সরকার আমিন : কবিতায় ভাবুকতার মৃদুল হাওয়া || আহমদ মিনহাজ

সরকার আমিন : কবিতায় ভাবুকতার মৃদুল হাওয়া || আহমদ মিনহাজ

ভাষা-প্রকরণে ভাবুকতার মৃদুল হাওয়া বহানোর তরিকায় কবি সরকার আমিন সূচনার দিনগুলো থেকে মরমি জীবনবেদের সাহায্যে নিজের অনুভবকে ভাষা দানে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ‘কবিতা দীর্ঘশ্বাসের মতো আরামদায়ক’ কিংবা ‘ঐ সাদা মোমবাতিটা আমার শ্রদ্ধেয় পীর…দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে নিঃশেষ হতে তার মতো সহজ শর্তে আমি পুড়ে যেতে আগ্রহী।’ — নব্বইয়ের মধ্যলগ্নে আমিনের এইসব দ্বিরুক্তিতে অনেকে চমক খুঁজে পেয়েছিলেন। তিন দশকের কবিতাযাত্রা থেকে অবশ্য প্রমাণিত তারুণ্যের ঝোঁক কিংবা আবেগের তাড়নায় দ্বিরুক্তিগুলো তাঁর কলম দিয়ে নামেনি। তিনি বিশ্বাস করেন সময়-পরিপার্শ্বের জটিলতা ও ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও কবি হলেন সহজ মানুষ এবং নৈরাশ্যের বেদিমূলে ব্যক্তিসত্তার বলিদান তার জন্য কাম্য হতে পারে না। সুতরাং কথার কারবারি কবিকে স্পিরিচুয়্যাল ক্যাথারসিস (spiritual catharsis) বা আত্মিক পরিস্রবণের জায়গা থেকে সরে গেলে চলবে না, এছাড়া বিচিত্র স্ববিরোধ ও দ্বিরাভাসে আবিল মানবসংসারে দীর্ঘশ্বাসকে আরামদায়ক ভেবে মোমবাতির মতো ‘সহজ শর্তে’ পুড়ে যাওয়ার আত্মিক শক্তিতে জারি থাকা সম্ভব নয়।

ভয় ও ত্রাস থেকে নির্গমনের উপায় সন্ধানে মগ্ন আমিনের কবিতা মোটাদাগে হাইকু অঙ্গের জীবনবেদ ও তাও প্রবচনে নিহিত দার্শনিক অনুধ্যানকে কবিতায় প্রাসঙ্গিক করে নিতে এখন স্বস্তি বোধ করেছে। পরিপার্শ্বে বিদ্যমান চিহ্নসূত্রকে দ্বিরুক্তিপ্রবণ পঙক্তির সাহায্যে পাঠের দীর্ঘ চেষ্টা তাঁর সত্তাকে ক্রমশ শুভ ও ইতিবাচক জীবনবেদে উপনীত হওয়ার তাড়া দিয়ে চলেছে বলেই মনে হয়। এই জীবনবেদের উপমা টানতে মোমবাতি, দেশলাই, রেলগাড়ি, চায়ের কাপ, পিঁপড়ে ইত্যাদি চিহ্নসূত্র কবি অহরহ ব্যবহার যান। জীবন-মৃত্যুর দ্বৈরথে ইতিবাচক মধ্যবিন্দুর তালাশ সরকার আমিনকে গত তিন দশক ধরে কবিতায় সক্রিয় রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ সেই কবে লিখেছিলেন :— “দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে? / বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।।  / জ্বলতে দে তোর আগুনটারে, ভয় কিছু না করিস তারে, / ছাই হয়ে সে নিভবে যখন জ্বলবে না আর কভু তবে।।” — রবিগানে মর্মরিত বাণীর মাঝে নিহিত কূটাভাস কবি সরকার আমিনের ভাষাঅঙ্গে লগ্নভরা তারুণ্য থেকে আজো সমানে বহে :—

কিছু কিছু সরল সত্যকে কবরে চাপা দিয়ে
কবরের মাটিতে আমরা বৃক্ষ রুয়েছিলাম
গতকাল সেই বৃক্ষে ফুল ফুটেছে
.           আজ মুর্দার নিঃশ্বাসের গন্ধে
.                                      সূর্য উঠেছে।
(চোখের জলে শ্যাওলা থাকে না)
*
ঘুমাবার সময় নিজেকে জিজ্ঞেস করি
.               ‘কেমন আছো?’
মনে হয় সবগুলো স্লিপিং পিল গিলে খেতে
আটলান্টিকের রাক্ষস জল ছুটে আসছে

নিজেকে জিজ্ঞেস করি ‘কেন বেঁচে আছো?’
ম্যাটার্নিটি হসপিটাল থেকে শিশুর প্রথম কান্না ভেসে আসে।
(বেঁচে থাকার ১টি কারণ)

*
টেবিলে সাজানো ছিল নানা পদের জীবন
বেছে নিতে বলা হলে
.             শেষ পর্যন্ত মৌনই থেকে গেছি…
(স্কচ টেপ দিয়ে হৃদয়ের মুখ বন্ধ করা যায় না)
*
সব জল কি জানে উৎসের যাতনা? ভেসে যাবার মধ্যে আছে
হয়তো কিছু অস্পষ্ট মধু।

জলে ভাসা পিঁপড়ে জানে ভালবাসলে ভেসে থাকতেই হয়।
(জলে ভাসা পিঁপড়ে)

আমিনের কবিতাকে যদি কবির আত্মদর্শন ভাবা যায় তাহলে সেখানে বোনা জীবনবেদকে ভাবিক বিচারে অধ্যাত্মমুখীন আর হৃদয়ের উষ্ণতায় মরমি বলাই সমীচীন। মানবজীবন দুঃখ-সুখের মিলন-সংঘাতের ঘটনায় বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও গতায়ু হওয়ার প্রকোপ প্রবল হওয়ার কারণে নিরাশা ও বিষণ্ণতা থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন হয়। সত্যটি মেনে নিয়ে সরকার আমিনের কবিতা জীবনকে ইতিবাচক মুকুর ভাবতে পাঠককে প্ররোচনা দিয়ে যায়। সময়ের আপতন-নিপতনে হরবখত সেই মুকুর কালশিটেয় ভরে উঠলেও তার খাঁজে-ভাঁজে লুকানো সতেজ দ্যুতি খুঁজে বেড়ানোর নেশা কবিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গতিশীল সময়-পরিপার্শ্বে বিদ্যমান বিচিত্র রুগ্ণতার লক্ষণ থেকে আরোগ্য লাভের বাসনাকে আমিন তাঁর কাব্যের বীজমন্ত্র করে নিয়েছেন। গত তিন দশকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের শিরোনামেও সেটি ধরা পড়ে;—‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’, ‘যাকে খুন করার কথা তাকে দেখে হেসে ফেলি’, ‘চার পাঁচ হাজার পিঁপড়ার দুঃখ’, ‘ব্লেড দিয়ে কেটেছিলে জল’, ‘আত্মহত্যার পরিবর্তে এক কাপ চা খাও’, ‘হৃদয় সাবানের মতো গলে যাচ্ছে’ কিংবা সাম্প্রতিক ‘মৃদু বেদনার হাসপাতাল’ ইত্যাদি শিরোনামের নেপথ্যে বিকার ও ব্যাধির পঙ্কিলে নিমজ্জিত অস্তিত্বকে নর্দমা থেকে টেনে তোলার প্রেরণাদায়ী উৎসাহ পাঠকের চোখে পড়ে। আমিনের কবিতায় সমবেত পঙক্তিমালা কবিসুলভ সূক্ষ্মতা ধরে রাখতে ত্রুটি করে না, তবে প্রেরণাদায়ী বক্তার (motivational speaker) ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝোঁক তাঁর কবিতায় মর্মরিত সূক্ষ্মতার রংকে অনেক সময় স্থূল ও ক্লান্তিকর করে তোলে!

প্রেরণাদায়ী বক্তার অভাব মানবসংসারে কস্মিনকালে ঘটেনি। নব্বই ও পরবর্তী কালপর্বে প্রবল আকারে বিরাজিত চাপা নিরাশা থেকে মানুষকে টেনে তোলার মিশনে নিয়োজিত শত রঙ্গের বক্তাকে পাঠক চারপাশে লীলা করতে দেখে। উদ্বেগ কবলিত যুগের খাটিয়ায় নিজের পতন ঠেকাতে নিরুপায় এইসব বক্তার প্রেরণা-মিশনে মানবসমাজের কী উপকার হয় সেটি নিরূপণ বিরাট ঝক্কির কাজ! কবি সরকার আমিন তাদের দলভুক্ত এমন নয়, তথাপি পাঠক-হৃদয়ে আত্মদর্শনের প্রেরণাদায়ী বার্তা পৌঁছানোর জন্য যেসব অনুষঙ্গকে উপায় ঠাওরান সেখানে ঝাঁকুনিটা কেন যেন শেল হয়ে হৃদয়ে বিঁধে না! ধরা যাক গলায় দড়ি দিয়ে মরবে পণ করেছে এমন লোককে এর পরিবর্তে এক কাপ চা পানের প্রস্তাব, অথবা নিজেকে সুখী ভাবতে অপারগ বান্দার জীবনে আমিন বিরচিত কাব্যেক্তি চিত্তে কতদূর বিচলন ঘটাতে সক্ষম (?),—এমতো জিজ্ঞাসা পাঠকের মনে জাগতেও পারে। কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য সরল,—যতেক ভাষা-অনুষঙ্গের সাহায্যে কবি ইতিবাচক পরিস্রবণে সত্তাকে দ্রবীভূত করার তাড়া বোধ করেন সেগুলো তাঁর নিজের অথবা অনুরূপ জীবনচর্চায় শান দিতে উৎসুক ব্যক্তির জীবনে হয়তো গভীর ছাপ রেখে যায়; এখন কথা হলো ‘হিং টিং ছট’ মার্কা সময়ের কোপানলে দিশাহারা এবং আত্মিক জীবনীশক্তির ইতিবাচক স্বরূপে উপনীত হতে ব্যর্থ মানুষ চারপাশে গিজগিজ করছে, ওইসব হতভাগার পক্ষে কবি-বিরচিত পঙক্তিমালায় সেই ঝাঁকুনি টের পাওয়া কঠিন যেটি তাদের হৃদয়ে জমাট বরফ গলিয়ে দিতে পারে।

ইতিবাচক পরিস্রবণ জীবনের জন্য জরুরি খাদ্য এবং কবিতায় এর প্রয়োগে তিল পরিমাণ দোষ ঘটে না, যদি-না এই প্রয়োগ অর্থস্তরে অপ্রয়োজনীয় ভাবালুতার সঞ্চার ঘটায়! ভাবালুতা দিয়ে জরুরি অর্থ উৎপাদন করা যায়; অর্থ উৎপাদন না করেও ভাবালুতা অনেক সময় মনোরম বিউটি যোগায়; তবে হ্যাঁ, দার্শনিক অনুধ্যানে পাঠককে উৎসাহী করার জন্য ভাবালুতাকে সঙ্গী করা হলে কবিতার অর্থস্তরে বহমান সংবেদন গুরুতরভাবে জখম হলো কি না সে-ব্যাপারে কবির সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সরকার আমিনের কবিতায় সংবেদঘন পঙক্তিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাজপাট বিস্তার করলেও খুব কম কবিতা বয়ানসূক্ষ্মতায় পূর্ণাঙ্গ পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে।

টেকনোশাসিত বিশ্বে দেহ-মনের বিকার-বৈকল্য ও ইলাজ নিয়ে মুনিগণে মতের ভিন্নতা থাকলেও মানুষের জীবনবেদে সুদীর্ঘকাল ধরে অনুপস্থিত আধ্যাত্মিক অনুবেদনকে (spiritual empathy) পুনরায় ফেরত আনার ব্যাপারে অনেকেই সহমত এখন। একুশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের গতিপ্রকৃতি মানবমনের গহিন অলিন্দে ঘুমন্ত অনুবেদনকে জাগিয়ে তোলার তাগিদ বোধ করায় নব্বই বা পরবর্তী দুই দশকের কাব্যভাষায় সহজ অনুভবে স্থিত জীবনবেদকে ফিরে পাওয়ার বাসনা কবিদের কমবেশি উতলা করে যায়। বস্তুপুঞ্জের সন্ধি ও বিচ্ছেদের রসায়নে সৃষ্ট মহাবিশ্বের কাজ-কারবার উপলব্ধির জন্য ফরাসি দার্শনিক র‌্যনে দেকার্তের বাতলে-দেওয়া পন্থাকে তোফা বিবেচনার দিন গতায়ু হওয়ার পথে। শতেক কলকব্জায় জোড়া জগৎ-প্রকৃতিকে দেকার্তে একখান ঘড়ি বলেই ভাবতেন। ঘড়ির প্রতিটি কলকব্জা পরস্পর সংযুক্ত হলেও নিজস্ব নিয়মছকে তারা সেখানে কাজ করে যায়। কলকব্জার বাহারি কারবার একবার বুঝে নিতে পারলে কেল্লা ফতে! তখন কেন তারা একে অন্যে মিলে এ-রকম একখান ঘড়ির জন্ম দিয়েছিল কিংবা ঈশ্বর নামক অতীন্দ্রিয় ব্যাপার নিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার অপ্রাসঙ্গিকতা বুঝে নিতে বেগ পোহাতে হয় না। দেকার্তের ভাবনা বস্তুজগতের ক্রিয়া-পদ্ধতি উপলব্ধিতে কাজ দিলেও বস্তুপুঞ্জ কেন ও কীভাবে কলকব্জায় পরিণত হয়, নিজের অবক্ষয় তারা কেন ঠেকাতে পারে না অথবা অবক্ষয়ের পরে তাদের গতি কী হয় ইত্যাদি প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর পেতে সাহায্য করে না। অগত্যা দেকার্তে থেকে ডারউইন অবধি কালপর্বে আবির্ভূত তত্ত্ব (thesis), প্রতিতত্ত্ব (antithesis) ও উভয়ের সংশ্লেষ থেকে প্রণীত অনুমানসিদ্ধ প্রকল্পনার (hypothesis) প্রভাবে যেসব ভাবনাকে অতীন্দ্রিয় বা অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ভাগাড়ে ফেলার চল শুরু হয়েছিল, বিগত কয়েক দশক ধরে সেগুলোকে পুনর্বিবেচনা ও নবীকরণের আওয়াজ তুঙ্গে উঠেছে। সংগত কারণে আধ্যাত্মিক অনুবেদন পুনরায় সেখানে জায়গা নিয়েছে। নব্বইয়ের কবিতা পাঠে বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন।

মাৎসুও বাশোর বিখ্যাত ব্যাং পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিল কারণ নিজের গন্তব্য ও পরিণতি নিয়ে বেচারার মনে সন্দেহ ছিল না। গন্তব্যের মামলা সময়ের আবর্তে অনিশ্চিত আকার ধারণ করায় বিটনিক অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন হাইকু কপচায় সেখানে ব্যাং বেচারার স্থান হয় ওষুধ রাখার বোয়ামে। নিজ হাতে সাজানো বাগানে শতপুষ্প বিরাজ করলেও তাদের নামধাম কবি মনে রাখতে পারে না! শীতঋতু ঘনীভূত হলে কেবল টের পায় পুষ্প দূরে থাক, বাগানটা তার চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে। পল এ্যালুয়ার যেমন ভাবতে বাধ্য হয়, জীবনের হাওয়া নির্ধারিত ও মীমাংসিত গন্তব্যপানে বইছে মনে হলেও তাকে অমীমাংসিত ভাবার বাতিক মন থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না। বাতাসে দলা-পাকানো সিগারেটের ধোঁয়ার মতো সবকিছু ঘোলাটে এখন! ঘাসে একরত্তি কাঁপন না তুলে জীবন মেঠো ইঁদুরের মতো গর্তে সেঁধিয়ে পড়ে,—ইংরাজ কবি এজরা পাউন্ডের স্মরণীয় কাব্যোক্তি আজোবধি তার প্রাসঙ্গিকতায় অমলিন! জীবনকে ঘিরে আবর্তিত এইসব কাউন্টার-ডিসকোর্সের অভিঘাতকে বিবেচনায় নিলে সরকার আমিনের ইতিবাচক পরিস্রবণে রঙিন দ্বিরুক্তিরা কেমন যেন একরৈখিক ও পানসে লাগে কানে!


নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: