… এক ব্যাটার আখখেতে আখ চুরি করতে ঢুকেছে তিনজন — একটা ব্রাহ্মণ, একটা শূদ্র আর একটা মুসলমান। খেতের মালিক আইসা ভাবে — তিনজনের লগে একা পারা যাইব না। তখন সে ব্রাহ্মণ আর শূদ্ররে ডাইকা বলে, আপনেরা নাইলে হিন্দু মানুষ, এই ব্যাটা মুসলমান আখ খায় কেন? তারে ধরেন। এইভাবে মুসলমান গেল। তখন বলে, ঠাকুর মশাই, আপনে নাইলে বামুনের ব্যাটা, কিন্তু এই শুদ্দুর হারামজাদা আখ খায় কেন? এইভাবে শূদ্র গেল। তখন সে বলে, ওরে শালা বামুনের পো, পাইসি তোরে একা।
মাথার উপরে ঝোলানো গল্প-উদ্ধৃতিটা আমি রীতিমতো কপি নিয়া রাখলাম ওয়ার্ডপেইজে। সেপ্টেম্বর মাসে, দুইহাজারপনেরো সালে, ফেইসবুকে এই জিনিশটা পেয়েছিলাম কবি অর্পণ দেবের টাইমলাইনে। এনগেইজড হয়েছিলাম সেখানকার কমেন্টে। সেই এনগেইজমেন্ট থেকেই নিবন্ধটির উৎপত্তি হয়েছে।
এইটা তো জনগুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য, গল্পাংশটুকু, সংসদে এই বিল ‘পঠিত বলিয়া গণ্য হইল’ মর্মে কোনো স্পিকারই পাশ কাটাইতে পারবেন না, আদ্যোপান্ত না-শোনা পর্যন্ত খামোশ বলবেন না কেউ। যত বেরসিক স্পিকার মাননীয়ই হোন-না-কেন, যত রসকষহীন লিস্নার, এই জিনিশ না-শোনা তক তিনি মাইক্রোফোন স্যুইচ-অফ করতে পারবেন বলিয়া মনে হয় না। তা, আমি নিজের কথা বলতে পারি অবশ্য যে, এরপর থেকে কারো আখক্ষেতে প্রবেশিবার আগে কায়দা পাল্টে একটু নবায়ন করে নেব স্ট্র্যাটেজিটা। আফটার অল, পরের ক্ষেতের ইক্ষুপানে নজর না-দিয়া লাইফ কাটাইবার মতো সন্ত মনে হয় এ-জিন্দেগিতে হতে পারব না আর, চেষ্টা কার-না থাকে বলেন! তবু, গল্পের শিক্ষা পাবার পর, জারা সামহাল-কে। অ্যানিওয়ে। গগনহাস্য।
অট্টহাস্য মিইয়ে এলে যেইটা ভাবায় সেইটে এ-ই যে, দেখুন কী দুর্ধর্ষ জনবুদ্ধিবৃত্তি আমাদের! ম্যাস্-ইন্টেলেক্ট ব্যাপারটা সবসময়ই এমন যে, এর সঙ্গে অধীত বিদ্যার জোরে-জবর্দস্তিতে সুগঠিত/দুর্গঠিত বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে পেরে-ওঠা মুশকিল। খনার বচন বলুন, অথবা তারও অগ্রে যুগযুগান্তর ধরে গড়ে-ওঠা আখ্যান-পূরাণ-রূপকথা-প্রবাদপ্রবচন-ডিঠান প্রভৃতিতে যে-জিনিশটা পাই আমরা, তা এ-ই তো, ম্যাস্-ইন্টেলেক্ট বলি বা জনবুদ্ধিবৃত্তি কি লোকবোধ, মোদ্দা হিসাবে এ-ই তো। ছয়শ বত্রিশ পাতার একটা মাথাগাট্টা-পাছাভারী রিসার্চ প্রোজেক্ট খাড়া করায়ে একদল কর্নফ্লেক্স ও মিল্কশেইক খেয়ে বেড়ে-ওঠা ভালো মেধাবাহক শিক্ষার্থীদিগেরে ফিল্ডওয়্যর্কে লেলিয়ে এটা-ওটা পাইচার্ট-বার্ডায়াগ্রাম বসায়ে অনেক ভুংভাং ফুটানি মেরে সেরে দিনশেষে যে-অশ্বডিম্ব পয়দাই, থিসিস-স্যুপারভাইজ্যরের বা প্রোজেক্টহেডের বাড়ে তাতে চেকনাই-আশনাই, কিন্তু অশ্বডিম্বে ব্রেকফাস্টও হয় না বিধায় মুর্গিডিম্ব লভিবার মানসে ফের পোল্ট্রিশেডের পানে ধাবিত হই, ফের একখানি রিসার্চ প্রোজেক্ট মুসাবিদা করিবারে নেমে পড়ি মালকোচা মেরে, এবং থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় ঘুরিফিরি।
তিন-তিনজনের সঙ্গে এই নিকষিত হেম নিয়া আলাপ করেছি, নিবন্ধটপে যে-এপিগ্র্যাফিক গল্প ঝুলিয়েছি, তিনজনের প্রত্যেকেই বিজ্ঞ ও বিদগ্ধ বয়োঋদ্ধ কলিগ আমার, তিনজনেই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভার্শন উপহার দিয়েছেন এই টেক্সটের। মোদ্দা জায়গাটা অলমোস্ট একই, কিন্তু উপস্থাপন ভিন্ন এবং প্রত্যেক উপস্থাপন আলগ-আলগ ভ্যালু অ্যাড করেছে বৈকি। এই এক মজা আমাদের লোকায়তিক জ্ঞানকাণ্ডের, একই ন্যারেটিভ নানামাত্রিক ডালে-উপডালে প্রেজেন্ট করার সুবিধা। ডালপালাগুলো শখের বশে তৈয়ার করা না একদমই, মাইন্যুটলি নিরখিলে একেকটা ডালের সনে একেক এলাকার আদিগন্ত শর্তপরিস্থিতি সংশ্লিষ্ট রয়েছে দেখা যাবে। অ্যারিয়া-স্পেসিফিক নেসেসিটিগুলো, ভৌগোলিক বিশেষ ফোকাসিং ইত্যাদি এসব শাখাপ্রশাখাগুলোকে দেখনভঙ্গি-বলনভঙ্গি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এবং স্মৃতিনির্ভর ও শ্রুতিবাহিত হওয়ার কারণে এই জ্ঞানকাণ্ড কতিপয় ইউনিক ফিচার অধিকারে রেখেছে। একটা যেমন এর নলেজ-ট্রান্সফর্মেশন প্রোসেস, যেহেতু এটি স্ক্রিপ্টেড জিনিশ না কাজেই এর ওপর কোনো চাপ নাই আরোপনের, এইটা আপনাআপনি স্থান-কাল-পাত্রের প্রয়োজনীয় নবায়ন-সম্পাদনসমূহ নিজের ভেতরে অ্যাকোমোডেট করে নিতে জানে। বেইসিক ফর্মেশনের ব্যাঘাত-বিচ্যুতি না-ঘটিয়েই এইটা তার সময়ের চিহ্ন ও স্থানিকতা জায়গা দেয় টেক্সটের শরীরে, এর সেচ্যুরেশনশক্তি অনেক বেশি। এমনকি স্পিকারভেদে, ডেলিভারিভেদে, এর ব্যঞ্জনাগুণ বেড়ে যায় অধিকতর।
