ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব ক্লাইমেট ক্যালামিটি  || কল্লোল তালুকদার

ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব ক্লাইমেট ক্যালামিটি || কল্লোল তালুকদার

‘কাল’ (সময়) শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে ‘কল্’ ধাতু থেকে, যার দুটি অর্থ — একটি ‘গণনা করা’ এবং অপরটি ‘ধ্বংস করা’। দ্বিতীয় অর্থে সময় মূলত বিনাশের মাধ্যম। আদিঅন্তহীন সময়ের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে সবকিছুই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়াকে আমরা ত্বরান্বিত করে দিচ্ছি। আত্মঘাতী কার্যকলাপের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ-প্রতিবেশকে দ্রুত নিজেদের জন্যই করে তুলেছি চরম প্রতিকূল।

সাম্প্রতিক মহাপ্লাবন কী আমাদেরই হঠকারিতা, সীমাহীন লোভ ও অদূরদর্শিতার ফলাফল নয়? হ্যাঁ, এই দুর্যোগের অন্যতম তিনটি প্রধান কারণ —

১. জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব,
২. পলি জমে নদীনালা-খালবিল ভরাট হওয়া এবং
৩. যত্রতত্র অপরিকল্পিত বাঁধ/সড়ক নির্মাণ।

গত সপ্তাহের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও রেট অব প্রিসিপিটেশন এবং বজ্রপাতের মাত্রা ও তীব্রতা নিয়ে কোনো বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হবে কি না জানি না, তবে প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তির কারণ যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফলাফল — একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষের কাছেও তা আর ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের দায় কমবেশি আমাদের সবার। এর বিরূপ প্রভাব মুকাবিলায় আমরা এখনও প্রস্তুত নই, আমাদের সেই সক্ষমতাও নেই। বৈশ্বিক এই সমস্যা একদিকে যেমন ক্রমশ প্রকট হচ্ছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত্যাচার করতে করতে একের পর এক হাওরকে আমরা খুন করে চলেছি। মাত্রাতিরিক্ত শোষণের ফলে হাওর-বেসিন এখন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। এই শোষণ আন-ওয়াইজ ও আত্মবিধ্বংসী।

প্রতি বছর হাওর-রক্ষা বাঁধের নামে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের খবর হরহামেশাই শোনা যায়। অপরিকল্পিত যত্রতত্র বাঁধ/সড়ক, অলওয়েদার সড়ক ইত্যাদি নির্মাণের ফলে হাওরে পানি চলাচলের প্রাকৃতিক সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। আপার স্ট্রিমে বন উজাড়, মাত্রারিক্ত কৃষিকাজ, মাইনিং ইত্যাদি মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে সিল্টেশন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যেই ভরাট হয়ে গেছে হাওরের নদীনালা, খালবিল। ফলে প্রাকৃতিক জলাধারসমূহ সামান্য বৃষ্টিপাতের পানি ধারণ করতেই এখন অক্ষম। তাছাড়া কৃষিজমি ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে নানান স্থাপনা, পত্তন করা হচ্ছে নূতন নূতন গ্রাম, হাটবাজার ইত্যাদি। পানি ধারণের জায়গা কোথায়? প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে হাওর-বাস্তুতন্ত্র ইতোমধ্যেই হয়ে পড়েছে ভারসাম্যহীন।

এনভায়রনমেন্টাল ইম্পেক্ট অ্যাসেসমেন্ট (EIA) না করে হাওরের বুকে একদেশদর্শী উন্নয়ন কার্যকলাপ বন্ধ করা জরুরি। ভরাট হয়ে যাওয়া নদীনালা, খালবিল খননের মাধ্যমে হাওর-বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। মনে রাখতে হবে, এবারের দুর্যোগই শেষ দুর্যোগ নয়। বরং বলা যায় দুর্ভোগের মাত্রা ও তীব্রতা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। ফি বছর ফ্লাডলেভেল পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। ফলে জন্ম নেবে লক্ষ লক্ষ ক্লাইমেট-রিফিউজি।

জলবায়ু-উদ্বাস্তুর প্রবল স্রোতের তোড়ে আমাদের সুরম্য অট্টালিকা তাসের ঘরের মতো যাবে ভেসে!


কথায় কথায় প্রকৃতি এখন তার চরমরূপ দেখায়! চোখ রাঙায়! খরা হলে সব জ্বলে-পুড়ে খাক। আর বৃষ্টি শুরু হলে অতিবৃষ্টিতে সবকিছু পচে ওঠে, গলে ওঠে, ডুবিয়ে দেয়, ভাসিয়ে নেয়!

এবার meteorological drought, অতঃপর hydrological drought-এর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর এখন চলছে বিরামহীন বৃষ্টি, মুষলধারে! যেন অন্তহীন!

পাহাড়ি ঢলে পানি বাড়ছে হুহু করে; চরাচর প্লাবিত হওয়ার শঙ্কায় কাঁপে বুক। দুঃস্বপ্নের মতো মনে ভেসে ওঠে গতবারের স্মৃতি! কী ভয়ানক রুদ্রমূর্তি!

সবকিছুই এখন এক্সট্রিম!


গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ভুবনজয়ী সৃষ্টি ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’-এ আমরা দেখি, আর্কেদিও বুয়েন্দিয়ার গ্রাম মাকোন্দোতে একবার শুরু হয় বৃষ্টি। বিরামহীন। টানা কয়েক বছরের অবিরাম বৃষ্টিতে সবকিছুতে শেওলা জন্মে যায়। এমনকি বৃষ্টি থামার পর দেখা গেল মাকোন্দোবাসীর শরীরেও গজিয়ে গেছে শ্যাওলা।

মাকোন্দোর ওই ঘটনাটি যদিও ছিল মার্কেসের জাদুবাস্তবতা। কিন্তু গত কয়েকদিনের বিরামহীন বৃষ্টিপাত দেখে ভাবছি, আমাদের পরিণতিও কী সেই মাকোন্দোবাসীর মতোই হতে যাচ্ছে! সেখানে যদিও বন্যা হয়নি, কিন্তু সুনামগঞ্জবাসীর জীবন উপর্যুপরি বন্যায় বিপর্যস্ত! দশ-বারো দিনের ব্যবধানে সুনামগঞ্জবাসী আবারও পানিবন্দি।


কল্লোল তালুকদার রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you