অন্যান্য অপারেটর নয়, মার্কেটে এছাড়া আরও অন্তত দশ/বারো অপারেটর রয়েছে যাদের বিজনেস্ বছরভর চলে এবং যারা রাষ্ট্রীয় বহুবিধ রেয়াতি সুবিধাপ্রাপ্ত, প্রতিষ্ঠান ও জনপারিমণ্ডলিক সমর্থন ও মদদে পুষ্ট, সেসব নয়, এই নিবন্ধে কেবল রবি অপারেটর নিয়া আলাপ সঞ্চালিত হতে চলেছে। এর বাইরে যেসব অপারেটর রয়েছে, এর মধ্যে যেমন কাজী অপারেটরের নামোল্লেখ করা যায়, সেসব নিয়া আলাদা সাপ্লি রিলিজের নেসেসিটি নিশ্চয় আছে। এই দুই অপারেটরের কার কত সাবস্ক্রাইবার, ইন্ মিলিয়ন্ গ্রাহকসংখ্যাটা কত অথবা সাবস্ক্রিপ্শন্ অলরেডি বিলিয়ন্ ছাড়ায়ে গেছে কি না, এখানে সেসব তথ্যালোচনা আমরা চালাতে চাইছি না। কাল্ট বলতে যা বোঝায়, ইন্ বেঙ্গলি, লিটারেরি কম্যুনিকেশন্ বিজনেস্ সেক্টরে এরা ফাংশন্যাল্ সমস্ত অর্থেই জায়ান্ট একেকটা কাল্ট। তবে দেশের টেলিকম্যুনিকেশন্ বিজনেসে যেমন বিটিটিবি ছিল মনোপোলি কিছু বছর আগেও, গত দুই দশকে সেখানে অ্যাট লিস্ট আট/নয়টা সার্ভিস্-প্রোভাইডার বাজারে এসেছে, প্রত্যেকেই পৃথক সাবস্ক্রাইবার রেজিম্ গড়ে তুলেছে ছোট-বড়-মাঝারি রেইঞ্জের, একচ্ছত্র বিটিটিবিকে এখন কম্পিট করে যেতে হচ্ছে এদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত। রবিকেও কম্পিট করতে হচ্ছে, কম্পিটিটরদের বিজনেস্ পোর্টফোলিয়োও মোটাতাজা হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যবহ ও সমানুপাতিক স্ট্যাটাসে। এতকিছুর পরেও, রবির কিংবা বিটিটিবির, রাষ্ট্র অথবা সাংস্কৃতিক মোটাগাট্টা প্যাট্রনশিপ্ সত্ত্বেও উভয়ের ব্যবসাগত কোয়ালিটি কিংবা কোয়ান্টিটি ঠিক কোন পজিশনে, এই নিবন্ধে সেসবের উত্তর মিলছে না। সাবস্ক্রাইবারদের স্যাটিসফেকশন্ লেভেলের কোনো জরিপও এখানে করা হচ্ছে না। আপন শক্তিতে জ্বলে ওঠার স্লোগ্যান্ নিয়া বাণিজ্য কতটা ভালো হচ্ছে না-হচ্ছে সেসব কিচ্ছুটিরই ফিরিস্তি এইখানে পাওয়া যাবে না। সাপ্লিমেন্টারি অন্ রবি অপারেটর মুখ্যত এই রচনার সাবটাইট্যল্ হতে পারে। কেবল রবি বিষয়ক কতিপয় আশকথা-পাশকথা, তা-ও গোছানো অতটা না, আর তারচেয়েও অধিক উৎক্ষিপ্তভাবে এসেছে ইমার্জিং নব্য লগ্নিকারক যারা লিটারেরি কম্যুনিকেশন্ ডোমেইনে ক্যারিয়ার বিল্ড-আপ্ করতে চেষ্টাশীল অধুনা, নানাবিধ শ্রমনিষ্ঠ ও শ্রমবিমুখ ফন্দিফিকিরে একটা অ্যাগ্রেসিভ বিজনেসে স্টেইক্ বাগাতে মত্ত যারা, তাদেরে নিয়া কিছু কন্সার্ন। উদ্বেগের কারণ ও ব্যাখ্যাবিস্তারণ মোটেও কোনো গবেষণাসমর্থিত নয়, নিছক মনগড়া, বানোয়াট। মোটামুটি ডিসক্লেইমার এবং ওয়ার্নিং বিসমিল্লায় দিয়ে থুয়ে এগোনো সততাসম্মত। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের যারা সম্ভাব্য দর্শক, অতএব, পোস্টস্ক্রিপ্ট পেরিয়ে ভেতরগলিতে প্রবেশের আগে স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেবেন নিশ্চয়।
২
আমার মতে আমার শেষ কর্তব্য হচ্ছে, যে-লেখাগুলিকে মনে করি সাহিত্যের লক্ষ্যে এসে পৌঁছেছে তাদের রক্ষা করে বাকিগুলিকে বর্জন করা। কেননা, রসসৃষ্টির সত্য পরিচয়ের সেই একমাত্র উপায়। সবকিছুকে নির্বিচারে রাশীকৃত করলে সমগ্রকে চেনা যায় না। … অরণ্যকে চেনাতে গেলেই জঙ্গলকে সাফ করা চাই, কুঠারের দরকার। …
বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কথাগুলো, শ্রী ঠাকুর তো বলাবলির কাজে চ্যাম্পিয়ান্; বাংলায়, এবং বাংলার বাইরেকার গোটা দুনিয়ায়, বলাবলিকাজে ঠাকুরের জুড়ি খুঁজে বের করা যাবে না এমন নয়, কিন্তু কাজটা ওই অমিতজির ‘ডন’ ম্যুভিতে ডেলিভার-করা ডায়লগ ‘ডন-কো পাকাড়-না মুশকিল নেহি, না-মুনকিন হ্যায়’-এর মতন মামলা। বাংলার ঠাকুরসদৃশ হিম্মতওয়ালা সাহিত্যিক গ্রিক-লাতিন-ইতালিয়ায় তালাশিয়া দেখা যাবে না তা নয়, তালাশিয়া দেখা যায় এবং তালাশতদন্তকর্ম অত্যানন্দময় হবে সন্দেহাতীতভাবেই, কিন্তু তন্নতন্ন খুঁজেমেগে অ্যাট-দ্য-এন্ড-অফ-ডে অসম্ভব হবে পাওয়া। তাছাড়া ঠাকুর পাকড়ানো দুই-মিনিটের নোটের/নিবন্ধিকার প্রোজেক্ট না। গাট্টাগোট্টা হাজারখানেক প্রতিষ্ঠানই তো রয়েছে এমন যেগুলোর দিবারাতির প্রকল্পকম্ম এইটাই, ঠাকুরধরা, ঠাকুরভজা। কাজেই দরকারও নাই, নিশ্চয়, আমাদের ন্যায় প্রাইভেট ডিটেক্টিভদের হেন প্রোজেক্টে শামিল-সংশ্লিষ্ট হওয়া।
ব্যাপার হচ্ছে কি, মানে যেইটা নিয়া আজাইরা আলাপে-ঝালায় এই টকটকানি-বকবকানি, সেইটাই বলি। বিগত বছর-সাতেক ধরে এই অ্যামেচারিশ ডিটেক্টিভ আর তার এক বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীর মধ্যে ঠাকুরগান ও কবিতা নিয়া নানা আলাপালোচনা সংঘটিত হয়ে আসছিল, সেইগুলোর মধ্য থেকে একটা আলাপের চুম্বকাংশ গড় করলে যে-ফল দাঁড়ায় এইখানে নিবন্ধিকার এই এপিসোডে তা-ই প্রেজেন্ট করা যাচ্ছে। ব্যাপারটা ঠাকুরকবিতা নিয়ে, সেই সহকর্মীর সঙ্গে এই ইশ্যু নিয়ে একসময় ঢের কথাবার্তা হয়েছে। এইটা তার একটা ড্রিমপ্রোজেক্ট ছিল ওইসময় যে তিনি ঠাকুরকবিতার একটা ‘মার্গীয়’ চয়নিকা করবেন। মানে, বেছে বেছে তিনি ঠাকুরকবিতার জেমজেলিটুকু ছোটখাটো মলাটের মধ্যে এঁটে ওঠাবেন। তো, ওই প্রোজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট করার মুরদ তার আছে কি না, বা তিনি শেষমেশ কোন কাননে যেয়ে ফুটায়েছিলেন ফণিমনসাফুল কিংবা আমড়াফ্রুট, সেইটা আলাদা আলাপ। ঘুরেফিরে একটা ঠাকুরকাব্যের অ্যান্থোলোজি প্রণয়নের নেসেসিটি নিয়া আমাদের