‘হেমন্তের দিন’ পড়ে শেষ করেছি বেশ কতকগুলো দিন হয়ে গেল। বইটা নিয়ে কিছু লিখবার বাসনা মনে মনে ছিল। তাই এই প্রয়াস।
আমি আজন্মকাল গ্রামের সন্তান। তাই হেমন্তকে ভীষণ কাছ থেকে দেখতে পাই। আমি জানি কার্তিকে কখন নধর ধানের গায়ে দুধ ঘন হবে। আর কখন মাঠে জ্বলে উঠবে শস্যের সোনালি রং। অগ্রহায়ণে কখন ধান কেটে নবান্ন ঘরে তুলবে কৃষক। হিজলের মিষ্টি ফুল কখন ঝরে যাবে নদীর স্বচ্ছ জলে। দূর্বার গায়ের শিশির কখন গেলে পাবো। হেমন্তের এইসব রূপ আমি দেখছি বাইশ হেমন্ত ধরে। ‘হেমন্তের দিন’ বইটা সেই সম্পর্কে নয়। এটি সমাজজীবনের বহু বাস্তবতা নিয়ে।
এখানে আমাদের এই সময়ের সমাজের বিভিন্ন ঘটনাকে পাপড়ি রহমান আপন আলোয় দেখেছেন এবং তাই নিয়েই ছোটগল্পগুলোতে বলেছেন। তার পার্সপেক্টিভ, তার বলবার ঢং নিসন্দেহে বেশ আলাদা। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তার গদ্যের গতিপ্রকৃতি। পাপড়ি রহমানের গদ্য, পটে আঁকা লক্ষ্মীর মুখের মতো মিষ্টি। কেবল তার গদ্যের স্বাদের জন্যে হলেও বইটা পড়া উচিত।
‘হেমন্তের দিন’-এর গল্পগুলোর ঘটনা আমাদের যাপিত জীবনের বিভিন্ন ভাঙাগড়া থেকেই নেয়া। আমাদের সমাজের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিপন্নতা, ভণ্ডামি, আবেগকে পাপড়ি রহমান নাড়ি টিপে টিপে দেখিয়েছেন হেমন্তের দিনের গল্পগুলোতে। এক্ষেত্রে প্রথম গল্প ‘বিড়ালিনী’-র কথাই বলা যাক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় তা ‘বিড়ালিনী’ গল্পে উঠে এসেছে। নিতান্তই সাধারণ এক কাহিনি ‘বিড়ালিনী’। কিন্তু তার সারকথা বড়ই করুণ। আমাদের সমাজের নারীর করুণতম দশাকে পাপড়ি রহমান নির্লিপ্তভাবে এঁকেছেন এই গল্পে।
এরপর যে-গল্পটা একটু নাড়া দিয়েছে, তা হলো ‘বাবার ভাত’। পৃথিবীর এত সমস্ত আয়োজনের মাঝেও আমরা যে একা এবং নিঃসঙ্গ তা ‘বাবার ভাত’ গল্পে উঠে এসেছে। আমাদের কাঁধে দিন দিন ভর করছে আত্মকেন্দ্রিকতার কুৎসিত ভূত, যা আমাদের পৃথিবীটাকে দিন দিন ছোট থেকে আরো ছোট করে দিচ্ছে। আমরা হয়ে পড়ছি একা এবং নিঃসঙ্গ। তাই তো আমাদের ভালোবেসে কেউ আর জ্বর থেকে সেরে উঠার পর কালোজিরে চালের ভাত সামনে তুলে ধরে না। কলাপাতা কেটে এনে মাথায় পানি ঢালে না। এখন সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। ‘বাবার ভাত’ গল্পটা পড়ে আমার কেবল মহীনের ঘোড়াগুলির সেই গানটার কথা বারবার মনে পড়ছে—
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর ক্যাবলের হাতে
ড্রইংরুমে রাখা বোকা-বাকশোতে বন্দি
আহা-হা-হা আ-হা-হা-হা-হা
আমাদের এই অবস্থান আমাদেরকে একে অপরের থেকে কীভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছে তা পাপড়ি রহমানের পার্সপেক্টিভ থেকেই আরেকবার দেখলাম ‘বাবার ভাত’ গল্পে।
তারপর যে-গল্পটার কথা বলতে ইচ্ছে করছে সেটা হলো ‘বান্দরলাঠি, ভাঙা স্লেট কিংবা সকাল নয়টার ফুল’। এই গল্পটা যে-কাউকেই স্মৃতিকাতর করতে বাধ্য। ছোটবেলার ঢুলুঢুলু ঘুমঘুম চোখে মক্তবে বসে হুজুরের সঙ্গে আলিফ-জবর-আ, বা-জবর-বা তো আমরাও পড়েছি। এবং যাওয়ার পথে সামনে দিয়ে একটা বিড়াল দৌড়ে গেলেও ভূতের ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছি। গল্পটা পড়তে গিয়ে সেই স্মৃতি এসে ভর করল ভূতে পাওয়ার মতো।
‘শ্যামল মেঘের ছলনা’ গল্পটা প্রথমে পড়া শুরু করলে কিছু মনে হবে না। কিন্তু পড়ে শেষ করার পর পাঠকের মনস্তত্ত্বে তুমুল এক ধাক্কা দেয়, যে-ধাক্কা সামলে উঠতে খানিকক্ষণ সময় লেগে যাবে। আমাদের সমাজে অহরহ ঘটে যাওয়া ধর্ষণের বিষয়টি লেখক গল্পটায় তুলে এনেছেন। মুহু নামের একটি মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অন্তু নামে একটা ছেলে এবং পরবর্তীকালে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে। ঘটনাটায় পাঠক কার দিকে আঙুল তুলবে, সেটা নিয়ে পাঠকের মধ্যে তৈরি হবে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন।
“শরীল-গতরের নিশা হৈল কাচের বাসন। ভাইঙ্গা যায়। মনের নিশা হৈল পেতলের থালা—ময়লা-কালি পড়ে কিন্তুক না-ভাঙ্গে।” এইটে ‘কুরবান আলি ও তার মনপবনের নাও’ গল্পের কুরবান আলির সংলাপ। তার বউ শহরবানু অধিক সুখের আশায় সিকিউরিটি গার্ড কুরবান আলিকে ফেলে চেলে যায় অন্য পুরুষের হাত ধরে। কিন্তু আবার ফিরেও আসে। সাধারণত আমাদের সমাজে পুরুষরা এমন ফিরে আসাকে মেনে নেয় না। কিন্তু গতানুগতিক ভাবনার বাহিরে গিয়ে পাপড়ি রহমান দেখিয়েছেন কুরবান আলির শহরবানুকে নিয়ে ফের সংসারসাগরে ডুব দেয়া।
‘হেমন্তের দিন’ বইয়ের আরেকটা গল্প ‘সুলুকসন্ধান’। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। গল্পটার ভাব আহামরি কিছু না হলেও এর আবহ সৃষ্টিতে পাপড়ি রহমান নিজের শিল্পীসত্তার সমস্ত অনুভব ঢেলে দিয়ে এক অসাধারণ গদ্য তৈরি করেছেন।
রাবেয়া খাতুনের গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানো আর উত্তর শিথানের গাছের অভিশাপে পিতার সন্তান হারানোর অলীক কাহিনি বলেছেন পাপড়ি রহমান ‘উত্তর শিথানে গাছ’ গল্পে। আক্কাস-ফরিদার প্রেম কীভাবে মিশে গেল শূন্যতায় তার এক বয়ান দাঁড় করিয়েছেন ‘উত্তুরে হাওয়ার বিভ্রাটে যেভাবে বিনষ্ট হয় একটি অমর প্রেম’ গল্পে।
‘হেমন্তের দিন’-এর আটটি গল্পে পাপড়ি রহমান মূলত আমাদের চেনা বয়ানই তুলে ধরেছেন। বলেছেন নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখেছেন আপন আলোয়। এইখানে তার গদ্যের গতরে ‘শাওন-মাইস্যা বিলের লাহান বিস্তর ঢেউ’!
কেউ পাপড়ি রহমানের লেখা প্রথম পড়া শুরু করতে চাইলে ‘হেমন্তের দিন’ দিয়ে শুরু করতে পারেন।
জিহাদ মুনতাছির সাইম ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
গানপারে পাপড়ি রহমান
গানপার বইরিভিয়্যু
- গল্পের বর্ণ, গন্ধ, ছন্দ ও গীতি || জিহাদ মুনতাছির সাইম - August 17, 2025
- শুকিয়ে যাওয়া ফুলেরা || মাহমুদুর রহমান - July 30, 2025
- জীবনের ঋতুসমুদয় || শিলামনি - July 20, 2025
COMMENTS