নিখিলদা, গানের মানুষ, গানের মতো মানুষ || সরোজ মোস্তফা

নিখিলদা, গানের মানুষ, গানের মতো মানুষ || সরোজ মোস্তফা

শেয়ার করুন:

আজ খুব ভোরে চিরনির্ধারিত গন্তব্যেই গেলেন ওস্তাদ নিখিল সরকার। উদয়ন রোডের বাড়িটায় নিখিলদা অপেক্ষা করছেন শ্মশানে যাবেন। মৃতের বাড়িতে কান্না থাকে, মলিন বিস্ময়ে আগন্তুকেরা স্মৃতিকথা নামাতে থাকেন। তবু বাড়িটাকে খুব নির্জন মনে হয়। বুকে লাগে পাখিদের কণ্ঠস্বর।

উনার বাড়ি থেকে ফিরছি। এই পথ খুব চেনা ছিল। গত কয়েক মাসে এই পথে আর আসা হয় না। হাঁটতে হাঁটতে মানুষকে কত পথের ধূলিকণা যে মাখতে হয়! শেষে পথই থাকে, পথিক থাকে না। বকুল থাকে না, মাটির গভীরে থাকে বকুলের ঘ্রাণ।

এই পথেই উনার সাথে প্রায়ই দেখা হতো। সকালে। আমি কলেজে যাচ্ছি। উনি বাসায় ফিরছেন। কোনো কোনো দিন বাজার থাকত হাতে। সামান্য সবজি কিংবা মাছের ব্যাগ হাতে অদ্ভুত সুন্দর সেই হাঁটা। মিষ্টি হাসিতে নমস্কার বিনিময় হতো। হয়তো গান শিখিয়ে ফিরছেন। বাড়ি ফিরে নাস্তা করবেন। খুব ক্লান্ত দেখাতো। ভারী শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতেন। আর হাঁটবেন না। ধীরে ধীরে প্রবীণ মানুষ নাই হয়ে যাচ্ছেন। মানুষ চলে গেলেও পৃথিবী স্বাভাবিক থাকে। কিশোর গ্যাংস্টারদের অনুভূতির মতো স্বাভাবিক।

মানুষ যে-পথে আসাযাওয়া করে সে-পথই তার পথ। উনার বাসার পাশ দিয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ওয়াজ শুনতাম। উনার বাসা থেকে হারমোনিয়ামের আওয়াজ আসতো। কখনো বা তবলার তেরেকেটেধিং। আর মানুষটাকে তো দেখতামই। রেওয়াজ শুনতাম। হাসি বিনিময়ে কথা। তবে ওই যে হারমোনিয়াম, তবলা—এই যন্ত্রগুলো আমাকে উনার আত্মীয় করেছিল। জানতাম তিনি গানের শিক্ষক। একই বাড়ির পাশাপাশি উঠানে ওস্তাদ গোপাল দত্তও থাকতেন।

নিখিলদা আমাদের শহরে গান শেখাতেন। মগ্নতায় ও জীবিকায় এই নিয়েই ছিলেন তিনি। সত্যি সত্যি মগরাতীরের শহরটা কী আশ্চর্য সুন্দর ছিল। এখন কেমন মরে যাচ্ছে। নিখিলদারা নাই হয়ে যাচ্ছেন। মগরার স্রোত থেমে যাওয়ার সাথে সাথে শহরের গানও থেমে গেছে। মরে গেছে পাঠাগার, বই পড়া ও কেনার সংস্কৃতি। কী সুন্দর ছিল আমাদের শৈশব! বাড়িতে বাড়িতে বাগান, হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা, সেতার, রেওয়াজ। বিকালে কিশোর-কিশোরীদের যৌথ খেলাধুলার ঐকতান। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব; বড় ও ছোটদের স্নেহ ও শ্রদ্ধার অপূর্ব আড্ডাগুলো হারিয়েই গেল। যুক্ত হলো লাল ইয়াবার বিষণ্নতা এবং গ্যাং সংস্কৃতি। নিন্দা, পরচর্চা, নেতিবাচক দৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়া আশ্চর্য সমাজ থেকে গৃহবন্দী প্রবীণেরা চলে যাচ্ছেন।

পাঠাগার, গান, শ্রদ্ধাবোধ ও ফুল ফোটানোর রেওয়াজ না থাকলে একটা সমাজ এমনিতেই মরে যায়। সর্বশেষে মগরার উপর একটা সরলরেখাধর্মী ব্রিজ করে নদীটার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিলাম। কেউ কথাও বললাম না। আচ্ছা, ব্রিজের নকশা কারা করে? তারা কি নদীর জীবনকে অস্বীকার করে? না-হলে সরলরেখার মতো ব্রিজের নকশা করবেন কেন তারা? ব্রিজগুলো যদি ধনুকের মতো বাঁকানো থাকত তাহলে আজকে মগরার এই দশা হতো না।

আমার মনে হয়, এই শহরে মগরা নদীটা না-থাকলে শহরটা আর শহর থাকবে না । হয়তো থাকবে কিন্তু প্রাণ থাকবে না। শহরটা এখন নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে। একে একে চলে যাচ্ছেন গানের শিল্পীরা। যারা যাচ্ছেন তারা রেওয়াজ ও ঐতিহ্যকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। এই শহর থেকে গান ও গানের মানুষেরা একেবারেই কি হারিয়ে যাবেন? বাউল সুফির সহজিয়া মন ও মানবিকতা একেবারেই কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? অন্ধ অনুকরণে পরদেশি বোধকে সবাই কি আঁকড়ে ধরবে? গ্যাংস্টার হয়ে সবাই কি সমাজের চালাকির ভেতরে ঢুকে যাবে?

নিজের মাটিকে কি কেউ উল্টে দিতে পারে? নিশ্চয়ই পারে না। মাটির সংস্কৃতি বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে সে-সংস্কৃতি রুগ্ন প্রদীপের মতো হলেও জাগ্রত থাকবে। মানুষ পিতাকে ভুলে যায় না। সেই রুগ্ন প্রদীপের আলোয় মানুষ ফিরে আসবে। গানের মানুষ ফিরে এলে, গানের মানুষ বিচরণ করলে শহরটাও গানের মতো সুন্দর হবে।

কিছুক্ষণ পরে শ্মশানধ্বনিতে শ্মশানবন্ধুরা নিখিলদাকে নিয়ে যাবে। শয্যা রেডি হচ্ছে। গানের মানুষ গেলেন।

আচ্ছা, শহরে কি গানের মানুষ তৈরি হচ্ছে? গান না-শুনলে শহর বাঁচবে কীভাবে!

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you