জলের গান || গ্যাব্রিয়েল সুমন

জলের গান || গ্যাব্রিয়েল সুমন

কাগজের নৌকা, কেউ বানিয়েছে তা / চুপচাপ ভাসিয়েছে জলে
কোনো-এক ঘোরলাগা দুপুরে বায়োলোজিশিক্ষক ভূগোল সংক্রান্ত একটা কথা বলে ফেলেছিলেন। মনে আছে, তিনি বলেছিলেন — এই অঞ্চলের মানুষ একটু জলপ্রবণ। বুকের ভিতর জল-হাওয়ার পরিমাণ আর জল-হাওয়ায় দোলা লাগার ব্যাপারটা একটু বেশি। কেননা এই অঞ্চল নদীকেন্দ্রিক। নরম পলিমাটিতে বেড়ে-ওঠা মানুষ এরা। এরা মানে আমরা। তাই মনে হয় — আমাদের জীবন একটা নদীর জীবনের থেকে ঠিক কতখানি আলাদা? কিংবা নদীর জীবনের সাথে ঠিক কতখানি একাত্ম? তাই কয়েকশ বছর ধরে এই অঞ্চলের মানুষ কোনোরকম গানের উপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই গেয়ে উঠেছে জলের মতো সরল গান, সুরে-বেসুরে এই গানের ধারাও জলের মতোই। কেউই বাদ পড়েনি। ক্ষেতের কৃষক, নদীর মাঝি, গাড়োয়ান, পালোয়ান থেকে বাউল পর্যন্ত কেউই বাদ পড়েনি এর ধারাবাহিকতা ও তার উস্কানি থেকে। এইখানে প্রথাগত তাল লয় মাত্রা সহ আরও যেসব নিয়মতান্ত্রিকতার মামদোবাজি আছে, তা ঠিক মার খেয়ে গেছে। কারণ এই গানের মধ্যে খুব সহজভাবেই এসবের সমাবেশ ঘটে গেছে — ঘটে যায়। এটা স্বাভাবিকভাবেই হয়ে গেছে — হয়ে যায়। কোনোরকম কর্মশালা অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ঘাসফড়িং উড়তে শেখে — কোকিল গান গায়।

আয়না আয়না হরেক রঙের বায়না — / এটা চাই তো ওটা চাই না / কোনটা যে ঠিক তাও জানি না
এই বৈশাখে রিলিজ পেলো জলের গানের প্রথম অ্যালবাম ‘অতল জলের গান’। জলের গানগুলির সাথে গানের ও গানের বাইরের অনেকেই কমবেশি পরিচিত। এঁরা দীর্ঘদিন ধরে গান করছেন। এদের প্লাটফর্ম মূলত চারুকলাকেন্দ্রিক। আস্তে আস্তে সেটার বিস্তৃতি ঘটে গেছে। অজস্র মানুষ তাদের গান ছুঁয়ে ফেলেছে। অথবা তাদের গান ছুঁয়ে ফেলেছে অজস্র মানুষকে। তবে কী ভালো গান ছোঁয়াছুঁয়ির অনুঘটক? অনুভূতির প্রচ্ছন্ন ও প্রকট প্রশ্রয়দাতা?

সুরের ভিতর পাওয়া যাচ্ছিল ইমেজ। কোনো কোনো লাইন এতটা আবেশিত করে যে, বাধ্য করে শীতের সকালে ঘাসজমিতে হাঁটতে। বন্ধ চোখে একটা শিশিরফোঁটা চমকে দ্যায়। মানুষ অনেকটা হরিণ স্বভাবের? আসলে তা না। কিছু কিছু সুরে — সুরের কথার সম্মিলনে, মানে গানে আচ্ছন্নতা থাকে, প্ররোচনা থাকে। এই গান বাজছে — বাজছে। আর খুব সহজেই একজন শ্রোতাকে হয়তো রাহুল আনন্দরা নিয়ে যাবেন সিনেমার ভিতর। দৃশ্যের ভিতর। সেখানে একটা নৌকা দুলছে — বিকেলের বাতাসে। বিভ্রম তৈরি হতে পারে নৌকাটা কে দোলায়? বাতাস নাকি রাহুল আনন্দ, কনক আদিত্য গং — মানে জলের গান? মনোগমনের এক রহস্যময় অদ্ভুত ও অ্যাবসার্ড এক দ্যোতনা ঠিকই তৈরি করে ফেলেছেন এঁরা গানে গানে।  ঠিক ঠিক স্পর্শ করা যায় প্রচ্ছন্ন দূরত্বের গল্প আর লৌহবেদনার ইতিকথা। সম্প্রচারিত হচ্ছে দৃশ্য, সম্ভবত ঘ্রাণের একধরনের ভূমিকা থেকে যায় এই সরাসরি সম্প্রচারে। এখানে এক অনুভূতির সন্ধান পাওয়া যায়, — যে বেড়ে ওঠে ঘরের বাইরে, ঘোরের ভেতর, পাতাবিহীন এক জনপদে।

এই বেড়ে-ওঠা ‘উড়ছি কেন?’ — এসব প্রশ্নের মানে বোঝার জন্য…

দূরেথাকা মেঘ তুই দূরে দূরে থাক 
জলের গানের গানগুলি মূলত এই অঞ্চলের আবহমান লোকগান। কী সুরে, কী গায়কীতে! লোকগানের ১২টি সুরের ব্যবহার হয়েছে বারবার। যদিও লোকগান এর বাইরে গিয়ে করা প্রায় অসম্ভব। গানের কথায় একধরনের নান্দনিক কাব্যিকতা। জীবনবোধের ঘ্রাণ। প্রথমে প্রশ্ন জেগেছিল, কাব্যিক কথার কারণে কী মূল বাংলা লোকগানের শ্রোতার কাছ থেকে এই গানকে আলাদা করে ফেলা হলো? এখন কথা হচ্ছে, লোকগানের মূল শ্রোতা কারা? এঁরা আসলে বাংলা গানেরই মূল শ্রোতা। এঁরা নিম্ন-আয়ের সাধারণ মানুষ।

এই অঞ্চলে মমতাজের গান নিয়েও হাসিঠাট্টা হয়েছে। এটি নিচু শ্রেণীর শ্রোতাদের গান — এমন তকমাও দেয়া হয়েছে বহুবার। মমতাজের গানকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসেন প্রথমবারের মতো হানিফ সংকেত আর ইথুন বাবু মিলে, ‘রিটার্ন টিকেট’ নামে একটা সলো অ্যালবামের মাধ্যমে। পরে মমতাজের গানের দরদ আর শৈল্পিক রূপটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি গিয়াস উদ্দিন সেলিম আর অর্ণবের কারণে। মনপুরা  সিনেমাতে ‘আগে যদি জানতাম রে বন্ধু’ গানটির মাধ্যমে। গত ৪০ বছর ধরে মমতাজের গানকে ধারণ করে আসছেন কলকারখানার শ্রমিক, ক্ষেতে-খামারে কাজ করা সাধারণ মানুষ। তাই, সন্ধায় সাইকেলে বাসায় ফিরতে ফিরতে কমদামের চায়না মোবাইল ফোনে ফ্যুল ভলিউমে যখন পোশাকশ্রমিককে ‘জলের গান’-এর গান বাজাতে দেখি — ‘আমি একটা পাতার ছবি আঁকি’ … শুধু এইটুকু কানে আসে … তখন অভিভূত হই। মনে হয়, জলের গান  অবশ্যই সফল। মনে হয়, জন্মগতভাবেই প্রতিটি মানুষ কবি।

ঋতুভিত্তিক নিয়মনীতির বাইরে গিয়েও কাগজের নৌকাটি ভাসিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার ইচ্ছেটা অমূলক নয়। এই চুপ থাকার অনেকরকম মানে থাকে। এই দুপুর বিকেল কিংবা সন্ধ্যাও সাধারণ কোনো দেয়ালঘড়ির লাগটানা দাস নয়। এঁরা শোনাচ্ছেন মহাকালের হাওয়াঘড়ির টিকটিক। এই নিমগ্নতার ভেতর খুব সহজেই নিয়ে যাবার মতো ক্ষমতাধর লাইন, সুর আর আওয়াজ। এই ক্ষমতা সম্ভবত দীর্ঘ সাধনায় তৈরি হয়। সহজাতভাবেই মুগ্ধতা তৈরির ক্ষমতা জলের গানের জলের সন্তানেরা প্রকৃতিগতভাবেই ধারণ করেন। শ্রোতাকে সোজা হাত ধরে একটা ঘোরের জগতে নিয়ে যান এঁরা। ঘোররাজ্যে নিয়ে গিয়েই সন্তুষ্ট নন; ঘোররাজ্যের সদর দরজা বন্ধ করে দেন। যার ফলে, খুব সহজে বের হবার আর উপায় থাকে না।

প্রথম প্রকাশকাল : অক্টোবর ২০১৩


গা ন পা র ভা ষ্য
এই লেখাটা বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানদল ‘জলের গান’-এর ডেব্যু-অ্যালবাম ‘অতল জলের গান’ রিলিজের অব্যবহিত সঙ্গে সঙ্গেই লিখিত হয়েছিল। লেখাটা ছাপাও হয়েছিল ‘লাল জীপের ডায়েরী’ লিটারেরি সাইটে। এর প্রথম প্রকাশকাল ২০১৩ অক্টোবর। অ্যালবামটাও মুক্তি পেয়েছিল ওই সময়েরই নিকটবর্তী বৈশাখে। গ্যাব্রিয়েল সুমন গোটা অ্যালবাম শুনে তাৎক্ষণিকভাবে তাড়িত হয়ে এই রিভিয়্যু করেছিলেন, কথাপ্রসঙ্গে এইটা গ্যাব্রিয়েল বলতেসিলেন গানপারে লেখাটা পুনর্প্রকাশের ব্যাপারে নেসেসারি কন্সেন্ট নিতে যেয়ে আমরা যখন তার দ্বারস্থ হয়েছিলাম। তো, বলবার কথা যেইটা তা এ-ই যে, পরবর্তীকালে স্টেজে এবং অন্যান্য মিডিয়ায় পার্ফোর্ম করতে যেয়ে ‘জলের গান’ তাদের গানের চেয়েও অতিনাটকীয়তা বা গান পরিবেশনকালে মেলোড্রামা দিয়া ক্ল্যাপ্স কুড়াতে থাকে ধুমিয়ে, ফ্যানবেইস শনৈ শনৈ বাড়তে থাকে, এদিকে গানের শ্রোতারা হতে থাকেন ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ। দলের লাইনআপেও পরিবর্তন আসে একসময়, বলতে গেলে দলের ভরকেন্দ্র কনক আদিত্য সংগীতসমুজদারদের কাছে প্রেফ্রেন্সের জায়গায় ছিলেন সবসময়, নাটামিপ্রিয় যারা তাদের প্রেফ্রেন্স যদিও রাহুল আনন্দ, জলের গান থেকে কনক অব্যাহতি নেন অচিরে। এইসব কারণে গ্যাব্রিয়েল সুমন, যিনি নিজেও সংগীতশিল্পী এবং কবি, বর্তমান রিভিয়্যুটা আবার প্রচারিত হোক তা চাইছিলেন না। প্রাথমিকভাবে এই গানদল মিউজিকের জায়গায় যে-ব্রেইকথ্রু ঘটাবে বলে আন্দাজ করা যাচ্ছিল শুরুয়াতের সময়টায়, তা আর হয় নাই। রিসেন্টলি জলের গান তাদের থার্ড অ্যালবাম রিলিজ করেছে যদিও, মঞ্চেও তাদের চাহিদা আছে, সংগীতপ্রশ্নে এই দল শুধু ফোকচর্বিতচর্বণ করে যেতেছে দেদারসে। অ্যানিওয়ে। গ্যাব্রিয়েল ফাইন্যালি রাজি হয়েছেন ফার্স্ট ইম্প্রেশনের রিভিয়্যুটা পুনর্পাব্লিশ করার ব্যাপারে, কেননা গানপারে একটা আর্কাইভ্যাল নেসেসিটি থেকে এই লেখাটা আমরা ছাপতে চেয়েছি। এমনিতে কিন্তু রচনাটা অত্যন্ত সুখপাঠ্য, অনুভূতিবিকিরক, সময়ের একটা সাক্ষ্য তো বটেই। গ্যাব্রিয়েল সুমনকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই লেখাটা গানপারে রিপাব্লিশের ব্যাপারে শেইকি থেকেও অন্তিমে সম্মতি দিয়েছেন বলে। থ্যাঙ্কস্ জানাই লালজীপ সাইটের সঞ্চালকপক্ষকেও, লালজীপের লেখাগুলা আজকাল শেয়ার ইত্যাদি করা যায় না সাইটমডারেশন বন্ধ হয়ে যাবার কারণে। — গানপার   

… …   

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you