জীবন ও অন্যান্য জৈবনিকী

জীবন ও অন্যান্য জৈবনিকী

বাংলা কবিতাপাঠকের ভেতরে জীবনানন্দের আসন এতটাই ডালপালামূলবিস্তৃত যে আজোবধি জীবনানন্দকে একটা সুস্থির দূরত্ব থেকে দেখা সম্ভব হলো না। একদিক থেকে এটা জীবনানন্দের কবিতাশক্তির জয়, আবার অন্যদিকে এর একটা নেতিদিকও বিদ্যমান। এ তো অসম্ভব যে, পূর্ণমনস্ক-অর্ধমনস্ক সর্বস্তরের পাঠকসাধারণ জীবনানন্দকে সমানভাবে স্বীকার করে নেবে, এইটা স্ট্যাটিস্টিক্যালি অসম্ভবই; কিন্তু নেয় তো! এর পেছনে কী বিচারবোধ কাজ করে, এর পেছনে ডিন্যামিক্সগুলো কি কি, এসবের একটা সমাজমনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি। কিন্তু ও-রাস্তা মাড়াচ্ছেন না কেউই। জীবনানন্দ নাম নেয়া মাত্রই এক-ধরনের আহা-হাহা শুরু হয়া যায়। জীবনানন্দাচ্ছন্নতা বা জীবনাসক্তি/জীবন-অবসেশন্ কবে যে কাটায়া উঠতে পারব আমরা, কবে তাকে সুস্থির পাঠকের জায়গা থেকে দেখে উঠতে পারব, আল্লাই মালুম।

শুধু উনি কিংবা আপনিই না, আমি নিজেও জীবনানন্দ-অবসেসড, — সংকোচে স্বীকার করে নেয়াই সততা। কিন্তু আজকাল কেন জানি মনে হয় যে গোটা ব্যাপারটা বাড়াবাড়িরও সীমা ছাড়ায়া গেছে। একজন কবির জন্য এ যেমন ভাগ্য, তেমন দুর্ভাগ্যও। দুর্ভাগ্য অন্য-অপরাপর কবিদের জন্য তো বটেই। এবং মহা অবিচারও। স্পোর্টসকোর্ট বা সিনেমা-শোবিজের ক্ষেত্রে এভাবে রেটিং দস্তুর হতে পারে, কিন্তু কবিতায়? সাহিত্যে অমন সর্বসেরা ছাপ্পা মারার রেওয়াজ শংসনীয়? এবং যেখানে রেটিং, সেখানেই আন্ডাররেটিং-ওভাররেটিং — এই দুই ভাগ। যখন কেউ-একজন ওভাররেটেড হয়, সঙ্গে-সঙ্গে শংকা থাকে অন্য সবার যার-যার প্রাপ্য রেটিং থেকে বঞ্চিত হওয়ার। এমন পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই অগ্রসরণ বলা যাবে না।

তা হতে পারে যে জীবনানন্দের বেলায় এই রেটিং যথাযথ ও ন্যায্য। খুব পাওয়ারফুল পোয়েট হলে এমনটা হতেও পারে। গোল বাঁধে তখনই, যখন দেখি অনেক শিক্ষিত-কবিতামার্জিত লোকলস্করও জীবনানন্দের আগে-পরে কাউকে কবিস্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা প্রকাশ করেন। কিন্তু কথা হলো, জীবনানন্দ অনেক পথ হেঁটেছেন আবার অজস্র মাইল হাঁটতেও পারেননি অমোঘ নিয়মেই। তাঁর পরে যারা হেঁটেছেন তারাও স্বাভাবিকভাবে সমগ্রমাত্রিক না-হলেও বহুমাত্রিক তো নিশ্চয়ই। তাদেরও দেখা হয়েছে কিছু নতুন দৃশ্য, শোনা হয়েছে নতুন কিছু সুর। সে-অনুযায়ী দেখিয়েছেন-শুনিয়েছেনও তারা যথাসাধ্য। এটা স্বীকার করলেই তো হয়।

জীবনানন্দপরবর্তী এই পঞ্চাশ-পঁয়ষট্টি-সত্তইর বছরে অসংখ্য কবি আবার এসেছেন-গিয়েছেন ফিরে এই বাংলায়, তাদের সকলের প্রতি সমকালের অজস্র আপত্তি ছুঁড়ে দেয়ার পরও তারা যে শক্তিমান কবি এবং স্ব-স্ব জমিতে সফল শস্যকর্তনকারী কৃতকার্য কবি, এ-ব্যাপারে নির্দ্বিধ হওয়া দরকার। একইসঙ্গে এই বিচারটাও সেরে রাখা দরকার যে, ওই তাদের মধ্যে অন্তত জনা-পনেরো বা তারও বেশি কবি রয়েছেন যারা জীবনানন্দের পরবর্তী পাঠক-পরিব্রাজকদের নিয়ে গিয়েছেন ভিন্ন ভূগোলে, অন্যধারা গানগোলার্ধের দিকে। জীবনানন্দ ধরেছেন, সব কোলাহলের পর এই বিষয়ে মতৈক্যে আসতেই হবে, জীবনের বিশেষ একটা সুর। চর্চা ও প্রকাশ করে গেছেন তিনি বিশেষ একটা স্বরগ্রামে। স্বরগ্রামটি যত অভাবিতপূর্বই হোক, প্রকাশের এত বছর পরও সেটি অপরিচিত-অভাবিত বলে গণ্য থাকে কী করে!

ঘাপলাটা এখানেই। আমাদের পাঠের ধারাবাহিকতা নাই। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পর জীবনানন্দ, এরপরে এম্পটি স্পেইস। ফাঁকা পাঠজমি। আর কেবল পাঠকের জাবর-কাটা। দেবতায়নের এহেন দৈন্যাবস্থা থেকে আশু উত্তরণ সম্ভব? একটা সুরাহাবাক্য ধার করা যায় জয়ের জবান থেকে। জয় মানে জয় গোস্বামী। অবিকল উদ্ধার করতে পারব না যদিও, জয়ের ভাষ্য অনেকটা এ-রকম : সুবোধ সরকারের মতো কবি আমাদের যাপিত জীবনের এমন কিছু অচেনা জায়গা নিয়া কাজ করসেন যা আমার লেখায় আসে নাই কখনো, এবং আসবেও না আমার লিখনরীতির কারণেই। এজন্য সুবোধ আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি।

তেমনি যে-কোনো গৌণ কবিই গভীর ও ধারাবাহিক পাঠে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য হবেন।

লেখা / জাহেদ আহমদ

জাহেদ আহমদ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you