মধ্যে আলাপসালাপের এক-পর্যায়ে তিনি একটা প্ল্যানও করে ফেলেন, ড্রাফ্ট প্ল্যান্, যুগপৎ কোয়ান্টিটেইটিভ ও কোয়ালিটেইটিভ উভয় অ্যাস্পেক্ট থেকে প্ল্যানটা হাইপোথেটিক্যাল্ লেভেলের, কোনো ব্যাখ্যা না-দিয়াই প্ল্যান্ মুসাবিদা ও পেশ করা হয়েছিল। পরিকল্পনায় প্রকাশ, আমার সেই সহকর্মী তার পরিকল্পিত রবিকাব্যচয়নবহির কলেবর দেড়-দুইফর্মার মধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারবেন বলে ভেবে রেখেছেন, কবিতাসংখ্যার হিসাবে গোটা-পঞ্চাশেক আইটেমের মধ্যে আঁটানো সম্ভব সেই নির্বাচিতা। ব্যাপারটা, অ্যাট-লিস্ট এত কম সংখ্যার ভেতরে রবীন্দ্রকবিতা বাছাই করে ওঠাটা, খানিক নয় বরং অতিশয় উচ্চাভিলাষ এবং এতে করে অবিচারের আশঙ্কা প্রকট। হয় অবিচার, নয় নির্বিচার, এই দুই কারবার ঘুরেফিরে বারেবারে জুটেছে রবীন্দ্রনসিবে। কপাল রবির মন্দ তাতে সন্দেহ কী! অ্যানিওয়ে। এত অজস্র কবিতা-গান থেকে বেছে কোনো সংকলন করতে গেলে পূর্বনির্ধারিত কোনো সংখ্যায় কুলিয়ে ওঠা যাবে না তা এক-প্রকারে ধরেই নেয়া যায়। আমাদের সেই সহকর্মী তবু অনড়। প্রোজেক্ট যেদিকে যায় যাবে, কিন্তু নিজের প্ল্যান্ তিনি ভাঙবেন না। খানিক মচকানো বরদাশত করা যেতে পারে, করতেও রাজি তিনি স্বীয় পরিকল্পনা আরও অধিকতর লক্ষ্যাভিমুখী করার স্বার্থে, প্ল্যান্ ভাঙা যাবে না কোনো ওজর-অজুহাতে। এবং তিনি তার পছন্দ-অপছন্দের যুক্তিও ক্রমে প্রকাশ করেছেন বটে। সেইটা আপাতত কথানুষ্ঠানে কাভার করা যাচ্ছে না।
কাকতালীয় হোক অথবা অন্য কোনো গোলতালপাকা কারণে সেই-সময় একটা ঘটনা ঘটে। যে-সময়ে এই কথাগুলো/পরিকল্পনাগুলো করছিলাম, সেই-সময়েই বাজারে এই একই চিন্তাজাত রবীন্দ্রকবিতার একটা বই বের হয়। দে’জ প্রকাশনাগার কলকাতা থেকে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থপ্রবাহিকীর আওতায় ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ শিরোনামে সেই বইটি বাজারে ওঠে বছর-কয়েক আগে। এইটে সম্পাদনা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রয়াণের বছর-তিন আগে এই কাজটা করেন তিনি, ইয়াদ হয় যেট্টুক। বইয়ের কলেবর আড়াই-শ’ পৃষ্ঠা মেরেকেটে। সেখানে, সেই বইয়ের ভেতরে, গুনে দেখেছি যে প্রায় ১৭৫টা কবিতা নির্বাচন করেছেন সুনীল, ভুয়া ম্যাটম্যাটে একটা ভূমিকাসমেত। ভূমিকা পড়ে এবং কবিতাগুলোর উপস্থিতি দেখে বিরক্তিতে বোবা হয়ে যেতে হয়েছিল সুনীলের অ্যাভারেজ্ কবিতাবাছাই আর নন্দনবিবেচনা ঠাহর করে। এত গড় স্ট্যান্ডার্ড সুনীলপ্রযুক্ত বাটখারা-পাল্লাপাত্থরের! কুঠার এত ভোঁতা! ঠাকুরের ভালো কবিতাগুলো সরিয়ে একপাশে রেখে বেছে-বেছে আজেবাজেগুলোই যেন সুনীলের অ্যান্টেনায় ধরা পড়েছে এবং ঘটা করে সেগুলো বড়তর প্রকাশঘর হইতে বেরও হয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ’ তিলক কপালে কেটে, এইটা আজব এক তিলিসমাতি মনে হয়েছিল। অথচ এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং উনার তৎকালে-তরুণ কবিবন্ধুবৃত্ত সক্কলে মিলে কৃত্তিবাসকালে একলাথিতে রবীন্দ্ররচনারাশি পাপোশে ফেলে দেবার ন্যায় বীরদর্প দেখায়েছেন। কত দেখলাম এই একজীবনে, বুঝলেন খালা-মামা-আঙ্কেল-আন্টি, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এন্ডিয়া-পাকিস্তান হয়ে এই বাংলাদেশ অব্দি। সেই দেখাদেখি নিয়া আরেকপ্রস্থ বলা যাবে বাদ-মাগ্রেব। “শোনো মুমিন-মুসলমান(ও) / করি আমি নিবেদন(ও) / এ-দুনিয়া ফানা হবে / কিসুই রবে না …”, আজ্ঞে, হ্যাঁ, সেইটাই।
৩
‘সন্ধ্যাসংগীত’, ‘প্রভাতসংগীত’ ও ‘ছবি ও গান’ এখনো যে বই-আকারে চলছে, একে বলা যেতে পারে কালাতিক্রমণ-দোষ। বালক যদি প্রধানদের সভায় গিয়ে ছেলেমানুষী করে তবে সেটা সহ্য করা বালকদের পক্ষেও ভালো নয়, প্রধানদের পক্ষেও নয়। এও সেইরকম। ঐ তিনটি কবিতাগ্রন্থে আর-কোনো অপরাধ নেই, কেবল একটি অপরাধ — লেখাগুলি কবিতার রূপ পায় নি। ডিমের মধ্যে যে শাবক আছে সে যেমন পাখি হয়ে ওঠেনি — এটাতে কেউ দোষ দেবে না, কিন্তু তাকে পাখি বললে দোষ দিতেই হবে।
এই কথাগুলো সঞ্চয়িতাপ্রারম্ভিকায় শ্রী ঠাকুর বলছেন, ভূমিকাপাতায়, কবিস্বাক্ষরিত ভূমিকাপাতার নিম্নবামে মার্জিন ঘেঁষে সাং-তাং দেয়া আছে — শান্তিনিকেতন / পৌষ ১৩৩৮। ঘটনা হলো, ঠাকুরের টনটনে অ্যান্টেনা; কাণ্ডজ্ঞান, কমনসেন্স বলি আমরা বাংলায় যে-ব্যাপারটাকে, সেইটেই ভিনভাষায় কাণ্ডজ্ঞান; রবির গুদামে এইটা সাধারণের চেয়ে একটু অধিক পরিমাণে ছিল বলেই তিনি শ্রী শ্রী রবিন ট্যাগোর, ওয়ার্ল্ডোয়াইড মশহুর। জ্ঞানবুদ্ধির ঢেঁকি ছিলেন রবি, এমন নয় কিন্তু; রবির আমলে জ্ঞানের গোঁসাই বিস্তর ছিলেন ভূভারতবর্ষে, এবং বঙ্গজ গোঁসাইদিগের সর্বজনগ্রাহ্য শুমার করা জাহিরি কোনো পরিসংখ্যানগণিতের সাধ্যির অতীত বটে, যেমনটা আজও। রবির কাণ্ডজ্ঞান তারে জ্ঞানগুণ্ডা হইতে দেয় নাই। দুনিয়ায় আখাম্বা জ্ঞানজীবী হাজারে-হাজার কাতারে-কাতার, শুমার করিলে দেখিবা তাদিগের জ্ঞান পগারপার, আর অসহনীয় অপরিসীম বঢ়েমিয়াঁ-ছুটেমিয়াঁদের জ্ঞানগুণ্ডামি। কিন্তু গুণ্ডামি দিয়া ঠাকুরের নাড়িভুঁড়ি প্যাঁচানো সম্ভব হইলেও কবিতা/গানের বুঁড়ি ছোঁয়া প্রায় অসম্ভব।
