আবির্ভাবদশক ও কবি নূরুল হক || সৈয়দ নাজমুল করিম  

আবির্ভাবদশক ও কবি নূরুল হক || সৈয়দ নাজমুল করিম  

তিনি ষাটের দশকে আবির্ভূত আত্মপ্রচারবিমুখ এক কবি। ষাটের প্রথমার্ধেই তাঁর কবিতাচাষবাসের সূচনা। সে-সময়েই নিজের জন্মজেলা (তখন মহকুমা) শহর থেকে প্রকাশ হতো পাক্ষিক উত্তর আকাশ  পত্রিকা। এই উত্তর আকাশ  পত্রিকায়ই সমসময়ের কবি রফিক আজাদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি আল আজাদ, কবি খালেদ মতিন (তখন খালেদ বিন অস্কার), কবি মুজিবুর রহমান, কবি শান্তিময় বিশ্বাস প্রমুখের মতো লেখা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁরও কবিসত্তার প্রকাশ ঘটে এবং ময়মনসিংহ ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় লেখা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তখনই তাঁর কবিপরিচিতও গড়ে ওঠে।

তবে ঐ যে বললাম আত্মপ্রচারবিমুখতা — পত্রপত্রিকায় ঘন ঘন লেখা ছাপানো, সমসময়ের পরবর্তী সময়ের কবিদের কবিতা নিয়ে মলাটবন্দি সংকলনগুলোতে নিজেও সংকলিত হওয়ার খবরাখবরটা রাখা, দশকের রেলগাড়ি ধরতে দশক ফুরানোর আগে বা পরের দশকের শুরুতেই একটা বই প্রকাশ করে ফেলা প্রভৃতি না-করায় একটা লম্বা সময়ের পাকে ডুবে গিয়ে তিনি সমসময়ের কবিদের থেকে প্রায় হারিয়েই গেলেন। অনেকে তাঁকে সত্তরের দশকে আবির্ভূত কবিও বলেন। নিজের জন্মজেলার অনেককেও বলতে শুনেছি। যাক, এসবে অবশ্য কারো কবিতাকীর্তির কিছুই এসে যায় না। কবি নূরুল হকেরও না। তিনি ষাটের দশকেই আবির্ভূত। এবং আশির দশকে তাঁর কবিতার একটা বৈপ্লবিক বাঁক/পরিবর্তন ঘটে।

প্রথমদিকের লেখা তাঁর কবিতার অধিকাংশই ছিল স্যাটায়ারধর্মী। ১৯৭৯ সালে সে-সময়ের কবিতাগুলো নির্বাচন করে ‘মধ্যরাতে মোকাবেলা’ নামে একটা পাণ্ডুলিপিও তৈরি করেছিলেন আশির দশকের শুরুতেই প্রকাশ করার ইচ্ছা নিয়ে এবং তখন নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত একটি নন্দনঋদ্ধ সাহিত্যপত্রিকা সৃজনীর এক সংখ্যায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন, কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক শেষাবধি সেই পাণ্ডুলিপিটি আর আলোর মুখ দেখেনি। কবি নূরুল হক এ-সময়ে সৃজনীর সম্পাদকমণ্ডলীরও ছিলেন অন্যতম এবং পত্রিকাটির কবিতা বাছাই/নির্বাচন তথা কবিতা সম্পাদনার দায়িত্বে তিনি এবং শামসুল হুদা ও নাসির উদ্দিন নামে দুই কবিম্যাজিস্ট্রেটও নিযুক্ত ছিলেন।

কবি নূরুল হক পেশাগত জীবনে ছিলেন কলেজশিক্ষক। ১৯৬৮/’৬৯ সাল থেকেই নেত্রকোনা কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং১৯৮০/’৮১ সালে কলেজটি সরকারিকরণের পরেও বছর-দুই সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মযুক্ত থেকে পদোন্নতি পেয়ে শিক্ষা-অধিদপ্তরে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। শেষে ঢাকার সরকারি ইডেন কলেজে অধ্যাপক পদে কর্মযুক্ত থাকাকালে অবসর নেন। নেত্রকোনা কলেজে শিক্ষকতাকালে আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর ছাত্র হওয়ার। ছাত্র বলতে যা বোঝায় তা তো আর ছিলাম না, বনবাদাড়ের মোষ তাড়ানোতেই দিন কাটত। তারপরও দুটি ক্লাস — নূরুল হক স্যারের বাংলা ক্লাস আর শাহজাহান কবীর স্যারের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্লাস দুটিতে পারতপক্ষে অনুপস্থিত থাকতাম না, কারণ দুটি ক্লাসে নিয়মিত থাকলে বিষয়গুলো দ্বিতীয়বার না-পড়লেও চলত।

কবি নূরুল হক স্যার কোলাহল বা হৈহুল্লোড়ে ভিড়তেন না, তবে সঙ্গীহীন জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসেও ছিলেন না তিনি। যথেষ্ট আড্ডাপ্রিয়ই ছিলেন। তবে আলবদর-রাজাকার ছাড়া বস্তুবাদী না-হলেও মুক্তচিন্তা পরিপন্থী নয় এমন দক্ষিণপন্থীকেও আড্ডায় আহ্বান করতেন। কেউ কেউ অন্তর্মুখী ও নির্জনতাপ্রিয় সত্তার যে-ব্যাখ্যাই দিন বা শব্দদুটি প্রচলিত যে-অর্থই বহন করুক, আমি কোনো কবিকেই নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা এবং মানুষের সংস্রববিমুখ সত্তা হিসেবে নির্বাচন করতে নারাজ। একজন অন্তর্মুখী ও নির্জনতাপ্রিয় সত্তা কী করে উপলব্ধি এবং উচ্চারণ করেন — “জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য / যা দেখে মানুষ / বাড়ি ফেরার কথা / ভুলে যায়”! সমগ্র মানবজীবন যদি তার ধ্যানজ্ঞান না হয়, সকল জীবনের সংলগ্নতা যদি কারো না থাকে, যদি সে বিশ্বলোকই ধারণ করতে না পারল, কী করে তবে হয় সে বাউল আর প্রত্যক্ষ করে এই চরাচরের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনকানন? অন্তর্মুখিতা বা আত্মমগ্নতা তো আটপৌরে জীবনাচারীর ধ্যানজ্ঞান। এ-জীবন কী করে কবির আরাধ্য হয়ে ওঠে, বুঝতে পারি না। কবি তাঁর কবিতায় অন্তর্মুখী বা আত্মমগ্ন হতে পারেন, যদি কোনো সুফলপ্রসূ চর্চা তাঁর লক্ষ্য হয়, কিন্তু কবির ব্যক্তিসত্তাটাই যদি অন্তর্মুখী বা আত্মমগ্ন হয়ে ওঠে তবে তো মুশকিল।

কবি নূরুল হকের স্কুলজীবনের অনেকটা সময় কেটেছে দেশবরেণ্য বাউল-কবি জালাল উদ্দিন খাঁর বাড়িতে অতিথি হয়ে। কবি সরোজ মোস্তফা জানিয়েছেন, কবি নূরুল হক বাউল হওয়ার জন্যে মসজিদে মোমবাতি মানত করেছিলেন। সরোজ মোস্তফা যথার্থই বলেছেন — সৃষ্টিকর্তা তাঁর মানত কবুল করেছেন। তাঁর কবিতা এক গহীন উপলব্ধিনিঃসৃত। তাঁর উপর্যুক্ত ‘পাদটীকা’ শীর্ষক কবিতাটি আমার তো বোধহয় তাঁর সমগ্র কবিতাকীর্তিরই পাদটীকা। জীবন ও জগতের বৈচিত্র্যই তাঁকে অন্তর্মুখী বা আত্মমগ্ন আটপৌরে জীবন থেকে মুক্ত করে বহির্মুখী বা অপূর্ব এই বিশ্বলোকমুখী করেছে এবং সূচনাকালের কবি নূরুল হককে দিয়েছে কবিতার নতুন বাকবিভূতিও।

কায়মনোচিত্তেই একটা বাউলিয়ানা তাঁর মধ্যে ছিল — যে-প্রবৃত্তি ও চৈতন্যের বীজ তাঁর মধ্যে সেই মসজিদে মোমবাতি মানতকালেই রোপণ হয়। আশির দশকে তিনি প্রায় অনালোচিত বা হারিয়ে-যাওয়া তিরিশি কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বাংলাদেশের কবিতাপাঠকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁর কবিতাকীর্তির আশ্রয় নিয়ে সামগ্রিক কবিতা বিষয়েই লিখলেন এক প্রজ্ঞাঋদ্ধ ও দীর্ঘ আলোচনা। এ-সময়েই অর্থাৎ আশির দশকে আবির্ভূত অন্যতম কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতারও সপ্রশংস পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন একাধিক দিন। কথাটা যে যেভাবেই নিক গীতাঞ্জলির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন তিরিশের দশকে নবীভূত হয়েছিলেন, কবি নূরুল হকও নবীভূত হলেন ঐ সময়ে তাঁর দুই দশকের কবিতাযাপনের পর দীর্ঘ বিরতি নিয়ে। আর একুশ শতকের প্রথম থেকে পরপর তিনটি গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করলেন গভীর উপলব্ধিজাত ও নন্দনঋদ্ধ এক স্বতন্ত্র বাকবিভূতি।


সৈয়দ নাজমুল করিম। কবি ও প্রাবন্ধিক

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you