খুব লম্বা নয়, সিনেমায় প্লেব্যাক আর্টিস্ট হিশেবে আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ার অত্যন্ত হ্রস্ব। বলা যায়, আশাহত হবার মতো হ্রস্ব, স্বপ্নভঙ্গের মতো ছোটখাটো, মাত্র কয়েকটা ছায়াছবিতে গেয়ে প্লেব্যাকসিঙ্গার হিশেবে ক্যারিয়ারের তামাদি ডিক্লেয়ার করেছিলেন সহসা আইয়ুব বাচ্চু। দৈনিক-পত্রিকায় এবির জবানিতে এই বিষয়ে দেশবাসীকে জানানো হয়েছিল যে আর-কোনো ম্যুভিতে প্লেব্যাক করবেন না তিনি। ঠিকঠাক বক্তব্যটা আজ আর ইয়াদ নাই, কিন্তু ওই বিবৃতির ভিতরে এবির বিরক্তি ও ক্রোধ ছিল, অন্তর্গত অভিমানও হয়তো, তখন ভেবেছিলাম এইটা সাময়িক নিশ্চয়, পেমেন্ট ইত্যাদি নিয়া ঝামেলা পাকিয়েছে ঢাকাই ডিরেক্টর কেউ, পরে মিটমাট হয়ে গেলে এবি ঠিকই ফিরবেন প্লেব্যাকে। কিন্তু না, আইয়ুব বাচ্চু বোধহয় আর প্লেব্যাকে ফেরেন নাই। ফিরবার রাস্তাও আর রইল না। আইয়ুব বাচ্চু অগস্ত্য যাত্রায় পাড়ি দিলেন সহস্র সুরের পদ্মসরোবর পশ্চাতে রেখে। সেই সুরপদ্মসরোবরের অল্প কয়েকটা আইয়ুব বাচ্চু দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের ধুমধাড়াক্কা ছায়াছবির এঁদো ডোবায়।
ব্যান্ডসংগীত জিনিশটা আলাদাভাবে আমার কখনো শোনা হয় নাই। কিছুটা আশ্চর্য শোনালেও কথাটা আমি স্বীকার করছি যে আমার বয়সী মানুষজন, বিশেষত শহরে বেড়ে-ওঠা যারা আমার মতো, সবাই ব্যান্ডগান শুনত অন্যতর উন্মাদনা আর আবেগ নিয়ে। এই দৃশ্যপটে বেড়ে উঠলেও রকমিউজিক বা পপমিউজিক বা ব্যান্ডমিউজিক নিয়া আমার আলাদা পাগলামি ছিল না কখনো। শহরের এই বিশেষ ধারার গানের প্রতি প্রীতি আমি বোধ কখনো করি নাই। বিরাগও বোধ করি নাই। সিনেমার পোকা আমি, হিন্দি আর বাংলা সিনেমার, ঠিক এই সূত্রে প্লেব্যাক সিঙ্গিং ও সিঙ্গার-স্যংরাইটার-কম্পোজারদের খোঁজখবর রাখি। সিনেমার গানের লিরিক ও সুর শোনামাত্র মুখস্থ হয়ে যেত উঠতি বয়সে, এখন অতটা না-হলেও সংগীতবাদ্য বলতে ফিল্মিগানাই মূলত শুনিয়া থাকি ইউটিউবে বা আইপডে।
একেবারেই শুনি নাই ব্যান্ডের গান, তা না। ব্যান্ডের গানবাজনা না শুনে এইদেশে ভোরে গাত্রোত্থান বা রাত্তিরে বিছানায় শয়ান সম্ভবই ছিল না যেই সময়টায়, সেই নব্বই-মাঝামাঝি থেকে এই দুইহাজার-মাঝামাঝি দশক পর্যন্ত, আমার ইশকুল-কলেজের বয়স কেটেছে এই সময়েই। কাজেই ব্যান্ডের গানবাজনার আওয়াজ না শুনে উপায় ছিল না। কানে যেত, শুনতাম, মনেও ধরত অনেক গানের সুর, রয়ে যেত সুরান্তের রেশ। ‘সোলস’, ‘মাইলস’, ‘চাইম’, ‘ডিফ্রেন্ট টাচ’, ‘প্রমিথিউস’, ‘আর্ক’ প্রভৃতি বিচিত্র সব ব্যান্ডের কিছু কিছু গান আছে আমার চিরপছন্দের তালিকায়। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ড ‘এলআরবি’ যেভাবে গান পরিবেশন করত, ব্যান্ডে এবি যেভাবে গাইতেন, ওই ধরনটা আমি ঠিক নিতে পারতাম না। হার্ডরক ঘরানায় গাওয়া বোধহয় এইটাকে বলে, জেনেছি ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে, এইটা আমার জিনিশ মনে হতো না, আজও মনে হয় না। তারপরও কয়েকটা গান তো সুন্দর লেগেছে, ‘সেই তুমি’ ইত্যাদি। কিংবা ‘একচালা টিনের ঘর’, ‘তিন পুরুষ’, ‘বারোমাস’ ইত্যাদি গান মাঝেমাঝেই গুনগুনাই আমি। কিন্তু ওভারঅল ব্যান্ডসংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু আমার পেয়ালায় তেমন উত্তেজক পানীয় মনে হয় নাই কস্মিনকালেও।
তবে আইয়ুব বাচ্চুকে পেয়েছি আপন করে একদম আমারই আত্মাশিল্পী হিশেবে অনেক পরে, যেদিন থেকে এবি সিনেমায় প্লেব্যাক শুরু করেছেন। খুব বেশি নয় সংখ্যায় বা পরিমাণে, এবং সংখ্যা আমার কাছে জরুরি নয় কখনো, কোয়ালিটির দিক থেকে সেই প্লেব্যাক আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে রইবে। একশত বা আধশত নয়, বারো-তেরোটা গানই তিনি গেয়েছেন সর্বসাকুল্যে। সেইসব গানের কোনোটা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বা আর-কারো কম্পোজিশনে, কোনোটা-বা নিজের। সব মিলিয়ে গোটা-আট/দশেক সিনেমায় সেই গানগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। এবং ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল প্রত্যেকটা গানই। বিস্তর কাটপিসের অশ্লীলতায় আবিল ঢাকাই সিনেমাপাড়ায় আইয়ুব বাচ্চুর প্লেব্যাকের ম্যাজিকে সেই সিনেমাগুলো বক্সঅফিস মাতিয়েছে। একেকটা হাউজফ্যুল শো উপহার পেয়েছে সেই সিনেমাহ্যলগুলো শুধু এবিপ্লেব্যাকের ক্যারিশমায়।
এইখানে কয়েকটা গানের লিরিক থেকে দুই-আড়াই লাইনের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে একটু কথাবার্তা চালানো যায় কি না ট্রাই করি আমরা। নায়ক মান্না প্রযোজিত ‘লুটতরাজ’ সিনেমায় সেই গানটার আবেশ তো ভুলবার নয়, যেই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু ও কনকচাঁপা, দৃশ্যের সঙ্গে লিপ্সিং ছিল মৌসুমী ও মান্নার; গানটা হলো : “অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে / প্রেমপিপাসায় ভরা এ মন / তোমার ভালোবাসা শুধু ভালোবাসার প্রয়োজন।” অথবা আরেকটা সিনেমার গান স্মরণ করি, ‘তেজি’ সেই সিনেমার নাম, গানটা হচ্ছে : “এই জগৎসংসারে তুমি এমনই একজন / তোমায় পরান ভরে এই অন্তরে রাখব আজীবন।” স্যুপারড্যুপার হিট ‘আম্মাজান’ সিনেমায় দুইটা গানের কথা বলা যায়, এক হচ্ছে “তোমার-আমার প্রেম এক-জনমের নয় / হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়।” কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান’ ছবির এই গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু এবং সহশিল্পী ছিলেন কনকচাঁপা। একই ছবির আরেকটি গান, যেইটা ছায়াছবির নামগান, “আম্মাজান আম্মাজন চোখের মণি আম্মাজান / আপনার দুগ্ধ করসি পান …” ইত্যাদি পঙক্তির অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় গানটা বাংলাদেশের আনাচেকানাচে উন্মাতাল হাওয়া এনে দিয়েছিল। মান্না ও মৌসুমী অভিনীত এই ছবির আরও কয়েকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। সম্ভবত এই সিনেমাতেই “স্বামী আর ইসতিরি / বানাইসে কোন মিসতিরি / এ বড় আজব কারিগর মওলা / এ বড় আজব কারিগর” ইত্যাদি গীতিপঙক্তির গানটাও রয়েছে। যেমন ‘কারিশমা’ ছায়াচিত্রে আছে এই গানটা : “ভালোবেসে কষ্ট বেড়ে গেল আরও / আরও দাও কষ্ট যত দিতে পারো / তুমি ছাড়া কারোতেই আর সুখ চাই না / তুমি ছাড়া কিছুতেই সুখ পাই না।” আর এই গানটির সঙ্গে সিনেমায় ঠোঁট মিলাইতে দেখা যায় রিয়াজ-শাবনূর জুটিকে। আরেকটা গানের কথা বলতে পারি, কিন্তু সিনেমাটার নাম মনে নাই, গানটা : “আমি হলাম প্রেমের বাউল / বাউলিনী তুই / আমার একতারাটা বেজে ওঠে / যখন তোকে ছুঁই।” ঠিক একই সাফল্যের পারদ ছুঁয়ে এবির প্লেব্যাক ক্যারিয়ার আগাইতে থাকে। হেলাল খান প্রযোজিত ও অভিনীত ‘সাগরিকা’ সিনেমার নামপঙক্তির গানটাও শ্রোতামাতানো বাণিজ্য করে। এই সিনেমায় “আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে” শীর্ষক গানে গ্রামবাংলার উঠতি তারুণ্য মোহিত হয় সেইসময়। ‘লাল বাদশা’ ছায়াছবির “আরো আগে কেন তুমি এলে না” গানের স্মৃতিও অবিস্মরণীয়। ‘মেয়েরা মাস্তান’ চলচ্চিত্রে একটা গান “ঘড়ির কাঁটা থেমে থাক” আইয়ুব বাচ্চুর ছোঁয়ায় আকাশে উড়েছিল। ‘চোরাবালি’ সিনেমায় যেমন “ভুলে গেছি জুতোটার ফিতেটাও বাঁধতে” গানটার কথা কি ভুলে যাব? অথবা ‘ব্যাচেলর’ সিনেমার সেই বিস্মরণ-অসাধ্য কম্পোজিশন “আমি তো প্রেমে পড়িনি / প্রেম আমার উপরে পড়েছে” কেউ ভুলে যেতে পারে, যে কিনা একবার শুনেছে এই আশ্চর্য রচনা?
আইয়ুব বাচ্চু ঘরানাই তৈয়ার করতে চলেছিলেন বাংলাদেশের ফিল্মিগানায়। পৃথক মর্তবার ঢাকাই ফিল্মিগানের ঘরানা। মাঝপথে থামিয়ে দিলেন ঘোষণা দিয়ে, কেন বলতে পারব না, আন্দাজ করতে পারব যদিও সকলেই। ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বাংলাদেশে যে-পরিবেশ হাজির রেখেছে, এই পরিবেশে এবির মতো সংগীতরচয়িতা শ্বাস নিতে পারবেন কেমন করে? এরপরও উনার চেষ্টা আপ্রাণ বজায় ছিল মানিয়ে নিতে। ফাইন্যালি পারেন নাই বলেই সরে দাঁড়িয়েছেন অ্যানাউন্স দিয়ে। এই জিনিশটা মাথায় রাখা চাই যে, আমরা যদি হিন্দি সিনেমার বিগক্যাপিট্যাল কমার্শিয়্যাল ভেঞ্চারগুলোর প্রতিবেশে নিজেদের বাংলা ছায়াছবি নিয়া ঘরকন্না করতে চাই তাইলে এর মিউজিকের দিকে সবার আগে নজর দিতে হবে। বেঙ্গলি ফিল্মিগানায় এমনকি কলকাতা রাজ্যের যে-মনোযোগ আর যে-বিনিয়োগ, আমরা কি তা খেয়াল করছি? নিশ্চয় খেয়াল করব, যদি সিনেমার ব্যবসা চাই বাংলাদেশে।
যে-সমস্ত ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন আইয়ুব বাচ্চু, সব-কয়টার নাম আমি বলতে পারব না, তারপরও উল্লেখযোগ্য কয়েকটা : ‘আম্মাজান’, ‘লাল বাদশা’, ‘গুন্ডা নাম্বার ওয়ান’, ‘ব্যাচেলর’, ‘চোরাবালি’, ‘টেলিভিশন’, ‘সাগরিকা’ ইত্যাদি ইয়াদ আছে। এবং খুব সম্ভবত গত শতকের সাতানব্বই/আটানব্বই খ্রিস্টাব্দের দিকে এবি সিনেমায় প্লেব্যাকে ডেব্যু করেন ‘লুটতরাজ’ ম্যুভির মাধ্যমে। এবং সম্ভবত ২০১২ অব্দের দিকে এবি ‘চোরাবালি’ সিনেমায় শেষ প্লেব্যাক করেন। এই ইতিহাস যদি কেউ সন-তারিখ দিনক্ষণ মিলিয়ে দেখতে চান তাইলে একটু গ্যুগল করে বা আর্কাইভ সোর্স ব্যবহার করে একটা ট্রাই নিশ্চয় করবেন। এইখানে যেটুকু কথা বলা হয়েছে এর উপর ডিপেন্ড করা ন্যায্য হবে না। কারণ এই নিবন্ধ মোটেও নৈর্ব্যক্তিক কিছু নয়।
প্লেব্যাকে এবি নিজের ঘরানা তৈয়ার করার যে-উদ্যম দেখিয়েছিলেন, এবং সেই উদ্যম ও উদ্যোগের অব্যর্থ সফলতাও উনি নিজে দেখিয়ে গেছেন, শুধু আশা করব আমরা যে এই নিশানার পরম্পরা চালিয়ে যেতে নয়া দিনের মেধাবী মিউজিশিয়্যানরা আগায়া আসবেন। বাংলাদেশের সিনেমায় কাহিনিদারিদ্র্য, চরিত্রদারিদ্র্য, প্রযুক্তিদারিদ্র্য, পয়সাদারিদ্র্য, দর্শকদারিদ্র্য, সুযোগসুবিধাদারিদ্র্য ইত্যাদি বিস্তর দারিদ্র্যের আগে এর সংগীতদারিদ্র্য নিয়া আজকের শ্রোতা আর আগামীদিনের সংগীতদ্রষ্টা ভাবিত হবেন এইটুকু দাবি জানিয়ে রাখা আশা করি বেশিকিছু চাইবার অন্যায় আব্দার বলে মনে হবে না কারো কাছে।
… …
- ঢাকাই ফিল্মে প্লেব্যাক ও আইয়ুব বাচ্চু ঘরানা || আলমগীর কবির - November 11, 2018
COMMENTS