এই নিবন্ধে একটা ব্যাপার দেখতে চেষ্টা করা যাক, সেইটে এ-ই যে, ঠাকুর স্বয়ং নিজের কবিতার একটা বড় অংশ সম্বন্ধে শেইকি ছিলেন, কিংবা, কি বলা যায়, তেমনটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না বলেই মনে হয় যতটা ছিলেন নিজের গানের ব্যাপারে। গানের ব্যাপারে রবি ছিলেন কনফিডেন্ট এনাফ। বলেছেনও যে তার কবিতা ভুলে গেলেও মহাকালের বাঙালিকে তার গান তিনি শুনিয়েই যাবেন; এবং যাচ্ছেনও তা-ই। রবিরচিত সুরের সংশ্রয় ব্যতিরেকে বাঙালির বছর শুরু হয় না, জাতীয় অনুষ্ঠানাদিতেও রবির ভর। মরে যাবার পর মোটামুটি পঁচাত্তর পার হয়েছে। এখন যতটা রবিগান শুনি আমরা, ঠাকুরকাব্য ততটা পড়ি দাবি করলে ডাহা মিছে বলা হবে। সেয়ানা ছিলেন টেগোর, আপনার-আমার চেয়ে একটু বেশিই সেয়ানা, আমি-আপনি বিরক্ত হয়ে উঠিবার আগেই তিনি নিজের খামতিগুলো বুঝেছেন ও স্বীকারও করেছেন যথাসাধ্য। খণ্ড-খণ্ড রবীন্দ্ররচনাসমগ্র হাতাবার দরকার কি, আমরা তো জ্ঞানী, কে না জানে যে জ্ঞানীদের জ্ঞানভাণ্ডার বইয়ের বড়জোর ভূমিকা বা ব্লার্ব/ফ্ল্যাপ্ নির্ভর করে গড়ে ওঠে। কাজেই আমরা খামাখা খাল কেটে রবীন্দ্রসমুদ্রে না-যাই। সঞ্চয়িতার ভূমিকা দিয়া জ্ঞানের গ্যাসবেলুন উড়াই আকাশে।
যে-কবিতাগুলিকে আমি নিজে স্বীকার করি তার দ্বারা আমাকে দায়ী করলে আমার কোনো নালিশ থাকে না। বন্ধুরা বলেন, ইতিহাসের ধারা রক্ষা করা চাই। আমি বলি, লেখা যখন কবিতা হয়ে উঠেছে তখন থেকেই তার ইতিহাস।
স্পষ্টত রচনার দুইটা পর্যায়ের দিকে রবি এইখানে পয়েন্টার-উচ্ছ্রিত আলোরশ্মি প্রক্ষেপণ করতে চাইছেন। রচনার লেখাপর্যায় এবং রচনার কবিতাপর্যায়। এখন তো ওসবের বালাই নাই, ওইসব চুকেবুকেছে, লিখে ফেলে এত খুঁটিয়ে দেখবার বা ভাবনাচিন্তা করবার অবকাশ বা অভিপ্রায় কোনোটাই লেখকের আছে বলিয়া মনে হয় না। আজকাল আপনি নিজের লেখা নিজে থেকে স্বীকার-অস্বীকারের হকদার না বিলকুল। আপনার গাঁইগুঁই প্রকাশ করার মওকাই পাবেন না আপনি। নিজে জেনে উঠিবার আগে আপনার পিতা/পিতৃব্যস্থানীয় প্রতিষ্ঠান জেনে যাবে কোনটা আপনার অভিপ্রেত পথ ও পন্থা। তা যতই আপনার বারোটা বাজাক, প্রতিষ্ঠান ডিসাইড করবে আপনি কি কিংবা আপনি কি নন। শুধু প্রতিষ্ঠান জানলেই কিছুমাত্র ক্ষতির ছিল না আপনার জন্য, উপরন্তু দুনিয়াসুদ্ধু লোকেরে সে নানাভাবে জানায়ে দেবার আঞ্জাম সেরে নেবে আপনার ‘আসল চেহারা’, তা যতই ভুল চেহারা বা আপনার নিজের কাছে আপতিক/অনভিপ্রেত হোক-না-কেন, উদ্ভট ও ক্ষতিকর কস্মেটিক্সপ্রসাধিত হোক-না-কেন, পুরস্কার বা পৃষ্ঠ-ও-পশ্চাদ্দেশ চাপড়ানোপ্রক্রিয়ায় সে আপনার মঞ্জিল-এ-মগডাল আঙুলের ডগায় এনে দেবেই দেবে অবিলম্বে। এরপর থেকে এই ভুল/শুদ্ধ মগডালে, এই সোনার খাঁচায়, ঢেঁকুর তুলে আর ছটফটিয়ে যেতে হবে আপনাকে। সেইটা অবশ্য যদি লেখকের ঈপ্সিত পরিস্থিতি হয়, তাহলে ব্যাপারটা ঠিকই আছে। লেখা আদৌ কবিতা হয়ে-ওঠা বা কাগের ডিম বগার ডিম কি হইল না-হইল, অত নকশি চিন্তার বেইলই নাই এখনকার লিখুয়াদের, আর যাদের খানিক লেখা নিয়া ভাবাভাবির শখাহ্লাদ আছে তাদিগের পাছায়/পেখমে পূরীষতেলে-চোবানো মুর্গাপাখির পালক বুলিয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর শান্তিনিদ্রা পাড়ানো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। রবীন্দ্রনাথ হওয়া, মানে ওই নিজেই টেগোরের চেয়েও স্বরাট ঠাকুর্দাপ্রতিষ্ঠান হওয়া, যা-ও খোলা আছিল আগে, যেভাবেই হোক রবিরে হাংরি-কৃত্তিবাসীদের ন্যায় বেমক্কা গালিগালাজ দিয়া, তা-ও রুদ্ধ ক্রমে; এখন রবিরে গালি দিলেও পুরস্কার তথা মাতারি প্রতিষ্ঠান, রবিরে সোহাগি কিস্ খাইলেও পুরস্কার তথা প্রতিষ্ঠান। মোদ্দা কথা বাঙালি আর লায়েক হইয়া উঠিল না। যাইতে রবি, আইতে রবি, অন্য অপারেটরদের বিজনেস্ ভাতের মাড়। দুঃখে হিন্দি কিংবা বাংলা অথবা দুই ভাষারই চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে জনৈক মধ্যযুগীয় মরাহাঁজা কবি গোঙাইয়া ওঠেন : রে বেঙ্গলি, তুই বালেগ ভইলি নে!
ইতিহাস-রক্ষার খাতিরে এই সংকলনে ঐ তিনটি বইয়ের যে-কয়টি লেখা সঞ্চয়িতায় প্রকাশ করা গেল তা ছাড়া ওদের থেকে আর-কোনো লেখাই আমি স্বীকার করতে পারব না। ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ সম্বন্ধেও সেই একই কথা। ‘কড়ি ও কোমল’-এ অনেক ত্যাজ্য জিনিশ আছে, কিন্তু আমার আদর্শ অনুসারে ওরা প্রবেশিকা অতিক্রম করে কবিতার শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। … এরকম সংকলন কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না। মনের অবস্থা পরিবর্তন হয়, মনোযোগের তারতম্য ঘটে। অবিচার না-হয়ে যায় না।
তা, ঠাকুরের আমলে এইসব ছিল বটে, এই দ্বিধা, এই ডিলেমা, দোদুল্যমানতা। এইগুলো রোম্যান্টিক এলিমেন্ট। বটে! এখন সব্বাই বাঘের বাচ্চা। সাচ্চা হোক আর ঝুটা হোক, বাঘের বাচ্চা তো বাঘের বাচ্চাই, তাই না? কাজেই কিসের দ্বিধা? কিসের দৈন্য? কিসের বিনয় কিসের ভয়! হাওয়ার বাঘ, হাওয়ার সিংহ, হাওয়ার হনুমানরঙ্গ। হও আগুয়ান, হো বুড়ো-ও-নওজাওয়ান, কমেন্টে কমেন্টে পার করো গুষ্ঠিকিলানো জীবন। দুনিয়ায় তুমিই তুমি, বাকিরা তো সব ছারপোকা, ওগো তোমারও লাগিয়া মহাকালের মা-বাপ-ভাইবহিন মিলিয়া ওয়েইট করতিছে ইটার্নিটি ইশটিশানের গুমটিঘরে। আরও দুই-তিনটা গাইল পাড়ো কষে, নিউজফিডে-স্ট্যাটাসস্পেসে দুই-চাইরটা নিরুদ্দিষ্ট চ-বর্গীয় ধ্বনিবিশিষ্ট পইদ্যফুল, প্রতিষ্ঠান পটানোর ওইটাই নির্ভরযোগ্য তরিকা, পাঠক পটানোর তরিকা আলগ অবশ্য, ওদিকপানে যাবার তো দরকারও দেখিনে বাপু!
