যাত্রায় বিবেক || সজলকান্তি সরকার

যাত্রায় বিবেক || সজলকান্তি সরকার

‘নব রসে যাত্রা, পঞ্চ রসে অভিনেতা’ — এমন কথা চ্যাংড়া বয়সেই এমএসআর যাত্রাপালার রিহার্সেলঘরে নাচ-গান ও পাঠ গ্রহণকালে ডিরেক্টরের মুখে অনেক শুনেছি। কিন্তু তখন এসব কথার মর্মার্থ জানা হয়নি। রস, যাত্রা ও অভিনেতা এই তিনটি বিষয় কীভাবে, কোন নিয়মে এক হয়ে যাত্রার পূর্ণতা পায় তা জানার কিঞ্চিৎ প্রয়াস থেকেই মূলত একসময় যাত্রাপালা মঞ্চায়ন, পালায় অন্তর্নিহিত বিবেক ও অন্যান্য সংগীত সংগ্রহ আমাকে ভাবায়িত করেছে। তাই শুরু হয় যাত্রা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। বিশেষ করে ‘একটি পয়সা’ যাত্রবইয়ে হরিপুরনিবাসী গিরিন্দ্র সরকারের অভিনয়ের কথা মনে হইলে প্রাণ দেওয়ানা হইয়া যায়। আহ্! গ্রিনরুম থাক্যিয়া যখন গান টান দিলো — ‘ইডিয়েট ভগবান রিটায়ার্ড লাইফ তোমার’, তখন আসরের দর্শক-শ্রোতা সবাই বলাবলি করতে লাগল, — কই-গ, কই! কেলা-গ, কেলা গান ধরছে! তারপর যখন গিরিন্দ্রবাবু ধীরলয়ে হেঁটে হেঁটে গাইতে গাইতে মঞ্চে উঠল তখন সবাই বলাবলি করতে লাগল — বিবেক! বিবেক! আর সবাই বুঝল বিবেকপাঠ কারে কয়! যাত্রা কী জিনিস! তবুও মাইনশে কথায় কথায় কেন যে কয় — ‘যাত্রা শোনে ফাত্রা লোকে / কবি শোনে ভদ্রলোকে’ … তার কোনও মানে বুঝি না!

তারপরও মানুষ যাত্রাপাগল। যাত্রা শুধু অতি জনপ্রিয় লোকনাট্যধারাই নয়, এটি একটি জাতীয় নাট্যও বটে। যার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। জানা যায় অষ্টম ও নবম শতকে এদেশে পালা অভিনয়ের প্রচলন হয়। একসময় রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুন্ড্র, চন্দ্রদীপ, হারিকেন ও শ্রীহট্ট সহ সমগ্র ভূখণ্ডে পালাগান বা কাহিনিকাব্য প্রচলিত ছিল। মূলত যাত্রা শব্দটি এসেছে ধর্মীয় বা কোনো উৎসব উপলক্ষে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে-গতি সেখান থেকেই। ‘যাত্রা’ শব্দটির অর্থ গমন করা। একসময় আমাদের দেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা ইত্যাদি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত ছিল। মূলত ১৭০০ সালে যাত্রার বীজ বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানের কুনজরের ফলে পূর্ববঙ্গের পালাকারগণ পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আবার ১৯৭১ সালের পর এদেশে যাত্রাশিল্প নতুনভাবে গড়ে ওঠে। তবে ঢাকায় ১৮৬০ সালে যাত্রা প্রথম মঞ্চায়ন হয়। গবেষক মুনতাসীর মামুনের স্মৃতিকথা অনুযায়ী ‘সীতার বনবাস’ আমাদের দেশে ঢাকাস্থ প্রথম যাত্রা। তারপর ‘স্বপ্ন বিলাস’, ‘রাই উন্মাদিনী’, ‘বিচিত্র বিলাস’, ‘ধনকুণ্ডু’, ‘নৌকাকুণ্ডু’, ‘কোকিল সংবাদ’ ইত্যাদি।

আমাদের দেশে যাত্রার প্রাচীনত্ব ও তার উদ্ভব নিয়ে অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের বক্তব্য এই যে, “বাংলাদেশে অনেক দিন হইতে অভিনয় হিসেবে যাত্রা চলিয়া আসিয়াছে। বস্তুত যাত্রা হইতেই আমাদের দেশে থিয়েটারের উৎপত্তি হইয়াছে বলিয়া আমার বিশ্বাস। যাত্রা নতুন জিনিস নয়, ইহার অস্তিত্ব প্রাচীনকাল হতেই আছে।” নাট্যগবেষক ডক্টর বৈদ্যনাথ শীলের মতে, “বাংলা নাট্যসাহিত্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে হইলে সর্বপ্রথম যাত্রাসাহিত্যের আলোচনা করা প্রয়োজন। … ইংরেজি নাট্যসাহিত্যের প্রভাবে আমাদের বাংলা নাট্যসাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে বটে; কিন্তু তার পূর্বে আমাদের এই বাংলাদেশ যাত্রা নামে এক প্রকার নিজস্ব জনপ্রিয় অভিনেয় সাহিত্য ছিল।” প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদক রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে শিশুরাম অধিকারী নবযাত্রার প্রবর্তক। মিত্রের রচনায় পাওয়া যায়, “গত বিংশতি বৎসরের মধ্য কবিদের সংখ্যা হ্রাস পাইয়াছে। তাহার ত্রিংশৎ বৎসর পূর্ব হইতে যাত্রা বিশেষ প্রচলিত হইয়া আসিয়াছে। পরশুরাম অধিকারী নামক এক ব্যক্তি কেঁদুলী গ্রামনিবাসী ব্রাহ্মণ যাত্রার গৌরব সম্পাদন করে।”

যাত্রা, থিয়েটার বা মঞ্চনাটক কিংবা লোকনাট্য বিষয়গুলি একই ধারায় হলেও তাদের সময়কালীন ও পরিবেশনায় সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য রয়েছে যেমন, যাত্রাসংলাপ হয় সুর ও মিউজিকের উপর। থিয়েটারডায়লগ হয় বাণীপ্রধান, যেখানে ডায়লগে পাইরেটি ওয়ার্ড থাকে না। মঞ্চনাটক একটি সেটে — যেমন, আঙিনায় বা বৈঠকখানায় কথোপকথনের মাধ্যমে উপস্থাপন হয়, যেখানে ডায়লগে পাইরেটি ওয়ার্ড থাকে। আর লোকনাট্য সাধারণত ঝুমুর ঢঙে গান ও সংলাপের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ বলা যায় যাত্রাডায়লগ সুরপ্রধান, থিয়েটারডায়লগ বাণীপ্রধান, মঞ্চনাটক কথোপকথন এবং লোকনাট্য গান-ও-সংলাপপ্রধান।

তবে লোকনাট্য একটি প্রাচীন অভিনয় কলা। যাত্রা, থিয়েটার বা মঞ্চনাটক ও লোকনাট্য প্রত্যেকটিই নবরসে পূর্ণতা পায়। রস হচ্ছে ভাবের স্থায়ী অবস্থান। মনের নিবিড় চেতনা। শিল্পীর আঙ্গিক বাচিক অভিনয়ের ভাবার্থ যখন দর্শক-শ্রোতাকে প্রভাবিত করে তখনই রসের সৃষ্টি হয়। মূলরস চারটি, যথা — শৃঙ্গার, রৌদ্র, বীর ও বীভৎস। এই চারটি রস থেকে যথাক্রমে আরো চারটি রসের উৎপত্তি হয়। হাস্য, করুণ, অদ্ভুত ও ভয়ানক। এছাড়াও শান্ত বলে আরো একটি রসের কথা উল্লেখ আছে। তাই নাট্যশাস্ত্রকারগণ মনে করেন রস নয়টি; যথা — শৃঙ্গার, বীর, করুণ, অদ্ভুত, ভয়ানক, বীভৎস, রৌদ্র ও শান্ত। এই নয়টি রস ব্যতীত যাত্রা, থিয়েটার, মঞ্চনাটক কিংবা লোকনাট্য কোনোটাই পূর্ণতা পায় না। আর এই রসগুলো দর্শকের হৃদয়কে ভরিয়ে তুলতে অভিনেতার গুরুত্ব সর্বাগ্রে। যাত্রাঅভিনেতাদের চরিত্র নানা ধরনের হয়, যেমন — নায়ক, সহ-নায়ক, নায়িকা, সহ-নায়িকা খলনায়ক, সহ-খলনায়ক, টপার বা মুখ্য চরিত্র, সি-কমেডিয়ান ডার্ক বা কুচক্রী, কমেডিয়ান, বিবেক ও বৌরানী।
‘ভাব’ অভিনেতাদের প্রাণ। তাই নয়টি রস থেকে আবার নয়টি ভাবেরও উৎপত্তি হয়, যেমন — রতি, হাস্য, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, ঘৃণা, বিষয় ও বৈরাগ্য। মনের সকল বৃত্তির বহিঃপ্রকাশই ভাব। সহজভাবে বলা যায় আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয় দ্বারা মনোভাব প্রকাশ করাকেই ভাব বলে। ভাব অভিনয়ের প্রাণশক্তি। কৃত্রিম ভাব প্রকাশকে অভিনয় বলে। অভিনয় প্রকাশের মাধ্যম চার প্রকার, যথা — আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য ও সাত্ত্বিক;— যা একজন অভিনেতার বিশেষ গুণ হিসেবে থাকতে হয়। তাছাড়া অভিনেতাদের প্রতিটি চরিত্রই প্রকাশ পায় যাত্রাপালার নবরসের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচটি রস নিয়ে। কোনো চরিত্র পঞ্চরসে কোনোটি চার রসে ও তিন বা তার কম রসে প্রকাশ পায়। তবে একজন অভিনেতার নবরসে ভাবায়িত হওয়ার দক্ষতা থাকতে হয়। মূলত যাত্রায় নবরসের নবভাবে ভাবায়িত হয়েই অভিনেতা দর্শকের কাছে তার চরিত্র অনুযায়ী রস পৌঁছে দেয়। আর তখনই অভিনেতার অভিনয়ের পূর্ণতা পায়। এভাবেই সকল অভিনেতার পূর্ণভাবের পূর্ণরসেই যাত্রার পূর্ণতা পায়।
যাত্রাপালার একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র বিবেক। কেননা বিবেক অভিনেতাদের জন্য অভিনয় করে। সে কাহিনি ধরে রাখার সূত্রধর। তাঁকে নানা ভাবের অভিনেতার সাথে যোগসাজস রেখে সংলাপে-সংগীতে পারদর্শী হয়ে অভিনয় করতে হয়। অভিনয়কালে বিবেককে প্রতিটি প্রস্থান-প্রবেশেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে রস তৈরি করতে হয়। বিবেক চরিত্রটি কাহিনিকেন্দ্রিক অত্যাচারী শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা ‘শাক্তশক্তি’। বিদ্রোহী কণ্ঠ। গল্পের আদর্শিক চরিত্র। জাগরণ। আর ‘বিবেক সংগীত’ হচ্ছে অগ্নিময়ী ভাষায় লিখিত প্রতিবাদের রূপ। নাট্যতত্ত্ব মীমাংসা গ্রন্থে ডক্টর সাধন কুমার ভট্টাচার্যের উক্তি এই যে, “বিবেকই বাংলা যাত্রা নাটকের পতাকা চিহ্ন।” শুরুতে যাত্রাপালায় বিবেক চরিত্র ছিল না। ১৮৯৪ সালে পালাকার অহিভূষণ ভট্টাচার্য্য তার ‘সুরথ-উদ্ধার’ যাত্রাপালায় সর্বপ্রথম বিবেক চরিত্র সৃষ্টি করেন, যার প্রথম গান —
ওরে আপন বুঝে চল এই বেলা
ও-যে বাস্তু শকুন উঠছে মাথার গো
বসে যুক্তি দিচ্ছেন হাড়গেলা…
(সংক্ষেপিত)
ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অশ্বিনীকুমার তার বক্তৃতায় বলেন, “আমরা যেসব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, তা যদি কেউ যাত্রা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এইরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী হয়।” আর তখনই চারণকবি যাত্রার অধিকর্তা মুকুন্দ দাস তার ‘মাতৃপূজা’ যাত্রাপালায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গলা ছেড়ে গাইলেন —
দশ হাজার প্রাণ যদি আমি পেতাম
তবে বিদেশী বণিকের গৌরব রবি
অতল জলে ডুবিয়ে দিতাম।
শুধু তাই নয়, প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় হাজার হাজার যুবকপ্রাণ শপথে দীপ্ত হয়ে বিবেক সংগীতে গেয়ে ওঠে —
ছেড়ে দাও রেশমী চুড়ি, বঙ্গনারী
কভু হাতে আর পরো না।
জাগো গো ও জননী, ও ভগিনী
মোহের ঘুমে আর থেকো না
এখানেই ক্ষান্ত নয় যাত্রাপালায় বিবেকের কণ্ঠে বিদ্রোহী উদাত্ত স্বরে ধ্বনিত হলো স্লোগান —
‘বাঙ্গালী এক হও’,
‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’,
‘বঙ্গভঙ্গ চলবে না’,
‘কার্জন নিপাত যাক’,
‘ফুলার বঙ্গ ছাড়ো’ … ইত্যাদি।
শুধু তাই নয়, যাত্রাপালায় বিবেকের কণ্ঠে অধঃপতিত, আত্মবিস্মৃত ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে আরও গাইলেন —
বান এসেছে মরা গাঙে খুলতে হবে নাও
তোমরা এখনো ঘুমাও? এখনো ঘুমাও?
আবার কখনো ইংরেজ শাসনের শৃঙ্খল ছিঁড়বার আহ্বান জানিয়ে বিবেক তাঁর কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন —
ভয় কী মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে
লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান
নিতে হয় মুকুন্দেরে নিও রে সঙ্গে।
আবার অন্য কোনোখানে, অন্য কোথাও ‘সোহরাব-রুস্তম’ যাত্রাপালায় সূচনাদৃশ্যে বিবেক আনন্দ-উল্লাসে গেয়ে উঠেছেন —
ভাবনা কী আর সই
ঘরের কাছে এসে গেছে স্বর্গে ওঠার মই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, স্বাধীনতা ইত্যাদি কারণে সামাজিকভাবে যে বিপর্যয় দেখা দেয় তা থেকে উত্তরণের জন্যও যাত্রাশিল্পের যথেষ্ট অবদান ছিল। আদি যাত্রাপালায় ধর্মানুভূতি, পদ্যসংলাপ ও সংগীতের প্রাধান্য বেশি ছিল। বর্তমানে যাত্রাপালায় সংলাপপ্রধান ও আধুনিক সংগীতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।


একটি যাত্রাদল গঠন করতে একজন উদ্যোক্তা থাকেন, যাঁকে বলা হয় ‘মালিক’ বা ‘সরকার’। একটি “এ ক্লাস” প্রফেশনাল যাত্রা অপেরায় দীর্ঘ নয় মাসের প্রস্তুতি থাকে। তিন মাস রিহার্সেল। ছয় মাস পরিবেশনা। সাধারণত শ্রাবণ-ভাদ্র মাস থেকে চৈত্রমাস পযর্ন্ত যাত্রাকাল। তবে যাত্রাবিধি অনুযায়ী ষষ্ঠী দুর্গাপূজা থেকে বাসন্তী দশমী পর্যন্ত পরিবেশনের উত্তম সময়। এখানে উল্লেখ্য যে অপেরায় রাষ্টীয় দিবসে, বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারিতে যাত্রপালা পরিবেশন হয় না। এইদিন মঞ্চে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে ভাষার প্রতি সন্মান জানানো হয়।সাধারণত গ্রামের স্বশিক্ষিতজন যাত্রার উত্তম শিল্পী। একটি “এ ক্লাস” অপেরায় শিল্পী, কলাকুশলী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সহ ১২০ থেকে ১৩০ জন পর্যন্ত প্রয়োজন হয়। বি ক্লাসে ৮০-৯০ জন। সি ক্লাস অপেরায় মূলত ঝুমুরপালা অধিক পরিবেশন হয়। তবে একটি এ-ক্লাস অপেরায় ডিরেক্টর, পুরুষ শিল্পী, মহিলা শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, হেড ড্যান্সার সহ প্রায় বিশজন যন্ত্রী, ড্রেসম্যান, তিনজন ম্যানেজার, তিনজন প্রোমোটার, দুইজন মেকাপম্যান, ক্যাশিয়ার, লাইটিংম্যান, প্রচারক, বাবুর্চি, চাকর ও নানা সহযোগী সহ আরও অনেকেই যুক্ত থাকেন। অপেরায় প্রফেশনাল শিল্পীদের সন্মানী হিসেবে মোট চুক্তির উপর তিন অংশের এক অংশ অগ্রীম প্রদান করা হয়।পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক যাত্রাপালা ভালো ভালো অভিনেতা ও কলাকুশলী দ্বারা মঞ্চায়িত হয়। যাত্রার শুরুতে জাতীয় সংগীত বা দেশাত্মবোধক গান ভাব-ভক্তির সাথে গাওয়া হয়। তবে লোককাহিনিভিত্তিক যাত্রাপালায় ‘বন্দনা সংগীত’ গাওয়ার প্রচলন আছে, যেমন —

প্রথমে বন্দনা করি গো
ও বন্দি প্রভু নিরাঞ্জন
দয়া করে পাঠালেন যিনি
এই ত্রি-ভুবন।

তারপরে বন্দনা করি গো
ও বন্দি সভায় যতজন
আশীষ নিবেন এই অধমের
পাই যেন চরণ।

পশ্চিমে বন্দনা করি গো
ও বন্দি ঠাকুর জগন্নাথ
জাত নাই বিচার নাইবাজারে বিকায় ভাত।

আমার আসর ছেড়ে যদি মাগো
ও মা অন্য স্থানে যাও
দোহাই লাগে দেব ধর্মের
গণেশের মাথা খাও।
প্রতিটি অপেরার গ্রিনরুমে নিয়মিত সন্ধ্যা-আরতি হয়। মা সরস্বতীর মাধ্যমে নটনারায়ণকে স্মরণ করা হয়। প্রতিটি অপেরায় শ্রীপঞ্চমীতে ঘটা করে সরস্বতী পূজা হয় শান-মান লাভের আরাধনায়। মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পীদের গুণগত মানের ওপরই যাত্রাদলের যশ-খ্যাতি নির্ভর করে। দলের পাশাপাশি অভিনেতাগণও খ্যাতি অর্জন করে স্বকর্মে। তবে অ্যামেচার যাত্রায় এসব গুণবিচারের তোয়াক্কা খুব বেশি হয় না।


১৯৮৭ সনের কথা। ‘কলঙ্কিনী বধু’ যাত্রাবই মঞ্চায়ন করব বলে গ্রামের আমরা বেশ ক’জন নওজোয়ান সিদ্ধান্ত নিই। দু-একজন ব্যতীত বেশিরভাগ অভিনেতাই নতুন। পাঠ নির্বাচন হলো আর্থিক (চাঁদার) সামর্থ্য অনুযায়ী। আমরা যারা প্রথমসারি আয়োজক ও দাতা তারা সবাই ভালো ভালো পাঠগুলো নিলাম কিন্তু শেষ অব্দি যাত্রা রিহার্সেলেই জমলো না। তাই মঞ্চায়নের ঠিক ক’দিন পূর্বে একজন প্রফেশনাল ডিরেক্টরের শরণাপন্ন হলাম। তিনি এসে পুনরায় যোগ্যতা-অনুযায়ী পাঠ নির্বাচন করে দিলেন। আমার পাঠ পরিবর্তন হলো। আমি পেলাম ‘হিমাদ্রি’ নামক চরিত্রের পাঠ। অর্থাৎ সাইডনায়ক থেকে ভিলেন চরিত্র হয়ে গেলাম। এভাবে সবার পাঠ চূড়ান্ত হলো, মঞ্চায়নের দিনক্ষণ ঠিক হলো। কিন্তু বিবেক চরিত্রের সংকট দেখা দিলো। বিবেক পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিয়ে ছোটাছুটির শেষ নেই। শেষ অব্দি একজন পল্লিগীতিগায়ককে বিবেকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য সাব্যস্ত করলাম। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ হলো না। এখন উপায়!মঞ্চায়নের তারিখ পেছানো হলো। তারপর এলাকার বিশিষ্ট বিবেক অভিনেতা গিরিন্দ্রবাবুকে এনে তাঁর দেওয়া দিনক্ষণ অনুযায়ী যাত্রা মঞ্চায়ন হলো। তখন বুঝতে পেরেছিলাম বিবেকের কত কদর। অথচ অন্যান্য চরিত্রগুলোতে অভিনেতার অভাব নেই। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। আর বিবেকের পাঠ এলেই যত বিপর্যয়। তখন মনে মনে খুব জেদ উঠেছিল আমার, যদি গানের গলা থাকত তাহলে বিবেক হতাম। কিন্তু তা আর হলো না।

পরবর্তীকালে যতবার যাত্রা মঞ্চায়ন করেছি ততবারই কমবেশি বিবেক চরিত্র নিয়ে সংকটে পড়েছি। আর তখন থেকেই বিবেক নিয়ে ক্রাইসিসের একটা দাগ আমার প্রাণে লেগে গেল। দীর্ঘদিন তা বয়ে বেড়ানোর পর অবশেষে ২০০০-২০১৮ সাল পর্যন্ত আমি কেন্দুয়া, মদন, নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ এ-সকল এলাকায় ঘুরে বেশকিছু যাত্রাপালার বই সংগ্রহ করি। আমার সাথে ছিল স্নেহাস্পদ প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরী। সেও এই সংগ্রহকে সাধুবাদ জানালো। বেশকিছু বই পড়ার পরে মনের দাগ থেকে একটা দায় অনুভব হলো। পাশাপাশি প্রাণকৃষ্ণের তাগাদা ও আন্তরিক সহযোগিতা। তাই সিদ্ধান্ত নেই যাত্রা ও বিবেক সংগীত নিয়ে কাজ করার।

অবশেষে করোনাকালে ঘরে বসে থাকার সময়টা কাজে লাগালাম। হাতের কাছে অনেক অনেক যাত্রাবই। ফলে কাজটা এতটা কঠিন মনে হলো না। তবে গান নির্বাচন করতে গিয়ে দেখলাম অন্যান্য গীতিকারের গানগুলো পালাকার তাঁর যাত্রাপালায় ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সহ অনেকের রচনা, যেমন —

চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।
পাগল হাওয়ায় বুঝতে নারে,
ডাক পড়েছে কোথায় তারে,
ফুলের বনে যার কাছে যাই তারেই লাগে ভালো।
(যাত্রাপালা, সাত পাকে বাঁধা, রঞ্জন দেবনাথ)

বিবেক চরিত্রটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘পাগল’, ‘দরবেশ’, ‘মুসাফির’, ‘যাযাবর’, ‘সন্ন্যাসী’ কিংবা দূত রূপে যাত্রাপালায় আবির্ভূত হয়। যেখানে সঙ্গতি-অসঙ্গতি ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দ ভেদাভেদ গানে গানে ও সংলাপে তুলে ধরা হয়। তাছাড়া পালায় ‘বাঈজি’ চরিত্রেও এ-রকম গানের ব্যবহার রয়েছে।

যাত্রা সমাজ ও জীবনের মৌলিক দলিল। আবহমান বাংলার প্রচলিত কিছু যাত্রাপালার গান, বিবেক চরিত্র ও সংগীতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারাও এ-দলিলের সার্থকতা।
(সংক্ষেপিত) 

COMMENTS

error: