সতীনাথের উপন্যাসমানস || সত্যজিৎ সিংহ

সতীনাথের উপন্যাসমানস || সত্যজিৎ সিংহ

‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ — মোট দুই পার্টের উপন্যাস। প্রথম খণ্ড পড়া শেষ করলাম। এটি ছাপা হয়েছিল বই আকারে ১৯৪৯ সনে। তার দুই বছর বাদে প্রকাশিত হয় ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। আমি যদ্দুর জানি আর-কি। বিপরীতও হতে পারে। উপন্যাস দুইটি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ অবধি। দু-জনের কেউ-একজন আরেকজনের লেখা পড়েছিলেন কি না জানি না। এই কথা বলার কারণ এই নয় যে, দুটো উপন্যাসের কাহিনি প্রায় সমান। এইটা বলার দেরি আছে এখনো। কারণ দ্বিতীয় পার্ট পড়া হয়নি যেখানে, শেষ না করে সেখানে কিছু বলব কী করে! করালিকে সেই ১৯/২০ বছর ধরে চিনি। সে বেপরোয়া, নায়ক মিঠুনের মতন প্রতিবাদী, প্রেমিক, গোঁয়ার, মারমুখো। তার জায়গায় ঢোঁড়াই? সে একবার প্রতিবাদ করেছিল তার ঝুপড়িঘর ভেঙেছে বলে, থানাপুলিশ ডেকেছিল, কিন্তু তার ঘরের প্রবীণ তাকে আর উৎসাহ না দিলে সে থেমে যায়। সেও করালির মতন সমাজের প্রচলিত রুটিরুজি বাদ দিয়ে অন্য জায়গায় কাজে যায়। সেও নায়ক, তবে মিঠুনের মতন না। আমার আপনার মতন, সহজ, সরল, ভীত। সেও গোঁয়ার গোবিন্দ, কিন্তু সমাজের, পাঞ্চায়েতের বাহিরে যাবার সাহস তার নাই। সেও প্রেমিক — প্রেমের জন্য সে ভিখারি হতেও রাজি আছে। সতীনাথ ভাদুড়ি বইটা মনের আনন্দে লিখেছেন, কেন বললাম এই কথা —  চাপানো কিছু নাই। রাজনীতির উপন্যাস লিখতে গেলে চাপানো অনেক ব্যাপার থাকে। বড় লেখকরা এইসব বুঝতে দেন না। তারাশংকরও দেননি। তবু মনে হলো, করালির চাইতে ঢোঁড়াই  অনেক সাধারণ, সহজ। উপন্যাসের এক অংশে কিছু সময়ের জন্য গানহিবাবা মানে গান্ধীজি এসেছিলেন। চালকুমড়ায় তার রূপ দেখেছিল এক তাতমা বুড়ো। ভেবেছিলাম, ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেবে। কংগ্রেস আসবে, ইংরেজ সরকার আসবে, মিছিল হবে, মিটিং হবে। কিন্তু কিসের কি। ভাদুড়ির প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’-র বেলায় এইসব দেখেছিলাম। চাপানো মনে হয়েছে কি? এই কথা বললে পাগল পর্যন্ত আমাকে উষ্টা মারতে আসবে। ‘জাগরী’ সম্পূর্ণ একটা রাজনৈতিক উপন্যাস। এইটা দু-পাতা পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু আমি বলছি, অন্য কথা —  আছে না শুরু হলো গ্রাম থেকে, খুব গরিব ঘরের কাহিনি থেকে, এখান থেকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র, রাজনীতি, মিডিয়া। এমন শ শ উপন্যাস আছে বাংলা ভাষায়। বলছি, বড় লেখকরা খুব সূক্ষ্মভাবে এইসব মিলিয়েমিশিয়ে পাঠকদের একাকার করে দেন। প্রশ্ন করবার সুযোগই থাকে না। গান্ধীর প্রসঙ্গ আসলে আমি ভাবলাম বুঝি ঢোঁড়াই চরিত মানসে  আরো বড় কিছু আসতেছে সামনে। কিন্তু ওই যে বললাম, লোকটা সতীনাথ ভাদুড়ী। কিসের গান্ধী আর কিসের কমিউনিস্ট। তিনি মনের আনন্দে দুই গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের কাইজাফ্যাসাদ, বেঁচে থাকবার লড়াই, শ্লেষ, ঈর্ষা — এইসব নিয়ে বয়ান করে গেছেন। আমি পড়তে যেয়ে হঠাৎ মনে হলো, গান্ধীবাবার প্রসঙ্গ বোধহয় আসতেছে সামনে। কিন্তু অনেকদূর যাওয়ার পরেও যখন পেলাম না তখন আবার ভাবলাম, লেখক কী তবে ভুলে গেছেন! তাই-বা সাহস করে বলি কী করে! আবার এটাও মনে হলো সতীনাথের সাহস এবং সততা আছে বটে। তিনি একটা জিনিস খুব ভালোমতোই জানেন, যা লিখব মনের আনন্দে লিখব, এবং চাপিয়ে দেবো না এক-কলম। এতকিছু লিখলাম, কিন্তু এখনো দ্বিতীয় অধ্যায় পড়িনি। উপন্যাস আগাগুড়ি শেষ না করা পর্যন্ত কোনো ধরনের মন্তব্য বালসুলভ নয় কী?


COMMENTS

error: