আমাদের মনে পড়বে যে, একাধিক প্রকাশনাগার ছিল নব্বইয়ের গোটা দশক ভরে — যেসব প্রকাশনাগার থেকে ঠিক আমাদের চেনা-চেনা লেখকদের বই বেরোত না একটাও। এইসব প্রকাশনীর অবস্থান ইন্ডিয়ায়, পশ্চিমবঙ্গে মূলত, আমাদের দেশে এই-ধারা আনকা লেখক খুঁজে বের করবার কোনো বিশ্বস্ত উদ্যোগ তখনও ছিল না যেমন তেমনি এখনও নেই। কিছু ছোটকাগজকেন্দ্রিক প্রকাশপ্রক্রিয়া নানান সময়ে গড়ে উঠেছে এখানে, এই দেশে, ফের ভেস্তেও গিয়েছে অচিরে, এইসব প্রকাশনার দেড়-দুইটা ভালো কাজের সঙ্গে তেরোটা আত্মতুষ্টিকীর্ণ গরিমাভারী ভুয়া কাজ, হঠকারিতায় ভাসা কাজ, ম্লান ও সন্দেহ-আবিল করে তুলত তাদের পূর্বকীর্তির সুনাম। “খুব বেশিদিন বাঁচব না আমি বাঁচতে চাই না” — এমন একটা লাইন আছে শক্তিতে, এইটা ঠিক আছে, কিন্তু যে-কয়টা দিন বাঁচবেন আপনি সে-কয়টা দিন যেন কোয়ালিটি বাঁচাটা বাঁচিয়া যাইতে পারেন। স্বল্পায়ু অফস্ট্রিম পাব্লিশিং প্লেইসগুলো, অন্তত আমাদের দেশে, সংখ্যা ও মান উভয় দিক থেকেই দাগ কাটার মতন বাঁচাটা বাঁচতে পারেনি বলে মনে হয়।
একটু-একটু বড় হচ্ছিলাম আমরা হাঁটি-হাঁটি পায়ে অথবা বড় হয়ে উঠতে চাইছিলাম এবং খুঁজে ফিরছিলাম নতুন ট্রেইল। যদিও বড়-হওয়া আর হয় নাই, কিংবা ব্যাহত হতে হতে বড়-হওয়া থামিয়া গেছে একসময়, অ্যানিওয়ে। এটুকু মনে আছে যে, বড় বড় বইপ্রকাশক মূলধারা ব্যবসাকারীদের পাশাপাশি প্রচুর বই আমরা হাতের নাগালে পেয়েছিলাম যেসব বই বের হতো ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ ও অন্য কয়েকটি প্রদেশ থেকে এবং যেগুলোকে আমরা অফবিট প্রকাশনা হিশেবেই চিহ্নিত করে রেখেছিলাম। অবশ্য খোদ ‘অফবিট’ নামে একটা প্রকাশনা ছিল, এখন আছে কি না জানি না, অনেক বই এরা বের করেছেন এবং এদের বইগুলো নির্বাচন করার ব্যাপারটা ঠিক মেইনস্ট্রিম প্রকাশনার মতন ছিল না। ‘অফবিট’ অবশ্য যথেষ্ট বৃহদাকার প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠানই ছিল, অলমোস্ট লাইকলি-টু মেইনস্ট্রিম। সংগঠিত ছিল যথেষ্ট, এই প্রকাশাগারটি। এইরকম আরেকটা পাব্লিশিং হাউজ যেইটা মেইনস্ট্রিম হয়েও অসংখ্য বই করেছে যেগুলো ঠিক মেইনস্ট্রিম চিন্তাভাবনাসর্বস্ব হইলে সম্ভব হতো না, সেই প্রকাশনাটা দে’জ পাব্লিশিং নামে মশহুর, এদের বইছাপার বনেদ অনেক পুরনো ও লম্বা। দে’জ-এর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সিরিজের বইগুলোর সুবাদে অনেক সত্যিকারের ভালো কবিকে আমরা ইন-অ্যান্ড-আউট পড়তে পেরেছি, আনন্দ হয়তো এই কবিদের বই ছাপানোর রিস্ক কোনোদিনই নিত না। তাছাড়া কথাসাহিত্যের জায়গাতেও দে’জ প্রচুর ভালো কাজ করেছে, এবং সাহসের ও ব্যবসাসংস্রবহীন সততার কাজ, সেই ফিরিস্তি দিতে গেলে আঁটঘাট বেঁধে বসতে হবে।