যাঁরা আমার কবিতা প্রকাশ করেন অনেক দিন থেকে তাঁদের সম্বন্ধে এই অনুভব করছি যে, আমার অল্প বয়সের যে-সকল রচনা স্খলিত পদে চলতে আরম্ভ করেছে মাত্র, যারা ঠিক কবিতার সীমার মধ্যে এসে পৌঁছয় নি, আমার গ্রন্থাবলীতে তাদের স্থান দেওয়া আমার প্রতি অবিচার।
এই অবিচারটাই করতে দেখেছি ট্যাগোরকবিতা সংকলনাকারে বের করতে গেছেন যারা তাদের প্রায় সক্কলকেই। সুনীল গাঙ্গুলির বিচার এক্ষেত্রে ‘দি ওর্স্ট’ বলে যারে বাংলায়। এর আগে এমন কাণ্ড এমনকি হুমায়ুন আজাদকেও করতে দেখব আমরা; আজাদের বিচারতরিকা সম্পর্কে বেশ খোলাসা জানা যায় বিশেষণবহুল তার ভূমিকাগদ্য থেকে; সহস্রাধিক পৃষ্ঠার ঢাউস কলেবরে তিনি সম্পাদনা করেন ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা’, খোদ ঠাকুরের অপত্য স্নেহবাৎসল্যলভিত সঞ্চয়িতার চেয়েও হুমায়ুন আজাদের ‘প্রধান’ বিশেষণবিশিষ্ট সংকলনখানা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠতে দেখি সাইজে, ওমিগড! মূলের চেয়ে দ্যাখো বটগাছের ঝুরিঝুলের দৈর্ঘ্য মহা! আজাদের অবতরণিকা অবশ্য রোম্যান্টিকদের সম্পর্কে বেশ কথাবার্তা খর্চে এবং পঞ্চাশোত্তর আজাদের পরিবর্তমান মানসজগতের মায়াবী তোলপাড় কবুল করে নিয়েই প্রণীত, সুনীলের ন্যায় ম্যাটম্যাটে ভাতমাড়গোছের আনন্দবাজারবাণিজ্যিক বেহুদা ভূমিকা না। আগ্লি-বারে-ম্যে এই নিয়ে, লেট’স্ সি, যায় কি না কথা বলা ট্রাই করে দেখব।
৪
রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটি সংকলন রয়েছে — চয়নিকা (১৯০৯) ও সঞ্চয়িতা (১৯৩১); এর মধ্যে প্রথমটি বিলুপ্ত, দ্বিতীয়টি সুপরিচিত। সঞ্চয়িতা যদি পরিতৃপ্ত করত আমাকে, তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা সম্পাদনার দরকার হতো না। সঞ্চয়িতা রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভালো সংকলন, তবে এটি রবীন্দ্রপ্রতিভাকে ঠিকমতো ধারণ করে না। এটিতে বাদ পড়েছে বহু উৎকৃষ্ট কবিতা, এবং সংকলিত হয়েছে বহু সাধারণ কবিতা। তাই আমি তৈরি করতে চেয়েছি এমন একটি সংকলন, যা হবে সঞ্চয়িতার বিকল্প, যাতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলো সব পাওয়া যাবে সহজে। এর নাম প্রধান কবিতা রেখেছি, শ্রেষ্ঠ কবিতা রাখি নি; কেননা শ্রেষ্ঠ কবিতা গুটিকয় হ’তে পারে, কিন্তু প্রধান কবিতা প্রচুর। প্রধান কবিতা বলতে বোঝাতে চেয়েছি তাঁর সেসব কবিতাকে, যেগুলোতে তাঁর প্রতিভার উৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটেছে। গানও বাদ দিই নি, কেননা কবিতা হিশেবে তাঁর গান অসামান্য।
অবতরণিকার শেষ অনুচ্ছেদের আগের অনুচ্ছেদে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা সংকলনগ্রন্থের, এই কথাগুলো হুমায়ুন আজাদ জানাচ্ছেন আমাদেরে। ক্ল্যারিফিকেশন্ পাওয়া যায় বেশ ভালোভাবেই, গোটা অবতরণিকা জুড়ে, কেন ও কোন তরিকায় সম্পাদিত হয়েছে এটি। এবং এই ব্যাপারটাই মিসিং সুনীলসম্পাদিত সংকলনে। এরপর উভয় গ্রন্থের ভেতর ধৃত কবিতাগুলো চোখ বুলিয়ে গেলে টের পাওয়া যাবে আজাদের সম্পাদনা অনেক বেশি হৃদয়স্নিগ্ধ ও মননপ্রদীপ্ত, অনেক বেশি ব্যক্তিক, অন্যদিকে সুনীলসম্পাদনা বাজারশাসিত এবং সবচেয়ে আপত্তির ও অবাক-করা ব্যাপার যে ব্যক্তি সুনীলকে সেখানে একদমই পাওয়া যায় না। ম্যাড়ম্যাড়ে ভাতের মাড় ভূমিকাটার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ সুনীলের হাত গলিয়ে এর আগে অন্যতর বিষয়োপজীব্য অনেক উৎকৃষ্ট সম্পাদনা আমরা পেয়েছি স্মরণ হবে, সংকলিত কবিতাগুলোর দশা তো অকতব্য। দুই বইয়ের কোনোটাই হাতের কাছে নাই, থাকলে বেশ তোফা আলোচনসভা টাইপের একটা-কিছু হতো নিশ্চয়, অগত্যা ঠারেঠোরে চালায়ে যেতে হচ্ছে কথাযান। আমরা এখানে আজাদের অবতরণিকা থেকে টোকা নিচ্ছি, সহস্রাধিক পৃষ্ঠা-কলেবরের সেই সংকলনগ্রন্থ থেকে নয়, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ থেকে তাঁর, হুমায়ুন আজাদের ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ বইটা বাংলাদেশর ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। আমাদের হাতে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সনে বেরোনো প্রথম প্রকাশ রয়েছে, যেটি আজাদের জীবৎকালে ছাপা, এরপরেও বইটির একাধিক সংস্করণ বেরিয়েছে, বলা বাহুল্য।
সুনীলের রবীন্দ্রকবিতা সম্পাদনা বইটি পড়ে এহেন সন্দেহ হবেই আপনার যে, এটি সুনীলের সম্পাদনা না মনে হয়! — কেননা, আগেই বলেছি, অনেক উন্নত সম্পাদনার নিদর্শন সুনীল দেখিয়েছেন আগে; কেননা, বাজারি জনতোষণ ইত্যাদি যা-কিছুই থাক বা না-থাক, সুনীলের কাণ্ডজ্ঞান, তাঁর সাহিত্যিক অন্তর্দৃষ্টি ও সজ্ঞা, ইত্যাদি সম্পর্কে সন্দেহপ্রশ্ন এমনকি তাঁর অতিবড় শত্রুও তুলবে না বোধহয়। এবং তদুপরি, সর্বোপরি, ছিলেন তিনি কবি। বাংলায় কনফেশন্যাল্ পোয়েট্রি প্রবর্তনে, আত্মস্বীকারোক্তিধারার কবিতা রচনকৌশল পত্তনিতে, সুনীল পথিকৃৎ একজন। কাজেই সুনীলের নির্বাচিত রবীন্দ্রকবিতা, তাঁর ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ, ওই-রকম ডাইলে-চাউলে বেয়াক্কলি খিচুড়ি হতেই পারে না। আপনার মনে হতে পারে এমনটা। আগাগোড়া আনন্দবাজার ক্যারিয়ারের অসংখ্য থোড়-বড়ি-খাড়া কাণ্ডকর্মের ভেতর সুনীলের শেষদিককার এই স্খলন রীতিমতো হতভম্বকর। গোটা বই স্কিপ-থ্রু করে গেলেও মনে হবে আপনার যে, এ তো হবুচন্দ্র মহারাজের