ষাটের দশকের গোড়ায় সেই-যে এসেছিল তুফানি দিনগুলো, গোটা দুনিয়ায় এবং বাংলাদেশে ও ভারতেও, প্রতুল মুখোপাধ্যায় সেই নিশিদিনগুলোতে একাধারে গেয়ে লিখে সুর দিয়ে বেড়িয়েছেন এন্তার গান। যদিও আমরা, বাংলাদেশের শ্রোতা সাধারণ এবং পশ্চিমবঙ্গ সমেত গোটা ভারতেরও বিপুল শ্রোতাগোষ্ঠীর বিবেচনায়, তার গান শুনতে পেয়েছি তিনদশক পরে ক্যাসেটযুগে এসে। সেইটা লাস্ট সেঞ্চুরির নব্বইয়ের দশকের একদম পয়লা। তার অভিষেক স্টুডিয়োরেকর্ড রিলিজ হয়েছে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে, ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’ নামে। এরপর বেরিয়েছে একে একে ‘যেতে হবে’, ‘তোমাকে দেখেছিলাম’, ‘ওঠো হে’ এবং আরও অন্তত ছয়-সাতটা অ্যালবাম যা আমরা বাংলাদেশের শ্রোতারা বাজার থেকে ক্যাসেট পার্চেজ করে শুনেছি। সর্বশেষ বাংলাদেশের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে বেরিয়েছে প্রতুল মুখুজ্জের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শীর্ষক একটা অ্যালবাম, ২০১১, হয়ে গেছে সে-ও অর্ধযুগ গিয়ে দেড়যুগ অতিক্রান্ত। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আশি-প্রায় বয়সে, অ্যাকুরেইটলি বিরাশি-তিরাশি পর্যন্ত স্কোর তুলে, ফেব্রুয়ারির পনেরো দুইহাজারপঁচিশে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
ছিলেন সক্রিয় অন্তিম বছর পর্যন্ত, সংগীত করায়, গানসৃজনে। এমন অনেক গান শোনা হয়েছে গেল-কয়বছরে, প্রতুলের, এর আগে ক্যাসেটযুগে যেগুলো শুনি নাই, ইউটিউবযুগে এসে এইগুলো রেকর্ড করা হয়েছে, যেগুলোর কোনো-কোনোটা আগের রচনা হলেও শ্রোতাসমাজে এর আবির্ভাব ইউটিউবযুগে। এক্সাম্পল দিতে পারি, ‘বিন্দুবৎ’ নামে একটা ব্যানারে এমন কয়েক আনকোরা গান আছে এবং এমন আরও কোথাও কোথাও নিশ্চয়। আর লাইভে এবং স্টেজে গাওয়া তার গানগুলোর ভিডিয়ো তো সুলভ। প্রতুল সম্পর্কে যত-যা জানার আছে, তার অ্যালবামসংখ্যা বা কোনটা কবে কোত্থেকে বেরিয়েছে, এইসব এখন গ্যুগল করে এক-লহমায় জেনে নেয়া যায়। কাজেই, জীবনীনিবন্ধ নয় যেহেতু, শীতের শেষাংশে ফেব্রুয়ারির পনেরো তারিখ দুপুরবেলার ওক্ত প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসানসংবাদ শুনে এই স্মৃতিনিবন্ধে সেইসব উইকিপিডিয়ায়-প্রাপ্য তথ্যের পুনর্বিন্যাস হুদা না-করি আর।
২
মনে পড়ে যায়, রিলেইটেড টু দ্য লাস্ট লাইন অফ দ্য অ্যাবাভ প্যারাগ্র্যাফ, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ / দুপুরবেলার ওক্ত / বৃষ্টি ঝরে বৃষ্টি কোথায় / বরকতের রক্ত’ পঙক্তিগুলায় সুর বুলিয়ে গেয়েছিলেন প্রতুল। কবি আল মাহমুদের এই কিশোরকাব্যের পঙক্তিসারি আমরা পড়েছি অনেক আগে, ইশকুলকৈশোরে, এর হৃদয়ভেজা আগুনফুলকি সুরটুকু শুনেছি পরে, অনেক অনেক বছরের বাদে। এমন আরও হয়েছে, স্কুলপাঠক্রমের বা আধুনিক আউটবইয়ের কবিতা আমরা আগে পড়ে এসেছি, প্রতুলের অননুকরণীয় গলায় গানটি শোনার আগে, এ যে গানেও গাওয়া যায় তা খুব কমই ভাবতে পারি আমরা। আবার উল্টাটাও হয়েছে। এমন অনেক কবিকে, দেশি-বিদেশি অনেক কবিকে, চিনে উঠেছি নিয়মিত প্রতুলের গান শোনার সুবাদে। জ্যাক প্রেভের, ধরা যাক, আমার ক্ষেত্রে।
এই কথাটা ভাবতে পারি স্পষ্টভাবে যে, ক্যাসেটযুগের শ্রোতা আমরা, প্রতুল মুখোপাধ্যায় চিনেছি সুমন চট্টোপাধ্যায় নামের ঘটনাটার সঙ্গে সাক্ষাতের পরে, আগে নয় কোনোভাবেই। ঠিক একইভাবে আরও যত কণ্ঠশিল্পী লিরিসিস্ট সিঙ্গারস্যংরাইটার আবিষ্কার করেছি এই বিশেষ যুগসন্ধি সময়টায়, এই সমস্তকিছুর সঙ্গে সুমনের, পুরাকালের সুমন চট্টোপাধ্যায় এবং পরবর্তীকালের কবীর সুমন ঘটনাটার যোগ অবিচ্ছেদ্য, অনস্বীকার্য। নব্বইয়ের গোড়ার দিকটার বাংলাদেশ মনে পড়বেই। কী কিনতাম ক্যাসেট আমরা, সাবস্ক্রাইব করতাম কোন ধরনের গান আমরা, বাংলাদেশের ব্যান্ডঅ্যালবামগুলোর বাইরে একটা বড় অংশে ইন্ডিয়ান গানের ক্যাসেট খরিদ করতাম তো, ওই সময়টায়, আর সুমন ঘটনাটার পরে আমরা ইন্ডিয়ান ক্যাসেট ইন্ডাস্ট্রির জায়ান্ট খরিদ্দার বাংলাদেশিরা কাদের ক্যাসেট খুঁজে খুঁজে বের করেছি, এই দুই চিত্র সাইড বাই সাইড রাখতে পারলেই দুই যুগের দুই কালের স্পষ্ট রেখাটা সহজে দেখা যায়।
আমাদের সঙ্গে প্রতুলের সাক্ষাৎ, স্বকর্ণে সাক্ষাৎ, হয়েছিল বিরানব্বইয়ের পরে এ-কথা যেমন সত্যি, ঠিক এই কথাটাও সত্যি যে প্রতুল গান গাইছিলেন বিরানব্বইয়ের বহু আগে থেকে। সেইটা আরেক জীবন, প্রতুলের এই জীবন নিয়ে মুদ্রিত প্রকাশমাধ্যমে জেনেছি, ইউটিউব-ওয়েবপোর্টালের মাধ্যমে এরপরে জেনেছি আরও। সমস্ত মাথায় রেখেও বলি, বিরানব্বই বিশেষ একটা মাইলস্টোন দুই দিকেরই বাংলা গানের জগতে। স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যান্ড ফর্ম্যাটে এবং পরাধীন পশ্চিমে এককের আদলে। সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন, মৌসুমী, শিলাজিৎ সকলেই ছিলেন সোলো বলে যারে, একক, ওয়ানস্টার পার্ফর্মার, হ্যান্ডস কোম্পানি নিয়েও গান করেছেন তারা ব্যক্তির একলার, একক ব্যক্তির, আর প্রতুল সঙ্গীসাথিহীন আক্ষরিক অর্থে একলা গান করেছেন কিন্তু সেই গানটা আসলে একক ব্যক্তি ছাপায়া যাওয়া সামষ্টিক, অনেকের উদ্গীরন ও অনুরণন ধারণ করেছে। এই সময়টায় লিটলম্যাগাজিনের সুবাদে বিদেশি বিভিন্ন তত্ত্ব, সবিশেষ সাহিত্য সমালোচনার তত্ত্ব, পড়ছিলাম। মিখাইল বাখতিন ওইভাবেই জানা। বাখতিনের পলিফোনি বা বহুস্বর ব্যাপারটাকে একই সঙ্গে উপন্যাসে এবং গানে খুঁজে খুঁজে বের করছিলাম। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের পরিবেশনায় পলিফোনি তথা বহুস্বরের সমাগম হতে দেখব সবসময়।
৩
আরেকটা কথা আলতো বলে রাখি। হিসাব করে দেখলাম সাত বছরের বড় প্রতুল, জন্মসালের গণনায়, সুমনের চেয়ে। বেয়াল্লিশে প্রতুল, সুমন উনপঞ্চাশে। এর মানে এ-ও যে, পরবর্তীকালে পড়ে পড়ে জেনেছি, প্রতুল গাইছেনও অনেক আগে থেকে। সেই গাওয়ার মাধ্যম ছিল সরাসরি মানুষের মাঝখানে গিয়া গাওয়া। মানুষের মুখে মুখে ফেরা। গানের সেই ইন্ডাস্ট্রিবিহীন মুখে মুখে ফেরা হাওয়াবাতাসের ইতিহাস আমরা যেন ভুলিয়া না যাই, ইয়াদ করি যেন পরের কোনো লেখায়। এমন অজস্র গান আমাদের প্রত্যেকেরই ইয়াদে আছে যেগুলা আমরা রেডিয়োয় রেকর্ডে নয় কারো-না-কারো মুখে শুনেছিলাম পয়লা। তারপরে রেকর্ডযুগে এসে সেগুলোর কিয়দংশ হয়তো স্টুডিয়োরেকর্ডেও শুনেছি। কিন্তু, সুমনের পরে ক্যাসেটফিতায় আবিষ্কার করেছি ইন্ডিয়ার এক বিচিত্র দিগন্ত তথা বাংলা গানের আধুনিক ও অন্যান্য গণ ও মৌন সংগীতের সম্ভার। এইচএমভি, আরপিজি, আশা প্রভৃতি অডিয়োকোম্প্যানির মাধ্যমে এই সময়টা পাওয়া। আর এইদিকে সারগাম, সংগীতা, সাউন্ডটেক প্রভৃতির মাধ্যমে।
এবং, কত আজব লাগে এখন ভাবতে যেয়ে, একটা বইয়ের সমান মর্যাদায় একটা ক্যাসেট কিনতাম তখন আমরা, টাকায় দাম চুকিয়ে, একটা হুমায়ূন আহমেদ চৌষট্টি টু আশি কি ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠা, মানে চাইর ফর্মা বা পাঁচ কি ছয়, পাঠকের প্রাপ্য কমিশন বাদ দিয়া চল্লিশ পঁয়তাল্লিশে একটা বই খরিদ করা যেত, চোদ্দটা গানের ক্যাসেট গানসংখ্যা হ্রাস পেয়ে বারোয় তারপর দশে একসময় আটটায় এসে থিতু হয়, সেই অ্যালবামও খরিদ করতে হতো ওই বইয়ের দামে তথা পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ টাকায়। একটা ফিডব্যাক একটা মাইলস একটা ফিলিংস একটা এলআরবি একটা রেনেসাঁ একটা ওয়ারফেজ যেমন তেমনি একটা সুমন একটা নচি একটা অঞ্জন একটা মৌসুমী একটা শিলাজিৎ একটা কাজী কামাল নাসের একটা চন্দ্রবিন্দু ও দোহার বা ক্যাকটাস ফসিলস ভূমি কিনেছি আমরা চাইরপাঁচফর্মা বইয়ের দামে। প্রতুল মুখোপাধ্যায় কিনতাম বইয়ের দামে, দেখতামও বইয়ের মতো, শুনতাম বইয়ের মর্যাদায়। এখন, দুইহাজারপঁচিশের বিশ্বে, বইপড়া বা গানশোনা ব্যাপারগুলা আগের মতো নয় আর। এখনকার ট্রেন্ড ও টেন্ডেন্সি অন্যপ্রকার। সেই আলাপ ঠিক এইখানে তোলা বাঞ্ছনীয় নয়।
৪
বিরানব্বই অব্দের কথা বারবার ইয়াদ হচ্ছিল প্রতুলের প্রয়াণসন্ধ্যায়। কারণ, বিরানব্বইয়ে ‘তোমাকে চাই’ ঘটেছিল। পরের আট-দশ বছরে এত অসংখ্য নয়া বাংলা গানের আর্টিস্ট আমরা পেয়েছি, কিনেছি, শুনেছি! ইন্ডিয়ায়, বাংলাদেশে এবং উভয় ল্যান্ডে গেল-শতকের নব্বইয়ের দশক অভূতপূর্ব প্রভাব সঞ্চারকারী একটা টাইম। সুমনের আবির্ভাববছর। যদিও, বলা বাহুল্য, সুমনও গানলিপ্ত ছিলেন বিরানব্বইয়ে রেকর্ডকোম্প্যানির লেবেলে মার্কেটে নামার বহু আগে থেকে, যেমন প্রতুলও। যদিও বলতে যেয়ে অনেকে এই বিভ্রান্তি ক্রিয়েট করেন যেন নব্বইয়ের দশকের বাংলা গান শুরু হয়েছে বিরানব্বই থেকে! ফ্যাক্ট হচ্ছে এ-ই যে দেখতে যেমন মনে হয় আদতে তেমন নয়। শুরু সবসময় শুরুরও অনেক আগে থেকে হয়, যেমন প্রতুলের রেকর্ড বেরোবার আগের মাঠময়দানের দুই-তিন দশক গোনায় রাখতে হবে, সুমনেরও তদ্রুপ, অন্য সকলেরও কমবেশ তা-ই।
আচ্ছা, বাকি থাকে এক : মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত বাংলা গান। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের এই ইনিশিয়েটিভ যত আগে থেকেই গৃহীত হয়ে থাকুক না কেন, যেমন ক্লেইম করতে দেখি বিভিন্ন রচনায়, আমরা বাংলাদেশিরা অ্যালবাম আকারে এদের কাজ হাতে নিচ্ছি বিরানব্বইয়ের পরে। এতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই যে সুমনের কমার্শিয়্যাল সাক্সেস সুমনের আগের-পরের সকলের বানানো গানবাজনা বাজারজাত করবার ক্ষেত্রে ব্রেইকথ্রু দিয়েছিল অডিয়ো রেকর্ডিং ও ডিস্ট্রিবিউটর অ্যাজেন্সিগুলোকে। ফলে আমরা মান্না-হাজারিকা-হেমন্ত-হৈমন্তী প্রমুখ শিল্পীদের ছাড়িয়ে পেয়েছিলাম নয়া নয়া বাংলা গানের সিগ্নেচার ও অথার্শিপ। পেয়েছিলাম ইন্ডিয়ান বাংলা ও হিন্দি ফিল্মি গানের গোটা গোটা অ্যালবাম ছাড়াও কমপ্লিট বাংলা গানের একেকটা অ্যালবাম।
৫
আজ থেকে প্রায় সাত/আট বছর আগে, দুইহাজারসতেরো/আঠারোর দিকে, গানপার সঞ্চালনার শুরুর সময়টায়, ‘ব্যক্তিসংগীত’ ও ‘গণসংগীত’ প্রকরণের গানবাজনার তুল্যমূল্য ও তফাৎ নিরূপণের একটা ট্রাই করতে চেয়েছিলাম নির্বাচিত কয়েকজন ‘একক’ সংগীতকার ও ‘সম্মেলক’ সংগীতকারের রচনা সামনে রেখে। সেহেতু প্রতুল মুখোপাধ্যায় এবং কবীর সুমন সহ কয়েকজনের, অজিত পাণ্ডে প্রমুখ আরও বেশ কয়েকজনের, রচনা গানপারটীকা সমেত প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছিলাম। পরে, প্ল্যান আর প্রোগ্রামের চিরাচরিত অনটনে, সেই ইনিশিয়েটিভ অসমাপ্ত রয়ে যায়।
অ্যানিওয়ে। সেইসময় ‘একক ও সম্মেলক’ শীর্ষকের আওতায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের নিজের একটা গদ্যলেখা গানপারে ছেপেছিলাম মনে আছে। এই লেখাটা আমরা কালেক্ট করেছিলাম স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘যুদ্ধজয়ের গান’ শীর্ষক একটা সংকলন থেকে, লেখাটা ‘একক ও সম্মেলক গান প্রসঙ্গে’ শিরোনামে মূলে পাওয়া। সংকলনের ৩৩২ পৃষ্ঠাঙ্কে লেখাপ্রারম্ভে এডিটোরিয়্যাল দুইটা লাইন পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে দেখছি লিখিত : “গণসংগীত মূলত সম্মেলক গান অথচ প্রতুল মুখোপাধ্যায় এককভাবে গেয়ে থাকেন। এই প্রসঙ্গে প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্য লিখিতভাবে জানিয়েছেন।” উল্লেখ্য, সংকলনে প্রতুলের দীর্ঘ কথোপকথা ছাড়াও অনেক লড়াকু গণসংগীতকারের অন্তরঙ্গ কথাবার্তা ছাপা আছে। এইটা বাইর হয়েছিল ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে, ‘এবং জলার্ক’ প্রকাশন কলকাতা থেকে, একহাজার পৃষ্ঠার কাছাকাছি কলেবরের সংকলনটা বাংলা-হিন্দি-মারাঠি-তেলেগু প্রভৃতি বিচিত্র ভাষার বিভিন্ন অঞ্চলের গণসংগীত নিয়া আলাপবোঝাপড়ার একটা জ্যান্ত আকরিক।
ও, বলা প্রাসঙ্গিক, ‘এবং জলার্ক’ ছিল মোটামুটি নিয়মিত-বেরোনো পশ্চিমবঙ্গীয় অবাণিজ্যিক উদ্দীপনার ছোটকাগজ বা লিটলম্যাগাজিন ধারায় বেরোনো অজস্র স্মরণযোগ্য ও অবস্থানধারক প্রকাশনাগুলোর মধ্যে একটা, যাদের অন্তত দুইটি রিসার্চারদের-জন্য-মহার্ঘ সংকলন রয়েছে, একটার কথা প্যারাগ্র্যাফের পয়লা লাইনে ব্যক্ত, অন্যটা নকশালবাড়ি ইতিহাস ও অনুষঙ্গের রাজনীতি নিয়া; তা, আলাদা জায়গায় প্রাসঙ্গিক হলেও প্রতুলস্মরণে এই নিবন্ধরচনায় ‘এবং জলার্ক’ নিয়া আলাপ অতিপ্রাসঙ্গিক অবশ্য।
৬
প্রতুল মুখোপাধ্যায় নিজে লেখেন গান, তারচেয়েও অধিক তিনি বিভিন্ন সময়ের ও বিভিন্ন ভাষার কবির কবিতায় এবং এমনকি পোলিটিক্যাল প্যাম্ফলেট-ম্যানিফেস্টোতে সুর দিয়ে অবাক করেছেন বারবার বাংলার সংগীতামোদীদের। বিশেষভাবেই চিনের ভাষায় অ্যাফ্রিকার ভাষায় হিন্দি ভাষায় কিছু লোকায়তিক সুরের কাঠামো প্রতুল বাংলায় ব্যবহার করে একে তো বাংলা সুরের ইডিয়মের সঙ্গে মেশামেশি ঘটিয়ে দিয়েছেনই, নিজের ইউনিক সিগ্নেচারটিউনও করে তুলেছেন যেন।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কাজ সোলো হয়েও সমবেত সংগীতের ব্যঞ্জনাবাহী; কিংবা, সমস্বরের কন্টেন্ট এর লিরিকে থাকলেও অন্তিমে যেন তা একা-ব্যক্তির ভাঙন-উত্থানের উপাখ্যান বলিষ্ঠভাবে ডেপিক্ট করে। একক নিঃসঙ্গ নিত্যজঙ্গের বীরটিকেই যেন প্রতুলের গান বন্দনা করতে চায়। ঠিক বইয়ের পাতার বীরবন্দনা বা জ্বালাওপোড়াও স্লোগ্যানের বাইরে এমন পোলিফোনিক দ্যোতনার অল্পবাদ্যবহ প্রতুলসংগীত শেষমেশ চিরন্তন প্রেমেরই গান। মিনিম্যালিস্ট অ্যাপ্রোচের সংগীতআয়োজনের এক আশ্চর্য উপস্থাপন।
প্রকৃত প্রস্তাবে, এনজিও-কর্পোরেটের সোশ্যাল রেস্পোন্সিবিলিটির ভড়ং দেখানো প্রচারণাগানের বেশিকিছু হইতে না পারা আজকালকার বাংলাদেশজ কিছু গণসংগীতদল হয়তো প্রতুলের গানের পরবর্তী বিন্দু থেকে তাদের গানকর্ম শুরু করতে পারে। এবং, বলা বাহুল্য, পরিবেশচেতনা বা রাজনীতিচেতনা বা মানবদরদচেতনা ইত্যাদি কিসিমের বিবিধ ব্যুকিশ ব্যাপার ঝেড়ে ফেলে একজন সংগীতজীবীকে তার গানচেতনাটায় শান দিতে হয়, গানকেই নিশানা করতে হয়, এনজিও আর বিজ্ঞাপনপটু প্রচারমাধ্যমের মানবকল্যাণকান্নার সঙ্গে একটা গণসংগীতশিল্পী/গণসংগীতসংঘের দৃষ্টিগ্রাহ্য ফারাক তো থাকতে হয়।