এইবার আসা যাক সত্যিকারের অ্যান্টি-মেইনস্ট্রিম তথা অফবিট প্রকাশনাধারার জায়গায়। এর আগে কবুল করি যে, সুবিমল মিশ্র বা উদয়ন ঘোষ বা ধরুন কবিদের ক্ষেত্রে প্রণব পাল বা এইরকম যারা ক্ল্যানভিত্তিক প্রকাশনার লেখক — প্রণব পাল প্রমুখদের ‘ভাষাবদল কবিতান্দোলন’ মোটেও মনঃপুত হয় নাই আমার কোনোদিনই — এদের কাজকর্ম গুরুত্বপূর্ণ, তবে এখানে এদের কথা ভাবতে চাইছি না। আমরা বরং বলতে পারি যে, ‘গ্রাফিত্তি’ নামে একটা প্রকাশনা ছিল — চালাতেন শুভঙ্কর দাশ ও শর্ম্মী পাণ্ডে স্বামী-স্ত্রী মিলে — এদের কাজকর্ম অফস্ট্রিম হিশেবেই দেখেছি আমরা। ‘এবং নৈকট্য’ নামে একটা প্রকাশনার কাজ প্রচুর দেখেছি, দুইহাতে কিনেছি, খুব সস্তা ছিল এদের প্রোডাকশন্স প্রাইসের দিক থেকে। ‘এবং নৈকট্য’ নামে একটা পত্রিকা করতেন এরা, অনেক সংখ্যা আজও সংগ্রহে রয়েছে, যেমন ‘অর্বাচীন’ নামে একটা পত্রিকা বার করতেন গ্রাফিত্তিওয়ালারা। পত্রিকাকেন্দ্রিক প্রচুর বইয়ের প্রকাশনা ছিল, বেশিরভাগ প্রকাশনাই জাঁহাবাজ এবং সত্যিকারের লিটারেরি নিরীক্ষা ও স্পিরিট ছিল সেসবের ভেতর। ‘কৌরব’ প্রকাশনীর অজস্র অবদান কেমন করে ভুলিয়া রই আমি! কিংবা কৌরব পত্রিকাটার দুর্ধর্ষ ও দীর্ঘ অভিযাত্রা! বারীন ঘোষাল আর কমল চক্রবর্তীর গদ্য তো আজও চমৎকার। কবিতা না অতটা যদিও। ‘কবিতাপাক্ষিক’ পত্রিকার চটি সংখ্যাগুলোও মনে পড়ে। কবিতাপাক্ষিক প্রকাশনীর বইপত্র অগোছালো ও অহেতু কম্মে ভরা ছিল বলেই মনে হয়। কিন্তু প্রচুর কাজ করেছেন বটে, এই গ্রুপটাও, প্রভাত চৌধুরী নিজে একজন ভালো কবি তো অবশ্যই। ঠিক এইরকম পত্রিকাকেন্দ্রী বইপ্রকাশের জায়গাগুলো স্বদেশসীমান্তের বাইরে থেকে বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে আমার বেড়ে-ওঠার সময়টায় বাংলাদেশে। এই ধারার বড় বড় কয়েকটা নাম এক-নিঃশ্বাসে বলে রাখি : ‘এবং মুশায়েরা’, ‘কবিতীর্থ’, ‘বিজ্ঞাপনপর্ব’, ‘অনুষ্টুপ’, ‘রক্তমাংশ’ ইত্যাদি। আরও কত অসংখ্য ছোটকাগজকেন্দ্রী প্রকাশনালয় একসময় ছিল! অনেকেই নেই আজ, অনেকেই অনেক বড় প্রকাশনায় গেছেন এবং টিকিয়া আছেন।
মনে পড়বে যে, একটা প্রকাশনা ছিল ‘প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন্স প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে, সংক্ষেপে ‘প্রতিক্ষণ’, এদের প্রচুর বইপত্র দেখেছি, কিছু কিনেছি সাধ্যানুযায়ী, কিন্তু আজও জুড়ি পাই নাই এদের কাজের। তখন এরা টানা অনেক বছর শারদীয় সংখ্যা বের করেছেন প্রতিক্ষণ নামে, আমাদের অনেকের সংগ্রহে সেই শারদীয় পত্রিকা প্রতিক্ষণ আছে আজও, খুব-বেশিদিন আগের কথাও নয় অবশ্য। দুর্দান্ত ছিল প্রতিক্ষণ দিনগুলো। ‘প্রতিভাস’ নামে একটা পাব্লিশিং হাউজ গড়ে ওঠে একসময়, এদেরও প্রচুর অফট্র্যাক কমার্শিয়্যালি রিস্কি কাজ রয়েছে, আমরা উপকৃত হয়েছি, কিন্তু প্রতিভাস সম্ভবত বিগ হাউজ হওয়ার জন্যই লগ্নি করেছে বইয়ের বিজনেসে, এবং যথেষ্ট উন্নতিও হয়েছে এইদিকে। এইটা খারাপ না আদৌ। প্রতিভাস ভালো করছেন এইক্ষেত্রে। একটা প্রকাশনা থেকে অনেক বই পড়েছি স্মার্ট অনুবাদের, ‘দাহপত্র’ সেই প্রকাশনী, মূলত ‘দাহপত্র’ ছোটকাগজের সুবাদে এই প্রকাশনীর সমস্ত বই হাতে নিয়ে দিনের-পর-দিন আদর করেছি। এমনি আরও কত প্রকাশনা!