গবুচন্দ্র মন্ত্রী! — যেন রবি হিংটিংছট ছাড়া আর-কিচ্ছুটি লিখিয়া যান নাই জিন্দেগিতে! এখন, আপনি সুনীলপক্ষ টেনে বলতে পারেন, হতেই পারে এমন যে ব্যক্তিগতভাবে সুনীল তাঁর শৈশবতাড়িত প্রৌঢ় বয়সে এই কবিতাগুলো দিয়াই তাড়িত অধিক। হতে পারে, কিন্তু জনসমক্ষে ব্যক্তিগত পক্ষপাত প্রকাশের ক্ষেত্রে, বিশেষত সম্পাদনার দায় নিয়েছেন যখন আপনি কোনো স্টোলোয়ার্ট কবির বেস্ট পোয়েম্স, তখন তো ন্যূনতম একটা-কোনো কৈফিয়ৎ হাজির রাখবেন লোকের সামনে। সেসবের ধার দিয়াও সুনীল যান নাই। ভূমিকাপাতাগুলোতে হারাম একটা লাইনও খর্চা করেন নাই কেন তিনি শ্রেষ্ঠ কবিতা ব্যানারের তলে রবির এহেন সর্বনাশ ঘটাইলেন, কেন মুমূর্ষু কবি রবিরে আরও মুমূর্ষু তথা ছড়াকার রবি বানাইলেন। রবিসাহিত্যের অ্যাডাল্ট রিডারদের কথা বেমালুম ভুলিয়াই তিনি সম্পাদিয়া গিয়াছেন রবিশ্রেষ্ঠ কবিতার শৈশবতাড়িত (মতান্তরে মালিকতাড়িত/বাজারতাড়িত) অহেতু সংকলন এক।
হুমায়ুন আজাদ এক্ষেত্রে দায়িত্বনিষ্ঠ, সম্পাদনাদায়বোধসম্পন্ন, উনার একান্ত নিজস্ব কায়দায়। সেখানে আপনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, অবতরণিকা থেকে শুরু করে গৃহীত প্রতিটি কবিতায় এমনকি ছত্রে-স্তবকে, হুমায়ুনচৈতন্যের পরিচয় হাজির পাচ্ছেন; সঙ্গে ফের পাঠক হিশেবে নিজের ভোটাভুটিক্রিয়াও সম্পন্ন করে নিতে পারছেন আপনি, পারছেন স্বীয় পছন্দ-অপছন্দগুলোর সঙ্গে আজাদীয় কেতার বিশেষণশ্বাসরুদ্ধ অহমিকাজাত অতিপ্রশংসা মিলিয়ে নিতে। আজাদপ্রণীত অবতরণিকা, ঝাড়াই-বাছাইয়ের পরেও প্রধান কবিতা হাজার পাতা, তাঁর টীকাটিপ্পনী-নির্ঘণ্ট সবকিছু উদ্বোধিত করবে আপনাকে আজাদসম্পাদনার সঙ্গে লিপ্ত হতে, বইটার সঙ্গে বাহাসে যেতে। সেদিক থেকে সুনীলের সম্পাদনা মামুলি, নির্জীব, নিষ্কাব্যিক, নিস্তেজ, নিরুত্তেজ, নিরাবেগ, নিরুদ্যম, নিশ্চরিত্র। রবির এমনিতেই হুমকিমুখো কবিতাব্যবসার বারোটা বাজানো সুনীলসম্পাদনাখানা আদিকাল-থেকে-গালিগালাজ-সয়ে-কায়ক্লেশে-বেঁচে-আসা ঠাকুরের অস্তিত্ব অধিকতর সঙ্কটাপন্ন করে রেখেছে। এর অন্তত, সুনীলঘটনার সূত্রপাতের হিসাবে, বছর-সাত আগে হুমায়ুন আজাদের প্রধান রবীন্দ্রকবিতার সংকলনাটি সম্পাদিত হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। সেখানে কেমন সম্পাদনা, একটা সংক্ষেপিত নজির দেখা যাক :
রবীন্দ্রনাথ বিব্রত ছিলেন তাঁর প্রথম দিকের কবিতা নিয়ে, কড়ি ও কোমলকেই তিনি স্বীকার করেছিলেন প্রথম প্রকৃত কাব্য হিশেবে। কিন্তু তিনি এর আগের চারটি কাব্য থেকে সাতটি কবিতা নিয়েছিলেন সঞ্চয়িতায়; আমি নিয়েছি আগের তিনটি কাব্য থেকে পাঁচটি, সন্ধ্যাসংগীত থেকে কোনো কবিতা নিই নি। এ-সংকলন শুরু হয়েছে, আমি সুখী, প্রভাতসংগীত-এর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ দিয়ে। তার পরের কাব্যগুলো থেকে নেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণে কবিতা, বিচিত্রিতায় এসে সংখ্যা কমেছে, কিন্তু শেষ দিকে আবার বেড়েছে। লিপিকার গদ্য রচনাগুলোকে কবিতা হিশেবে প্রশংসা করা আমাদের অনেক দিনের স্বভাব, কিন্তু তাঁর কাব্যসংকলনে এর থেকে কবিতা নেয়া হয় না; আমি নিয়েছি তিনটি কবিতা, যদিও এগুলো গদ্যের মতো বিন্যস্ত; এবং শিশুদের জন্য লেখা কবিতাকেও আমি উপেক্ষা করি নি।
তো, এইভাবেই, হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রকবিতা সংকলিত করতে যেয়ে হাজারপাতা বরাদ্দকরণের বেশ একটা কৈফিয়ৎই দিয়েছেন, যেইটা আজাদের তরফ থেকে বলা যায় বিরল বিবেচনাবোধের প্রকাশ। বিরল, কেননা আজাদ চিরকাল একপেশে, একদেশদর্শী, একদম নিজের ধরনে তাঁর বিদ্রোহ ও প্রথাবিরুদ্ধতা; আজাদের বিচারসালিশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় ধসানো, নয় উঠানো; ধসানো ও উঠানো, আজাদের আলোচনাস্টাইলে, দুই-ই অভিন্ন উৎসসঞ্জাত, দুই-ই একই জিনিশের অভিন্ন উৎসারণ বলে মনে হয়, জিনিশটা আবেগ — অতিবিশেষায়িত পরিস্থিতি প্রণয়নপূর্বক এক উপভোগ্য আবেগ — আজাদের আবেগ বহুলাংশে বহির্বাস্তবতার চাপপ্রসূত, ফলে এর আপাত যুক্তিফাটলগুলো অথবা তার ব্যাখ্যাঘাটতি সহসা সমক্ষে আসে না, আজাদের প্রাবন্ধিক রচনা পাঠোপভোগ্যতার দিক থেকে চমৎকার, আজাদ পাঠোত্তেজক ও অনুসন্ধিৎসা জাগৃতির অনুঘটকও বটে। এইসব অন্যতর প্রসঙ্গ। এইখানে প্রাসঙ্গিক এইটুকুই বলা যে, রবিবিবেচনায় আজাদের স্বতঃপ্রণোদিত কৈফিয়ৎমূলক অবতরণিকাটি রচনা হিশেবে স্বয়ম্প্রকাশ ও স্বব্যাখ্যাত। মনে পড়বে যে, আরম্ভজীবন থেকে শুরু করে শেষ-দশকে আলোচ্য প্রধানকবিতা সম্পাদনার পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে অজস্রবার অজস্রভাবে আক্রমণ করেছেন আজাদ, অবশ্য সেই আক্রমণে বহির্বাস্তবতা ও অন্তর্বাস্তবতা দুইয়েরই চাপ ছিল, সমানুপাতিক না-হলেও উভয় চাপ থেকে রবীন্দ্রাক্রমণগুলো শানিয়েছেন তিনি, স্বীকার করব আমরা। তিরিশি পাঁচ আধুনিক দেবতামুগ্ধ হুমায়ুন আজাদ প্রচুর গালিগালাজও করেছেন রবীন্দ্রনাথকে, নজরুলের বিরুদ্ধে ব্যাপারটা প্রায় বিষোদ্গার হলেও রবীন্দ্রনাথে খানিক রয়েসয়ে, নজরুলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কার্যত বাহ্যিক চাপ ও বহির্বাস্তবতা সামলানোর/মোকাবেলার ব্যক্তিক প্রেরণা। আজাদের এই পরিবর্তন সূচিত হতে দেখা যাবে একটা বিশেষ বয়স-সন্ধিক্ষণে, এবং ব্যাপারটা এতই ব্যক্তিক ও রক্তজারিত যে আজাদ তা স্বীকারও করেন অননুকরণীয় সিন্ট্যাক্সে। একটা, বা একাংশ মাত্র, উদ্ধৃতি :
প্রস্তুত হচ্ছি যখন পঞ্চাশ হওয়ার জন্যে, এবং খুব সুখী বোধ করতে পারছি না, তখন ঘটলো এ-অসামান্য অভিজ্ঞতাটি। ধীরশান্তভাবে প’ড়ে উঠলাম তাঁর চার হাজারের মতো কবিতা ও গান; মনে হলো ধন্য হচ্ছে আমার ভোর, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত্রিগুলো; আমার মেঘ, শিউলি, জ্যোৎস্না, অন্ধকার; আমার প্রত্যেক মুহূর্ত, প্রতিটি তুচ্ছ বস্তু। পড়ছিলাম ও অনুভব করছিলাম ঢুকছি এমন এক বিশ্বে, বিশ্বের বদলে যাকে ভুবন বলতেই ভালো লাগে, যেখান থেকে আমি দূরে রয়েছি তিন দশক। বোধ করছিলাম এক বায়ুমণ্ডল থেকে আরেক বায়ুমণ্ডলে নামার চাপও; আমার শরীর ও হৃদয় অনুভব করছিলো নেমে আসছি আমি নিঃসঙ্গ শিখর থেকে আদিগন্ত ছড়ানো সমভূমিতে, যেখানে বাস করে এক বিস্ময়কর প্রাণী, মানুষ, যেখানে ঋতুর পর ঋতু আসে, ফুল ফোটে রঙিন ও সুগন্ধী হয়ে, পাতা সবুজ হয়, এক সময় ঝ’রে পড়ে, যেখানে নদী বয়, আকাশ জুড়ে মেঘ ঘনিয়ে আসে। তাঁর কবিতা পড়ছিলাম, এবং ঢুকছিলাম এক অসীম মানবিক বায়ুমণ্ডলে।
এ-ই হলেন হুমায়ুন আজাদ। সুস্পষ্ট। লক্ষ করব যে, তাঁর একদেশদর্শিতা, তাঁর একবগ্গাপনা, তাঁর উন্নাসিকতা, আলগ প্রকারের; — এটি নিরদ সি. চৌধুরীর হিংসাহিংস্র উন্নাসিকতা নয়, চিরস্থায়ী বিদ্বেষ নয়, ন্যাটিভঘৃণা নয়। এইসব অবশ্য আলাদা জায়গায় উত্থাপনের জোখা আলাপ, এখানে নয়, এখানে এতদপ্রসঙ্গে একটু সুনীলপ্রসঙ্গ অনাহূত মনে হবে না হয়তো। সুনীল কোনো ব্যাখ্যা রাখেন না চাইল্ডিশ্ তাঁর ট্যাগোর-অ্যান্থোলোজি প্রণয়নের-পরিকল্পনের পশ্চাদভূমি হিশেবে; উপরন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কবিতা ব্যানারে সেই কাজ জায়েজ করে নিতে যান। অথচ সুনীল সূচনাজীবনে সেই-যে অ্যাটাক্ করেছিলেন ট্যাগোরকে, পাপোশে ফেলে দেয়া সেই-যে রবিরচনাবলির ছবিচমক দেখায়েছিলেন কবিতায়, কিংবা নানান ইস্তেহারভাষায় চমকদ্যুতিবিকীর্ণ গদ্য লিখেছিলেন, তা যত শিল্পরহিত/সাহিত্যসুঘ্রাণহীন হোক অথবা সাংঘাতিক সুগন্ধযুক্ত, পরিণত সুনীলচৈতন্যে এর পক্ষে-বিপক্ষে কোনো সাফাই পাওয়া যায় না তেমনভাবে। বেখেয়ালে যেন ঘটেছিল সবই। অথচ অভিপ্রেতই ছিল বরং প্রত্যাবর্তনের সাফাই/কৈফিয়ৎ। ঘটনাটা আরেকটা জায়গায় প্যাঁচ খায়, মনে হয়, এ-প্রসঙ্গে ফের একবার ফিরতে হবে আমাদেরে। একটু পরে। সেখানে দেখতে চেষ্টা করব যে গালাগালি আদতে বেসামাল ভক্তি ও ভৃত্যগিরি প্রকাশের সূচক, অহমিকাদারিদ্র্যের এক করুণ রুগ্ণ দশা, মনন-ও-চৈতন্যবৈকল্যের এক বিশেষ-ও-সাময়িক পরিস্থিতি, এহেন অনুসিদ্ধান্তের পক্ষে একটা-দুইটা ছায়াছবি কৃপাতরু জগজ্জননীর ইজাজৎ নিয়ে দেখতে ও দেখাইতে চেষ্টা খানিকটুকু করা যাবে। একটু পরে, একটু ধীরে, একটু মুখতসর ও হয়তো বহুলাংশে ঝাপসাভাবে। ব্যাখ্যা হাজিরার মুরদ না-থাকাজনিত দৈন্য ও দহনের চিরাচরিত পোভার্টি নিবন্ধকারের রয়েছে এইটাও কবুল করে নেয়া কর্তব্য।
৫
রোম্যান্টিক কবি বাহ্যজগতকে দেখেন নিজের অহংবোধের ভেতর দিয়ে; তিনি মন্ময়, আমিময়; তিনি বস্তুগত দৃষ্টিতে জগতকে দেখেন না। কোনো কিছু কেমন, তার স্বরূপ কী, তা মূল্যবান নয় রোম্যান্টিকের কাছে; তাঁর কাছে মূল্যবান হচ্ছে বস্তুটি তাঁর কেমন মনে হয়। রোম্যান্টিকের আমিময়তার চরম ঘোষণা পাই রবীন্দ্রনাথেই; “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, / চুনি উঠল রাঙা হয়ে। / আমি চোখ মেললুম আকাশে — / জ্বলে উঠল আলো / পুবে পশ্চিমে। / গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’ — / সুন্দর হল সে।” কথাগুলো সুন্দর, কিন্তু এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে রোম্যান্টিকের ভয়ঙ্কর আমিমযতা বা অহমিকা। তিনি কোনো কিছুকেই বস্তুগতভাবে মেনে নিচ্ছেন না, স্বীকার করছেন না কারো নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকেই; সব কিছুতে তিনি সঞ্চারিত করে দিচ্ছেন নিজেকে। পান্নাচুনির নিজস্ব রঙ যেমন স্বীকার করছেন না, তেমনি স্বীকার করছেন না সূর্যকে ও গোলাপের সৌন্দর্যকে; তাঁর কাছে এসবই তাঁর নিজের সত্তার সম্প্রসারণ। রোম্যান্টিকের মহাবিশ্ব উৎসারিত তারই অহম থেকে।
এখন, অন্তত গত এক-দশক ধরে, একটা ব্যাপার আবছা মনে হয় যে, হুমায়ুন আজাদ রোম্যান্টিকদের পরিচয়তিলক হিশেবে যে-অহমিকাবাদের উল্লেখ প্রণিধানযোগ্যরূপে টেনেছেন, বলেছেন এই অহমই হলো রোম্যান্টিকদের মহাজগৎকেন্দ্র, — এই অহমের, এই আমিময়তার, এই আত্মগুরুত্বের ব্যাপারটা আজকাল সাহিত্য থেকে বেরিয়ে যেন ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপ্ত চরাচরের সর্বত্র। ঘটনাটা তাইলে তো অতীব শ্লাঘার হবার কথা। না, মনে হয়, তা হয় নাই। প্রথমত রোম্যান্টিক পর্যায় পেরিয়ে এসেছি আমরা সেই-কবেকার বদু-খাঁ আমলে, সাহিত্যের ইজম্ যে-রোম্যান্টিসিজম্ সেইটার কথা পাড়ছি এইখানে, এখনকার সমাজবাসীরা রোম্যান্টিক নঞর্থে। কেমন ব্যাপারটা, বলছি।
নিজেকে ছাড়া আপনি যখন কাউকেই শুনছেন না, আপনিই আপনার তালুই আপনিই আপনার বেয়াইসাব বেয়াইনসাহিবান, আত্মকুণ্ডয়ন বলে ব্যাপারটাকে। একটা পর্যায় পর্যন্ত রোম্যান্টিসিজম্ ছিল দিগদর্শী, সভ্যতাকে একটা আতসকাচ দিয়েছে দেখার আলাদামাত্রিক, কিন্তু তখনই এই ইজম্ বিকল ও বাতিল হতে শুরু করেছে যখন এটা আত্মকুণ্ডয়নে মেতে উঠেছে। নার্সিসিজমের নামান্তর নয় রোম্যান্টিসিজম্, আর-যা-ই-হোক, মনে রাখতে হবে এই নোক্তাটুকু।
