দুর্গম গিরি পাড়ি দেয়ার গল্প || আফসানা কিশোয়ার

দুর্গম গিরি পাড়ি দেয়ার গল্প || আফসানা কিশোয়ার

সাহিত্য করতে আসা মানে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়া। এমন-তেমন অন্ধকার নয়, ঘোরঘুট্টি-নিকষকালো অন্ধকার। পাপড়ি রহমানের সম্প্রতি প্রকাশিত বই একলা পথের সাথির শুরু হয়েছে এভাবে। সেই অন্ধকারে কি লেখক তার স্বপ্নদেখা ভুলে যাবেন, কলম ও কাগজ নিয়ে যে-স্বপ্নের সূচনা? না। কীভাবে একটা একটা পাথর-অন্ধকার কঙ্কর সরিয়ে সেই যাত্রা অব্যাহত রেখে ‘খালেকদাদ পুরস্কার’ পেলেন লেখক পাপড়ি রহমান তার এক সংক্ষিপ্ত চিত্র দেখতে পাই আমরা এই মলাটবন্দি জবানিতে।

শহরজুড়ে তখন দৈনিক পত্রিকার ডামাডোল চলছে। টিভি খুললেই চোখে পড়ছে দৈনিক জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, শৈলী  ইত্যাদির রমরমা বিজ্ঞাপন। তখন হলুদ-খামের চিঠিযুগ। লেখক সেই খামে পুরে জানা-অজানা বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠাতে থাকেন তার লেখা।

লালসবুজের পাতায় সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও নানাবিধ ফিচার লেখা শুরু করেন লেখক। এর মাঝে ভোরের কাগজের অন্যপক্ষ, মেলার পাতায় পাঠানো লেখা সযতন ছাপা হতে থাকে। ভোরের কাগজের পাঠক ফোরাম  পাতায় লিখে পেয়ে যান পাঠক-ফিচার বিজয়ীর পুরস্কার। পরিচয় হয় তার পাঠক ফোরামের বিভাগীয় সম্পাদক গিয়াস আহমেদের সাথে। গিয়াস আহমেদ লেখকের সুহৃদ তা বই পড়ে বুঝতে পারি অনায়াসে।

লেখক ধৈর্য আর অধ্যবসায় দিয়ে লিখে যাচ্ছেন। শৈলীর সম্পাদক কুয়াত-উল-ইসলাম লেখকের এক গল্পকে তিনবার কাটাছেঁড়া করলেও লেখক দমে যান না। লেখক ভেবেছেন এ-জীবনের যত হলাহল তিনি অনিচ্ছাতেও পান করে চলেছেন তা উগড়ে দিতে পারবেন লেখার মাধ্যমেই। কিন্তু লেখক এও উপলব্ধি করতে পারছিলেন বিষে বিষে বিষক্ষয়ের বাসনায় ভারী পাথরটা ঠেলতে ঠেলতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে ধাবিত হচ্ছেন ঠিকই, পাথর নেমে যাচ্ছে গড়িয়ে আবার পাহাড়ের সানুদেশে।

[And I wanted it in fears / Night and morning with my tears / and I stunned it with smiles, / And with soft deceitful wiles. (A Poison Tree, William Blake)]

পত্রিকাগুলোর এই-যে পাঠকদের নিয়ে ও ফিচার-রাইটারদের নিয়ে জমায়েত গড়ে তোলে — এর মজার দিক হচ্ছে, এর সব কাজ এই পাঠক ও ফিচার-রাইটারদের নিজের টাকাতেই হতো। ফিচার-রাইটার বা প্রদায়কদের পত্রিকাগুলো ব্যবহার করত তাদের বিনি পয়সার মার্কেটিঙের কাজে। এদের দেখা হতো নমঃশূদ্রের দৃষ্টিতে, তাচ্ছিল্যভরে। এমনই এক অভিজ্ঞতা হয় লেখকের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে। ফোরামবাহিনীর কেউ যেন স্যুভেনির না পায় এবং অন্যদের খাওয়া শেষ হলে খাওয়ার জায়গায় যায় তা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য স্বয়ং পত্রিকার সম্পাদক দাঁড়ানো। এহেন অভিজ্ঞতার পর লেখক বিভিন্ন পত্রিকার অনুষ্ঠানে যাওয়া ধীরে ধীরে কমিয়ে দেন।

যারা যারা সাহিত্য করেন তারা জানেন বড় বড় মিডিয়া-হাউজগুলোর সিন্ডিকেট কীভাবে কোনো-একজনকে হঠাৎ করে পাদপ্রদীপের নিচে নিয়ে আসার কারসাজি করে। এই কারসাজিতে যারা টিকতে পারে না তারা থেকে যায় পুরস্কার বা আলোচনার বাইরে। নিদেনপক্ষে বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হবার সুযোগও কর্পোরেট হাউজগুলো ভীষণ দুরূহ করে রাখে তাদের রাডারে না-মেলা লেখকদের জন্য।

লেখক কেন পুরস্কার চেয়েছেন মনে মনে? কারণ পুরস্কারের টাকা পেলে তিনি বাচ্চাদের খানিক স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারবেন। টাকা পেলে তিনি ভ্রমণে বের হবেন। তার অপূর্ণ শখ নিজের টাকায় পূর্ণ করবেন। লেখক নিজেকে নিজে বলেন, “আমি চাই না আমি যখন থুত্থুড়ে বুড়ি হয়ে যাব, তখন আমার জীবন্ত-কঙ্কাল কেউ টেনেহিঁচড়ে মঞ্চে উঠিয়ে পুরস্কৃত করুক।”

আমাদের (নারী) লেখকদের জীবন কেমন? — “আমার লেখার সরঞ্জামাদি চুপিচুপি গুছিয়ে রাখতে হতো। এই সঙ্গোপনের প্রয়োজনও ছিল। এক দৈত্যপুরীর কেউ আমার অতি-সংবেদনশীলতা বুঝতে পারবে, সে-রকম কোনো সম্ভাবনা একেবারেই ছিল না।” তার প্রিয় পাঠক-ফোরামের আরেক বিভাগীয় সম্পাদক পাপড়ির লেখা অন্য আরেকজনের নামে প্রকাশ করে দিলেন। এই তো আমাদের (নারী) লেখকদের ভেতরের কান্নার গোপন খবর।

লেখক কি শুধু বঞ্চনার আর বাধার কথা বলেছেন এই বইতে? পার্টনার কেমন হয় (নারী) লেখকদের? “আমি ছিলাম ভীত খরগোশের মতো জড়োসড়ো। গৃহশান্তি বজায় রাখার জন্য বা নিজেকে সেফ রাখার জন্য আমি সর্বত্রই আমার পার্টনারকে সাথে নিয়ে যেতাম। এজন্য আমাকে প্রায় শত শত লিটার তেল খরচ করতে হতো।”

একজন গদ্যলেখক, যার ঘরে অসংবেদনশীল পার্টনার, চারিদিকে প্রতিবন্ধকতা, যার নিজের টাকা নেই, তার নিভৃতির আশ্রয় যে কবিতা হবে এ আর বিস্ময়ের কী! কিন্তু সেই কবিতাকেও যখন পত্রিকার সাহিত্যসম্পাদক খুঁত-নিখুঁতের বাউন্ডারিতে ফেলে দেন — কবিসত্তা নিজের সাথে নিজের করা যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে ওঠে মানবীয় চরিত্রে।

পিতার মৃত্যুতে শোকে পাগল লেখক এক পত্রবন্ধুর সাথে আবোলতাবোল চিঠি দিয়ে নিজেকে মানসিকভাবে চাঙা রাখার চেষ্টা করছেন। কারণ এই দুঃখবৈতরণি পার হওয়ার জন্য যে সান্ত্বনা, সাহচর্য লেখকের দরকার তা তিনি পাচ্ছিলেন না। অদেখা মানুষের সাথে অক্ষরবিনিময় লেখকের জীবনে এক কালো অধ্যায় নিয়ে আসে। তার পার্টনার খোলা তলোয়ার হাতে নামেন। আল্টিমেটাম দেয়া হলো — লিখতে পারবেন না, বাসার বাইরে যেতে পারবেন না, ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। কাজে-কাজেই, লেখকের জীবনে নেমে আসে সব ধরনের সাহিত্যকর্মকাণ্ডের সাথে চার বছরের বিচ্ছিন্নতা।

এত অপ্রাপ্তির মাঝে শৈলী  পত্রিকার বিশেষ গল্পসংখ্যায় শহীদুল জহিরের সাথে লেখকের ‘শ্যাওলা রেখেছে জমা রৌদ্র ও শিশির’ গল্পটি ছাপা হয়। লেখকের চোখ থেকে ঝরতে থাকে জল।

লেখক ‘তরুণ লেখক প্রকল্প’ — বাংলা একাডেমির — উদ্যোগে সামিল হন এক-সময়। এ-পর্বে এসে লেখক নিজেকে নিজে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, “আমি ভেবে পাচ্ছি না, শুধুমাত্র রান্না-খাওয়া, বাচ্চা লালনপালন, ঘর গোছানো ও রূপচর্চার মাঝে একজন নারীর জীবন কী করে ব্যয়িত হতে পারে?”

দুই বাচ্চাকে রেখে কোনোদিকে যাওয়ার জো নেই। সাংসারিক সমস্ত দায়িত্ব গাধার মতো পালন করে এদিক-ওদিক করে নিজের জন্য সময় বের করা। বহু সময় ক্ষেপণ করে লেখক বাংলা একাডেমির পঞ্চম ব্যাচে যোগ দিলেন।

সতীর্থ লেখকরা কি তাকে সাদরে নিয়েছেন? না তো! মানবজীবনের ষড়রিপুর একটি ঈর্ষা, তা দিয়ে লেখককে বিদ্ধ করেছেন অনেক সমকালীন লেখকরাই। ২০০০ সালের মে মাসে নির্বাচিত সেরা ১০ তরুণ লিখিয়ের মাঝখানে পাপড়ির বই স্থান করে নেয়। তাকে আরেক লেখক বলে বসেন, “আপনার যা পাবার তা তো আপনি পেয়ে গেছেন, আর কী চাই?”

লেখক সেলিনা হোসেন যখন তার স্নেহের পাপড়িকে দীর্ঘশ্বাস আটকে বলেন, “পাপড়ি, এত রূপের মূল্য দাও এইবার।” পাঠকমাত্রই অনুধাবন করে ফেলেন (নারী) লেখকের সাহিত্যসাধনা, একটা মানসম্মত বইপ্রকাশ, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্য পাওয়া কত দুষ্কর হয়ে ওঠে শুধু তার জেন্ডার পরিচয়ের কারণে।

সেইসব বন্ধুর পথ মোবারক হোসেন, সেলিনা হোসেন … এমন অগ্রজদের দেয়া সহমর্মিতায় ও স্নেহে কোনোরকমে অতিক্রম করেছেন আমাদের লেখক। বাচ্চারা একটু বড় হতে লেখক আবার ধীরে ধীরে কাজে ফিরলেন। গাঁথা, কালি — এ-ধরনের সাহিত্যসংগঠনের সাথে যুক্ত হলেন।

তার এ-বই পড়ে পাঠক হিসেবে বুঝেছি তার লেখার যোগ্যতা, পত্রিকা-ম্যাগাজিন সম্পাদনের ক্ষমতা — কোনো জায়গাতেই তার কমতি ছিল না। ছিল অভিজ্ঞতা বা গাইডেন্সের অভাবে করা ভুল। এর মধ্যে অন্যতম অ্যাবিউসিভ সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাওয়া, আর্থিকভাবে নিজে স্বাবলম্বী না হওয়া এবং পিতার মৃত্যুর পরে বিশেষ করে মানসিকভাবে এক-ধরনের ভয়ার্ত ট্রমার সাথে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা।

বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে পুরুষ ও নারী লেখকের জার্নি আলাদা। এ যাত্রা, এ তীব্র প্রখর দাবদাহযন্ত্রণা যে নিজের দেহ ও মন দিয়ে না-জেনেছে সে বলতে পারবে না এর কদর্যতা আর এর তাপ কেমন। ‘একলা পথের সাথি’ সাবলীল গদ্যে এক প্যান্ডোরার বাকশো খোলার সংক্ষিপ্ত আয়োজন। একটানে পড়ার মতো বইটিকে পাঠক আর একলা না-রাখুক।

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৮৯। বইটি বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত। চলতি বছর ২০২৩-এর বাংলা একাডেমি বইমেলাতে পাওয়া যাবে; বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের স্টল নং ২৩৮, ২৩৯ ও ২৪০। বইয়ের গায়ে লেখা মূল্য ৫০০ টাকা।

পাঠকের বই পড়া চলুক লেখকের হাত ধরে।

COMMENTS

error: