মেটামরফসিস
তুমি যে ছবির মতো কোনো-এক শূন্য দেয়ালে
দাঁড়িয়ে দেখছো নীল, রেলগাড়ি, সেলাইমেশিন
আমি সেই চোখ দেখে, দেখা দেখে কিছুই দেখছি না
সময়গ্রন্থিতে গান, আমি কেন বধির আশ্চর্য!
দৃশ্য ভেতর থেকে চোখ রাখে বাহিরের চোখে
পরিচিত লাগে মুখ, কিন্তু আরো কোনো রহস্যপ্রবণ
রাজার নির্দেশ মেনে, কীটের ভেতর থেকে বের হও
গ্রেগর স্যামসা? আমাকে চিনেছো তুমি, আর ওই
জীবনঘনিষ্ঠ মেয়েটিরে? বুকের ভূভাগ যার নদীনাম
ফসলে ফসলে মিশে দিয়ে গেছে হলুদ আকাশ।
.
সুইসাইডনোট
সাক্ষি হিজলফুল, সন্ধ্যা-সমুদ্রতীর, ইকারুস তোমার আকাশ
আত্মহত্যার আগে যেন কার করুণ আঙুল
একটি সকালরেখা এঁকেছিল নম্রবালুতীরে
শতাব্দীপ্রহার শেষে অকস্মাৎ আমার হৃদয়
সূর্য-হতে-নেমে-আসা সোনার মাছির কথা ভাবে,
শুনতে পায়, ক্ষীণস্বরে, অশ্রুগাথা সকালসংগীত
দূরাগত কাল ভেঙে স্মৃতির হীরক এসে বলে :
তবে কি তুমিই সেই অসমাপ্ত গানের অপেক্ষা —
তরঙ্গবিভোর জলে ছড়িয়েছো, ঝিনুকে ঝিনুকে
রেখেছো বিষের পলি, যন্ত্রণায় আর্ত ভায়োলিন
নম্র বালুতীরে আঁকা অসম্ভব প্রভাতপ্রস্তুতি…
উন্মাদ সমুদ্রবক্ষে দুলে ওঠে চাঁদ
মৃত নক্ষত্রের পাশে কেঁদে ওঠে বেদনার ভ্রুণ।
.
ভূমধ্যসাগর হয়ে জেগে ওঠো, নয়নের তারা
ও-ভাবে ডাকতে নেই, স্বপ্ন ভাঙে, বদহজম হয় —
বলে সে আলতো করে ঘুরালো কম্পাস।
সমুদ্রসঙ্গমে এসে, সফোক্লেস, বহুদিন পর
পর্বতশিখরে বসে সূর্যাস্ত দেখার কথা ভাবি,—
প্রভাতপ্রান্তের চাকা চক্রাবর্তে কালো হয়ে এলে
সমাধিপ্রস্তরে গিয়ে ভুলে যাই আত্মজের নাম
প্রতিটি কবরে যেন আমি একা, ধুলোমাটিজলে
বিছিয়ে গানের পাতা, ধরে রাখি পদাঘাতগুলি,
ছিন্নপল্লবে প্রেম, আন্তিগোনে — বুকের বাঁ-পাশ
কথা বলো, কথা বলো, মুহূর্তবিচূর্ণ পথরেখা
যে-মুখ আড়াল করে চক্রবর্তী রাজার পর্বত
ভূমধ্যসাগর হয়ে জেগে ওঠো, নয়নের তারা!
.
উন্নতি
কাঠধর্মে নির্বাসিত, পেয়ে গেছি শিমুলের তুলা
অদূরে, ইস্পাতশব্দে জয় নিয়ো, বুঝে নিয়ো তোমার উন্নতি।
নিরাশাকরোজ্জ্বল দেশ, তরুকল্প, জাগ্রত ছায়া —
নদীসংগীতে তুমি স্নান শেষে, প্রভাতপ্রান্তে চলে যাও
আমি কারো বিক্ষত শরীর থেকে স্মৃতি তুলে দেখি
সমাধিভূমির পাশে জেগে আছে একটি ডালিম,
তার পাশে, তোমার পায়ের দাগ, সকরুণ ঘাসে
শিশির ঝরিয়ে গেছে সূর্যালোক, অবিশ্বাস্য দিন
রাত্রিগুলি —
অদূরে, ইস্পাতশব্দে জয় নিও, বুঝে নিয়ো তোমার উন্নতি।
.
ওগো দুখজাগানিয়া
কয়েক শতাব্দী গেল সংকেতে, কত নদী, শহর সন্তান
তুমি এলে না
একেকটি আকাশ থেকে একেকটি সূর্য গলে গলে
ঠাণ্ডা সমুদ্রজলে নামতে নামতে নামতে
ভোর এল
অশ্বারোহী ঘাতকেরা কেটে নিলো হাত, চোখ থেকে
খুলে নিলো আমার শরীর;
রক্তে মিশে গেল সন্ধ্যা —
ঠাণ্ডা
হিম
কালোবরফের স্তূপে ঢেকে গেল আমার স্মৃতি —
দুখজাগানিয়া গান
.
হিস্ট্রি অব এনলাইটেনমেন্ট
হেমন্তহলুদ পাতা ঝরে যায় পথে
ফিরে যায় বেদেনির দল
আগুন উৎসবে এরা গেয়েছিল
ধাতব মুদ্রায় ঢেকে সলজ্জ শরীর,
ফেলে গেছে সোনামাঠ, খড়-সম্মান
অনুচ্ছলে একদিন, কোনো-একদিন…
ঘুঙুরসকাল, রোদ এসেছিল ইতিহাসরেলে
ঘড়ির সময় থেকে সেইসব সোনালি ঈগল
আলোকের অভিসারে নিয়ে গেছে মানুষের জ্ঞান
.
নিয়োলিথ পাতাঝরা
ঘুমিয়ে পড়েছি আমি ভূগোলের গোলকধাঁধায়
শিয়রে, স্বপ্নের পাশে মোম জ্বেলে বীজ বলে ডেকো
দেখব তোমার মুখ — জলেভাসা শাদা রাজহাঁস
রক্তের মতো সেই লাল ঠোঁট, ফুটেছে গোলাপ
একটি পুষ্পকাল, মধুবন — কার প্রতিশ্রুতি
উত্তরবসন্তে আজ শহরে শহরে উড়ে যায়
বেদুঈনপথে নেমে চেয়ে দেখি — পিরামিড চোখে
আমি কারও ফেলে-যাওয়া হাসির উড়াল
লৌহপ্রস্তর রাতে বেদনা কি স্মৃতি থেকে জন্ম হয়েছিল
নিয়োলিথ পাতাঝরা ডালে
তারপর ঝরে গেছি, ঝরে ঝরে ভূগোলের গোলে
.
ঈগল
বাতাসেরা যে-রকম পেয়ে থাকে বকুলের প্রকৃত ঘ্রাণ
তুমিও কি পাও, জানো নিশিব্যাপ্ত হয়ে জাগে গন্ধে কার
আরক্ত বেদনা, গানে কার তীব্রতর প্রেম নিশিদিন
সে কি হাসে, প্রবাহবাতাসে কাঁদে
অথবা সে হাসে না, কাঁদেও না; মর্মস্থলে
জীবনের কোনো-এক গভীর স্মৃতির
সুউচ্চ মিনার জেগে রয়, অনঙ্গ প্রেমের ধ্বনি তুলে
জীবন জাগিয়ে রাখে এইভাবে, পৃথিবীর সাথে।
কোনো কোনো পাখিদের গানে পথরেখা ভুল করে ফেলি
হাতগুলো উড়ালের জড়োসড়ো ডানা হয়ে আসে,
সীমানাপ্রাচীরগুলি ছোট হতে হতে
আকাশের মতো এক বিশাল সাগরে মিশে যায়,
পেরিয়ে পর্বতশৃঙ্গ ঈগলের দূরগামী চোখে
মায়ের মুখের মতো সূর্যের দিকে যেতে যেতে
গ্রিসা ও যিশুর মুখ বড় বেশি মনে পড়ে যায়।
.
রক্তানুরাগ
তোমাদের নিবিষ্টতা বটের ছায়ার মতো বড় হয়ে গেল
শিশুদের মতো দৌঁড়ে গিয়ে ছায়ার পেছনে
লুকোতে চেয়েছি মুখ, পিপীলিকা — তৃণের জীবনে
যে-গান বসন্ত আনে — খুলে ফেলে সব অবয়ব
সমস্ত বৃক্ষ থেকে, নদী থেকে, বনভূমি থেকে
কুয়াশার সাথে এসে কুয়াশার সাথে চলে যায়
শান্ত করে দিয়ে যায় পাথরের জলকাতরতা,
অন্তিম দূরে হাসে, আমার কি চাই আমি জানি
বীজাণুর সঙ্গে আমি যুদ্ধহীন আরূঢ় জীবন চেয়েছি
ফুলকে বলেছি ফুল, প্রজাপতি তোমার সুন্দর
নদী ও নুড়ির মতো, শিশুদের কাছাকাছি রেখেছি স্মৃতিকে
যেন তারা পাখিদের মতো সংগীতে আর্দ্র রেখে ডানা
বসন্তপ্রস্তাব নিয়ে শহরে শহরে ঢুকে পড়ে
চেয়েছি ধুলোপথে, ডালমগ্ন তৃণের জীবন।
.
একদিন মহুয়ার বন
দিগন্তের অন্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কিন্তু কোনো অন্তিম
ধারণা নেই আমার। হাওয়া ঘুরে যায়। করপুটে
ধরেছি সমুদ্র,— তুমি পান করো গাঢ় পিপাসা
আমার পিপাসা নেই, ক্ষুধা নেই, শুধু এক সুতীক্ষ্ম বেদনা
বসে থাকে হৃদয়ের পাশে — বোবা ও উন্মাদ কোনো
মানুষের মতো। চোখ লাল, দুইহাতে লোহার খঞ্জনি
রাজাকে মানে না সে। কিন্তু রাধা তুমি কার ভয়ে
উন্মাদনৃত্যের থেকে, শব্দ থেকে, রক্তকে নিরাপদ রাখো
পা থেকে নূপুর খোলে একসঙ্গে ফেলে যাও হৃদয়নিক্কন?
এই পথ প্রেমিকের। সর্বাঙ্গ ভস্মের পর অবয়ব পায়
যে-কোনো পাখির মতো ডানা পায় — কণ্ঠে পায় গান
গান পায় গানের স্মৃতিকে;— ‘একদিন মহুয়ার বন…’
তারাদের মতো ঝরে পাপড়ি। চলন্ত হাওয়ায়
ভাঁজ খোলে বেরোয় সমুদ্র — সঙ্গিনীর ঘ্রাণ শুঁকে মাছ
তোমার উজ্জ্বল মুখ বিজলীর মতো ভেসেছিল,—
জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু কেউ খোঁজে দিতে সক্ষম হলো না।
- ঈগল, বেদুঈন ও বসন্তের উদ্গান || আলফ্রেড আমিন - May 1, 2025
- ক্রমশ প্রকাশমান মেঘদলের তৃতীয় অ্যালবাম অ্যালুমিনিয়ামের ডানা || এমজি কিবরিয়া - April 28, 2025
- মধ্যনগরে বঙ্গাব্দবরণ ১৪৩২ || বিমান তালুকদার - April 18, 2025
COMMENTS