সার্ফবোর্ডে হেলেনের সঙ্গে একটা রাইড

সার্ফবোর্ডে হেলেনের সঙ্গে একটা রাইড

স্পার্টার নয়, হেলেন অফ ট্রয় হিশেবে একনামে চেনে যারে এই মিথশাসিত দুনিয়া, একটা চক্কর দিয়া আসতে পারি আমরা আজকে হেলেন হান্টের সঙ্গে। এই হেলেন গত কয়েক দশকের অভিনয় দিয়ে কেবল স্পার্টার মেনেলাউস নয়, কিংবা নয় কেবল ট্রয়ের শেহজাদা প্যারিস, শিকার করেছেন অসংখ্য প্রণয়তীর্থকাকের হৃদয়। বাংলা বিহার উড়িষ্যা আজার্বাইজান আদ্দিসআবাবা সর্বত্র।

অস্কারজয়ী অভিনয়শিল্পী হেলেন হান্ট রিসেন্টলি ডিঙিয়ে এলেন ফিফটিফাইভের সিঁড়ি। কিন্তু অবয়বে এখনও সেই ছিপনৌকার আদল। নির্মেদ, নির্মেঘ, রৌদ্রোজ্জ্বল। ছিপছিপে একহারা। ব্যাপারটা খালি মেইন্টিন্যান্স-মেরামতি কি নিছক যত্নআত্তি দিয়া না-মুমকিন। সম্ভবত এতটা স্বাস্থ্যসম্পন্ন থাকতে পারাটা মানুষের জিনেটিক্সের অন্তর্গত রহস্যদেশের মামলা।

তার সিনেমা আমরা দেখেছি নিশ্চয়। দেখেছি অসংখ্য। ‘হোয়াট উয়োমেন ওয়ান্ট’ তো মনে আছে। ‘অ্যাজ গ্যুড অ্যাজ ইট গেটস্’ অবশ্যই। ‘অ্যা গ্যুড উয়োম্যান’ সিনেমায় তার অভিনয় ইয়াদ হয়। ‘ক্যাস্ট অ্যাওয়ে’। এটেসেটেরা। ‘দ্য সেশন্স’ সিনেমায় ভালো অভিনয় দেখানোর রোল ছিল। করেছেনও ভালো। অথবা লাস্ট ফোর্টিনে একটা ছায়াছবি রিলিজ হয়েছিল ‘রাইড’ নামে, এইটাও অভিনয়-দেখানো ম্যুভি বটে।

একাধারে অভিনয়শিল্পী, ডিরেক্টর এবং স্ক্রিনরাইটার হেলেন হান্ট। অভিনয়ে বেশ কয়েক বছর হলো অনেকটাই ঢিমেতালে দেখা যায়, আগের মতো বক্সকাঁপানো প্রোজেক্টে নেই, বেছে বেছে কিছু অভিনয়কাজ করেন শুধু। তবে পরিচালনায় এখন অনেক বেশি ইন্ট্রেস্টেড তিনি। চিত্রনাট্যও লিখছেন। মোট কথা, সামনাসামনি অ্যাক্টিং করার চেয়ে নেপথ্য কলাকারি নিয়াই তিনি বিজি।

কিন্তু অভিনয়ও যে একেবারেই করছেন না তা নয়। রিসেন্টলি ‘রাইড’ নামে হেলেনের পরিচালনায় এবং অভিনয়কলায় যে-ম্যুভিটা অ্যাক্লেইমড হয়েছে বিভিন্ন মহলে, সেই সিনেমার বিষয়াশয় হাল্কা চালে বেশ-খানিকটা আলাপচারিতার বর্ণনা এসেছে একটা পত্রিকায়। সেইখান থেকে একাংশ কথাবার্তা আমরা এই নিবন্ধে দেখব।

উল্লেখ থাকুক যে এই ‘রাইড’ ম্যুভির চিত্রনাট্যটাও হেলেনেরই লেখা। তারই সৃজিত গল্প। ওভারপ্রোটেক্টিভ একজন সিঙ্গল মাদারের ভূমিকায় একটানা অনবদ্য অভিনয় করেছেন হেলেন এই সিনেমাটায়। নিউইয়র্কের প্রেক্ষাপটে হেলেনের রোলটা পর্দায় স্টার্ট করলেও অচিরে দেখা যায় ক্যালিফোর্নিয়ায় শিফট করে সেই প্লট। ছেলের সঙ্গে সি-সার্ফিং পুরা ছায়াছবিতে দেখতে পাই আমরা। ভালো একজন মা হিশেবে নিজেরে ক্যারেক্টারটা এস্ট্যাব্লিশ করতে যেয়ে যে-স্ট্রাগলটা করেছে, সেইটা আনফর্গেটেবল।

ম্যুভিটার রিমার্কেবল ব্যাপার হচ্ছে এইখানে বিস্তর ওয়াটার-সার্ফিং সিন্ সন্নিবেশিত হয়েছে। ক্যামেরার কাজটা কাজেই ডিফিকাল্টই ছিল করা। বানানোর সময় সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হন সনি মিলার নামে এক পানিবিশারদ। উনিই দৃশ্যগুলো শ্যুট করার মূল মিস্ত্রি বলিয়া অ্যাক্নোলেজ করেন নির্মাতা হান্ট। উনাকেই সিনেমাটা ডেডিকেইট করেছেন হেলেন। অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন রাইডের সার্ফদৃশ্যধারণে এই ভদ্রলোক, অনেক দৃশ্যের শ্যুট হয়েছে পানির নিচে যেয়ে। একটা বাকশে ক্যামেরা ঢুকিয়ে পানিতে ভেসে থেকে সনি মিলার দৃশ্যগুলো শ্যুট করেছেন। নিজে ভিজেছেন দিনভর কিন্তু ক্যামেরার গায়ে যেন জলের ফোঁটাটাও না লাগে সেইদিকে ছিল তার কড়া নজর। উপস্থিতমুহূর্তে ট্রাবল শ্যুট করার একটা দারুণ শৈল্পিক দক্ষতা সনি মিলারের মজ্জাগত বলে হেলেন স্বীকার করেন।

ছবিটিতে হেলেনের কোআর্টিস্ট অল্পবয়সী অস্ট্রেলিয়ান অভিনয়শিল্পী ব্র্যান্ডন টোয়াইট। ওর অভিনয়ে হেলেন মুগ্ধ। ওকে ছাড়া ‘রাইড’ কল্পনাও করতে পারা হান্টের পক্ষে সম্ভব নয়। এবং এই জিনিশটা ব্র্যান্ডনের সঙ্গে অ্যাট দি ভ্যেরি বিগিনিং মিট করেই হেলেন বুঝে ফেলেন। সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেন যে একেই তিনি তার ছেলে হিশেবে ছবিতে নিচ্ছেন।

অভিনয়ের কাজ শুরু করার পরে দেখা যায় যে ঠিক যেভাবে তিনি স্ক্রিপ্ট ড্রাফ্‌ট করেছেন সংগত কিছু কারণে সেখানে চেইঞ্জ আনা মাস্ট। চেইঞ্জ আনেন। তারপর আবার চেইঞ্জ। আবার। আবার। রিরাইটের পরে রিরাইট। রিরাইটের পরে রিরাইট। যেমন দেখা গেল যে স্ক্রিপ্টের ছেলেটা যেভাবে কথা বলে, ব্র্যান্ডন স্বভাবজ স্বকীয়তায় সেইভাবে কথা বলে না। হান্ট সঙ্গে সঙ্গে রিঅ্যালাইন করেন বাস্তবের নায়কের সঙ্গে স্ক্রিপ্টের নায়ককে। এইভাবে এগোতে হয়েছে।

এই সিনেমায় একটা দারুণ মেটাফোর হিশেবে এসেছে সার্ফবোর্ড জিনিশটা। সার্ফ শেখার সময় দেখা যায় মায়ের ক্যারেক্টার চিত্রায়নকারী হেলেনকে ইন্সট্রাক্টর বলতেসে যে সার্ফবোর্ড জিনিশটা হচ্ছে একটা ইনঅ্যানিমেইট অব্জেক্ট এই নিত্যপরিবর্তনীয় প্রতিবেশে। এই কথাটায় যে-গূঢ় রূপক ধরা আছে, সেইটাই যেন গোটা সিনেমায় বিস্তার পেয়েছে।

এই প্রসঙ্গে কথা বলতে যেয়ে হেলেন তার সার্ফশিক্ষকের কথা ইয়াদ করেন। উনিই পয়লা হেলেনের মাথায় ঢুকিয়ে দেন যে এই সার্ফবোর্ড কখনো ম্যুভ করে না, চারপাশের সবকিছুই ম্যুভ করে কেবল সার্ফবোর্ড অনড় থাকে। অথচ মনে হয় সার্ফবোর্ড চলছে, আর বাকি সবকিছু অচল। অবাক আশ্চর্য কূটাভাস যেন। মনুষ্যজীবনের কূটাভাস। সার্ফবোর্ড জিনিশটাকে এরপর থেকে হেলেন আর হেলাফেলায় দেখেন না। তার মেজাজমর্জি নিয়ন্ত্রণে রাখার পিছনে এই জিনিশটার ভূমিকা তিনি স্বীকার করেন অকুণ্ঠ।

হেলেন আরও বলেন, সার্কবোর্ড আমাদেরে শেখায় যে যতক্ষণ পানির উপরে আছো সুস্থিরে চিন্তা করে স্টেপ নাও। তলিয়ে গেলে ভেসে উঠতে পারবে হয়তো, তবে তলানোর সময় চিন্তা করার চান্স পাবে না। স্ট্রেইট চিন্তার চান্স নাই নিচে নিমজ্জিত মানুষের। সুতরাং যতক্ষণ ভেসে আছো ততক্ষণ চিন্তাটা থামিও না। থামাইলেই তলায়ে গেলে।

এই সিনেমাটা থার্টিফাইভ এমএম দিয়া ধারণ করা। ডিজিট্যালযুগের সুবিধাদি না থাকলে এর যে কি নসিব হতো, হেলেন ভাবতেও পারেন না। আইডিয়ার এই ইমপ্লিমেন্টেশনগুলা আমরা যে করতে পারছি, সেজন্যে প্রযুক্তির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা ছাড়া আর তেমন কোনো কুর্ণিশযোগ্য কিছু আছে বলে হেলেন মনে করেন না। আইডিয়া আমার, বাস্তবায়নে টেক্নোলোজির কৃপা। হান্টের মজার মন্তব্য।

অবশ্য ম্যুভিডিরেক্টর বাপের কন্যা হিশেবে হেলেনের ব্লাডে সেলুলয়েডের অলৌকিক জীবাণুজার্মগুলা আগে থেকেই ছিল। তবে বাপের কাছ থেকে ম্যুভির কলাকানুন ততটা শেখেন নাই, শিখেছেন অন্যকিছু। আব্বার কাছ থেকে শিখেছি দুইটা জিনিশ, দয়া আর ধৈর্য। অভিনয় করার কিছু কলা আমি শিখেছি স্বীকার করব। শিখেছি কীভাবে একজন সহশিল্পীর সঙ্গে কথা বলতে হয়। শিখেছি কীভাবে একেকটা মুহূর্তের প্রতি কৃতজ্ঞ রইতে হয়। জীবন তো কয়েকটা মুহূর্তের একটা মালা। হান্টের এই স্বীকারোক্তি জীবনোজ্জীবক ভীষণভাবে।

একটা ব্যাপার লক্ষ না করে পারা যাবে না যে হেলেনের পরিচালিত ও গল্পায়িত ম্যুভিগুলোতে গ্যুড মাদারিং ইশ্যুটা সাধারণদৃষ্ট। হেলেন নিজেও তা লক্ষ করেছেন বলিয়া জানাইলেন সাক্ষাৎকারগুলায়। কিন্তু খুব যে প্ল্যান করে এমন হয়েছে, ব্যাপারটা তা না আসলেই। জাস্ট হয়ে গেছে। নেক্সট কাজগুলোতে এইসব হয়তো অন্যভাবে থাকবে, কিংবা থাকবেই না, এখনই কিছু বলতে চাইছেন না। চাইছেন না মানে প্ল্যান নাই সেভাবে, কাজেই বলতে পারছেন না।

 প্রতিবেদন : বিদিতা গোমেজ

… …

বিদিতা গোমেজ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you