কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’  || সুমনকুমার দাশ

কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’  || সুমনকুমার দাশ

আগেকার দিনে তো দশ-বারো গ্রাম কিংবা পুরো এলাকা ঘুরে একজন চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যেত না। তাই গ্রামীণ সমাজে ওঝা, কবিরাজ, তান্ত্রিক, মওলানারাই বৈদ্যের ভূমিকা পালন করতেন। ঝাড়ফুঁক-মন্ত্র-দোয়া-তাবিজ ইত্যাদির সাহায্যেই নতুন-পুরাতন রোগ সারানোর কাজ সারতেন বৈদ্যরা! বর্তমানে গ্রামের পরিবেশ পাল্টেছে, সেখানে শিক্ষার হার বেড়েছে, তাই কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাস আগের মতো নেই। এ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য কবিরাজ-তান্ত্রিকনির্ভরতাও কমেছে। গ্রামীণ মানুষেরা সচেতন হওয়ায় সামান্য রোগশোকেও এখন চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় সঙ্গত কারণেই কবিরাজ-তান্ত্রিকদের পেশা ক্রমশ বদলাচ্ছে। সেই পেশা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ওইসব কবিরাজ-ওঝা-তান্ত্রিক-মওলানাদের লোকচিকিৎসা পদ্ধতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।


গ্রামীণ লোকচিকিৎসাপদ্ধতি কতটুকু আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত — সেটা এ লেখার বিষয়বস্তু নয়। এখানে কেবল লোকসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে তন্ত্রসাধকদের নানা ধরনের লোকচিকিৎসাপদ্ধতির কিছু বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।

তান্ত্রিক সাধক-কবিরাজেরা রোগ তাড়াতে মন্ত্র প্রয়োগ করতেন। ভূত-প্রেত তাড়ানো এবং ভয় পাওয়া সহ নানা ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের তাবিজ বেঁধে দিতেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী তান্ত্রিকেরা শ্রীমদভাগবত গীতা কিংবা কোনো শাস্ত্রের শ্লোক এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী মওলানারা কোরানের আয়াত কাগজে লিখে সেটা তাবিজে ঢুকিয়ে মোম দিয়ে সেঁটে দিতেন। আবার একই কাজে উপশমের জন্য একশ্রেণির সাধকেরা ‘বশীকরণ মন্ত্র’ প্রয়োগ করতেন।

স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া কিংবা প্রেমঘটিত সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব দূর, যৌনসমস্যা সহ নানা ক্ষেত্রে কিছুসংখ্যক শাক্তসাধক ও তান্ত্রিকেরা ‘বশীকরণ মন্ত্র’ প্রয়োগ করতেন। গ্রামীণ সমাজ-সংস্কৃতিতে এই ‘বশীকরণপদ্ধতি’ ব্যাপক জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই পদ্ধতি প্রয়োগ এবং ব্যবহার কমে এলেও একেবারেই যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। যেহেতু ‘বশীকরণপদ্ধতি’ গ্রামীণ সংস্কৃতিতে অতি প্রচলিত, তাই ‘বশ করা’, ‘বাণ মারা’, ‘সম্মোহন করা’  — এসব শব্দের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষ কমবেশি পরিচিত। আর শক্তিসাধক, সন্ন্যাসী অথবা কবিরাজরা এই বশপ্রক্রিয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। তাঁদের অধিকাংশই মূলত কোকা পণ্ডিত রচিত ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ বইটির আলোকে মন্ত্র এবং তন্ত্রের প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকেন।

গ্রামীণ লোকসমাজে অধিকাংশ তন্ত্রসাধকেরা কোকা পণ্ডিত রচিত ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ গ্রন্থটির উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করছেন। অনেক তন্ত্রসাধক ও কবিরাজ এ গ্রন্থের আলোকে সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মন্ত্র/তাবিজ ব্যবহার করে থাকেন। ধূর্ত কবিরাজদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে গ্রামীণ নিরক্ষর সহজ-সরল মানুষেরা অহরহ প্রতারণার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তবে এসব মাথায় রেখেই লোকসমাজে গ্রন্থটির ব্যাপক আবেদনের কথা বিবেচনায় রেখে এ লেখার অবতারণা।


‘কোকা পণ্ডিতের বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ — এ নামেই বশীকরণ প্রয়োগ সম্পর্কিত একটি বই দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালি গ্রামীণ সমাজে আদরণীয় হয়ে আসছে। এ বইটি মূলত ভারতীয় নানা তন্ত্রশাস্ত্র হতে সংগৃহীত মন্ত্র-তন্ত্র-শ্লোকের সংকলিত রূপ। ৩২টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ বইটিতে শক্তিধর ব্যক্তির বশীকরণ মন্ত্র, পুরুষ বশীকরণ প্রয়োগ, স্ত্রী বশীকরণ মন্ত্র, দেহরক্ষার মন্ত্র, গর্ভধারণের মন্ত্র, শত্রু-বশীকরণ মন্ত্র, প্রেত বশীকরণ মন্ত্র, সর্ববাধা নিবারক প্রয়োগ, মালিক-চাকর-কর্মচারী বশীকরণ প্রয়োগ, দূরদেশে যাওয়া ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনার বশীকরণ প্রয়োগ, প্রভাবশালী বশীকরণ প্রয়োগ, পতি-পত্নীর মধ্যে প্রেম বৃদ্ধি, প্রেমিক-প্রেমিকা আকর্ষণ, পশুপক্ষী বশীকরণ, ধনী ব্যক্তিকে বশীকরণ করার জন্য মায়ামন্ত্র, প্রেমে পাগল করার জন্য মন্ত্র, বিবাহ বাধা নিবারণের জন্য মন্ত্র প্রয়োগ, রোগমুক্তির জন্য মন্ত্র প্রয়োগ, ধনসম্পদ-সুখ-সমৃদ্ধি-ঐশ্বর্য প্রাপ্তির জন্য মন্ত্র, সর্বদা সধবা থাকার মন্ত্র — এ-রকম কয়েক হাজার সমস্যার সমাধানে নানা মন্ত্র-তন্ত্রের কৌশল/প্রয়োগ রয়েছে। আগেকার দিনে অশিক্ষিত/নিরক্ষর মানুষেরা রোগশোক-হতাশা-অপ্রাপ্তিতে শক্তিসাধক, সন্ন্যাসী, কবিরাজ, মওলানাদের দারস্থ হতেন। ঐতিহ্য-পরম্পরায় তাঁরাও কোকা পণ্ডিতের বৃহৎ ইন্দ্রজাল অনুযায়ী বৈদ্যের ভূমিকা নিয়ে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক দেওয়ার পাশাপাশি কবচ-তাবিজ প্রদান করতেন। এভাবেই কোকা পণ্ডিত ও তাঁর রচিত বৃহৎ ইন্দ্রজাল বইটি সুদীর্ঘকাল ধরে গ্রামীণ লোকসমাজে অনন্য স্থান দখল করে রেখেছে।

সাধকেরা বিশ্বাস করেন, প্রকৃত সাধনার সর্বশেষ স্তর হচ্ছে বশীকরণ-পদ্ধতি। কোনো ভ্রষ্ট-ভণ্ড বা অসাধক কখনোই এ প্রক্রিয়ায় পৌঁছাতে পারেন না। যোগ্য ও লোকহিত চিন্তাবিদ গুরু/সাধক ছাড়া মন্ত্র-তন্ত্রপদ্ধতি প্রকৃত সুফল নিয়ে আসে না। তাই বশীকরণ-প্রক্রিয়া যথাযথভাবে তিনিই সফল প্রয়োগ করতে পারবেন, যিনি প্রকৃতই সাধক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।