৭
আমাদের দেশের গণসংগীত নিয়া সাংগঠনিক তৎপরতা খুব বেশি ছিল, পশ্চিমবঙ্গ সহ তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলায় যেমন রাজনৈতিক কারণেই ছিল গণসংগীতের ধারাবাহিক ও বিচিত্র পন্থায় ধারায় এর ব্যবহার, বলা যাবে না বাংলাদেশে এমন ছিল বলিয়া, কারণ বাংলাদেশের তৃণমূলের গানচর্চার খবর যেটুকু বইপুস্তকে আছে তা কেবলই পিরফকিরি বাউল ও বৈষ্ণবের, বাউলবৈষ্ণবগিরির বাইরের যেই বিশাল বিচিত্রিতা গানভাণ্ডার, সেসবের খোঁজ অল্পই কিতাবে মেলে। একজন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানজীবনের উৎস, বিকাশ ও পরম্পরা সম্পর্কে কেউ সুলুকসন্ধানী হলে দেখবেন কোথায় যেয়ে একে আর খাপে আঁটানো যাচ্ছে না, চারপাশের ডোমিন্যান্ট ফর্ম্যাট-ফ্রেইমোয়ার্কের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে এ, যেমন যায় কফিল আহমেদ বাংলাদেশে… এই কিসিমের কথাগুলো প্রতুল মুখোপাধ্যায় নিয়া প্ল্যানড লেখাটায় রাখব ভেবেছিলাম, বছর-সাতেক ধরে লিখব-লিখব ভঙ্গির লেখাটায়, এরই ভিতর মহামারী বান আগুন গুম খুন পলায়ন কতকিছু হয়ে গেল, এরই মধ্যে দেহ রাখলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
৮
যে-কথাটা না-বললে নয়, লাল ফৌজের লোক হোন আর না-হোন প্রতুলের গান শুনে আপনি লাল ফৌজের প্রেমে পড়বেনই পড়বেন। আমরা পড়েছি, প্রেমে। প্রতুলের গলা দিয়া আঁকা লাল ফৌজের প্রেমে। এদেশে যদিও সেই প্রতুলের লাল ফৌজের লড়াকু লোকটিকে দেখিনি কোথাও। ওখানে ছিল। বইপত্র পড়ে জানি, ছিল। বহু প্রমাণ পেয়েছি, বইপত্রে, সেই থাকার। আমাদের এখানে বহুজনের কথা বলা সেই বইটা নাই। বহুজনের কণ্ঠ ও কথা ধরা সেই গানটা নাই। যা নাই তা স্বীকার করে এগোলে একটা সম্ভাবনা তৈয়ার হয়, পাবার। আমরা যে-প্রেমে প্রতুল সুমন প্রমুখের গান শুনেছি, কিডস ফ্রম নাইন্টিস, এখন তা প্রাকৃতিক কারণেই অবসিত হবে। এভরি জেনারেশন গেটস ইটস লিট্রেচার অ্যান্ড মিউজিক ইট ডিজার্ভস। কাজেই, চিন্তার কিছু নাই, ‘ডাঙ্গার টানে পরান ছিল বাঁধা কেন রে বন্ধু এতকাল / গরজি গুমরি ডাকে শোনো ওই তরঙ্গ উথালপাথাল’ বা আর-কোনো প্রতুলগানের লাইন গুনগুনাইতেগুনাইতে কান পেতে রইব নতুন সময়ের গানের পানে।
৯
এই ট্রিবিউটগদ্যটি লিখতে যেয়ে, শেষাশেষি শীতের পক্ষাঘাতগ্রস্ত সন্ধ্যায়, যেহেতু রচনাসমাপনে বেশ বিলম্ব হচ্ছিল, দেখি অনলাইনে অ্যাভ্যাইল্যাবল পোর্টালগুলায়, নিউজ ও নননিউজ উভয় কিসিমের পোর্টালগুলায়, লিখেছেন অনেকেই। স্মৃতিচারণ, মূল্যায়ন, নানান রকমের। কবীর সুমন স্বভাবসুলভ ট্রিবিউট জানিয়েছেন। আরও অনেকেই, লেখক, কথাসাহিত্যিক, কবি, ওয়েস্টবেঙ্গলের অনেকেই লিখেছেন। বাংলাদেশের একটা পত্রিকায় মাহমুদুজ্জামান বাবুর লেখা পড়লাম, প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে নিয়া বাবুর শ্রদ্ধাগদ্য, বহুদিন বাদে সেই তিক্ত ও অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটাই মৃত্যুদিনে মনে পড়ল, যে-প্রসঙ্গ প্রতুল কখনো এড়িয়ে যান নাই, মুদ্রিত অনেক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রতি তার অভিমানভরা বিরাগের কথা জানিয়েছেন এদেশের এক গায়ক অনুমতি ব্যতিরেকে তার গান গেয়েছে বলে। টেরিস্ট্রিয়্যালে বহুল প্রচারিত ওই গানটার সুবাদে এবং ওই পত্রিকাগোষ্ঠীর মদতে বাবু অনেক উন্নতি করেন শোবিজনেসে। যেমন যখন নায়ক দরকার যথা মুসা ইব্রাহিম বানানো পত্রিকাগোষ্ঠীটি বিপ্লবী, লাল, চিরকাল। তা অবশ্য সকলেই জানেন, বায়তুল মোকারম থেকে মাস্টারমাইন্ড পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সর্বমহল, তবু যদি কেউ না-জানা থাকেন, তাই জানাইলাম। তো, যা-হোক, যাবার আগে একটা বোনাস ট্র্যাক। অনেক লেখার ভিড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন ওয়েবম্যাগ থার্ডলেন স্পেইসে একটা লেখা পড়ে এলাম, প্রতুলের প্রতি ট্রিবিউট, তাৎক্ষণিক অথচ তাৎপর্যপূর্ণ, ‘প্রতুলকে বিদায় বলাটা যে-কারণে সম্ভব নয়’, লিখেছেন আহমদ মিনহাজ, পড়ে দেখতে পারেন সময় জুটলে।
১০
এবং গণসংগীত। প্রতুল মুখোপাধ্যায় এই প্রকরণের প্রায়োগিকতা অনেক প্রসারিত করে গেছেন। গোটা গানের ব্যাপ্তিটা বাড়িয়েছেন। গণসংগীত বলতেই যে ‘দেশের জনতা জাগানো’, প্রতুল তার গান দিয়ে এই রদ্দি ধারণা পাল্টে দিয়ে গেছেন জীবন ধরে। দেশের মানুষকে জাগানো তো নোবল কাজ, সন্দেহ নাই; কিন্তু সুরটাকে, কথাটাকে, ব্যথাবেদনার উপশমটাকে, কে জাগাবে? কে ভাবে এইসব নিয়া! খালি মিনারের বেদিমণ্ডপে আর রাস্তাপাশে মাচা বেঁধে শালু ঝুলিয়ে কিছুদিন ধুমাইয়া গাও আর বাকি জিন্দেগির লাগিয়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হইয়া যাও। গণসংগীত সম্প্রতি এইভাবেই বিরাজিছে, বোধহয়, অসমর্থিত খবরে প্রকাশ। শুধু অসমর্থিত খবরই তো নয়, দেখতেও তো পাই নিজের নয়নে। এখনও ‘শঙ্খচিল’ বা ‘তেলেঙ্গানা’ গাওয়া হয় বামধারা সাংগঠনিক সংস্কৃতিইভেন্টগুলায়, আর বামধারার সংস্কৃতিইভেন্ট মানেই তো কোটআনকোট গণসংগীত। প্রতুলের পরেও এককভাবে স্টেজে গণসংগীত পার্ফোর্ম করতে দেশের কণ্ঠশিল্পীদের কমই দেখা যায়। গণসংগীত মানেই বৃন্দ তথা সম্মেলক, এ যেন অলঙ্ঘনীয় প্রথার মতো হয়ে উঠেছে। এর ভিতর যদি নতুন সময় ধারণ করা আখ্যানের গণসংগীত খুঁজতে যান, তো পস্তাবেন। অলমিতি বিস্তরেণ।
- প্রতুল স্মরণ - February 23, 2025
- বাত্তির রাইত - February 15, 2025
- চিকন চালের চলাচল - February 13, 2025
COMMENTS