গ্রন্থিক, গ্রন্থিকা

গ্রন্থিক, গ্রন্থিকা

বছর-দশেক আগের পড়া ও খরিদ-করা দুটো বই নেড়েচেড়ে দেখছিলাম মেদুর সন্ধ্যায়। শীত গয়ংগচ্ছ হলেও চলিয়া যায় নাই পুরাপুরি। শীতবৃষ্টির ছ্যাঁকালাগা হিম রিমিঝিমি। বৃষ্টিবিধুর রাত্তিরে ন্যাপথলিনের গন্ধভরা তোরঙ্গ খুলে বেনারসি-কাতান দেখার মতো স্মৃতিভারাতুর সন্ধ্যা। ভাঁজে ভাঁজে রাখা নিমপাতার গুঁড়ো সরিয়ে উঁকি দেয়া বইয়ের পাতায় বৃদ্ধের সোনালু যৌবন। অনেকটা ওইরকমই। ধীরে পেইজ উল্টে দেখছিলাম বইদুটি।

ঠিক বই হয়তো বলতে চাইবেন না, — যারা কিনা পাঁচ-সাতফর্মা কাগজ ঠেসে একত্র করে বোল্ডারের মতো শক্ত বাঁধাই না-হলে সেই অশক্ত পাৎলাপুৎলা কাগজগুচ্ছ বই হিশেবে ভাবতে অনভ্যস্ত। চটিবই বলাই বোধহয় নিরাপদ। তো তা-ই বলি, নামে কি-বা আসে যায়, শেইক্সপিয়্যর সহায়। প্রতিবছর বোল্ডার বেরোতে দেখি লাখে লাখে, বিহঙ্গ কদাচিৎ। গল্প-কোবতে দুইচারিখান লেখা হইলো, তো দৌড়াও, বোল্ডারমেস্তরির লগে প্রেমপিরিতি করে একখান সিমেন্টজমাট মলাটের বহি বাহির করাও। সময় নাই, বোন ও ভাই, যত বেশি পারা যায় বইয়ের জননী ও জনক হওয়া চাই। কিন্তু সাধু, সাবধান! ভূমি যেই হারে ঘনঘন কেঁপে উঠছে আজকাল! জগৎ জুড়িয়া সর্বত্রই বিকল্প পথের সন্ধানে ব্যস্ততা বাড়ছে দেখতে পাই। বেইল থাকতে ঢালাই মালের উপর হইতে আস্থা কমায়ে নিন! র’-ম্যাটেরিয়্যাল হিশেবে রড-সিমেন্ট আর ঝামা ইট কোনোকালে একমাত্র ছিলনাকো। বর্তমানে লেখকদিগের বাঙ্গালা বাজারে বোল্ডার পাত্থরের মলাট ছাড়া আর কিচ্ছুটিরই কদর নাহিকো।

বলছিলাম চটিবই প্রসঙ্গে। এক নয়, দুটো। দরকারি ও ভালো দুটো বই। ইচ্ছেনিরপেক্ষ ব্যুকর‍্যাক হাতড়াতে যেয়ে উঠে এল হাতে। একটি ডুবসাঁতার ও সিনেমাতন্ত্র,  অন্যটি নতুন সিনেমা, সময়ের প্রয়োজন । গ্রন্থিক যথাক্রমে এবাদুর রহমান ও নূরুল আলম আতিক। পাণ্ডুলিপি কারখানা  নামের একটি অফবিট প্রকাশনাগারের দুটো প্রকাশনা, সমীহ-করার-যোগ্য সুন্দর উৎপাদন এককথায়। এই দুই কিতাবেরে এই নিবন্ধে চটিবই কী-হেতু বলা হচ্ছে, এইটা জিগাইলে অ্যান্সার আদৌ মনঃপূত হবে না কারোরই। পিনআপ অর্থে যে-চটি, তা নয়; কেননা, বইদ্বয় পিনমারা নয়, সেলাই করেই বাঁধানো। বক্সবোর্ড বাইন্ডিং। পেপারব্যাক যথা। আর অ্যাডাল্ট কন্টেন্টপূর্ণ ফর্বিডেন এক-ধরনের প্রকাশনা অর্থে এই পিনআপ, তা বলা যাবে না আবার যাবেও। কন্টেন্ট বলতে একটা আখ্যানের যুক্তিতর্কপ্রস্তাবনা ব্যাপারটাকে যদি মাথায় রাখি, তাইলে এই বইদ্বয়ে একদমই থোড়-বড়ি-খাড়া টাইপের ইম্যাচিয়্যুর আলাপবিস্তার নাই বিধায় এইটা অ্যাডাল্ট ও অ্যাডভ্যান্সড রিডার তথা ছায়াছবিথিঙ্কারদেরই জিনিশ। সবচেয়ে ব্যেটার হয় এই বইদ্বয় হাতে নিয়া বাংলার ঐতিহ্যসিদ্ধ বটতলার সাহিত্য প্রকরণের প্রকাশ, প্রচার, প্রসার ও প্রভাবের প্রক্রিয়াটা মাথায় রাখি যদি।

কিন্তু এই বইজোড়া হাতে নিয়া চ্যাপ্টার সার্ফ করবার সময় একটা ব্যাপার ভালো লাগে ভাবতে যে, লেখকেরা এখানে নিজেদেরে গ্রন্থিক হিশেবে পরিচয় দিতে সচ্ছন্দ বোধ করেছেন, — অর্থাৎ চটিবইগুলোকে তারা গ্রন্থের মর্যাদা দিচ্ছেন। অথবা গ্রন্থও নয়, একটু রহস্যভরা বিনয় যেন, গ্রন্থিকা। তাৎপর্যবহ। পুস্তকের আরও কোমল রূপ পুস্তিকা যেমন, গ্রন্থের কোমলাঙ্গ গ্রন্থিকা যেন। চটিবই দুইটিকে এভাবে দেখতে যেয়ে বেশ সিগ্নিফিক্যান্ট মনে হয়েছিল পয়লাবার। ফিরে দেখতে যেয়েও পুরনো বোধের খুব হেরফের হচ্ছে না দেখতে পাচ্ছি। এগুলো কাজের বই, এই সময়ের সিনেমা-উদ্যমী তরুণদের কাছে সুখপাঠ্য হবার সম্ভাবনাবহ বাংলা দুটো বই। পড়ে ভালো লাগবে আপনার, বলা যায়, অনুপ্রাণিত লাগবে। এই নিবন্ধকার সাক্ষ্য দিতেছে যে আলোচ্য ঘুঘুছোট্ট বইদুটো পড়ে একনাগাড়ে বেশ কয়েকটুকরো সন্ধ্যা ইন্সপায়ার্ড ছিল ছবি বানাবার দুর্মর খোয়াবে, একটা ডায়লগে-প্রেম-ও-পুংটামি-মারা প্যাকেজও অন্তিমে সে বানাইতে পারে নাই যদিও। তবে এখান থেকে এমন কোনো ডিসিশন কেউ নিতে পারবেন না যা থেকে এই বইদুটো অভীষ্ট অডিয়েন্স পাওয়া থেকে ডেপ্রাইভড হয়।

চেয়ে দ্যাখেন চতুদ্দিকে যে কেবল কাব্য কেবল গল্প কেবল উপন্যাস কেবল প্রবন্ধ কেবল গবেষণা চারিপাশে দেদারসে চলছে। কেবল সিনেমা কেবল ড্রামা কেবল ডক্যু কেবল অ্যাডভার্ট আর কেবল ডেইলি-উইক্লি স্যোপঅপেরা নাট্য-নেত্ত। কোথাও পরিত্রাণ নাই, পরিত্রাতা-পরিত্রাত্রী নাই, কোনো ত্রাণ নাই যেন এ একঘেয়ে হেন গতানুগতিকতা থেকে। পরিচিত পথের বাইরে কেউ হাঁটতে চায় না, বার হতে কেউই চায় না চেনা গতের বাইরে, চাইছে না। আহা! বাছা মোর! পারতে যদি তুমি! একবার শুধু, একবার যদি … একটাবার … একটামাত্রবার …

গ্রন্থিকদ্বয় নিয়া আপাতত বৈঠকে বেশি কিচ্ছু বলবার নাই। নিবন্ধটা পাঠের আগে থেকে এই দুনোরে কেউ যদি চিনিয়া না থাকেন, তাইলে এখন চিনবেন দুরাশা। আতিক আর এবাদ না-চিনেও বঙ্গসংস্কৃতিলিপ্ততৎপর হওয়া না-মুমকিন নয়। কিন্তু যদি চিনিয়া থাকেন তবে একবার অন্তত থমকাবেন। বরং আমরা আগাইতে থাকি, যেমন বেণী তেমন রাখি চুলটা না ভিজাই।

‘ডুবসাঁতার’ একটা সিনেমা। আর এরই সূত্র ধরে এবাদের সঞ্চালনায় একটা আলাপচক্র, অ্যা সিরিজ অফ ট্যক্স, ইন্ডেক্সটা আসেন একবার দেখে ফেলি ‘ডুবসাঁতার ও সিনেমাতন্ত্র’ গ্রন্থিকার। চাইরটা সাক্ষাৎকার ভিত্তি করে এগিয়েছে এবাদুর রহমানের এই ডিটোনেটর। তারেক মাসুদের সঙ্গে একটা, নূরুল আলম আতিকের লগে একটা, অ্যালেহান্দ্রো ইনারিতুর লগে একটা, এই মোট তিনটা আলাপের সঞ্চালক এবাদুর রহমান। অবশিষ্ট একটা আলাপ অনুবাদ করেছেন এবাদ, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যেখানে ডেরেক ম্যালকম কথা বলেছেন। মোদ্দা কথায় এইটুকু। সঙ্গে একটা প্রারম্ভিক প্রস্তাবনা, বা প্রিফেইস, গ্রন্থিকের।

এবং রিডিং বিটুয়িন দ্য লাইন্স আরও কতকিছু! যদি এবাদপাঠের পূর্বাভিজ্ঞতা থাকে তাইলে এক-রকম টেইস্ট পাবেন এই ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠা সচিত্র গ্রন্থিকার, না থাকলে ব্যাপারটা আলাদা। না থাকলে কেমন তা আজকের এই নিবন্ধকার বলতে পারবে না, কারণ না থাকার অভিজ্ঞতাটা তার নাই ইন্সিডেন্ট্যালি।

এবাদের, এবং আতিকের, গ্রন্থিকাদ্বয়ের শেষে এর প্রকাশনাপ্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে একটা অ্যাডকণিকা অ্যাভেইলেবল। ‘পাণ্ডুলিপি কারখানা বিষয়ে ২/১টা কথা, যা আমরা জানি’ শীর্ষক সন্দীপনস্টাইলে সেই বিজ্ঞাপনে এদের বেশকিছু প্রোজেক্টের খবর পাওয়া যায় যেইগুলার মধ্যে ৩/৪টা আলোর সংস্পর্শে এলেও অধিকাংশ অন্ধকার বিবরে এখনও। অসুবিধা নাই। যা পাওয়া গিয়েছে তা-ই সই।

সিনেমা সংক্রান্ত যা-কিছু ভাবনা জরুরি — এই দেশে, এই মুহূর্তে আমাদের মনে উঁকি দেয় তার মুদ্রিত রূপ ‘পাণ্ডুলিপি কারখানা’ দেখতে চায়। তা সিনেমা নিয়ে লেখালেখিই হোক, কর্মশালা আয়োজনই হোক, আর সরাসরি সিনেমা নির্মাণ — এই সবই পাণ্ডুলিপির কাণ্ডকারখানা।

আজ থেকে একদশক আগে এলান হয়েছিল কথাগুলা। আজকে কেউ বলতে পারেন কারখানার কর্মসূচি কিয়দ্দুর এগোল কি না? ছাপাছাপি বোধহয় তিন-চাইরের বেশি আগায় নাই। সিনেমা বা অডিও-ভিশ্যুয়্যাল নিয়া আশাব্যঞ্জক কোনো অগ্রগতি?

‘ডুবসাঁতার ও সিনেমাতন্ত্র’ গ্রন্থিকাটারে এবাদুর রহমান যে-বাক্যে উৎসর্গ করেছেন তা দ্রষ্টব্য —

জহির রায়হান, যে-ঈশ্বর ব্যর্থ, তাকে এই সামান্য বহিখানা উৎসর্গ করি

অক্টোবর ২০০৯ খ্রিস্ট-অব্দে এইটা পাব্লিশড। লগে আতিকেরটাও। দুইটা সাযুজ্য বহন করছে টেম্পেরামেন্ট ও কন্টেন্ট সব দিক দিয়াই। ডিজিটাল সিনেমার নির্মিতি ও অন্যান্য ওজারতি-তেজারতি নিয়া গ্রন্থিকাদ্বয়ে এগিয়েছে আলোচনা। ঢাকা থেকে এইসব কর্মকাণ্ড মহাবিশ্বে রাষ্ট্র হয়ে আছে।

লেখা / জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you