মঈনুস সুলতান, মোস্তাক আহমাদ দীন ও মাণিক্য চামার : প্রসঙ্গ দেশভাগ, দেশস্বাধীন, দেশান্তর ও দেশান্তরীণ || সত্যজিৎ সিংহ

মঈনুস সুলতান, মোস্তাক আহমাদ দীন ও মাণিক্য চামার : প্রসঙ্গ দেশভাগ, দেশস্বাধীন, দেশান্তর ও দেশান্তরীণ || সত্যজিৎ সিংহ

আপনার ক্যামেরায় তোলা গাছে-ঝোলানো
.                                         কাঠের মুখোশটি দেখে
আমার মাণিক চামারের মুখের কথা মনে পড়ল
সেই একই দাড়ি, লোকে বলত মাণিক্যা চামার,
যে পাশ দিয়ে গেলে পায়ের চামড়ার স্যান্ডেলের দিকে

তাকিয়ে বলত; ‘সিলাই লাগবনি বা মলবির পুত?’

আমি মনে মনে শ্যানানডোয়ায় ওই মুখোশটির

.                                                     কাছে চলে গেলাম
অবিকল মাণিক্যা চামার, আমার ভয় হয়,
মাণিক্যা কাকা সত্যি সত্যি যদি তাকায় তো নির্ঘাতই বলবে :

‘এ তো বেটা রাবারের বুট, আমি ইতা সিলাই করি না’

গত ১৩ মে মধ্যরাতে আমাদের গ্রামে
আমি আর শেখ লুৎফর, যার গল্পে আপনারই মতো
খাঁটি মৈমনসিংগের শব্দের সঙ্গে পেহলভি শব্দ একাকার
মাণিক্যা চামারের বাড়ি খুঁজতে গিয়েছিলাম
দেখি ৪৭টি ঘাসের ওপর থেকে ৭১টি জোঁক
আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে
আমরা এক দৌড়ে মতিলাল ডাক্তারের বাড়ি পার হয়ে
সোনাওর ডাক্তারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম
আমাদের গন্তব্য আর দূরে নয়
আলজান্নাত এডুকেশন ইন্সটিটিউট
যেখানে মুহম্মদ ইমদাদ সেই রাত ১২টার পর থেকে
তার রাগী মুক্ত কবিতা শোনানোর জন্য অপেক্ষা করছে
[মোস্তাক আহমাদ দীন  / মঈনুস সুলতানকে লেখা চিঠি]

১।
সাম্প্রতিক সময়ের এইটি আলোচিত কবিতাগুলোর একটি। আমি নিতান্ত নাদান হয়ে এমন রাজনৈতিক কবিতার যে কিছু আলোচনা করতে যাচ্ছি, বিষয়টা হয়তো এ-রকম না। এ কবিতা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, হচ্ছে এখনো — আমি মনে করি বাংলা কবিতার জন্য এইটা উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির একটা। শুধু বাংলাদেশ নয়, ওপার বাংলাতেও এর আঁচ যে পড়েছে বা পড়বে — এ অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে-লেখাটা অস্বস্তিতে রাখে, ভিতরে ভিতরে কুটকুট করে কামড়ে বেড়ায়, বিরামহীন শরীরে বিশ্রামে খোয়াবে — স্পর্শকাতর কাগজের দেয়ালে নুড়িপাথরের টোকা মারার মতো মারতে থাকে, সে-লেখা থেকে বেরোবার একমাত্র পথ কি আছে আমার জানা নাই। দস্তয়েভস্কির উপন্যাস শেষ করার পর যে-মানুষটা ঘোরের মধ্যে জগতসংসার থেকে বিলুপ্ত হয়ে থাকে দিনের পর দিন, তাকে আপনি কী দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন! আছে কিছু ব্যাখ্যা করার! কবিতা উপন্যাসের মতন নয়। এইটা যে দিনের পর দিন ঘোরের মধ্যে ফেলে রাখবে, তা-ও সম্ভব হয় না তার স্বাভাবিক প্রকৃতির জন্য, যে সামান্য সময় সে অতিবাহিত করে যাবে — ঐ সময়টকুতে সে আপনাকে ভেঙেচুরে, ধ্বস্ত করে, তছনছ করে চলে যাবে।

