ফেব্রুয়ারিশিখা || শাহবাগ ২০১৩ স্মরণিকা

ফেব্রুয়ারিশিখা || শাহবাগ ২০১৩ স্মরণিকা

অনেক অনেক দিন আগের কথা। বাংলায় লিখতে জানতাম না আমি বিলকুল। মোস্তফা জব্বারের ছেলের নামধারী সিস্টেম এস্তেমাল করে বাংলা টাইপ আজোবধি শিখতে পারি নাই। মিনোয়াইল, সহসা, ডালপালা উতালা করিয়া আইলো জুকার্বার্গের ফেসবুক। ২০০৬ বা ’০৭ হবে বোধহয় বাংলাদেশে ফেসবুকের আরম্ভ। তখন আমি ইংরেজি অ্যালফ্যাবেটে এক-দুই সেন্টেন্সে টুটাফাটা স্ট্যাটাস-আপডেট শেয়ার করতাম, করে বেশ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কেঁপে কেঁপে দিন কাটাইতাম একা একা।

দাজ আই স্পেন্ট অল দি ইয়ার্স আন্টিল টু-থাউ-থার্টিন। পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায় একসময়, বেশিদিন আগের কথা না সেইটা, এরই মাঝে মেঘে-রইদে বেলা তো কম হলো না। শাহবাগজাগৃতির দিনগুলায়, ডিউরিং ফেব্রুয়ারি থার্টিন আই রিমেম্বার, একটা মওকা পাই জিমেইল অ্যাকাউন্টের মেসেজ-কম্পোজ অপশনের সুবাদে। কেননা আমার কাছে অভ্র টাইপটাও সুবিধাজনক মনে হয় নাই, চেষ্টা চালায়া ব্যর্থ হইসি শিখতে, অভ্রব্যবস্থায় ঠিক সড়গড় হইতে পারি নাই আজও। তো, জিমেইল আমারে একটা আস্বাদ দিলো মুক্তির, মনের হরষে মাতৃভাষায় চিল্লাইবার লিবার্টি। ইউনিক এই এক্সপেরিয়েন্সটা আমার কাছে। এভ্রিডে, রোজ, কিছু-একটা বাংলায় লিখে সেইটা কাট/কপি দিয়ে ফেসবুকের স্ট্যাটাসবক্সে যেয়ে পেইস্ট করে পোস্ট/রিপোস্ট করা আমার একটা পাগলপারা কাজ হয়া দাঁড়ায় নিতিদিনকার। আমি দিব্যি রিকল করতে পারি যে এহেন অবস্থা চালু ছিল অলমোস্ট পুরাটা ফেব্রুয়ারি জুড়ে। ফেব্রুয়ারি মিড-উইক থেকে শুরু হয়েছিল, পুরা ফাল্গুন জুড়ে এইটা চালায়ে গেসলাম।

অব্যবহিত পরে এক বন্ধু, কবি ও কাগজসম্পাদক, আহমদ সায়েম, আমারে নোটলেখা শেখান। সম্ভবত তিনি বিস্মৃত হয়ে গেসিলেন ওইসময় যে পাগলকে নৌকা চালানি শিখাইলে বেহাল অবস্থা কোথায় নিয়া যাইতে পারে। সেই সময়টাই ছিল এমন, কয়েকটা আগুনসুন্দর সেই দিন, ঝটিতি এসেছিল ঝড়ের বেগে, সেই-সময় কেবল বুদ্ধিবৃদ্ধরাই পারসিলো পরিণামচিন্তায় পেরেশান হয়া ব্লাডস্যুগার বাড়াইতে। বেশিরভাগ মানুষ তখন, অন্তত শুরুর কয়েক হপ্তা, চিৎকারে চনমন হয়া উঠসিলো। বহুদিন বাদে এনজিয়োস্থবির দেশে এমন চিৎকার, উৎস খুঁজতে খুঁজতে অনেকেই গিয়েসিলো যার যার তরিকা ও বাহনে চেপে কেন্দ্রস্থলে। এইটা টানা মাসখানেক বলবৎ ও বহাল ছিল। পরে কি হলো না-হলো তা-সব বলার এখতিয়ার আমার বুদ্ধিজীবী কনিষ্ঠ ভ্রাতার, বয়োজ্যেষ্ঠ খুল্লতাত-মাতুলের, তথা আমার কড়ে-আঙুলের। যুগ যুগ ধরে আমি শুধু তর্জনী ও মুষ্ঠি উঁচিয়ে গেসি পৃথিবীতে এসে। এইটাই আমার কাজ। ওয়েল, প্রসঙ্গ পাল্টাই।

ডিউরিং দ্যাট পিরিয়ড অফ টাইম আমি স্ট্যাটাসগুলো পোস্ট করতেসিলাম আর এর মধ্য দিয়া কাইন্ড-অ্যা ক্যাথার্সিস খুঁজতেসিলাম। একপ্রকার সেল্ফ-ক্যাথার্সিস, আত্মবিমোক্ষণ। সম্প্রতি এইগুলো খুঁজতে যেয়ে দেখি ঠিক ফেসবুকের সময়রেখা ধরে এগুলো উদ্ধার করা যাচ্ছে না, টাইমলাইনে একটা পাইলে তিনটা মিসিং। গতি, অগত্যা, জিমেইল। কম্পোজ অপ্শনের ড্রাফ্ট স্পেসে স্ক্রল করে করে পেছায়ে গেলাম। কয়েকটা পাইলাম খুঁজিয়া, বাকিগুলা পাই নাই, অনুমান করি যে কাট দিয়া উঠায়া নিয়া ফেবুতে পেস্ট করা পোস্টগুলো তবে চিরতরেই মিসিং হইল। ক্ষতি হয় নাই, খচখচ হইতেসে, অ্যানিওয়ে। ব্যক্তিগত খচখচ, জাতীয় অথবা ঐতিহাসিক খচখচ নয়, ভাগ্যিস। তো, বন্ধুদের বকাবকিতে একসময় বাধ্য হয়ে এইধারা স্ট্যাটাস শেয়ার দেয়া হইতে রিটায়ার করতে বাধ্য হই। আমার বন্ধুরাই আমার শত্রু ও সাধনা। “বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি, তুমি আমার সাধনা” — আজও রোদন-উর্দ্রেকী সিনেমার এই অনিন্দ্য-অসাধারণ গানটা। যা-ই হোক, বন্ধু ও বন্ধুস্থানীয়দের আমাশয় ও উদরাময়ের ঝুঁকি থেকে রক্ষাকল্পে একসময় এইধারা স্ট্যাটাস মুসাবিদা ক্ষান্ত দিয়া দেই। কিন্তু কোনোদিন যা করিনি — লেখালেখি — বুড়া বয়সে তা করতে যেয়ে দেখি, যা-ই করি সব শিশুতোষ রাইম হয়া যায়। তেজ নাই, কিক নাই, নিতান্ত উইক একেকটা শট। যা নাই, তা আমার জীবনেই নাই, কাজেই এদিকটুকু কন্সিডারেশনে নিলে এই চিজগুলা আমার জীবনঘনিষ্ঠ হইতে পারসে। অ্যানিওয়ে, এইগুলি বিক্রয়ের জন্য নহে, এইগুলা তাই প্যাটেন্ট বা লাইসেন্স করাতে হয় নাই। অ্যান্থোলোজি করতে যেয়ে একটুকরো ভূমিকা লেখার কর্তব্য হঠাৎ মাথায় ঝিলিক দিলো, মুখবন্ধধর্মী, লিখলাম।

ভুল ছন্দে বেফজুল এই নিম্নসংকলিত পদ্যসমগ্র ডেডিকেইটেড টু অল মাই গ্র্যান্ডডটার্স। ওরাই, আমার মেয়ে ও তার ছেলেমেয়েরা, এইগুলার উদ্দীষ্ট পাঠকগোষ্ঠী। আলাপ শেষ, এইবার ঝালা, কার্দানি শুরু। কিম কার্দাশিয়ানের ন্যায় বেহুদা হাইট অ্যান্ড টাইট। অভ্যুদয়দিন স্মরণ করি শাহবাগজাগৃতির, আর বাকি জিন্দেগিভর ঝিমাই, এল ওই জাবর-কর্তনের ঋতু আমাদের। বয়স হইবার আগেই বয়সভারে ন্যুব্জ হয়া যাও, অগত্যা। ক্যায়া বাত!

সংক্ষেপে একটি প্রিফেস লিখতে চাইসি, অত লম্বা হয়া যাবে ভাবি নাই, কী-আর-করা। আর জিনিশগুলার বহু জায়গায় রিটাচ-রিরাইট করতে কিবোর্ড নিশপিশ করতেসিলো, নোলা সামলাইতে হইল। ওই সময়ের বুঝসমুজ আর এখনকার বুঝসমুজে এরই মধ্যে বেজায় ফারাক ঘটে গেসে। অ্যানিওয়ে। এই ফারাকটা আমি রিড করতে চাই ফিরে ফিরে। লাইফের ন্যাকামি-বোকামি কিছুই তো ফেলনা নয়। শাহবাগ ২০১৩ স্মরণিকা  আদতে সেসবেরই ক্ষীণ গ্রন্থনা।

আর, আরেকটা কথা, এই কম্পাইলেশনের বাইরে অ্যাট-লিস্ট আরও অন্তত ডজনখানেক খোঁড়া আবেগী জিনিশ রয়ে গেল। কখনও খুঁজে পেলে সেইগুলা আলাদা কোনো ভল্ট বানায়া রাখা যাবে সেখানে।

ফেব্রুশিখা বা ফল্গুশিখা বা ফেব্রুয়ারিফ্লেইম্স যা-ই বলি, কিংবা আস্ত শব্দে ফেব্রুয়ারিশিখা, প্রিফেস/উপক্রমণিকা ছাড়া কারো পক্ষে টের পাওয়া না-মুনকিন হতো যে এইগুলা প্রাপ্তবয়স্ক কোনো লোকের করা। কাজেই, নিচের জিনিশগুলা আদতেই সিরিয়াস কিছু নয়, আল্লার দোহাই, নিবেনও না সিরিয়াস্লি।
— নিবেদক, জাহেদ আহমদ


ফেব্রুয়ারিশিখা ।। শাহবাগ ২০১৩ স্মরণিকা ।। জাহেদ আহমদ


প্যান্টোমাইম
আয় বাপু দেখে যা
ঝাঁপিভরা সাপে
জনে জনে ডেকে যায়
দিনগত পাপে

দেখে যা রে খেলুড়ে
মাদারি-কা-খেল
রঙ-বেরঙের কত
কচমা আঁতেল

ধেঁড়ে দুই-তিনজনে
টাইম-টু-টাইম
কসরতে যায় করে
প্যান্টোমাইম

এ বলে আমারে দেখো
ও বলে আমায়
দেখানোপনার ঠাপে
কাছা খুলে যায়

ল্যাংটা রাজার দেশে
ল্যাংটো প্রজা
মুশকিল আসান দেবে
নাহিকো ওঝা

ওঝা-সঙ্কটে পড়ে
রাজার দুলাল
নাকানিচুবানি খায়া
মহা নাজেহাল

ঘুরেফিরে একই ওঝা
আচোদা আঁতেল
দেখে যা দেখে যা ওরে
মাদারি-কা-খেল

কত কথা বলে এরা
আবার জিগায়
কীরূপে পড়িল মাইনক্যা
এহেন চিপায়

প্রয়োগিতে ঝানু এরা
বাগালঙ্কার
এদের কথায় বৃথা
খুঁজিও না সার

হেনকালে উদয়িলা
দরদিয়া সাপে
কৌশলী নিঃশ্বাসে
সহিংস ধাপে

সাপে কয় বাপো মোর
দংশিব যবে
বুঝিবা সাপের খেলা
প্রাণপ্রিয় সবে

কিন্তু কে কারে শোনে
সেয়ানা পাগল
কিম্ভুতে একাকার
সার্কাসদল

মত্ত সকলে মিলে
জিন্দবাদ ও জয়ে
কুঁজো হয়ে গেনু ভূত
সিন্দবাদ লয়ে

ভবিষ্যতের কথা
কী কহিব আর
সুফলা শস্য শুধু
বুদ্ধিজীবিতার

———

এল. বাবর রিলোডিং
The revolution will not be televised.
(a funk-rap song by Gil Scott-Heron released and popularized in 1971)

লুকিং ফর শত্রুজ
কুকিং ফর দাঙ্গা
বুকিং ফর ভোটাভুটি
ওয়াচিং মুড চাঙ্গা

সার্চিং চিরুনি দিয়া
চকির তলায় ভূত
মার্চিং পাস্ট ডিয়ার
নিয়া আঙলিশীর্ষে ট্রুথ

সংযোগে চাই শান্টিং
নয় ট্রেন হবে লাইনচ্যুৎ
সিজন অপোন্যান্ট হান্টিং
তুই ব্যাটা বাইনচোৎ

মুই হনু সব-সাচ্চা
সাব্বে সুখিতা ভবন্তু
তুই বিরোধীর বাচ্চা
ফ্রাইটেনিং জন্তু!

জোকিং উইথ হিস্ট্রি
অ্যাগেইন-অ্যান্-অ্যাগেইন
ফাকিং আপ এন্সেস্ট্রি
অল দেম ইনসেইন

স্পিকিং আমি ম্যাঙ্গো
নই ইয়োর সিন্সিয়ার
ছিপছিপে এই ব্যঙ্গ
পোলিটিক্যালি ক্লিয়ার

টেমিং অফ দ্য শাহবাগ
যারা খোয়াব দেখিচ্ছো
লাফিং ইভেন গোরু-ছাগ
গোকুলে বাড়তেসে বিচ্ছু

এই রাইম এবং রাইমার
এরা মাটি-মানুষের ভ্যানগার্ড
এদের হিস্ট্রিতে নাই হার
দ্যে আর শাহবাগ-ইন্সপায়ার্ড।।

———

পাঁচালি
যদিও আমি নিঃসন্তান এবং বিপত্নীক
যদিও আমি না-বিপ্লবী কিংবা না-প্রেমিক

যদিও আমার কাছা খুলে যায় একপাক ঘুরতেই
যদিও আমার ভান ষোলোআনা আছি হিতসংঘেই

যদিও আমি মিছিলে যায়া দাঁড়াইনি কোনোদিন
যদিও আমি স্বীকার করিনি মাতৃদুগ্ধঋণ

যদিও আমার উপচিকীর্ষার ফিরিস্তি শত শত
যদিও আমার জীবনযাপন সু-সমাজসম্মত

যদিও আমি তিনকাল থেকে পেরিয়েছি দেড়কাল
যদিও আমি মাঝবয়সেও ঠুকছি শিশুর তাল

যদিও আমার অসুর গলায় শখের গায়েনগিরি
যদিও আমার গানের বেলায় গিমিক ও গিটকিরি

যদিও আমি তিন-পা আগায়ে তেরো-পা পিছায়া আসি
যদিও আমি শরীরে শীর্ণ মগজে খোদার খাসি

যদিও আমার দাবিদাওয়া নাই তিনকুলখ্যাত ভীতু
যদিও আমার পালোয়ানভাব পিঁপড়েতে শঙ্কিত

যদিও আমি মনে মানি না মুখে বলি মারহাবা
যদিও আমি মৃত অগ্নির গিরিতেও দেখি লাভা

যদিও আমার এ-ই তো প্রথম এ-জন্মে জাগৃতি
যদিও আমার জীবন ব্যাপিয়া জাতিস্মরের স্মৃতি

যদিও আমি ভীষণ সুবিধা পাইবার লোভে জেরবার
যদিও আমি মেনে-চলা আর মানায়া-চলা আপোসের সমাহার

যদিও আমি এমনতর অথবা আমার ধরন যেমন-তেমন
ইতিহাস শুধু সাক্ষী কখনো ক্যুয়িট করিনি রণ

কেননা আমি যদিও ভীতু মনেপ্রাণে চাই হোক সাহসী আমারও সন্তান
ওই তো বাড়ছে শ্রেয়াস দ্যাখো ওই তো বাড়ছে অয়ন ও আইমান।।

———

আমার সময় : ছড়ার মতো মনে হলেও ছড়া নয়
আমার সময় একদঙ্গল ছদ্ম সাধুর হাতে
একের পর এক দলাই-মলাই হচ্ছে দেখতে পাই
আমার সময় একটা ব্যাপক বজ্জাত সংঘাতে
কেটে গেল শুধু ঝরিয়ে গলিয়ে রক্ত ও চেকনাই

আমার সময় একপাল ছুঁচো বুদ্ধিঢিবির জিভে
লেলিহান আর লাঞ্ছিত হয়া মুমূর্ষুপ্রায় লীন
আমার সময় ঢাকতে লজ্জা পাতালেই প্রবেশিবে
দ্যাখো দৈত্যের সনে যুঝিয়া আমার অবস্থা সঙ্গিন

আমার সময় বিদঘুটে যত পেশাজীবীদের চোখে
একটা দারুণ ধুম-লুণ্ঠনের মওকাটা অবারিত
আমার সময় খুঁড়িয়ে চলেছে অনিশ্চিত সম্মুখে
এখনও দৈত্য দশের নিকট হচ্ছে সমাদৃত!

আমার সময় এখনও পুরনো শকুনের হাঁকডাকে
কেঁপে-ওঠা হাঁসপাখিটির ন্যায় দু-চোখের বিস্ফার
আমার সময় রেয়াত দিতে একাট্টা তার মাতৃহন্তাটাকে
দ্যাখো ভয়ঙ্কর এক হাইফেনে যুক্ত দুরাত্মা যত বুদ্ধিজানোয়ার।।

———

অবরুদ্ধ দুপুরে
যদি লিখি প্রেমের গল্প অনাড়ম্বর
মধ্যবয়সের দিগ্বিদিক দিশাহারা যাপনের গান
যদি ভীষণ রাক্ষস-আশ্লেষার এই দিনে বাজাই মিষ্টি ঝাঁঝর
ঢাক ও ঢোল সঙ্গতে যদি করি শান্তি সন্ধান

যদি আমপিঁপড়ার আরোহনদৃশ্যে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি
আঁকি তিনটা হাঁসের তা-তা-থৈ-থৈ পুকুরে গুগ্লিভোজ
যদি বিতার্কিক বন্ধুর বকাবাদ্যিতে মুখ ফিরায়া রাখি
আর জঙ্গলের গাছে গাছে করি পাখির বাসা খোঁজ

যদি উদগ্র না হই দেখতে আমার দেশে দাঙ্গার উস্কানি
পাঠে মন না দিই যদি বিচিত্রাকাগজের রাজনীতি-রেটোরিক
যদি ঈমান রাখি তৃণফড়িঙে এবং পড়ি ঘাসের হৃদয়খানি
কিংবা যদি তেঁতুলপাতায় ন-জন বসার ব্যবস্থা চাই সঠিক —

মহামান্য দুনিয়া আমার নামে দুয়োধ্বনি দেবে কি?
কিন্তু সত্য ও শাশ্বত হলো অনলের পাশে বসে অন্তরোদ্ভাস
সমুদ্যত সুধীন্দ্রীয় দৈবে-দুর্বিপাকে এ-ই আত্মজৈবনিকী
নিশিরাত বাঁকাচাঁদ দেখে দেখে এবে চাই জবাকুসুম-সঙ্কাশ…

———

২০১৪
(বসিয়া বাতায়নে ২০১৩ ফাল্গুনে)

আজি হতে একবর্ষ পরে যে-তুমি পড়িছ বসি
এই পোস্টখানি
ইন্টার্নেটে ঢুকে ফেসবুকপত্রে হে আনোখা প্রেয়সী

জেনে রেখো তোমার মতো খুঁজতে খুঁজতে আমিও
পড়ে গেসলাম ভুল বিরিখের প্রেমে একদিন, প্রিয়!

ফলশোভা গাছ তার বিষবৃক্ষ নাম
শিকড়ে-শিরায় বহে চুপিসার হিংসা অবিরাম

তারই সনে মিলায়াছিলাম আমি নিঃশ্বাস আমার
যাকে দেখে একদিন হয়েছিল মনে
(আহা সেই মধুর কুক্ষণে) —
“এই তো সূর্যসেনের বংশধর, লুঠে নেবে নক্ষত্রাগার
লুঠে নেবে রৌদ্রগোলাপ যত, স্বপ্ন ও ভবিষ্যের প্রচুর ভাঁড়ার
প্রহরীকে বোকাচোদা বানাবে আবার!”

বেহাত হলেও আমি নিশানের ছায়াতেই নিতেসি বিশ্রাম
পুনরায় প্রেম আর পুনরায় পরিণয় পুনরায় গান
ক্রুশের বদলে এবে ক্রিসেন্থিমাম
মুখে হেমলক আর মুকুটে কাঁটার স্থলে এবেলা জাগৃতিবিষাণ

আনমন কৌতূহলে যে-তুমি নিতেস উদ্ধারিয়া
আনজানা এ-ফেসবুকস্ট্যাটাসের লিপি
জেনো ভুল হোক শুদ্ধ হোক মনুষ্যেরই চক্ষু-কর্ণ-হিয়া
জানে না আবেগের মুখে এঁটে নিতে বুদ্ধির ছিপি

আমি কি ভুল করেছিনু, প্রভু হে পরমন্তপ, বলো?
প্রসূতি মুর্গির মতো তন্দ্রাচ্ছন্ন দুপুরে
মানুষেরই আওয়াজে ভেসে যেয়ে মানুষের সনে টলোমলো —
যখন করাল খোক্ষসের কালে একদা
আসর গুলজার করে রেখেছিল বর্ণচোরা সুরে ও অসুরে!

এটুকুই ইতিহাস, এ-ই লব্ধ শিক্ষা আমার, এইটুকু হুঁশ
বাতাস মন্দ্র হয়ে এলেও প্রবহমান রয় চিৎকার
মানুষেরই গলা আসি’ যুগে যুগে মানুষেরে করে অধিকার

যদি পারো খুঁজে নিও ময়দানে যাবার আগে মনের মানুষ

———

আমার দেশের এক বুদ্ধিজীবীর জন্য শোকগাথা
ঘরে এবং বাইরে দেখি
তোমারই বিজয়রথ
একে মারছ ওকে কাটছ
রুদ্ধ করে দিচ্ছ চলার পথ

কথা বলবার বাহানা করে তুমি
তলে তলে করো কিরিচ বিতরণ
একচক্ষু দৈত্য বুদ্ধিজীবীর
বাক্যে বাক্যে হিংসার বরিষন

কে তুমি ওগো বুদ্ধিভ্রষ্ট জীব
পক্ষ নিচ্ছ স্থলজ দস্যুদিগের
ভাবখানা যেন সাঁইজি কিংবা শিব
যদিও উপদেষ্টা ডাকাতসংঘের

আমার দেশের পাতায় পাতায় তুমি
ইনিয়েবিনিয়ে এ কী বিলাতেসো নাথ
বাজাতে একদা বামঢোল-শামবাঁশি
আজিকায় দেখি হুজুরের ভিন জাত!

মিছাই কী তবে এত পদাবলি কীর্তন
দরদি কিতাব এবাদতনামা-শিবাজীবন্দনা?
দিগন্তে ভেসে এখন তব তন্ত্রানুশীলন
খুনপিপাসায় ন্যাংটো লোলুপ রসনা

আমরা আগেও ভনেছি এমন কুরঙ্গনাটগীতি
বিদ্যাপতির দেশে কত-না ভাম ঘুঘুকুঞ্জন
আস্তাকুঁড়েই গিয়াছে সেসব অপপাখিদের প্রীতি
মহাকাল মনে রাখিবে না হায় সাধের ভাবান্দোলন

এক্ষণে মোরে কও দেখি কথাবাজ
একজীবনে কত আর তুমি বদলাবা প্রাণমন্ত্র!
বহুবর্ণ বুদ্ধিগির্গিটি ওহে দেউলে বাউলাসাজ
কত আর হেন চলবে মেশিন, মিথ্যেকথনযন্ত্র?

