শহরে হেমন্ত আসে না কিংবা শহুরে কর্মজীবীর চোখে হেমন্ত ধরা দেয় না। হেমন্ত মানে আমার কাছে সকালের ভেজা দূর্বাঘাসে নগ্ন পায়ে হাঁটা, হেমন্ত মানে মিষ্টি রোদের সকাল, হেমন্ত মানে সন্ধ্যার হিম হিম হাওয়া, হেমন্ত মানে গাছিয়াদের খেজুরগাছের বাকল চেঁছে রসের হাঁড়ি বাঁধা।
‘হেমন্তের দিনে’ মূলত নানা রঙের মিশেলে সাজানো এক গল্পগ্রন্থ, হেমন্তের রূপকে পাপড়ি রহমান মানবজীবনে উদিত ঋতুসমুদয়ের সাথে তুলনা করেছেন। ভিন্ন স্বাদের মোট আটটি ছোটগল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে হেমন্তের দিনে।
Golden shower tree অর্থাৎ সোনালু/বানরলাঠি (Cassia Fistula) ছিল ছেলেবেলার এক আশ্চর্য ফুল। রৌদ্রের প্রখর আলোয় সোনালু ফুলের দিকে তাকানোর পর কিছুসময় দৃষ্টি থাকত ঝাপসা, হলুদ ফুলের আলোয় চোখের আলো নিভে যেত ক্ষণিকের জন্য। ভোরবেলায় মক্তবে আরবি পড়তে যাওয়া, কল্পনার ভূত কিংবা মুর্দার ভয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে হোঁচট খাওয়া, তুলনামূলক অস্বচ্ছল কোনো সহপাঠীর দুঃখ মনে দাগ কাটা, আম কুড়ানো কিংবা নীল-সাদা স্কুলড্রেস পরে স্কুল যাওয়া। এ-সকল স্মৃতিই আমায় নিয়ে যায় আমার মেয়েবেলায়, যে-স্মৃতি আমি ভুলে গেছি বলেই জানতাম সে-স্মৃতি এত প্রবলভাবে জেগে ওঠা যেন অজানা বিষাদের দরজা খুলে দিলো। সুখের মতো দুঃখ কিংবা দুঃখের মতো সুখ এসে বুকে বসে রইল যখন পড়ছিলাম ‘বান্দরলাঠি, ভাঙা স্লেট কিংবা সকাল নয়টার ফুল’।
দেখা হলো আতরজান বিবি নামের এক অদ্ভুত বিড়ালের সাথে, যে ঘরে আসার পর থেকে যেন ঘরে অন্যজগতের কারো অস্তিত্ব বোধ হয়। দেখা হলো আমার মতো কোনো বাবাপাগল মেয়ের সাথে, যে বাবার ভাতের অভাবে আর মমতার অভাবে শিশুকালের ন্যায় সান্নিপাতিক জ্বরে ভোগার আকুতি নিয়ে বাঁচে। তবু যদি অন্য কোনো ভুবন থেকে বাবা আসে, কলাপাতায় জ্বরমাথায় ঢালে জল, হয়তো আমাদের সব অসুখ সেরে যাবে।
শহরবানু সুখের সংসার ছেড়ে পালায় অধিক সুখের আশায়, দিনকতক বাদে আবার ফিরে আসে নিজের সংসারে। কুরবান আলী লোকের কথা ভুলে পালিয়ে ফেরত আসা শহরবানুকে নিয়ে আবার সংসার পাতে কেননা সে বিশ্বাস করে, “শরীল-গতরের নিশা হৈল কাচের বাসন। ভাইঙ্গা যায়। মনের নিশা হৈল পেতলের থালা—ময়লা-কালি পড়ে কিন্তুক না-ভাঙ্গে।”
জানা গেল শ্যামল মেঘের ছলনায় কী করে একজন মানুষের বাচ্চা ধর্ষক তৈরি হয়, উত্তর-শিথানের গাছের অভিশাপে কী করে আমিনুল তার সন্তান হারায়, রাবেয়া খাতুন কেন গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়, উত্তুরে হাওয়ার বিভ্রাটে কীভাবে বিনষ্ট হলো ফরিদা আর আক্কাস আলীর অমর প্রেম। কেন আলেকজান বিবি আমৃত্যু করে গেলেন সুলুকসন্ধান।
আমি ছোটগল্প ভালোবাসি, এমন অদ্ভুত ছোটগল্প আরও ভালোবাসি। রয়েসয়ে অনেক সময় নিয়ে পড়লাম। একটা গল্প পড়ে এত ঘোর লেগে যায় যে, সে-ঘোর কেটে যাবে বলে পরের গল্পে যেতে দেরি করি। আমি ভাবি। আমি ভাবি তাদের কথা, যারা বাস করে কল্পনায়। আমি ভাবি সে-জীবনের কথা, যে-জীবন ফেলে এসেছি অন্য জীবনে।
শিলামনি ১০ জুলাই ২০২৫
গানপারে পাপড়ি রহমান
গানপার বইরিভিয়্যু
- জীবনের ঋতুসমুদয় || শিলামনি - July 20, 2025
- কেইটের কামাই - July 12, 2025
- অন্যদিন সিনেমাটি || তুহিন কান্তি দাস - July 12, 2025
COMMENTS