অবাধ্য স্ত্রীকে বশ করে নিজের অনুগত কিংবা বাধ্যগত করতে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করলে যথাযথ ফল পাওয়া যায় বলে বৃহৎ ইন্দ্রজাল গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। এক্ষেত্রে একটি খিলিপান হাতে নিয়ে ২১ বার মন্ত্র প্রয়োগ করতে হবে। মন্ত্রটি এ রকম — ‘হরে পান হরিয়ালে পান / চিকনী সুপারী শ্বৈত খৈর / দাহিনে কর চুনা / মোহি লেয় পান / হাথ মে দে / হাথ রস লে / এ পেট মে ইয়া / পেট রস লে / শ্রী নরসিংহ বীর / থারী শক্তি / মেরী ভক্তি / ফুরে মন্ত্র / ঈশ্বর মহাদেব কী বাচা।’ তবে মন্ত্রটি প্রয়োগের পূর্বে দশ হাজারবার ওই মন্ত্র জপ করে এবং ১০৮ বার ওই মন্ত্রের মাধ্যমে আহুতি দিয়ে পুরো মন্ত্রদান-পদ্ধতিটিকে সিদ্ধ করে নেওয়ার রীতি রয়েছে। আর এ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারলেই কেবল স্ত্রী-বশীকরণ প্রক্রিয়ায় ফলাফল নিশ্চিত হবে।

একইভাবে কাগজে নানা রকম বশীকরণ নকশা অঙ্কন করে রূপা/পিতল/তামা/লোহার তাবিজে ঢুকিয়ে তা বিভিন্ন কৌশলে সিদ্ধ করে প্রয়োগ করার রীতি বৃহৎ ইন্দ্রজাল গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। আবার রাশি অনুযায়ী রত্ন ব্যবহারের নানা বিধিও এ-গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে।


প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। তাই নানা ধরনের কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাস গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপনে আচার-সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে যায়। সমাজে অনেকটা ব্রাত্য হিসেবে পরিগণিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা জীবনের নানা অপ্রাপ্তিকে অলৌকিক পন্থায় সমাধান করতে চান। আর এ জন্যই তাঁরা সাধু-সন্ন্যাসী-মওলানা-কবিরাজদের দারস্থ হতেন। এসব সাধু-সন্ন্যাসী-মওলানা-কবিরাজদের অনেকেই ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে ঝাড়-ফুঁক ও কবচ-তাবিজ করে মানুষের চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা করতেন। কথায় আছে — ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। তাই কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করে এসব ব্রাত্য মানুষদের অনেকে ইতিবাচক ফলও পেতেন। যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় দুর্বল মানুষেরা কখনোই সবলদের বিপক্ষে লড়াই করার মানসিক ক্ষমতা রাখতেন না। তাই তাঁরা অলৌকিক বা বিশেষ পন্থায় ক্ষমতাশালী-শোষক-নিপীড়ক-ধনী-প্রভাবশালী-ক্ষমতাবানদের পরাজিত করার কৌশল খুঁজতেন।এ-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই তাঁরা সন্ন্যাসী-মওলানা-কবিরাজদের দ্বারস্থ হতেন। একইভাবে রোগশোক-দুর্ভোগ-অশান্তি থেকেও মুক্তি পেতে ভুক্তভোগীরা তন্ত্রসাধকদের শরণাপন্ন হতেন। আর এ কারণেই ঐতিহ্য-পরম্পরায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে তন্ত্রসাধক-শেণির একটা আলাদা কদর ধারাবাহিকভাবেই তৈরি হয়েছে।

আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে অবৈজ্ঞানিক হিসেবে মনে করা হলেও গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে এই লোকচিকিৎসাপদ্ধতিগুলো বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে চলেছে — এটা নিঃসন্দেহে বলাই যায়। কোকা পণ্ডিতের ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ গ্রন্থটি একই সঙ্গে উর্দু, হিন্দি, বাংলা, সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় প্রকাশ হওয়ার বিষয়টি এ ধারণাকেই পাকাপোক্ত করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক চিকিৎসা-পদ্ধতির উত্থানে তান্ত্রিক সাধক/গুরুদের সামাজিক অবস্থান ক্রমশই তলানিতে ঠেকেছে। সঙ্গত কারণেই এঁদের অনেকেই পেশাবদল করে এখন নানা পেশায় ঢুকেছেন। আর এতে করে লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you