ম্যাক্রো লেভেলে এইধারা জ্ঞান উৎপাদন ও প্রয়োগ হয়ে আসছে এফেক্টিভলি, সিন্সিয়ার্লি, নিরবধি আবহমান। ফলে এইধারা মাইক্রোন্যারেটিভগুলো সংগৃহীত হলে বেনিফিট অশেষ। সংগ্রহণকালে একে ক্লাসিফায়েড নলেজের মর্যাদায় নিতে হবে, নির্বিচার চুটকি-কৌতুকীগুলো পৃথক রেখে। সেসব কৌতুকী ভিন্ন অধ্যায়ে নিশ্চয় মূল্যবহ। তো, আমাদের আদিকালীন পূর্বজদের উইট ও হিউম্যর মেইকিং কোয়ালিটি, তাদিগের পোলিটিক্যাল উইজডম প্রভৃতির তারিফ না-করে তো আমরা পার পাই না।
তা যাক, এই লোকায়ত শ্রুতিবিভূতিপূর্ণ গল্পে একটি বিশেষ পেশাজীবী গোষ্ঠীকে হেয় প্রতিপন্ন করা হলো কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটা চারসদস্যবিশিষ্ট কমিশন বসতে পারে। পেশাগোষ্ঠীটি বিজনেস কম্যুনিটি। কিন্তু যদি কৃষক বলিয়া রায় দেয়া হয় কমিশন থেকে, সেক্ষেত্রে অবশ্য অভিযোগ থাকে না। কারণ প্রোডিউস্যর গোষ্ঠীর সেইফটিনেট তার বুদ্ধিবিবেচনা ছাড়া আর-তো কিছু না। ব্যবসায়ীদিগেরে অবশ্য ফড়িয়া-মাঝস্বত্বভোগী বলি না আমরা, চায়না-থাই ইলেক্ট্রোনিক গুডস এনে দেশের বাজারে বেচে পকেটে মার্জিনপ্রোফিট ঢুকানো ছাড়া তো ওরা ব্যবসা সেই-অর্থে করেও না আমাদের দেশে। ইধার-কা মাল উধার-ম্যে করা কমার্স আমাদের। হায় চাঁদবেনের দেশ! কোথায় সেই সপ্তডিঙা মধুকর, আর কোথায় এই জমিদালাল-ভূমিখেকো-বনখেকো-ক্ষুদ্রঋণখেকো খোকাবাবুদের কাড়াকাড়ি-মারামারি! কৃষক তো দিগন্তে বিলীন, কিষাণী তো আকাশলীনা আজকাল। পাট পটল তুলেছে সেই কবে, পেঁয়াজ-সর্ষে যাই-যাই, ধানটা আছে দানবিক জিএম উচ্চফলনশীলার সুবাদে বৈচিত্র্যহীন বর্ণগন্ধসোয়াদহীন বেঁচে। সে-ও অচিরে যাবে বিদেশি ধানচাল আমদানীর পার্মিটখানা পাইয়ে দেয় যদি ঈশ্বরে।
এবং রইল বাকি এক ইক্ষু, তথা আখ, কুশিয়ারের চাষ। সিলেটের লোকজন ডাকে কুইয়ার নামে। রাজশাহী গিয়েছিলাম, রসালরাজ্যি, আমবাগানের পাশাপাশি আখবাগান অনেক দেখেছি আমি দু-নয়ন মেলে। কেরু কোম্প্যানিটারে যদি ডানা মেলে উড়তে দেয়া হতো, আহা, দ্রাক্ষারসের বদলে স্বর্গের বেভারেজ হিশেবে ইক্ষুরস শতগুণে উমদা তাহে নাহি সন্দেহ বলিয়া রসাস্বাদকের অপিনিয়ন। দর্শনা হতে পারত দুনিয়ার নেভার্ল্যান্ড, আখচাষীরা হতে পারতেন দ্য মার্চেন্ট অফ য়্যুনিভার্স। হতে তো কতকিছুই পারত ও পারতে ও পারতিস ও পারতাম ও পারতেন। হলেন যা তা তো রোজ নজর করছি।
জাহেদ আহমদ ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
- যখন অন্ধকার, বাপ্পা মজুমদার - October 23, 2025
- একটা পাখি, হিচককের নয়, লটকনগাছের - October 21, 2025
- মঁসিয়ঁ মু য়্যু - October 18, 2025

COMMENTS