বলা বাহুল্য, লেখাপড়া ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিতে শিখেছি এইসব প্রকাশনার দৌলতে। লেখালেখি জিনিশটা-যে ফাইজলামি নয় শুধুই, এই ব্যাপার জেনেছি জীবনের সকালবেলাতেই, এইসব অফস্ট্রিম প্রকাশনীর মারফতে। আমাদের দেশেও অল্প-গুটিকয় এমন উদ্যোগ মাঝেমাঝে দেখেছি, অপুষ্টির শিকার হলেও গুটিকয় ভালো কাজ হয়েছিল এ-বাবতে, অ্যানিওয়ে, এই নিয়া বাদে একসময় যেতে পারে বলা। তারপরও বলি স্মৃতি হাতড়ে দেড়-দুই দৃষ্টান্ত সংক্ষেপে। একটা পত্রিকাকেন্দ্রী ‘শিল্পতরু’ প্রকাশনীর কথা মনে পড়ছে, একটু বড় আকারে এরা করতে চেয়েছিলেন কিছু মনে হয়, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবিদ আজাদ এইটা চালাতেন, বন্ধ হয়ে যায় একসময়। এরপর সীমিত আকারে ‘গাণ্ডীব’ ইত্যাদি কিছু লিটলম্যাগ নিজেরা নিজেদের বই ছেপেছেন, যা-হোক, আমাদের দেশে এই জিনিশটা ঠিক সর্বাঙ্গসুন্দরভাবে চালানো যায়নি। কিন্তু প্রচুর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গজাইছে ফি-বছর, তরুণ লগ্নিকারকও আসছেন নতুন নতুন, কিন্তু বিড়ালের গলায় তো ঘণ্টা কেউই বাঁধছেন না, মানে তারুণ্যস্পন্দী লিটারেচার নিয়া তো তরুণ প্রকাশকদের কোনো হেলদোল দেখি না। আর যেখানে দেখি, সেইখানে তো দ্বিতীয়বার দাঁড়াবার সাহস হয় না, ঈমান ও আমল দুইটা একসঙ্গে হারাইবার ভয়ে। এইসব সিরিয়াস ব্যাপার, গবেষকদের ব্যাপার, নোটকের নয়, অ্যানিওয়ে।
সবশেষে যে-প্রকাশনাটা আমাদের মন ও মনন ধাঁধিয়ে দেয়, সেইটা নিয়া খানিক বলেই বিদায় নেই। ‘মনচাষা’ নামে এরা আসেন, নাম দেখেই তখন প্রেমে পড়বার বয়সের শেষ ঘাটে এসে পৌঁছেছি আমরা, বছর-দুয়েকের মধ্যেই সম্ভবত এদের নাম হয়ে যায় ‘মনফকিরা’। অসংখ্য সুন্দর বই, বিশেষত অনুবাদের, পড়েছি এই প্রকাশনার সুবাদে। মনচাষা থেকে, যদ্দুর মনে পড়ে, একটা পত্রিকা বেরিয়েছিল গান বিষয়ক, ‘ত্বষ্টা’ নাম সেই পত্রিকার, একটামাত্র সংখ্যা আছে আমার কাছে, এইটা পরে কন্টিনিউ করেছে কি না আমি জানি না। যা-হোক। মনফকিরা এখন পূর্ণযৌবনা, টাট্টুঘোড়া, তাদের কাজ এখন সমীহ করেন বাংলার সক্কলে। এই মনফকিরা তথা এর কাণ্ডারিদের একজন সন্দীপন ভট্টাচার্যের একটি ইন্টার্ভিয়্যু পড়ে এতকিছু মনে পড়ে গেল। সুন্দর ইন্টার্ভিয়্যু, জটিলতাহীন, অথচ জবর্দস্ত্! কাজের কাজ হয়েছে একটা। সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটা। যারা করেছেন, সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন, নমস্য তারা। নমস্য মনফকিরা। আমাদের কালের গরিমা এই একটা প্রকাশনালয়ের কাজে দেখা যায়। যারা রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ নিয়া নাকিকান্না কান্দেন, ধ্রুপদী হিন্দুস্তানি মিঠাই-জিলিপি-লাড্ডু ও ম্যুজিক নিয়া ফালাফালি-বিজ্ঞবুড্ডাগিরি করে বেড়ান, তারা জানেন না মনফকিরার মালামাল বিষয়ে। বুড়োরা থাকুন তাদের থানকুনিপাতা আভিজাত্য নিয়া। আমরা জানি যে, এভরি জেনারেশন গেটস্ দি লিট্রেচার ইট ডিজার্ভস্। কিপ গোয়িং, লাল জীপ, কিপ ইট আপ মনফকিরা!
লালজীপ আয়োজিত সম্পাদক ও প্রকাশক সন্দীপন ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার থেকে তিনটি অংশ উৎকলন করছি নিচে, সেইসঙ্গে একটা গদ্যের লিঙ্ক, উৎকলিত অংশের বানান মূলে যা তা-ই রইল অবিকল।
____________________________
ইন্টার্ভিয়্যুয়ের একাংশ :
লাল জীপ : যেকোন ধরনের পাঠক দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, এটা হামেশাই শোনা যায়। মনফকিরাও কি তা-ই মনে করে? বা এর কি পুনরুদ্ধার সম্ভব, নাকি এটা কোন ট্রানজিশন। বই এবং পাঠকের এক ধরনের ইভালুয়েশন?
সন্দীপন : আপাতভাবে শোনা কথাটা সত্যি বলেই মনে হয়। কিন্তু আমাদের মনে হয় এর পেছনে কোথাও একটা অন্য গল্পও আছে। সত্যিই কি পাঠক কমছে, নাকি তাকে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য কোথাও, অন্য কোন দিকে, যেখানে ভাবনা-কল্পনার তেমন কোন অবকাশ নেই। ছাপা অক্ষর পড়তে যে খুব মিনিমাম স্কেলেও খানিকটা ভাবতে হয়, কল্পনা করে নিতে হয়, এ কথা তো সত্যি। তার বদলে ভাবনাহীন, কল্পনাহীন কোন জগতে আমাদের নিক্ষেপ করার সচেতন কোন পরিকল্পনা কোথাও কাজ করছে না তো! সে পরিকল্পনা বানচাল করে দেওয়ার মধ্যেই হয়তো আছে পাঠক ফিরে পাওয়ার চাবিকাঠি।
…
লাল জীপ : ইন্টারনেট ও ইবুক এর এই যুগে ছাপাগ্রন্থের ভবিষ্যৎ কী, আপনার মতে?
সন্দীপন : ভবিষ্যৎ যদি না-ই থাকে, তাতেই বা ক্ষতি কী? সে ভাবেও তো পাঠ্যবস্তুর কোন অভাব হচ্ছে না। দরকার তো পড়ার মত লেখা। তা অন্য কোন ভাবেও যদি আপনার কাছে পৌঁছয়, তাতে অসুবিধে কী? কাগজে ছাপা বই যদি লুপ্তই হয়ে যায়, অন্তত তা নিয়ে আমাদের কোন দীর্ঘশ্বাস নেই। বরং হয়ত ভালোই হবে তাতে, পৃথিবীর অবশিষ্ট গাছপালাগুলো বাঁচবে।
…
লাল জীপ : কবিতা, গল্প না প্রবন্ধ কোন ধরনের গ্রন্থ পাঠে আপনার আগ্রহ বেশি?