জয়ভেরী কী থামিবে না তবে, মেশিন তোমার চলবেই?
আমরা কি ভায়া জন্মেছি স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুল চুষতেই?

———

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ফুলখেলার দিন হয়তো নয়
কিংবা আমি নিশ্চিত নই ইহা ঠিক কোন খেলার উপযুক্ত মরশুম

তবে এটা আলবৎ গুলিখেলাখেলির দিন নয় —
প্রিয় কমরেড, গুস্তাকি মার্জনীয়, কথাটা মানবেন নিশ্চয়?

এইটা ঠিক যে, এইটা ইতিহাসপ্রমাণিত, খেলায় আমি চিরকাল কুণ্ঠিত-উদাসীন
আমিই ক্রীড়াসামগ্রী, ক্রীড়াকার নই, ক্রীড়নকের কূট ও রঙিন কামনানিবৃত্তিকারী —
চিরনিঃস্ব হয়েছি, যুগে যুগে, চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার দিন

ঘরপোড়া গাধা আমি, তাই, সিঁদুরে মেঘের গপ্পো শুনিয়া ঘাবড়ায়া যাই

কিন্তু, কমরেড, সদেহহৃদয় ফুলখেলার সমর্থক আমি
পৃথিবীতে এই একটি খেলার আমি প্রকাশ্য প্রচারক
অনুমোদন করি এই একটি খেলা আদ্বিজচণ্ডালে দিবাযামী

বুর্জোয়া বলো লুম্পেন বলো সব সইব
শুধু তুমিই ক্রীড়াযাজক — স্বঘোষিত তোমার এই গাঁজাবাক্য সইব না

আমি খেলারাম নই বলেই
খেলা যবে খেলি আমি প্রাণ দিয়াই খেলি
কান খাড়া করে শুনিয়া রাখো সত্বর
গর্ভ হইতে গোর অব্দি আমি বিরতিহীন গ্ল্যাডিয়েটর

খেলো বা না খেলো, কমরেড, করো যথেচ্ছ গোলেমালে আশেকানা
শুধু সকালে-বিকালে ফুলগাছটিতে জল দিতে ভুলিয়ো না

———

নেড়ি ও নেকড়ের সন্ত্রস্ত পথ ধরে বাড়ি ফিরতেসি এই সহিংস সন্ধ্যায়
আমি বাড়ি ফিরতে চাই সহিসালামতে। এই সময়, গেহে ফেরার বেলায়, নেড়ি ও নেকড়ে কেউ যেন পথরোধ না করে এইটুকু নিশ্চয়তা চাই। কিন্তু কোথা যায়া কার কাছে চাইব বরাভয়? বেডরুমের নিরাপত্তা আমি নিজে নিশ্চিত করেছি, বটি-দা আছে বাড়িতে এবং আছে বাপ-দাদার শেখায়া যাওয়া আত্মসম্মানবোধ, কিন্তু রাস্তায় নিরস্ত্র আমাকে কে দেবে নিরাপত্তা? আমি এই মুহূর্তে নেড়ি কিংবা নেকড়ে কারো মুখের/ভোটের গ্রাস হতে চাই না। আমি ধীর পদক্ষেপে দেখে দেখে যেতে চাই কুরুক্ষেত্রসন্ধ্যার রূপ, বাড়ি ফিরে খেতে চাই আমড়াডিম/আমড়ামুকুল সহযোগে টেংরামাছের ব্যঞ্জন দিয়া ভাত, আম্মা আর বোনদের লগে মাতব্বরি ফলানোর সুখটুকু ভোগ করতে চাই। আমি বাড়ি যাচ্ছি। আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি।

———

অল্পানুপ্রাস
বলিব বলিব বলে বলিবার বেলা বয়া যায়
সব শালা সিঁধেলেরা সাজতেসে সাজ-সাজ সোনার বাংলায়
সিদ্ধাচার্য সবে যেন যন্তরমন্তরযোগে জঙ্গ জিনে নিয়ে
শাকচুন্নির সনে শিবঠাকুরের দেয় সমারোহে বিয়ে

আমরা আঙুল চুষি জিয়াফতে জাউভাত খেয়ে
গাধা হোক গরু হোক উদ্ভট উটেদের কাণ্ডকীর্তি-কৃপা চেয়ে চেয়ে
বেলা যায় আমাদের সুরে সুরে সুকুমারের মশহুর হাঁসজারু গেয়ে

মোদ্দাকথা আমাদের গুণগত পরিচয় আমরা অবলা চারপেয়ে।।

———

অসময়
নেড়ি ও নেকড়ের নিনাদে ত্রস্ত নীলিমা

আমরা অচল আজ এইসব অগ্নিদানোর সদুপদেশ ছাড়া?

পৃথিবী পরিত্রাণ চায় ইহাদের খপ্পর থেকে

———

জাগৃতি
এই সুবেসাদিকের বেলা
কাহারা জাগিয়াছ ঘুম থেকে
এখন শুনিতেছ এত্তেলা
কাহারা বারে বারে যায় ডেকে

এই নিশীথের অবসানে
কে এসে ডেকে যায় ফিরে ফিরে
কী গান দোলা দিয়া যায় প্রাণে
এই বিদিশা রাত্রিতিমিরে

এই সুবেসাদিকের আলো
তোমায় জাগার ডাক পাঠালো
তবু তুমি কী হে এরপরও
ঘুমের খোয়াব মকশো করো!

———

পিএম
পুড়ুক আগুনে আমার কান্নাহাসি
তোমাকেই আমি তোমাকেই ভালোবাসি
: কবীর সুমন

যুগযুগান্ত অগ্নিদগ্ধ ঘুরিয়াফিরিয়া আমারই কান্নাহাসি
তবুও তোমারে আমরা বাকরুদ্ধ দমিত-পীড়িত ভালোবাসিবারে বাধ্য
মম সম্পাদ্য উপপাদ্য
ওগো ও জনগণমনপ্রেমিকা, জানেমান, নোবেলবঞ্চিত, ওগো ও সর্বপ্রাণনাশী!

———

উপসংহার
ব্যর্থ হয়েছে কার পোলিটিক্স
কারা-বা হয়েছে সফল
অহেতু ওসব না-ভেবে বরং
ফুলগাছে দাও জল

ফুলগাছে দাও জল এবং
ধানে-ধমনীতে সার
শত্রুবধের অগ্রে করো
হিংসার সংহার

হিংসা রাখিয়া তিরের ফলায়
তরণী ভাসানো বৃথা
তালগাছ অধিকারে রেখে কেউ
রহে না অপরাজিতা

পরাজয় যদি হয় হবে তবু
লড়াইটা হোক খাসা
একটা-কিছু করেই জুটুক
পবিত্র হতাশা

যা-কিছু যখন করবার কথা
যা-কিছু যখন জরুরি
তা-কিছু করিয়া যাও তুমি আজ
ওহে ও পূর্বসূরি

যেখানে যখন যেই কীর্তিটা
কথা ছিল করবার
করিয়াছ কি না হাতমুঠো তুলে
আবশ্যকীয় চিৎকার

সকলকিছুই নিঃশেষি যায়
এ-ই তো মুখ্য সংবাদ
ক্রিয়াশীল শুধু যুগযুগান্ত
গান আর প্রতিবাদ।।


ফেব্রুয়ারিশিখা ।। জাহেদ আহমদ ।। প্রচ্ছদছবির শিল্পী  সত্যজিৎ রাজন ।। রচনাকাল ২০১৩ ।। গানপার প্রকাশ ২০২৩


জাহেদ আহমদ রচনারাশি

COMMENTS

error: