান তার আখ্যানখণ্ডের বিপুলায়তন জুড়ে। এইগুলোই জীবনকথাসাহিত্যের কেন্দ্রসত্য বলাটা আদৌ অভিপ্রায় নয় এখানে। এইগুলো ঘুরেফিরে এনকোডেড হতে দেখা যায় জীবনালেখ্যে, বলবার কথাটা এইটুকুই। কিন্তু মূল/কেন্দ্রসত্য নস্যাৎ করার দিকেই জীবনসাহিত্য বরং আগুয়ান, কবিতায় কি কথাখ্যানে, অত্যুক্তি হয় না বলে নিলে। এবং তখন পর্যন্ত উপন্যাসে ব্যক্তিকে, নিরেট ব্যক্তির বিবিক্ততা আর বিবমিষা ভিত্তি করে, একক ব্যক্তির বদমায়েশি-ভালমানষি নির্ভর করে, স্রেফ একা ব্যক্তির মেলাঙ্কলিয়া উপজীব্য করে লেখালেখির সাহস বাংলা আখ্যানজগৎ অর্জন করে নাই। মানিক তো অনেক পরে শুরু করেছেন, ভালো করেছেন, সমাজ নিয়া আদ্যোপান্ত জোরালো চৈতন্যওয়ালা আখ্যানভাগ ব্যানার্জির। জগদীশ-সুবোধ-জ্যোতিরিন্দ্রও তথৈবচ। ওয়ালীউল্লাহ খানিকটা আলাদা এক্ষেত্রে। অ্যাট-অ্যা-গ্ল্যান্স এগুলো বর্তমান নোটকের বহুকাল আগে ছেলেবেলায় গল্পগাছা পাঠসময়ের একটি ক্ষীণ ও অজ্ঞান বীক্ষণ। অবিচার হচ্ছে এভাবে এ-ধারা আপ্তবাক্যে জেনারালাইজ করে বলা। তা, জীবনজগতের চুলচেরা বা বাংলা আখ্যানভৌগলিক বিশ্লেষণ যেহেতু প্রতিপাদ্য নয় এইখানে, সেইটা বাংলার লোকে ঢের করছে এবং করুক অধিকতর অপরিমেয়ভাবে, এমনধারা সাধারণীকরণ ন-দোষায় অতএব। কাজের কথার আগের ভূমিকা এট্টুক।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ইন দিস রিগার্ড পয়লা ব্যক্তি যিনি এহেন পর্যবেক্ষণজাত প্রতীতি প্রথম বোল্ডলি এক্সপ্রেস করেন যে, জীবনানন্দের কথাসাহিত্য সময়মতো প্রকাশিত হলে কী দুর্ধর্ষ ঘটনাটাই-না ঘটত! অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে যদি জীবনানন্দকথাখ্যানমালা পাঠকের সামনে আসত, সোপ-অপেরা টাইপের বাংলা উপন্যাসের আজকের এই প্রতিষ্ঠিত দশা হতো না। কাফকা নিয়া মাতামাতি না-করে দুনিয়া বাংলা আখ্যানকার নিয়াই নৃত্যানুষ্ঠান আয়োজন করত নিত্য — সন্দীপন এতদূর পর্যন্ত বলতেও কসুর করেন না। কাব্য তো বটেই, জীবনানন্দের কথাসাহিত্যের এতটাই কদর করতেন বাবু সন্দীপন এবং তার দুর্দান্ত ননফিকশন প্রোজগুলোতে বা আপন সংগোপন দিনলিপিতে এই বিশ্বাস পুনঃপুনঃ ব্যক্ত করে যেতে দেখব আমরা তাকে তার আয়ুর শেষ দিন পর্যন্ত। সবাই সমর্থন করেন কি না জানি না, বাবু সম্ভাষণে আদৃত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যিনি কিনা বাংলা সাবভার্সিভ গদ্যের/আখ্যানের এক অতিকায় দানো, চাটুজ্জেবাবুর এই বিশ্বাসের সঙ্গে একমত লোকের সংখ্যা আঙুলে গোনা আদৌ সহজ হবে না।

এহেন কথাসাহিত্য লিখে জীবন কি তবে স্রেফ ল্যাক-অফ-কনফিডেন্স থেকেই বিরত রইলেন প্রকাশ করায়? আই ডাউট। ঘোরতর সন্দেহ হয় জীবনানন্দ প্রোব্যাব্লি নিরোকমপ্লেক্সের নির্মম ভিক্টিম। তিনি নিজে শেইকি ক্যারেক্টারের লোক ছিলেন, এই বিবৃতি বিশ্বাস করে নিলেও শত্রুমিত্র সকলেই স্বীকারিবেন যে এই লোক নিজের লেখাটার ব্যাপারে বেয়াড়া আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বুঝতেন কোনটা বা কারটা হচ্ছে আর কোনটা বা কারটা হচ্ছে না, তারটা আদৌ কতটুকু হচ্ছে এইটা আলবৎ বুঝতেন এতে লেশমাত্র সন্দেহ হয় না, আর এইসব বোঝাবুঝির জন্য সম্প্রতি ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদনায় জীবনানন্দের লিট্যার‌্যারি নোটস  না-পড়লেও চলে। এ আমরা সকলেই জানি অবশ্য, এর বাইরে কিচ্ছুটি কেউ জানি বলে মেহসুস হয় না, যে আমারটা ছাড়া আর কারো কিচ্ছু হচ্ছে না। বাবু জীবনানন্দ শুধু জুয়াটা মারকাটারি জিতে গেছেন, আর আমরা মারকাটারি হারুপার্টির মেম্বার হয়েও তাসির হচ্ছে না চামড়ায়। অ্যানিওয়ে।

সেইসময় জীবনানন্দের সতীর্থরা আখ্যানসাহিত্যে কি করছিলেন তা একবার নজর করে দেখে গেলেই বোঝা যাবে জীবন কেন ওই বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো যথাকালে ময়দানে নিয়া আসতে চান নাই বা পারেন নাই কিংবা আদতে চেষ্টাটাও হয়তো করেন নাই। তিন-চারটা মাল তো নয় মামা, ট্রাঙ্কের-পর-ট্রাঙ্ক ডিটোনেটর! অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেন নাই মশহুর বাংলা সম্পাদক কবিতাত্রাতা বুদ্ধদেবদিগেরে যে আমিও গপ্পোসপ্পো দুই-চাইরটি লিখিছি বাপু, বুঝবাম কেমনে সেগুলো মন্দ না ভালো, দোস্তো ইট্টু দেখিয়া দাও দিকিনি! বুদ্ধদেব তখন চুটায়া সাহিত্য করছেন, কথাসাহিত্য ও কবিতা নামাচ্ছেন আর জীবনানন্দকে নির্জনতম অভিধায় অ্যালুফ-অ্যালিয়েন বানায়া রাখছেন সমাজসংসারে। এইসব ভয়াবহ সমাজের আরতি আর আড়ম্বর সোশ্যালিস্ট বিপ্লবের! এই জিনিশগুলো কথাপ্রসঙ্গে একবার বলে নিতে পারলে বোঝা যাবে কেমনভাবে লেখকের বারোটা বাজায় নিরোভয় তথা সমাজ ও অন্যান্য দৈত্যদানো। বোঝা সহজ হবে খোদ সমাজ কীভাবে অপূরণীয় ক্ষতি করে সমাজের। গোড়ার কথাটা কে না জানে যে, পাখিকে গাইতে দাও, পঙ্গপালকে দাও উড়িতে, বেহালাবাদিয়েকে দাও বেহালা বাজায়ে যেতে, বাঁশিওয়ালাকে বাঁশি। বিশেষ দ্রষ্টব্য এ-ই যে, বেহালা/বাঁশি মানে লেখকের অভিপ্রেত লেখা, আর এই নিবন্ধনোটে ‘সমাজসাহিত্য’ মানে স্ট্যাটাস আপডেট বা হাউকাউ সমর্থন প্রহরে প্রহরে নিজকার কাজধর্ম ভুলিয়া সামাজিকতার সুসভ্য ঠাপে বা চাপের ফেরে ফেঁসে।

 

নিরো ও নগরসভ্যতা, বাঁশিবিরুদ্ধ যুগযুগান্ত

উপরিতলে মনে হতে পারে, যেমনটা আমরা বলেও থাকি যে, মানুষ খুব বাঁশিপ্রিয়। বলি আমরা হামেশা যে মানুষ তার প্রাণের খানাখাদ্য পায় গানে-বাদনে। কার্যত উল্টা দেখবেন আপনি, একটু যদি ক্রিটিক্যালি দেখার একটা স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যাস থাকে আপনার তবেই নিরোর ডেস্ট্রাক্টিভ ক্যারিয়ার থেকে, ট্রেচ্যারাস কিংডম থেকে, এই ফিডলিং তথা বাজনাপ্রিয়তা/বাজনাবিলাস ব্যাপারটাকে একটুখানি সিঙ্গল-আউট করে নিয়ে একটা আলাপ আপনি নিজমনে চালাতে পারেন, স্যলিলকির মতো করে। দেখবেন যে আমরা স্রেফ বলি এক আর করি আরেক, জগতের সমস্ত ইউনিভার্স্যাল সত্য ধসে গেলেও এই বাক্যের চিরন্তনতা থাকিয়াই যাচ্ছে। ব্যাপারটা আমি নিজেই ক্লিয়ার না, খানিক লম্বা আলাপে দেখি নিজের ক্ল্যারিটি আসে কি না। আচ্ছা। আগে দেখা যাক বাঁশুরিয়াদেরে লোকসমাজ কেমন দৃষ্টিতে দেখে।

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পটা আমরা জানি নিশ্চয়। সেখানে সেই লোকটার দুইটা রূপ দেখতে পাবো। নগরপিতা বাঁশিওয়ালার সঙ্গে কথাখেলাপি হবার পরের দৃশ্যে যেই রিভেঞ্জ, সেইটেই লোকে দেখে এবং উল্লেখ করে; কিন্তু চুক্তিমুতাবেক যে-কর্তব্য তথা দায়িত্ব পালন করার দৃশ্য, সেইটা আমরা আলাপে তেমন তুলি না। বাঁশিওয়ালাকে ঠকানোর যে-ব্যাপার, তাচ্ছিল্য করার যে-ব্যাপার, এইটা আবহমান। ঘটনাটা আরেকটু সিরিয়াস হয়েও ভাবতে পারেন এই অ্যাঙ্গেল থেকে যে, এই-কিসিমের নেগ্যাটিভ গল্পচূর্ণ-উপকথাখ্যান লোকচৈতন্যে ব্যাপক, ছড়ায়া রাখা সমাজমানসে বিস্তর এহেন নেতিজ্ঞাপক কেচ্ছাকাহন। ফলে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা টাইপের থ্রেট হরকিসিমের শিল্পী-আর্টিস্ট-কবি-লিখিয়েদিগেরে নিয়া মানুষের মাঝে বিরাজ করতে দেখা যায়। ঠিক দেখা যায় না-বলে বরং বলি টের পাওয়া যায়। দৃশ্যমান সবকিছুর একটা ফায়সালা করে নেয়া গেলেও যা-কিছু চক্ষের সম্মুখে অঙ্গুলিনির্দেশ্য নয় সেসবের নিষ্পত্তি রিস্কি। ঠিক অঙ্গুলি দিয়া যা ধরা যায় না, তা হাজির নাই তো বলা যাবে না। আছে, দেখতে পাই, কিন্তু দেখা যায় না। তা, দেখানো কি যায়? যা আপনি নিজে দেখতে পারছেন, যদিও হস্তে ধরতে পারছেন না, তা কি আপনি দেখাতে পারেন? এইটা আরেক লাইনের আলাপ, বগি লাইনচ্যুত না-করি বরং।

ক্যাট্যাস্ট্রোফি চলছে মনে করেন। তো, উকিল-জজ-ব্যারিস্টার-মোক্তার বা মনে করেন ডাক্তার-সচিব-মডেল-কেরানি-বিজ্ঞানী কিংবা আমদানি-রফতানিকারী কারোর কাজকর্ম থামায়া রাখার আব্দার সমাজ করে না, খালি শিল্পী-কবি-লেখকদেরকেই ছিছিক্কারে ভাসায়ে দেয়া হয়। বিপর্যয়্কালে লেখক-কবি-মুরলিবাদক নিজের কাজটা থামায়ে রেখে বিপর্যয় ঠেকাবেন, নাকি নিজের কাজটা বা প্রেমের গানটা/ক্বাসিদাটা/কত্থকভরতনাট্যমটা চালায়া যাবার সমান্তরালে একটা নাগরিক বিবেকতাড়িত প্রোটেস্টকর্ম সাধন করবেন, এইটা একটা ব্যাপার যা নিয়া ডিবেইট চলতে পারে এন্ডলেস। তবে দেখবেন যে জেহাদের/বিপ্লবের পয়লা চাপাতির কোপটা পড়ে লেখনী/ঝুনঝুনি/বাঁশিযন্ত্রটার ওপর। যুগে-যুগেই ইহা দেখা দিয়া যাইছে। প্লেটোর রিপাব্লিকের বাইরে বের হচ্ছে না আমাদের প্রগতিচিন্তা। অঘটন কিছু-একটা ঘটল, তো সঙ্গে সঙ্গে বাঁশির দোষ, মানে বাঁশিওয়ালার দোষ। রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকঠাক চলছে না, আর আপনি বাঁশি বাজাচ্ছেন, ফাইজলামি পেয়েছেন আপনি? রিবিউকড হবেন পদে পদে। এই ফ্যাকড়া থেকে নিস্তার নাই শিল্পীর/লেখকের/কবির/বাঁশিওয়ালার। অবশ্য কবি/শিল্পী/লেখক তার নিজের নিজের ধরনে একটা আপোস করে নেবার রাস্তা বার করে ফেলেন। পরে এ-বাবতে হিস্ট্রিপাতা হাল্কা উল্টানো যাবে না-হয়।

 

বাংলার নিরো

‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ — লিখেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি ভারতচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন নদীয়ার/নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাসদ। মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত ‘অন্নদামঙ্গল’ শীর্ষক কাব্যের পঙক্তি এটি। কিংবা আরও কয়েকটা ভারতচন্দ্রপঙক্তি নিশ্চয় আমরা আজও ভুলিয়া যাই নাই, যথা — ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’, ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ / ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ’, ‘না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল / অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল’ প্রভৃতি। ঠিক যে সেকালে এই-ই ছিল দস্তুর, রাজারাজড়ারা সাহিত্য ও সংগীত প্রভৃতি শিল্পকলার পৌরোহিত্য করতেন, দরবার বসাতেন ললিতকলার বিবিধ রত্নরাজির সমাহারে। দেবদ্বিজে ভক্তি ছিল রচনার উপলক্ষ্য, পূজাআচ্চা টাইপের ইভেন্টগুলায় কাস্টোমাইজড টেক্সট দরকার পড়ত মহারাজদিগের। ফলে বিশেষভাবেই কবিসাহিত্যিকরা রাজানুগ্রহে মাসোহারা ভাতায় অ্যাওয়ার্ডে এবং রঙ্গিবিরঙ্গি অভিধায় লালিতপালিত হতেন আর দেবদেবিকীর্তনের প্যারালাল রাজবংশকীর্তন করে যেতেন কৌতুকে ভাঁড়ামোয় নকশায় এপিকে। এই সিলসিলায় মেডিয়েভ্যাল বাংলায় ব্যাপক টেক্সট রচিত হয়েছে এবং সেসবের ভিতর চোঁচা আর ধান দুনোটাই মিলেছে। সেই ইতিহাস সকলেই জানেন। সভাগায়ক-সভাকবিদের যুগ অবসিত বহুকাল হলো। মহারাজপাটের জায়গায় রাষ্ট্র পত্তনিরও কম অতিবাহিত হয় নাই। কিন্তু সভাভাঁড়দের ছ্যাঁচড়ামি দিন-কে-দিন কমার বদলে বেড়েছে লেলিহান। বর্তমান বাংলায় শিল্পসাহিত্য বলে যে-দেবালয় আছে সেখানকার কয়টা আখর নগরভস্মসর্বস্ব মহাকালে বেজান বাংলাদেশে টেকে, দেখা যাবে। এত অসহনীয় বেহায়া অ্যাওয়ার্ডকাঙাল রাজভিখারি মিস্টিক কবিলেখকদের লালসায় আবিল বাংলায় কে আর ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের ন্যায় রেজিস্টার রাখছে দেবকীর্তনের ফাঁকে ফাঁকে দেবতাদিগের দুর্নীতির? আর, বাংলার নিরো? কোথায়? কে, বা, কারা? আছে নাকি নিরো, দ্রষ্টব্য, বর্তমান বাংলায়? ছিল, অতীতে? কে নিরো, দুইহাজারতেরোর এই গনগনে-গ্রিন বার্ন্ট-রেড বাংলায়? এই নিরঙ্কুশ লুটপাটে লিপ্ত কবিলেখকদের কুলটা কারখানায়?

 

ফ্যাক্টচেক ফ্রম উইকিদ্রুম

উইকিপিডিয়া আবির্ভাবের পর গবেষণাটবেষণা আজকাল ডালভাত বা রাসায়নিক সারসমৃদ্ধ মুড়ির বানানো মোয়া। মানে, গবেষণাটবেষণা আর করবার দরকার পড়ে না। আল্লার দুনিয়ার সমস্ত পথঘাট যেমন রোমে যেয়ে মিশেছে, এই বিশ্বাস ছিল রোমকদের মধ্যে, বেদে বাইবেলে কোরানে যেমন সমস্ত মুশকিলআসান সুলভ বলে একিন করে একেকটি বিশেষ ধর্মানুসারী, ইদানীং অনুরূপ নির্ভরতা আমাদের ভিতর গ্রো করেছে টেক্নোলোজিক্যাল অ্যাডভ্যান্সমেন্টের অপরূপ উপহার গ্যুগল গ্যাজেট মাইক্রোসফট গ্যাজেট প্রভৃতির প্রতি। কিছু-একটা জানতে চান বা জানাইতে, লৌড় দেন, লৌড়ান, তুরন্ত ঝাঁপান উইকিপিডিয়ায়। পাবেন, ‘গিয়ান’-‘বয়ান’ ও অন্য-অন্য যা যা চাই, মিলাবেন তিনি মিলাবেন, ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটায়। কাজেই, দিরং না-করি, আমরাও যাই। কই? উইকিগৃহে। কেন? টু ফাইন্ড আউট দ্য ফ্যাক্ট। উইকি-ওভার্ভিয়্যু বলতেসে দেখি, নিরো কখনোই ঠিক বাঁশি বলতে যা বোঝায় তা বাজাতেন না। চালু সত্য তো সকলেই অবগত, — রোম যখন পুড়ছিল, মহামহিম সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু রোমের সেই বিখ্যাত আগুনের সময় নিরো নগরীতেই ছিলেন না। নানাবিধ সোর্স লিঙ্ক সাবুদ বরাতে উইকিপিডিয়া সালতারিখ পর্যন্ত উদ্ধার করে জানাচ্ছে যে চৌষট্টি সালের আঠারো জুলাই রাতে যখন আগুন লাগে নিরো তখন রোম থেকে ছাপ্পান্ন কিলোমিটার দূরের শহর অ্যান্টিয়ামে। রেগ্যুলার রাজ্যসফরে বেরিয়েছিলেন নিরো। রোমানরা বিশ্বাস করেন নিরো তার পরিকল্পিত প্রাসাদোপম একটি কমপ্লেক্স তৈরির জন্য জায়গা বাইর করতেই বিল্ডিঙে আগুনটা লাগিয়েছিলেন। কিন্তু আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল ঘোড়দৌড়ের মাঠের দক্ষিণপ্রান্তে যেখানে দাহ্য-পদার্থের দোকানপাট ছিল। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, একটানা পাঁচদিন ধরে চলা ওই আগুনে রোমের চৌদ্দটি ডিভিশন্যাল অ্যারিয়ার তিনটি বিলকুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, এছাড়া আরও সাতটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিরো সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত রোমে ফিরে আসেন এবং ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেন, যার পুরোটাই তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে খরচ করা হয়। এক এই উইকিপৃষ্ঠা হাতড়ে পেয়ে যাবেন আরও শত শত স্কলার্লি নিবন্ধপ্রবন্ধের সূত্র। রোমে তখন প্রায়ই আগুন লাগত, পঞ্চাশোর্ধ্ব বর্তমান বাংলাদেশের মতো, উনসত্তর এবং আশি সালেও রোমে এমন মারাত্মক আগুনের ঘটনা ঘটে। চৌষট্টির আগুনের আরও বছর-চার পরে এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যূত হন নিরো। যা-ই হোক, বলতেসে উইকি, নিরো লায়ার/সিথ্যারা বাজায়া গান করতেন। প্রথমে ঘনিষ্ঠ মহলে গান করলেও পরে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে জনসম্মুখেও পার্ফোর্ম শুরু করেন। রোমের তৎকালীন ঐতিহাসিক টেইসিটাস বলেন, রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন লায়ার বাজায়া গান করছিলেন এমন কথা শুধুই গুজব!

 

অনুচ্ছেদ দুইহাজারচব্বিশ

উপসংহার টানতে হয়, তাই উপসংহার টানি। কিন্তু জানি, জীবনের উপসংহার ড্র করা প্রায় নামুমকিন। বহতা গাঙের ধারণাটি জীবনধর্ম বুঝাইতে যেয়ে ব্যবহৃত হতে দেখব আমরা আদিকাল থেকে। ব্যক্তি বিদায় নিলেও প্রকৃত প্রস্তাবে একটা বহুস্বরিক মহাব্যবস্থায় ব্যক্তিই বিরাজ করে অনন্ত, অনাদি, আবহমান। কবিনাম মুখে না-নিয়াও অতএব কবিতা আওড়ানো যায় : “মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব / থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে / প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।” এই নিবন্ধের সংহারকল্পে, কাজেই, কতিপয় ইনফর্ম্যাশন জুড়ে রেখে এখান থেকে এবারের মতো প্রস্থান অঙ্কন করা যায়। এক হচ্ছে, এটি লিখিত হয়েছিল দুইহাজারতেরোয়, ফেইসবুকের ফ্লুরোসেন্ট পাতায়, পাব্লিক পোস্ট প্রকারে একটানা, শাহবাগ-শাপলা ঘটে যাবার পরের বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ভয়াল ভুলযাত্রার আশঙ্কায়। আরেক দিক থেকে দেখতে গেলে, তেরোপরবর্তী পাক্কা এক দশকে কে নিরো আর কে নিরো নয় নির্ণয় করা সাধ্যাতীত হওয়ায় এর উপসংহার টানা আজও সম্ভবপরতা থেকে ঢের দূরে। এই অনুচ্ছেদটাই শুধু দুইহাজারচব্বিশের সংযোজন। ফলে, এই নিবন্ধগুচ্ছ অদ্য অবধি মীমাংসারহিত, অসমাপ্ত, এনকোয়্যারি করতে করতে এ-নিবন্ধগোছা মাঝপথে থেমে গেছে বলে মনে হতে পারে এর পাঠকের কাছে। এই মনে-হওয়ার কারণে ব্যাহত হবে না, আশা করা যায়, লেখকের/লেখাটার অভিপ্রায়। আর কিছু নয়, লেখকের/লেখাটার অভিপ্রায় এবং সার্থকতা পাঠকেরে নিরো-অনুসন্ধানে নামানোয়। নিজেরাই নিরো যদি, নিরো-অনুসন্ধানে মিলবে না অবধি। কিন্তু খুঁজতে-যে বেরিয়েছিলাম, পথে পথে এত এত নগরভস্ম ও নগ্নগাত্র উন্মত্ত নরগোষ্ঠী দেখে এলাম, নিরোখোঁজা বাদ দিয়ে এই কথাগুলাই লিখে গেলাম।  উপসংহার টানা অ্যাভোয়েড করলাম।

জাহেদ আহমদ

জাহেদ আহমদ রচনারাশি

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you