ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার

ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার

কবির দ্বিতীয় কবিতাবই, শিরোনাম ‘ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার’; বইটি ২০১৭ সনের বইমেলায় প্রেজেন্ট করেছে জেব্রাক্রসিং প্রকাশন। যদিও বই প্রকাশিত হয়েছে সে-বছরের জানুয়ারিতে, প্রিন্টার্স লাইনে এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, মেলার হুড়াহুড়ি এড়িয়ে একটা শান্তিশ্রী যত্নের ছাপ বইটার অবয়বে দুর্লক্ষ নয়।

হাসনাত শোয়েব দ্বিতীয় দশকে আবির্ভূত কবি। লিখছেন গদ্য ও কবিতা সমান অভিনিবেশে। এরই মধ্যে ফেসবুকে এবং বাংলা ওয়েবম্যাগগুলোতে এই কবির যুগপৎ গদ্য ও কবিতাবিষয়ক সক্রিয়তা পাঠকগোচরে এসেছে। এর আগে ‘সূর্যাস্তগামী মাছ’ শীর্ষক কবিতাবইটি দিয়ে অভিষেক হয়েছিল হাসনাতের; এইটা কবির দোসরা বালাম। অবশ্য পরে, এরই মধ্যে, এই কবির বোধহয় আরও কয়েকটা বই বেরিয়েছে।

এই বইটা আগাগোড়া গদ্যফর্ম্যাটে লেখা; আর সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংলাপ। গত প্রায় তিন-তিনটে দশক ধরে এই ফর্মটা বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। শোয়েব এক্ষেত্রে নতুন কিছু যোগ করতে পারলেন কি না, নাকি দ্বিতীয় বইতে এসেও অনতিপূর্ববর্তী ডিকেডের কোনো কবির অনুসৃতিতেই বিলীন রইলেন, ব্যাপারটা আন্দাজ করতে চাইলে বইটার কাছে যেতে হবে কবিতানুসন্ধিৎসু পাঠককে।

এমনিতে কবিতাগুলো সুখপাঠ্য। কোষ্ঠকাঠিন্য নাই চিত্রকল্পের বা বাকস্পন্দের। মূলত কনক নামে একটা ক্যারেক্টারের সঙ্গে দেখা হয় পাঠকের, বইটার পাতা বেয়ে আগাতে যেয়ে, সেই কনকের সঙ্গে কবির কথোপকথার ধাঁচে ন্যারেটিভ গড়ে উঠেছে গোটা বইয়ের। ভিন্ন ভিন্ন নামে একতিরিশটা কবিতা আঁটানো হয়েছে সাকুল্যে আড়াইফর্মা ব্যাপ্তির দৃষ্টিনন্দিতা আকৃতির বইটার ভিতরে। হরফবিন্যাস ও পৃষ্ঠাসাজসজ্জা প্রশংসনীয়।

দুয়েকটা কবিতা থেকে দৈবচয়িত অংশবিশেষ উঠিয়ে এনে এখানে দেখানো যায়, যেন খদ্দেরের আগ্রহটা বাড়ে বইক্রয়ের। যেমন একটা কবিতা পাওয়া যাচ্ছে ‘বুলগেরিয়ার রাজধানীর নাম হয় সোফিয়া লরেন’ শীর্ষ দিয়ে, যেখানে রয়েছে এহেন মজার কিছু কথাগুচ্ছ :

বুলগেরিয়ার রাজধানীর নাম সোফিয়া জানার পর, আমার সোফিয়া লরেনের কথা মনে পড়ে। সোফিয়া লরেনের ডাকনাম টুথপিক। একদিন মাংস খাওয়ার পর দাঁত খিলাল করার সময় মনে হয় সোফিয়া লরেনকে দিয়েই দাঁত খিলাল করছি। এরপর থেকে প্রায় মাংস খেতাম সোফিয়া লরেনকে দিয়ে দাঁত খিলাল করার লোভে। এভাবে পৃথিবীর বহু মাংসল প্রাণীকে হত্যা করা হলো।

কবিতাটার সূচনাস্ট্যাঞ্জাটাই উল্লেখ করা হলো, গোটা কবিতায় এবং গোটা বই ব্যেপে এমনতর মজা ছড়ানো রয়েছে। যেমন ‘হাওয়াই গিটার’ কবিতার ইন্ট্রোপ্যারা হাতে নেয়া যাক :

আমার মনে পড়ছে সেইসব কান্নার কথা যা আমি আর তুই একসঙ্গে কেঁদেছি। মনে আছে সেই নর্থ ডাকোটার রোদের কথা। আমরা দুজনের কেউই ডাকোটা দেখিনি অথচ পৃথিবীর সবকটি শহরের নামে আলাদা রোদের নাম দিয়েছি। একদিন ফনিক্সের সেই সাইকেলের পিছনে আমাকে নিয়ে উড়ে গিয়েছিলি ট্যাটুবন অবধি। আমার সারা পিঠে রক্তকরবীর শেষ দৃশ্য এঁকে দিয়েছিলি। মা খুব বকেছিল। আমি মায়ের খোঁপার ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলাম পঁচিশ পয়সার দুইটা মুদ্রা। কেন জানি না তুই আমার নাম দিয়েছিলি অর্থ। কেন?

চমক-মোড়ানো কথাবার্তায় এগিয়ে চলে বইটা, খানিক অর্থ-অনর্থ রহস্যদোলাচলে, পাঠকের তরতরিয়ে পড়ে যেতে আদৌ কোনো ভোগান্তি হয় না। পাঠশেষে পাঠক কন্সিডার করতে প্ররোচিত হবেন কবিতাগুলো কি স্মার্ট উচ্চারণের কাব্যঘেঁষা ফানমেইকিং আইটেম হলো, মজামাস্তিতেই মিইয়ে এল বুঝি বিকেলের আলোটুকু, চমকেই ফুরায়ে এল কি চালচিত্র, নাকি ভিন্নতর দ্যোতনায় ফ্লাইট সম্ভবপর হতে পারল?

সংখ্যায় বেশ কয়েকটি ইংরেজি গানের নামোল্লেখ পাওয়া যায় হাসনাতের কবিতাগুলোর নানান জায়গায়, গিটারস্ট্রিংস্ আর রকমিউজিকের তালে হেডব্যাঙ্গিং ইত্যাদি জিনিশের উল্লেখ তো প্রায় লাইনে লাইনে। ফেয়ারোয়েল অ্যাঞ্জেলিনা, বাই বাই বিউটিফ্যুল, কাম্ সেপ্টেম্বর, নভেম্বর রেইন, এবং সর্বোপরি ‘বেস্ট অব ব্রায়ান অ্যাডামস’ তো বটে। সেসব অবশ্য অচিন কিছু নয়, অত্যন্ত প্যপুলার গানগুলোরই শ্রোতা হাসনাত, কাজেই পাঠক ভড়কানোর কিছু নাই কিংবা আঁতকে উঠে শোয়েবের কবিতাবই থেকে দূরে সরে দাঁড়ানোরও কিছু নাই।

কিন্তু কথা হচ্ছে, সেইসব গানের নামাবলি কিংবা রকগানের প্রতিটি ছত্রে-শব্দে উচ্চারিত প্রণয় কি নিরর্থ ধ্বনিবিজড়িত উচ্চারণেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়, নাকি দিগন্তে কোথাও অন্যতর উদ্ভাস জাগাতে পারে? একদা ক্যাটালগিং পোয়েট্রি ছিল বাংলায়, শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের বিশালাংশ কবিতা তালিকায়ন তরিকায় ঢের পরিমাণে ফেঁপেছে-ফুলেছে এবং আশ্চর্যের নয় যে জনপ্রিয়ও হয়েছে সেসব তৎক্ষণাৎ, দেখতে হবে যে হাসনাত শোয়েবের কবিতায় এবং বলা আপাতত বাহুল্য যে একই দশকের আরও অনেক আপাতস্মার্ট কবিদের কবিতায় সেই ক্যাটালগিং ক্রাইটেরিয়াটা আবারও ঘুরছে কি না। যা-ই হবে তা আপাতত বাংলা কবিতার ভবিতব্যজ্ঞানে দ্রষ্টব্য। শোয়েবের কবিতার বইটি নিশ্চয় পাঠকটেবিলে আরোহণের যোগ্য।

কবি হিশেবে হাসনাত শোয়েবের সিদ্ধি বিচার করতে আগ্রহী রিডার সবাইকে যেতে হবে জেব্রাক্রসিং প্রকাশিত ‘ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার’ বইটার কাছে। জেব্রাক্রসিং প্রকাশনীটাও শুরু করেছে বেশিদিন হয় নাই, এই ২০১৭ বছরেই, এই নতুনের কেতন কতটা উড্ডয়নক্ষম তা-ও পরখ করা যাবে জেব্রাক্রসিঙের প্রকাশিত বইগুলোর উৎপাদনমান হাতে নিয়ে দেখলে।

বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। বইয়ের গায়ে ধার্য হাদিয়া ১২০ টাকা। ঢাকা থেকে ২০১৭ অব্দে এইটা পাব্লিশড।

প্রতিবেদন / সুবর্ণ বাগচী

… …

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you