২।
এ-কবিতার সবচাইতে যেইটা চোখে পড়ে সেইটা হলো, ৪৭ আর ৭১। এই দুই সনের ইতিহাস ভারতবর্ষে কমবেশি সবার জানা। আপনি যখন পড়ে যাবেন তখনই ভাববেন, দেশভাগের বেদনা আর দেশ স্বাধীন হয়েও প্রকৃত স্বাধীনতা না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে লেখা হয়েছে কবিতাটি। এইটা যখন ভাববেন তখন এ-কবিতার আরো যে কিছু খুঁটিনাটি আছে, নদীর বাঁকে বাঁকে আরো যে কিছু দেখবার সৌন্দর্য আছে, মাটির ফাটা কঙ্কাল, রোদে ঝলসে যাওয়া ফসলের ওইপাড়ে কৃষকের নোনা শুষ্ক চোখ যে আপনার কল্পনার জগতের ভিতরে মুহূর্তের মধ্যে এসে আপনাকে পিড়পিড়ানি দিচ্ছে — এইগুলাও সাথে করে নিতে হবে আপনাকে। নাহলে এ-কবিতার পুরা স্বাদ আপনি ঠিকটাক নেয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। রাজনৈতিক কবিতা পাঠের এই একটা রিস্ক থাকে।

৩।
আরেকটা কথা বলে নেই, আমি কবিতাটি হুবহু তুলে আনতে চেয়েছিলাম, মানে লাইন টু লাইন যেভাবে আছে ঠিক সেভাবে। কিন্তু যখন মোবাইলে লিখছি, দেখলাম লাইন টু লাইন করতে পারছি না। সব গদ্যের মতন এলিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাই বাধ্য হয়ে কয়েকটা শব্দের পরপর ছন্দের চিহ্ন দিয়ে এগোই — কিন্তু এর মানে এই নয় যে হুবহু ছন্দটা আমি তুলে আনতে পারছি, সম্ভবত তা-ও পারিনি। তাই হুবহু কবিতাটি যারা পড়তে চান তারা দয়া করে গ্যুগলে যেয়ে পড়ে নেবেন। আসুন, এই নাদান এ-কবিতা নিয়ে কী ভাবছে বা কী এমন বিষয় আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাইছে, যা আসলেই আপনাদেরই মনের কথা কারো কারো জন্য আবার কারোর জন্য একেবারে নতুন কিছুও হতে পারে; আবার আমি যে বলে গেলাম সেইটা হয়তো একেবারেই ধারেকাছে যায়নি মূল কবিতার — এ-রকমও তো হতে পারে, পারে না! ফেসবুকের এই একটা মজা, মতের মিল অমিল মুহূর্তেই স্পষ্ট দেখা যায়।

৪।
আপনারা কবিতাটির প্রথম তিন চরণের পরে শ্যানানডোয়া নামে একটা শব্দ দেখবেন। আমি প্রথমে ভেবেছি, এইটা হয়তো ভিয়েতনামি কোনো মুখোশের নাম। পরে এই শব্দ নিয়ে গ্যুগলে লিখলে, এইটা নিয়ে মঈনুস সুলতানের অনেকগুলা ধারাবাহিক গদ্যের আয়োজন দেখলাম। শ্যানানডোয়া, যুক্তরাষ্ট্রের একটা জায়গার নাম। যেখানে হাইকাররা নিয়মিত ভ্রমণ করে। কবি মোস্তাক আহমাদ দীন তার পোস্টে বলছেন, প্রথম আলোর কোনো-এক সাময়িকীতে মঈনুস সুলতানের শ্যানানডোয়া সিরিজের একটা লেখা পড়ে এই কবিতাটি লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আমি প্রথম আলোর সাময়িকীর সে-লেখাটা পরে যোগাড় করে পড়ি, সেখানে মঈনুস সুলতান একটা জায়গায় বলছেন, একটা গাছে কাঠের একটা মুখোশ ঝুলে আছে, দাড়ি আছে এমন বৃদ্ধ মানুষের মুখ যেন। মঈনুস সুলতানের এ সামান্য অংশ নিয়েই মোস্তাক আহমাদ দীন তার কবিতাটি শুরু করেছেন, তারপরে আমরা দেখব, এ মুখ দেখে কবি মনে মনে মাণিক্য চামারের কথা বলছেন। এখানে আমরা এখন থামব, মানে প্যজ মারলাম আর-কি। ফিরে যাই আবার শ্যানানডোয়ায়। মঈনুস সুলতানের শ্যানানডোয়া নিয়ে কয়েকটা লেখা আছে। তার মধ্যে একটা হলো প্রথম আলো  ছাপিয়েছিল, যেইটা পড়ে এক ঘোরের মধ্যে যেয়ে মোস্তাক আহমাদ দীন তার এ-কবিতাটি লিখে ফেলবেন। মঈনুস সুলতানের আরেকটা লেখা পড়লাম, শ্যানানডোয়া নিয়েই — সেইটা নিয়ে যদি কিছু না বলি তাহলে এ-কবিতার জার্নিটায় একটা অতৃপ্তি থেকে যাবে। কবিতা পড়ার মজাটা কোথায় জানেন, দেখবেন কোনো-এক কবিতার সাথে কোন আমলের গদ্য সুরে সুরে ভিতরে ভিতরে মিলে যাচ্ছে। শলোখভের ধীরে বহে দন  পড়বার সময় আমার চোখে কেবলই মোহাম্মদ রফিকের কীর্তিনাশার কবিতাগুলি ভাসত। এইটা শুধু কবিতা আর উপন্যাসের বেলায় নয়, দুইটা কবিতার বেলায়ও হতে পারে। দুইটা উপন্যাসের, দুইটা সিনেমার মধ্যেও হতে পারে, পারে না? সেই লেখাটায় মঈনুস সুলতান শ্যানানডোয়ায় গিয়ে ভিন্ন এক জগতের অভিজ্ঞতা আমাদের তুলে ধরেছেন। সেখানে একটা জায়গায় আছে এক নিসঙ্গ আফ্রিকান বৃদ্ধ এই শ্যানানডোয়ায় বিভিন্ন সবজি ফলিয়ে সেইগুলা স্টেক করে একা খায়, হাইকারদেরও ডেকে খাওয়ায়। সেই বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বলছে, কিন্তু মঈনুস সুলতান এ লাইনের পরে আবার বলছেন, হাসতে হাসতে নয় তিনি বৃদ্ধের সামনে একটু এগিয়ে যাবেন, গিয়ে দেখবেন, বৃদ্ধ আসলে কাঁদছে, তার ফোকলা দাঁতের নড়চড় দেখে তিনি মনে করেছিলেন হাসছে, আসলে সেইটা নয়। বৃদ্ধ বলছে, সে একটা পা-ভাঙা হরিণের বাচ্চা পালছিল কদিন ধরে, বড় যত্ন করে শুশ্রূষা করছিল, কিন্তু দুইদিন হলো বাচ্চাটা ফিরে আসছে না। বৃদ্ধ আশঙ্কা করছে, নিরীহ বাচ্চাটাকে শিয়ালে নয়তো পুমায় খেয়ে ফেলতে পারে। বৃদ্ধ চোখ মুছতে মুছতে বলবে, “কুকুরের বাচ্চা একটা পালছিলাম, সেটাও শিয়ালে খেয়ে ফেলেছে, একজোড়া কবুতর পালছিলাম, এরাও আমাকে ফেলে চলে গেছে।” এই বৃদ্ধের সাথে এবার মাণিক্য চামারের মিল খুঁজে দেখেন। যে মানিক্য চামার জীবনভর চামড়ার জুতা সেলাই করে অভ্যাস, তাকে মলবির পুত বলছে রাবারের বুট সেলাই করে দাও! মাণিক্য চামার তাকে বলছে, আমি তো বেটা রাবারের জুতা সিলাই করি না। এইটা কি এ-রকম নয় যে দেশ ভাগ করে শত্রুসম্পত্তি করে দেশ স্বাধীনের পরে গণতান্ত্রিক ভোটের পরে দেশ হারানো মাণিক্য চামারকে আবার বললাম, দেশে কি আসবা? তখন সে রাবারের জুতা দেখিয়ে বলছে, এমন টুটাফুটা দেশ দিয়া আমি কী করব? সেই আফ্রিকান বৃদ্ধ যার দেশ নাই, যার কাছ থেকে সবাই চলে যাচ্ছে তার সাথে মাণিক্য চামারের কোথাও না কোথাও একটা মিল আমি অন্তত পাচ্ছি। আবার আরেকটা উদাহরণ দেই, মঈনুস সুলতানের সেই লেখাতেই আছে, হাইকাররা ক্ষুধায় কাতর হয়ে গেলে একটা না একটা বিনিময়ের মাধ্যমে খাবার পেতে পারে। হাইকারদের মধ্যে এটাই নিয়ম। যেমন তুমি বিস্কুট দিলে আমি তোমাকে ওয়াকম্যানের ব্যাটারি দিতে পারি। অথবা তুমি আমাকে বড়শির টোপ দিলে আমি তোমাকে কয়েকটা ম্যাচের কাঠি দিতে পারি। এ কবিতার প্রসঙ্গে যদি এমন কথা আসে, তাহলে ধরে নিলাম মাণিক্য চামার বলছে, আমি একদিন তোমাকে চামড়ার জুতা বানিয়ে দিয়েছি, তুমি আজ রাবারের জুতা দেখাবা? মলবির পুত? এই আমার এতদিনের পুরষ্কার?