তো, বৈকল্যে ধরেছে বলেই ইজমটা বাতিল পরিগণিত হতে শুরু করে মডার্নিস্টদিগের হাতে। এর আগেই রোম্যান্টিসিজম্ ফলিয়ে তুলেছে তার যা-কিছু ফলাবার। আমাদের ভূখণ্ডেই তো রোম্যান্টিসিজমের অন্তিম পর্যায়িক ঢেউ উঠে ফের মিলিয়েও গেছে এন্তার স্বর্ণবিন্নিধান কেটে সেরে সোনার তরীর লগি-বৈঠা মেরে। এরপরও দুনিয়া আগায়েছে, সাহিত্যে-শিল্পে এবং জীবনযাপন-চিন্তনপদ্ধতিতেও, লেবেল-সাঁটা নামফলকের হিসাব মোতাবেক ব্রডার হেডে অন্তত দুইটা ফেইজ্ তো অবশ্যই। মডার্নিস্ট, পোস্টমোডার্নিস্ট, খুব ভালো তথ্যাভিজ্ঞ না-হলেও আমরা গরিবগুর্বা জ্ঞানের ম্যাঙ্গোমানুষ এট্টুক বুঝি। কিন্তু ওই হাজারিকাগানের লিরিক্সটাতে একটা-যে সপ্রশ্ন সংশয় দেখতে পেয়েছিলাম আমরা, ওই যে গো — “পুরনো ইতিহাস ফিরে এলে / লজ্জা কী তুমি পাবে না!” — সেই পুরনো ইতিহাস প্রত্যাবর্তিত হতে দেখলাম আমরা গত গোটা-এক দশক জুড়ে, দেখে চলেছি উত্তরোত্তর ক্রমবর্ধমান রেইটে ও রেশিয়োতে, হেলদোল নাই আমাদিগের, লজ্জা আগে যেটুকুও-বা খানিক পুরুষের ও অনেকটা নারীর ভূষণ ছিল, এখন উবে গেছে একদম। বর্তমানে এরশাদ, বিশ্ববেহায়া যার বিশেষ্য-বিশেষণ-সর্বনাম-অব্যয়-ক্রিয়া একাধারে, স্বদেশের হালফিল হকিকতে যারপরনাই লজ্জায় দিনাতিপাত করে চলেছেন বলিয়া বাংলাদেশজ সংবাদমাধ্যমে রাষ্ট্র হয়েছে।
এখন রোম্যান্টিসিজমের কেন্দ্রচিহ্ন অহমিকা, হার্মফ্যুল্ হন্তারক আত্মম্ভরিতা আর কলসবাদ্যিনৃত্যের সারশূন্যতা, আশাপাত্রমিত্র তরুণাস্থিরও যেন অবিকল্প সংস্থান। চলছে একটা আজদহা বাইম মাছের কাল। আশ্রাফ-আত্রাফ মিলিয়া, ব্রাত্য-অভিজাত একব্র্যাকেটবদ্ধ হইয়া, চালাইয়া চলিয়াছে এই রোম্যান্টিসিজম্। অহমিকান্দোলন। এহেন রোম্যান্স। কোনো কৌশলে, কোনো যন্ত্রে, কোনো ফোর্সেপ্ দিয়ে এই বাইম মাছেরে আপনি পাকড়াও করতে পারবেন না। আপনি নিজেও তথৈবচ। তথা বাইম মাছ। দুই সেকেন্ড না-যাইতেই আপনি বলে উঠছেন ওইটা আপনে বলেন নাই। প্রমাণ হাজির হলে বলছেন ওইটা আপনি মিন্ করেন নাই। মিনমিনিয়ে এইগুলো করে সেরে এরপর অচিরে হেঁকে উঠছেন, বলেছি তো বলেছি বেশ করেছি ভালো করেছি, আরও বলব, এ-দেশের সক্কল মাছেরে বাইম মাছ বানায়ে ছাড়ব ইনশাল্লা। তা, এ-ই হলো অবস্থা। ইন-শর্ট, পরিস্থিতির বিবরণ এ-ই। এরে বলে প্লেফ্যুলনেস্। পোস্টমডার্ন প্লেফ্যুলনেস্। ভানুমতির এই খেইলও তো পুরানা জামানার। এইটিজের। আমার মতো গরিবগুর্বা জ্ঞানচক্ষেও ধরা পড়ে ব্যাপারটা। কুতুবদের নেত্র হইতে পিঁচুটি কি ইরেইজ্ হইবার না ইহজনমে? লক্ষণ তো দেখি না।
গালিগালাজ নিয়া গাইতে বসে এখন দ্যাখো রোম্যান্ হলিডে প্লে করে চলেছি, মীন, তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছি আমি জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিয়া গালিগালাজের প্রসঙ্গে কেমন করে গোটা সোসাইটির গালিগালাজ ইনক্লুড করিতে পারিলে, এইটা এক রহস্য, নোটনিবন্ধিকা সাঁটতে যেয়ে দেখি রবির কাব্যবই নৈবেদ্য রিমিক্স ভার্শন্ প্রোডিউস্ করতে লেগেছ হে! একটু রোসো ঠাকুরপো, তর সইছে না বুঝি! রবিরে গালিগালাজে, সমাজেরে মর্নিং-ইভনিং চ-বর্গের ধ্বনিধুন শুনাইবার মাঝারে, একটা ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স বিরাজে, সেইটা কহিবারে দেহো বল মোরে! “পার্ভেইচ্যা রে! বল খেলাডা তওবা কইরা ছাড় / আমি তর বাপ কইত্যাছি পাগল(ও) সাত্তার / পার্ভেইচ্যা রে …”
অ্যানিওয়ে। নেক্সট এপিসোডে আমরা রবির মরা মা-বাপ তুলিয়া গালি দিয়া নিজেরা বালেগ হইবার ফিকির খুঁজিব কথা দিনু। পুরস্কার-দেনেওয়ালারা আরাম পাইবেন, নেনেওয়ালারা তো কমোডে না-বসিয়াই স্বীয় পট্টবস্ত্রে ছেড়ে দিয়া অভ্যস্ত, সকলেরই আরামে আমাদের আরাম। শিরোনামহীনের ‘আমাদের ভুবনে স্বাগতম’ গাইতে গাইতে এ-যাত্রা বাড়ি ফিরি। গালির ডালি নিয়া আবার আসিব ফিরি সিক্সটিজের হাংরি ট্রিক্স পুনরপি ফিরায়ে। ম্যায় ফিচারিং তুম। হাম-তুম রবিনাথ-কি টাকডুম-টাকডুম। যদিও বহির্বিভাগে, আউটডোরে, রবিবিরোধী তথা জিপি অপারেটর, মানে কিনা গালাগালিপ্লেয়ার। যে যত বেশি গালাগালি-উদগ্রীব, সে তত রবিপ্রেতাত্মা, রবিতাড়িত অজভূত, ইনসিকিউর্ড ফিলিংস্ থেকেই রিডিকিউল্-রিবিউক্ করে চলে খোদা-না-খাস্তা নাই-হয়ে-যাওয়া আদিম রোম্যান্টিক লোকটারে, নিজের ভেতরে ওই লেভেলের অহমিকা নাই এবং ওই অহমিকাই আজও ওই গালিপ্লেয়ারের মগজে-বাঁড়ায় একমাত্র জোর বলিয়া মাতৃক্রোড় হইতে জানিয়া আসিয়াছে সে ও তার রক্ষাকর্তারা। আজও, এত বছর বাদেও, মরা কবির কেশর ধরিয়া বৈতরণী পারাতে হয় যে-লিট্রেচারের ল্যাংটাদেরে, এদের বাটপারিকীর্তন গাহিবার স্ট্যামিনা কার আছে এ-ভুবনে! অ্যানিওয়ে। ফির মিলেঙ্গে নেক্সট এপিসোডে। স্টে টিউনড অর নট।
৬
