জন্মদিন
জন্মদিন নিয়া আনুষ্ঠানিকতা-পার্বণ-উৎসব আমাদের লোকালয়ে সেভাবে দেখা যায় না। আমাদের সমাজে অবশ্য শিশুজন্মের অব্যবহিত পরে এবং পরপর কয়েক বছর ধাপে ধাপে কিছু চমৎকার আনুষ্ঠানিকতা-আচারকৃত্য পালন করা হয়ে থাকে। যেমন, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আজান দিয়া বা উলুধ্বনি দিয়া আগতকে স্বাগত জানানো, মধু আর তালমিছরির আরক খাওয়ানো, নাম নির্বাচন ও নবজাতকের আকিকা ইত্যাদি, প্রথমবার কেশ ছাটানোর সময় কৃত্যাদি, মুখেভাত অনুষ্ঠান বা অন্নপ্রাশন, হাতেখড়ি ইত্যাদি কিছু অনুষ্ঠান একেবারেই শিশুজন্মের সাদর অভ্যর্থনার বহিঃপ্রকাশ। এরপর ধাপে ধাপে শিশুর বয়ঃবৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে বেশকিছু অনুষ্ঠান করা হয়। যেমন, খৎনা দেয়া বা নাক-কান ফোঁড়ানো ঘটা করে, উপবীত বা পৈতে নেয়ার অনুষ্ঠান ইত্যাদি। কিন্তু এরপর, অর্থাৎ, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কের জন্ম/জন্মদিন নিয়া সামাজিকভাবে তেমন কোনো অনুষ্ঠান থাকে না আর। এর নানারকম কারণ আমরা ভাবতে পারি। ব্যাপারটা আমাদের সমাজগড়নের সঙ্গে মিলিয়ে ইতিবাচকভাবে দেখা যায়, এবং উল্টোটাও। তবে এটা আলবৎ ঠিক যে, একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্মদিন উদযাপন পারিবারিক ও সামাজিক কোনো পর্যায়েই হতে দেখা যায় না। শুধু তা-ই নয়, এখানকার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্মদিন পালন সমাজে বেশ হাস্যরস যোগায়, ব্যাপারটাকে একপ্রকার প্রদর্শনকামিতা বা আদিখ্যেতা বলে গণ্য করা হয়। ব্যক্ত ওই বাক্যেই প্রকাশিত বক্তার শ্রেণিচরিত্রটি। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার শ্রেণির মানুষের কাছে ব্যক্তিগত জন্মদিন নিয়া আন্দুধুন্দু ঘটা করা আদেখলামো ও অতিরিক্ততা ছাড়া আর কিছু না। আমাদের সমাজে অবশ্য শ্রেণিবৈচিত্র্য রয়েছে, শ্রেণিফারাক দুস্তর অপার, কিন্তু শ্রেণি নিয়া কথাবার্তা বলা ভদ্রলোকের কাজ নয়, ব্যাপারটা ট্যাবো আসলে। বেশ শ্রেণিসুন্দর সমাজে বাস করি আমরা, সুখে। এবং অস্বস্তি উৎপাদন করতে কে চাইবে, বলুন? বলা যেতে পারে, কেবল বিত্ত নয়, চিত্তের দিক বিচারেও এরা, মানে আমরা, দরিদ্র নেহায়েত। এরা মানে আমার শ্রেণির মানুষেরা। কালচারালি ইনফ্যান্ট বা পুওর বা যা-ই বলো, আমরা তা-ই। অসুবিধা নাই। আর আমি যে-সময়ে ও যে-সমাজগণ্ডিতে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, সেখানে জন্মদিন আলাদা কোনো গুরুত্ব পায়নি কখনো। জন্মমুহূর্তে সন-তারিখ-দিন-ক্ষণ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে লিপি-আকারে একটা ছোট্ট পকেটবুকে, ব্যাস, আর কী চাই! সত্যিই তাই। ওইটুকুই তো ঢের। যেখানে রোজকার আহার যোগানো নিয়া হতে হয় গলদঘর্ম প্রতি পলে, সেখানে জন্মদিনে কেক-পলান্ন-তরলকঠিন ভোজনের জায়গা বা ফুরসত