৫।
কবি বলছেন ভয়ে ভয়ে তিনি মুখোশের দিকে তাকিয়েছেন, যদি ভুল করে মাণিক্য চামারের মুখ দেখে ফেলেন — এই কবিতার আসল মজাটা এখানেই। দেশভাগের এত পরে দেশস্বাধীনের এত পরে এসে একুশ শতকের মধ্যম আয়ের দেশ বলে টিভিতে বারংবার মুখস্থ করা নেতানেতৃদের সুটেডবুটেড হাই-তোলা চামে চামে চেহারা, — এমন দেশে কবি এত উৎকণ্ঠিত কেন? তবে কি তিনি মাণিক্য চামারদের দেশ থেকে চলে যাওয়াটা আজো ভুলতে পারেননি? আজো তিনি তাদের নিয়ে অবচেতনে এক ধরনের আত্মনিপীড়ণের শ্লাঘা অনুভব করেন?

৬।
এবার কবিতার পরবর্তী চরণগুলি দেখি, কবি তার বন্ধুকে নিয়ে মাণিক্য চামারের বাড়ি খুঁজতে যেয়ে পেলেন ৪৭টা ঘাসের উপরে ৭১টা জোঁক হা করে তাদের দিকে আসছে। এই সিম্বোলিকটা পরের চরণে এসে কেমন মিলে যাচ্ছে দেখুন, তারা ভয় পেয়ে মতিলাল ডাক্তারের বাড়ি পার হয়ে সোনাওর ডাক্তারের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছেন। মতিলালরা চলে গেছে বিশাল অংশ দেশভাগে আর তার পরের অংশ স্বাধীনতাযুদ্ধে এমনকি দেশস্বাধীনের পরেও প্রতিদিন অবিরাম যাচ্ছেই। মতিলাল চলে গেলে থাকল কে? — সোনাওর! আশ্চর্য মিল হচ্ছে, সেও ডাক্তার। এক ডাক্তার চলে গেলে আরেক ডাক্তার আছে। অসুবিধা কোথায়? কবি ও তার বন্ধু সোনাওরের বাড়ির সামনে এসে মনে করলেন এবার গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়। তার মানে কবি ও তার বন্ধু হয়তো বলতে চাইলেন, মতিলাল চলে গেলেও সোনাওর তো আছে। তাকে নিয়েই আমরা চলতে পারব, চলতে হবে। কিন্তু তারপরে সেখান থেকে তারা কবি ইমদাদের বাড়ি গিয়ে দেখবেন, কবি ইমদাদ রাগী মুক্ত কবিতা নিয়ে বসে আছে। এই লাইনে পরিষ্কার বোঝা গেল, সোনাওররাও সুখে নাই। যে-আশা নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সে-আশা দূরাশা মাত্র। কবি ইমদাদ রাত ১২টার পরে কেন কবিতা পড়বেন? এত রাতে তো কবিতা আর কবিতা থাকে না — সেটাও কবি বলছেন, মুক্ত রাগী কবিতা, — তাহলে আমরা কী ধরে নিব হুলিয়ার মতন! কবি ইমদাদ এবং তার বন্ধুরা কী তাহলে দেশে বড় একটা বিপ্লবের প্রত্যাশা বুকে ধারণ করেন? এইটা কি সেই কৈবর্ত বিপ্লবের মতন আধিয়ার বিপ্লবের মতন ইলিয়াসের খোয়াবনামার পাকুড় গাছের মুনশির মতন হাড্ডিখিজিরদের মতন — যে-বিপ্লবে মাণিক্য চামার, সোনাওর, ময়মনসিংহের নিরীহ চাষারা নেতৃত্ব দেবে!


সত্যজিৎ সিংহ রচনারাশি

COMMENTS

error: