বাওনপুরের এলিজি ও অন্যান্য || বেলাল আহমেদ

বাওনপুরের এলিজি ও অন্যান্য || বেলাল আহমেদ

শেয়ার করুন:

বাওনপুরের এলিজি

পাণ্ডুর চাঁদের আলো
সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো,
বুনোহাঁসের মতো জেগে ওঠে—

আমার প্রেমিকা ছিল, শান্তসবুজ

গ্রামটা নেই, বেপরোয়া ট্রাকের ভেতর
নদী আর আমি
পাথরের কবরের দিকে যাই।

মৃত্যু এক শান্ত সময়ের গান;
যেদিন জেনেছি,
সেই থেকে আমি
প্রেমিকার খোঁজ নিতে যাইনি আর

ও মৃত্যু তুমি কী?
কীভাবে তীব্র ফলার মতো
ঢুকে গেলে বুকে?
আমি কে?
স্বরহীন, প্রাচীন মৃত্যু দেখে
কী করে জানবে?
আমি পাথরের কবরের
দিকে হেঁটে যাই।

 

 

আব্বার শবযাত্রা থেকে ফিরে

দেওকলস মন্থর এখন, তুমি যাও না বলে
নদী, বৃক্ষ, চাঁদ, ত্রস্ত খাড়িমুখে আচ্ছন্ন সূর্য—
পরস্পর সংক্রমিত। ক্ষোভে, ভয়ে পুনরাভিনয়
তুমি যাও না বলে, জয়শঙ্খের মর্মছিঁড়া ডাক শুনি না

ফ্যাকাশে অবয়ব, নিশুতি গোপন এবং সোঁদাগন্ধ
বালিভূমি, শাখামূল; বাতাসে ভাসমান, ঘোরগ্রস্ত—
সন্দিগ্ধ সন্ধ্যাসংগীত, এখনও বিমূঢ়ভাবে উপেক্ষারত
তুমি যাও না বলে, গাছের জীবন নিয়ে চলে তারা

আব্বা আমি ভ্রান্তিমগ্ন; হৃদয়চ্যুত, অকৃতকার্য শব
বাজাও বিকল ভায়োলিন, বুকভরা দীর্ঘশ্বাস তোমার

 

 

অন্তঃস্থ পৃথিবীর জার্নাল

লাল ঘোড়ার ক্ষুরের গরিমা মাখা মুখ
এই মুখ, কার মুখ? অধো-নিমীলিত
ডাকে, রক্তিম ত্বক—বীজবান লাল নখর
ধরে রাখে আগুনের স্তম্ভ।

এই মুখ, কার মুখ? প্রশ্ন কোরো না
বহুবর্ণ, ঝলমলে হাওয়ার তীক্ষ্ণ ঘ্রাণ
প্রহরবৃক্ষের নিচে সুরমার তীব্র স্রোতের মতো
নিস্পন্দ জ্যামিতি
প্রশ্ন কোরো না, সে অলীক দূরবীন

এই মুখ পতাকা, সত্যের প্রস্রবণ
জলজ বন্ধ্যাশক্তি, ইঙ্গিতের সারি
বৃক্ষ, পাহাড়, মেঘ, রঙের প্যালেট
এই মুখ অন্তঃস্থ পৃথিবীর জার্নাল
সুগন্ধির মতো
ভাসে

 

 

বেঁচে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই

ঘোরে, রক্তরাগে প্রফুল্ল দুপুর ডেকে উঠেছিল
এখন অধিক রাত, নির্ভেদ গণিত-গুণফল

দরজায় কে? নকশি ত্বক, ত্রিভঙ্গ সরণি
আমার তো শরীর পাতা, মড়কে ও নরকে

নদীভাব নিয়ে ব্যাবিলনের বাগান, পিরামিড আতঙ্কিত
ভেতরে বিহার, বেঁচে আছি

বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই!

 

 

সময়ান্ধ এস্রাজ

অস্থি-সমুদ্রের গভীরে
ফুলে ওঠে গোপন কৌটা
ভোর ঝরছে বাইরে
বৃষ্টির মতন—

শৈশবের ফণার মতো
অস্থিরতা, রক্তে-অভিজ্ঞানে

বৃষ্টিভাষার কন্যা জয়শঙ্খ বাজায়
বাজে এস্রাজের সুর—মুগ্ধবোধ
প্রাচীন পুঁথির ছন্দ, হিরন্ময় জিকির

শীত নেমে আসে, খুলে গেলে ছিপি

(এখন আমার)
ডান চোখ থেকে রক্ত ঝরছে
বাম চোখ থেকে জবাফুল

 

 

অশ্বের রক্তজিহ্বা

কল্পনাকুম্ভের সঙ্গে, অতিপরিচিত সেই সাপটির সঙ্গে
নীল শিরার সঙ্গে—নদীতে নয়, পরাভূত অবিমৃষ্য—
ধাবনক্ষেত্রে নেমে আসে হিমপক্ষ, কুয়াশাকুটুম
তুঙ্গ মুহূর্তে নাচে ইস্পাত পিঠ

জ্বলেছে চেরাগ, প্রাচীন রক্তরাগের সুর, প্রহররেখা
মোরগফুল, গাছের কান্ড, গুল্ম ও এলাচের—
বাগানে অন্ধকার, আঁকাবাঁকা হরফ, দেখো—ও অশ্ব
বিকল আড়াল ডাকছে, মৃত মানুষের অশ্রুবিন্দুর মতন

তোমার হাওয়াভ্রমণ থামাও, ঝাঁপ দাও,
‘বাতাসে কিসের হাহাকার’, চুম্বন, পালার দূরাগত ধ্বনি
কুম্ভকে প্রগাঢ়ভাবে দেখো, তার ময়ূরসৌন্দর্য, লৌহফলক

ও অশ্ব, বিস্ময় কোলাহল থামাও, রক্তজিহ্বাও
নদী ও নোনাজলে, সহসা বাতাসে—কিনারে
বমখুমিদের পাড়ার দিকে মহাপ্রস্থান তার

রাত বাড়ে, পরাভূত উরুতে, ইস্পাতের পিঠে
শোনো, বিপুল রহস্যজল নিয়ে
মৃত মানুষেরা ডেকে ডেকে যায়

 

 

মৃত্যুগাছ

আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল মৃত্যুগাছ—
হাড়-কোলাহল ও অন্যান্য হাতছানি নিয়ে

ক্ষমতা মানেই তো লু-হাওয়া—
হতবাক নদী

অন্ধ তস্কর জানে,
নদীরা বাকল খুলে দিলে
বান আসে—
মৃত্যু ও মাছ এবং নিরুপায় পাখি

তুমি তো চন্দ্রপুরি, ডাকবাকশো।
ও সমুদ্রের মা—
চলো, একসঙ্গে ভালোবাসি
মৃত্যুগাছ অথবা নদীকে।

 

 

ব্লাইন্ড ম্যাজিক

নিমগাছের ডাল ধরে ঝুলে থাকে মিথ্যা,
ডুবে যায় সূর্য এবং একটি প্রজাপতি

বুক থেকে কালো ডানাটি উড়ে গেলে
এই পৃথিবীতে শরৎ নামাই

দৃশ্যের ভেতরে ক্ষুধা, এক অমিয় সুধা
নিসঃঙ্গ, নিরাবরণ এবং মৃত্যুর মতো

এই পাখিশহরে আনন্দের গলায়—
তাই ফাঁস পরিয়েছি বারবার

 

 

আম্মা

এই যে বেলা গেল, নদী ও গতরের অ-ভাব
আম্মা বলেছিলেন, সে বেলায়-ই, অথচ—
আম্মা কেবল রক্তাক্ত সময়ের ঘড়িই ছিলেন

জাতিস্মরের অগ্নিভ বন্ধনী এঁকে এঁকেই—
কণ্ঠ ও স্বরহারা হয়েছেন, নিভৃতে উদ্দেশ্যহারা
তবু আম্মাই স্থৈর্য আর মেধানদীতে ভাসিয়েছেন

আম্মা আম্মা বলে যত গান, শব্দরা ছিল, তারা সবাই—
বলে গেছে, আম্মা ব্যথাকারখানা, আম্মা বিষাদের টোটেম

 

 

এ গল্প শীতের নয়, তবু শীত আছে

প্রতিটি কবরের পাশেই থাকে
একেকটি ফসলের মাঠ

এখানে মুগ্ধতা নেই,
একটি ফড়িঙের মুগ্ধছুরিকাঘাতে
জড়িয়ে থাকে—তার
গাঢ় বর্ণ বাহু থেকে সুউষ্ণ ঘ্রাণ;

সংক্রামক বটে! দেহভাগ হয়ে গেলে মাংসল নাভিতে
বাজে ঋতুবদলের গান;
তোমাতে মিনতি রাখি, ও রাধা—
ঘাসফড়িঙের সাজে
এই দেহ ভাগ করো
ঋতুতে ঋতুতে


গানপার কবিতার, কবিতার গানপার

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you