কোথায়? তা-ও আবার বছর-বছর! জন্মদিনের খোঁজ পড়ে, আমার শ্রেণিগণ্ডির মানুষের জীবনে, সাকুল্যে দুই-চারবার। সে-ঐ পরীক্ষার ফর্ম-ফিলাপ বা বিদেশযাত্রার প্রাক্কালে, তা-ও দিনটি প্রকাশের তাগিদে নয় বরং লুকানোরই প্রয়োজনে। পরীক্ষায় আমরা বয়স কমিয়ে বসি, খুবই প্র্যাক্টিক্যাল তার পেছনের কারণ। আমরা ধরেই নেই আমাদের চাকরি পেতে বিলম্ব হবে, সময়ের প্রাপ্তি সময়ে পাবো না জীবনে কুত্রাপি। আমরা মানে, আবারও রিপিট করি, আমার শ্রেণির মানুষেরা। সেইজন্যেই যাতে দু-চারবছর সময় হাতে থাকে, চাকরি পেতে এবং জীবনের অন্যান্য আগডুমবাগডুম পাওনা হাসিলে, তাই ওই জন্মতারিখ চুপানো চুরি। কিন্তু আজকাল এক্ষেত্রে বেশ উন্নতি সাধিত হয়েছে, মারহাবা, একটা উপরিতলের হলেও উন্নতি তো বটেই।
মৃত্যুদিন
যে-পাখি দৌড়ায়, মেঘ ভরে আছে তার ছুটন্ত ডানায়
শুরু তো করেইছিলাম একদিন, নইলে কেমন করে এই এত নোটঘাট-চোটপাট, চুনিপান্নার রঙ রাঙা ও সবুজ থেকে নৈরঙ করে ফেলল কে তবে! এবং, হোয়াট দ্য ফাক, কোন ফাঁকে! এই তো সবে শুরু হয়েছিল, ফুরায়া আসে এরই ভিতরে! এখন প্রশ্ন, আল-কাপোন, শেষ করব কবে? এই হাড়জ্বালানি জিল্লতি কবে ফুরোবে? এটা আদৌ কোনো ঘটনাব্যাপার নয়, শেষ নিয়া ভাবিত হওয়াটা আদৌ কোনো কাজের কথা নয়। এখানে বরং ভাবি শুরুটা করেছিলাম কীভাবে এবং শেষটাই-বা কেমন হবে—অন্তত কল্পনা করার চেষ্টা নেয়া যাক। মনে পড়ছে, বইপুস্তকে পেয়েছি, আমার শুরুর বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন এক রঙিন রূপবান জলপাই-উর্দি। কিন্তু ওটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নয় তেমন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জেনেছি কিছু পরে, আম্মার কাছ থেকে। জেনেছি যে আমি দৌড় শুরু করেছিলাম ঝুম আষাঢ় মাসে। জিগ্যেশ করা হয়নি, আম্মাকে, সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল কি না। কল্পনা করছি, দিনরাত-একাকার বেদম বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রসবিণীর শরীর জুড়িয়ে দিয়েছিল ভরা আষাঢ়ের বৃষ্টিছাঁট। ও আচ্ছা, আমি জন্মেছি ডাক্তার-নার্সের দস্তানাপরা হাতে—মাতৃমঙ্গল সদনে। যদিও আমার বাকি সব ভাইবোনের জন্ম গণ্ডগ্রামের মমতাগাঢ় ধাত্রীর হাতে। তখন তো অত মাতৃযত্নচেতনা ছিল না আজকের মতো, তবু কেন আমার বেলায় আম্মাকে যেতে হলো হাসপাতালে? জেনেছি, আমি নাকি পেটের ভেতরে সাংঘাতিক সহিংস আচরণ করছিলাম তাঁর সঙ্গে। সেহেতু অবস্থা বেগতিক দেখে বেচারিকে যেতেই হয় চিকিৎসাসদনে নিয়ে। সে-যা-হোক, গল্পটা আরও ঘনদীর্ঘ করে বলা যাবে, এই গল্পের সিক্যুয়েল নির্মিত হবে বাঁচি-যদি-তো পরের বছরে। এরপরে প্রয়োজনে প্রিক্যুয়েলে সিক্যুয়েলে মেলামেশি ঘেঁষাঘেঁষি করে। এবার ভাবি, আমার অন্তিম কেমন হবে এ-নিয়ে একটু। মনে হয় আমি শেষ করব কোনো-এক শীতকালে, খুব কুয়াশামায়ামাখানো নরম নতস্নিগ্ধ রাত্তিরে। একটা আলতো জবাফুলগাছের গতর ঘেঁষে। এবং সে-সময় আমার চোখে থাকবে চালতাফুলের মমতা আর খরগোশের পশম থেকে উঠে-আসা হার্দ্য ধবধবা শাদা। ভালোবাসি এমন কোনো এক বা একাধিক মানুষ আমার পাশে থাকবে তখন, অনুমান করি। ভালোবাসাহীনতায় কে মরিতে চায় হে…
- শীর্ষপঙক্তির কবি উৎপলকুমার বসু
ও অন্যান্য অবসিন
রবীন্দ্রনাথের খুবই ছিল। দুনো দিন নিয়াই পিরালি ব্রাহ্মণ পরিবারে বেশ ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ কর্মকৃত্যাদির চর্চা ছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখায় নিজের লোকশ্রুত জন্মদিন ও কল্পনাবাহী মৃত্যুদিন নিয়া নানাভাবে হাজিরা দেখি। বিচিত্র ও অতিকায় হাজিরানা। প্রায় অবসেসডই ছিলেন রবি নিজের জন্মদিন নিয়া। বারবার ফিরেছে পঁচিশে বৈশাখ, বহু সরাসরি বহু আকারে বহু ইঙ্গিতে আধ্যাত্মিকতায়, উভয়ত কবিতায় এবং গানে। একই জিনিশ জরিপ করা যাবে রবির মৃত্যুদিন নিয়া প্রায় ফেটিশ পর্যায়ের ভাবনাভাবনি, কী যে শ্যামসম মর্বিডিটি, লিরিকে এবং কবিতায় চিঠিচাপাটি সবখানে। আক্ষরিক বাইশে শ্রাবণটুকু শুধু বলা বাকি ছিল। পরে সেইটা আমরা তার আশেকানেরা ভালোমতো পুরিয়ে নিয়েছি ফিল্মে গানে কবিতায় গালগল্পে গবেষণায়। কেওড়াতলায় নিয়া যাবার সময় গুরুদেবের মস্তকের একগাছি কেশ স্যুভেনির হিশেবে রেখে দিতে মরিয়া বাঙালি, এতটা আশিকি অসভ্যতা ঠাকুর যদিও কস্মিনকালেও কল্পনা করতে পারেননি। জীবনানন্দের কী ছিল? জন্ম নিয়া আদিখ্যেতা তার মধ্যে দেখি নাই। মৃত্যু নিয়া আছে। অ্যাজ ইফ মর্বিডিটিই জীবনানন্দ, বলছি না, বাট উনি মৃত্যু নিয়ে প্যাশনেইটেড খুবই। মৃত্যু আবাহন করার পৌনঃপুনিকতা দাশ-উত্তর গুপ্তলুপ্ত জীবনানন্দের সাহিত্যে দেদার। জন্ম ও মৃত্যু কোনোটাই কিছু নয় যার কাছে, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী জীবনড্রিভেন। সর্বাবস্থায় জীবনচালিত, জীবনতাড়িত, জীবনভাবিত কবি। কিন্তু অটোবায়োগ্রাফিকতার আনুপাতিক পরিমিতি রেখে একটা সাহিত্যকর্ম যতটা লাইভ করা যায়, ডিফিকাল্ট এবং রেয়ার অন্যথায়। কিন্তু, তবু, অবসেশন নয়। কিছুতেই যেন অবসেশন না হয়। না সাহিত্যে, না পৌরোহিত্যে। না ঘরে, না ঘরানায় বাহিরানায়। আসক্তি। অ্যাডিকশন। নির্ঘাৎ মরণ। অতি আত্মজৈবনিকতায় শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ হয় কি না তা জানি না, আমাশয় হয়। পাঠকের আমাশয়। লেখকেরও অবসিনিটি ইউটিলাইজ করা জানতে হয়। বা, তা হয়তো অন্ধকারেরই জিনিশ, ব্যাকস্টেইজে একটা লাগাম হাতে লেখক স্বয়ং সেই নীল ঘোড়ে কা আসোয়ার।
—জাহেদ আহমদ ২০১৩
জাহেদ আহমদ রচনারাশি
- ভারতীয়া শারদীয় সংখ্যায় একটা বাজারবান্ধব নভেলা পাঠের স্মৃতি - November 9, 2025
- সন্দীপন স্বল্পায়তন - November 5, 2025
- ম্যাক দ্য রকার || জাহেদ আহমদ - November 3, 2025

COMMENTS