সন্দীপন : আগ্রহের তো এমন কোন নির্দিষ্টতা থাকতে পারে না, সময়বিশেষে তা পালটে-পালটে যায়। তবে যদি সত্যি কথা বলি, বলতে হয়, সবচেয়ে ভালো লাগে লেখকের নিজ অভিজ্ঞতায় জারিত একেবারে ভণিতাহীন লেখা পড়তে, সে লেখার রূপ যা-ই হোক না কেন। সে দিক থেকে আত্মকথা, স্মৃতিকথা বা ব্যক্তিগত ডায়েরি-র কোন তুলনা হয়না, যদি তা নেহাত ‘আমি’-ভারাক্রান্ত না হয়। এমনকী সাক্ষাৎকার পড়তেও চমৎকার লাগে। তবে এ সবই তথাকথিত কথাসাহিত্যিকদের না-হলেই ভালো। ভালো হয়, যদি তা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন, বা শিল্পের ভিন্ন কোন মাধ্যম নিয়ে চর্চা করছেন, এমন কারও লেখা হয়। সাধারণ প্রবন্ধের বই-ও তখনই ভালো, যখন সেখানে লেখকের জ্ঞানগম্যি জাহির করার বাতিক থাকে না।
ভালো লাগার কথা যখন হল, তখন খারাপ লাগার কথাও একটু হোক। সবচেয়ে খারাপ লাগে অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ পড়তে, সে যে-বিষয়েই হোক না কেন। বিরক্তিকর। ভূরি-ভূরি রচিত হয় এই সব ধান্ধাবাজির লেখা, দিব্যি সে সব ছাপাও হয়। না-হলেই ভালো হত বোধ হয়।
____________________
সন্দীপন ভট্টাচার্য ইন্টার্ভিয়্যুলিঙ্ক
সন্দীপন ভট্টাচার্য রচিত অটোবায়োগ্র্যাফিক গদ্য
পোস্টস্ক্রিপ্ট দুইহাজারপঁচিশ
রচনাটা তাৎক্ষণিক, দুইহাজারচোদ্দ সালের মে মাসের, যখন অনলাইন আর্টপত্রিকা লাল জীপের ডায়েরী ইন্ডিয়ান প্রকাশনা মনফকিরাপ্রধান সম্পাদক ও অনুবাদক সন্দীপন ভট্টাচার্য মহাশয়ের সাক্ষাৎকার আয়োজন করে, যেখানে দেশের বিদেশের বাংলাদেশের ভারতের বইয়ের বাজার বিপণন ও বইক্রেতা পাঠক পণ্ডিত পামর অনেককিছু নিয়া আলাপ হয়েছিল, সঙ্গে একটা আলাদা গদ্য, মনফকিরার ভূতভবিষ্যৎ সম্পর্কিত সন্দীপন ভট্টাচার্যের আত্মগত গদ্য। মনে হয়েছিল, মনফকিরার মতো তখন পর্যন্ত অফস্ট্রিম আরও কিছু প্রকাশনা হাউজ নিয়া লালজীপ বোধহয় ধারাবাহিক কাজ করবে। সেইটা না হলেও অর্পণ দেব বিজয় আহমেদ সঞ্চালনায় লালজীপ সেই সময় বাংলাদেশে জন্মানো ওয়েবক্ষেত্রগুলোর অগ্রসারির একটা, যাদের একটা প্ল্যানড সম্পাদনাদৃষ্টি ছিল। প্রত্যেকটা পার্ট বাই পার্ট পোস্টগুলি মিলে সেই ইন্টিগ্রেইটেড সম্পাদনাদৃষ্টির নিদর্শন অনায়াস বোঝা যেত। কবিতা, গান, ম্যুভি, চিত্রকলা, ভাস্কর্য সহ সব দিকেই লালজীপের আগ্রহ লক্ষ করা যেত, সর্বোপরি বাংলাদেশের নতুন গদ্য শোকেইসিঙের দিকে এর বিশেষ আগ্রহ, ওই সময়টায় লালজীপ ফেনোমেনাল হয়ে উঠতে পেরেছিল অন্তত কয়েক বছরের জন্য। পরে এইটা ডাই ডাউন করে। একটা টাইমের পর থেকে একদশক পার হয়ে গেছে এর আর সঞ্চালনা নাই। কিন্তু ব্লগযুগ অবসিত হবার কালে অনলাইন পোর্টাল প্রকাশের গোড়ার টাইম থেকে এমনকি ইয়ার টুথাউজ্যান্ডটোয়েন্টিফাইভ অবধি ইন্ডি মডারেশনের একটা মার্ক লালজীপ। ওয়ার্ডপ্রেসে এর আর্কাইভড ভার্শনটা চাইলে দেখে নেয়া যায়। অ্যানিওয়ে। এখানে এইটুকু শুধু বলি, বিচিত্র রঙ ও বল্লরীর অনলাইন প্রকাশনার জগতে যেটুকু সম্পাদনা থাকলে একটা সাইট রিমার্কেবল হয়ে উঠতে পারে সেটুকু সম্পাদনা লালজীপের ছিল বলেই একদশক পরে এসেও ঘটনাটা জানান দেয়। ফেইসবুকে মেমোরি ফিরায়া আনে, যেখানে মে মাসের এক দিনে দুইহাজারচোদ্দ সালে লালজীপের একটি ইনিশিয়েটিভ মার্ক করে রেখেছিলাম যাতে একসময় বিশদে লেখা যায় বাংলাদেশের অফস্ট্রিম প্রকাশনা নিয়া। তা আর হয় নাই। নিবন্ধটা লালজীপলিঙ্ক শেয়ার করার সময় যেটুকু হয়েছিল লেখা, তা-ই। বিশেষ আর কী বলব। অফস্ট্রিমের প্রকাশনায় বাংলাদেশের পিকচারটা আর দেখা হয় নাই ফিরে। এর মধ্যে গেছে চলে একদশকের বেশি সময়। এই সময়ে মেইনস্ট্রিম অফস্ট্রিম দুনো ধরনের বইপ্রকাশনা বাংলাদেশে ব্যাপকতর হয়েছে। একসময়কায় লিটলম্যাগকেন্দ্রী ছাপাছাপি স্তিমিত হয়ে এলেও প্রকাশনা আরেক প্যাটার্নে বেড়েছে। এখানে মেইনস্ট্রিম নিরূপণ করে এরপরে অফস্ট্রিম পাওয়া যাবে। সেই কাজটা করতে পারলে অফস্ট্রিম প্রকাশনায় বাংলাদেশের বিগার পিকচারটা গ্র্যাব করা যাবে। এইটা কর্তব্য। অফস্ট্রিম স্ট্রেঙদেন করা না গেলে মেইনস্ট্রিম ধুঁকবে। এই কথায় ট্রাস্ট রেখে যদি বাংলাদেশের ব্যক্তিকেন্দ্রী প্রিন্টবইয়ের বাজার রিভিয়্যু করা হয়, যেখানে রয়েছে বন্ধুবান্ধব মিলে কবি কথাসাহিত্যিকের বইটা বার করে দেয়ার ভ্যানিটি প্রেস, রয়েছে লেখকের নিজের বই নিজে ছাপাবার মর্যাদার সেল্ফপাব্লিক্যাশন, তরুণ প্রকাশন ইনোভেশনসমূহ, সব দিক বিবেচনায় রেখে একটি বিগার পিকচার ক্যাপচার করা যায় বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার অফস্ট্রিম প্রকাশনা ছাপাছাপির। বর্তমান নিবন্ধে সেই ইচ্ছাতাড়িত স্বতঃপ্রণোদনাটা হাজির ছিল না, লালজীপের একটা আয়োজন নোটের অপশন ব্যবহার করে একটা পাঠকডাকা আলাপ ছিল রচনাটা। তা-ই রইল। শুধু পোস্টস্ক্রিপ্টামটুকু যুক্ত হলো। নভেম্বর দুইহাজারপঁচিশ। অগ্রহায়ণের তিসরা রাইত। শরীরে স্যুয়েটার চাপাবার মতো কুসুমস্পর্শী শীত সবেমাত্র পড়তে শুরু করল।
জাহেদ আহমদ
- ইন্ডিয়ান বাংলায় মেইনস্ট্রিম ও অফস্ট্রিম প্রকাশনা - November 18, 2025
- নৃপতি নিরো ও নগরভস্ম - November 15, 2025
- ভারতীয়া শারদীয় সংখ্যায় একটা বাজারবান্ধব নভেলা পাঠের স্মৃতি - November 9, 2025

COMMENTS