রবীন্দ্রনাথের কাছে তিরিশি পাঁচজনের সবাই, কমবেশি, ঋণী। তাঁরাই প্রথম বাংলা ভাষায় দেখালেন যে মহাপ্রতিভার অনুকরণ করাই কবিতাজগতের একমাত্র রীতি নয়, ঋণও নেয়া সম্ভব এ-জগতে; এবং সে-ঋণ ভিত্তি ক’রে গ’ড়ে তোলা সম্ভব অগাধ ঐশ্বর্য। শুধু ঋণ নয়, অনুকরণও করেছেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথের : বুদ্ধদেব বসুর কৈশোরিক কবিতাগ্রন্থ মর্মবাণী, অমিয় চক্রবর্তীর উপহার, সুধীন্দ্রনাথের প্রাক্তনী ও তন্বী রবীন্দ্রাচ্ছন্ন। কিন্তু যে-দিন তাঁরা বুঝলেন রবীন্দ্রনাথে মুক্তি নেই তাঁদের, ও বাংলা কবিতার, সেদিন সূচিত হলো বিংশশতাব্দী — এক নতুন, জটিল, যুদ্ধাহত, অবিশ্বাসী, ও গাঢ় চৈতন্যময় সময় — যার কবিতাও নতুন। আধুনিক পাঁচজনের মধ্যে বিংশশতাব্দীর জটিল যুদ্ধক্ষেত্রে নায়কের ভূমিকায় নামতে চেয়েছিলেন যিনি, তিনি সুধীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা, যাকে বলতে পারি এ-শতাব্দীর সারকথা, পেশ করেছেন সংবর্ত-এর ‘যযাতি’ কবিতার এ-অংশে : “জাতিভেদে বিবিক্ত মানুষ; / নিরঙ্কুশ একমাত্র একনায়কেরা। কিন্তু তারা / প্রাচীর, পরিখা, রক্ষী, গুপ্তচর ঘেরা প্রাসাদেও / উন্নিদ্র যেহেতু, তাই ভগ্নসেতু নদীতে নদীতে, / মরু নগরে নগরে। পক্ষান্তরে অতিবেল কারা / তথা সংক্রমিত মেরু ব্যক্তির ধ্বংসাবশেষে : দ্বেষে / পুষ্ট চীন থেকে পেরু; প্রতিহিংসা মানে না সিন্ধুর মানা। / … আমি বিংশ শতাব্দীর / সমানবয়সী; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে; বীর / নই তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে বিপ্লবে বিপ্লবে / বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনুষ্যধর্মের স্তবে / নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে / যত না পশ্চাৎপদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে।” এ-ভয়াবহ শতক তার হাত বাড়ালো সর্বত্র : গোত্রে গোত্রে বিভেদ বাড়ালো, বিচ্ছিন্ন হলো ব্যক্তিমানুষ, বড়ো শরীরের ক্ষুদ্র মানুষেরা তুলে নিলো স্বহস্তে শাসনব্যবস্থা, যার হিংস্র দীর্ঘ বাহুর আওতায় এল এমনকি দূরপল্লীর রাখাল, অরণ্যের গোপন পশুপাখি। এ-সময়ের আবেগ-চিন্তা-স্বপ্ন-জীবন পৃথক, ও বিপরীত, অব্যবহিতপূর্ব সময়ের থেকে : তাই তার আত্মার উৎসারণ কবিতাও ভিন্ন। সুধীন্দ্রনাথকথিত বিংশশতাব্দী সশরীরে, ব্যাপক গভীরভাবে, এসেছিলো পাশ্চাত্যে; বাংলায়ও পৌঁচেছিলো তার অমোঘ তাপ; আর ওই তাপ যাঁদের চিন্তা-বোধি-আবেগ-স্বপ্নে পৌঁচেছিলো, তাঁরাই জনক হয়েছিলেন, বাংলায়, আধুনিক কবিতার।
হ্যাঁ, সেইটাই, যেইটা বলা হলো যে অনুকার হবার দরকার নাই, হরবোলা হয়ে কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়, কিন্তু কর্জ তো করাই যায়। কেবল কর্জ করে লাইফ কাটায়ে দিতে পারা গেলে ব্যাপারটা আদৌ মন্দ হয় না নিশ্চয়। আদতে সেইটা না-মুনকিন। লোন্ করবেন আপনি, ডিফল্টারও হবেন, সেইটা সম্ভব দুনিয়ার শিল্পোদ্যোক্তাদের আদলে গ্র্যান্ড-ডিজাইনের প্ল্যানিং করতে পারলে। দুনিয়া মানে আমাদের কাছে বাংলাদেশ, এই নিবন্ধে তো বটেই এবং গোটা যাপনজীবনেও, বাংলাদেশের বাইরে দুনিয়ার অস্তিত্ব রয়েছে মর্মে একিন অল্পই। কিন্তু ওই আলাপ থাক। পরাধীন ওয়েইস্টবঙ্গ যদি বিদেশ গণ্য করেন আপনি, কিংবা না করেন, সেক্ষেত্রে এই নিবন্ধ কেন গোটা সাহিত্যজৈবনিক কথাবার্তা আপনি ইন্টার্পেট করবেন আলাদা আলাদা ভাবে ও ভঙ্গিমায়। সেই সুবিধেটুকু যথাহিম্মৎ রাখিয়াই যাক যাওয়া। মাইক্রো ও ম্যাক্রো ক্রেডিট নিয়া আলাপে রিটার্ন করা যাক। লেট’স্ গেট ব্যাক্ টু রবি দি মোস্ট ওয়ান্টেড ভিলেইন্ অন্ দ্য আর্থ। বলি আরবারও, আর্থ অর্থ বাংলাদেশ; অথবা আরও স্পেসিফিক্ হতে চান যদি তো যার যার গ্রুপ্, গুলতানিবৃত্ত, সাহিত্যসিন্ডিক্যাট।
রবিঋণ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে একজন উদয়শঙ্কর নাচতে পারেন না? আলবৎ পারেন। খোদ এই পিগ্মি নিবন্ধক রবিঋণের গুষ্টি কিলিয়ে এই নিবন্ধ পয়্দাইতে নেমেছে। এইটা একটা এক্সাম্পল্, হ্যাভ ফান্, ডোন্ট টেইক্ ইট সিরিয়াস্লি। কিন্তু গ্র্যাম্যাটিক্যালি ঋণ ছাড়া আপনার অস্তিত্ব মর্ত্যলোকে টেকানো অসম্ভব। সবসময় ঋণ করছেন আপনি, জ্ঞাতসারে হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে, স্বীকারও বাহুল্য এমন ঋণই বেশি। স্বীকারবাহুল্য শ্রেণির ঋণের আওতাতেই পড়বে এই রবিঋণ, কাজীঋণ, মধুঋণ, জীবনঋণ, সমরঋণ, রাহমানঋণ, শক্তিঋণ, উৎপলঋণ, মাহমুদঋণ, বিনয়ঋণ প্রভৃতি। আপনি হয়তো অজান্তেই ঋণ করে কেল্লা ফাটিয়ে ফৌৎ করে দিতেছেন, জানবার দরকারও হয় না সবার অবশ্য, তবে ঋণের যে-একটা চ্যানেল্ আপনি জন্মসূত্রে পেয়েছেন সেইটা ব্যাহত না-করে তহবিল তছরুপ করুন বা যা-কিছু গলাগলি-গালাগালি করুন তাতে আপনারই মঙ্গল। নতুবা আপনার ধারকর্জ-করিয়া-বানানো ভবনদেয়ালে ক্র্যাক্ ধরিলে রিনোভেশন্ প্রোজেক্ট ছকিয়ে সেই-তো গুটিকয় ঋণদানসোর্সের কাছেই ধর্না দিতে হবে। আর তাছাড়া আপনি জন্মেছেন মানেই ঋণগ্রহীতা হয়েছেন। পদে পদে ফেভ্যর আপনার অজান্তেই নিতে হচ্ছে আপনেরে। রোদের ফেভ্যর, বৃষ্টির ফেভ্যর, প্যারেন্টস্ ফেভ্যর, প্রেমাষ্পদের ফেভ্যর ইত্যাদি এইগুলোর কথা বাদই দিলেন মনে করেন; কিন্তু বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল? খালি চিল্লালেই হইল? আপনি নিজেই নিজেরে, নিজের মায়েরে-বাপেরে-বৈনেরে-প্রেমিকারে-প্রেমিকেরে একাধারে, একাধিকাধারেও হয়তো, ডট ডট ডট করলেন মনে করেন, দেনা তো শোধ করনা-হি পড়ে-গা আপনের পাশের জনেরে দুগ্না দাদন। ‘মরে গেলে হবে? তারও পরে খরচাপাতি আছে।’ — হেন উৎপলপঙক্তি, মনে কি পড়ে না মঁসিয়ঁ? অথবা আপনি জানেন ধরে নিলাম, মনে আপনার পড়ল বলে গেল ধরে নেয়া, আপনি হিৎস্-স্টিগ্লিৎস্-অমর্ত্য পড়ুয়া জ্ঞানদার আর বুঝবুদ্ধির অতিকায় বেওসাদার ধরে নিলাম, কিন্তু আপনার শিশুসন্তানটি কি জানে যে তারও শিরোপরে কত ডিজিটের ঋণের বোঝা? বা জন্মায়েই গিয়াছে মরিয়া সাফ হইয়া এমন-যে এম্ব্রায়ো, সকরুণ ভ্রুণ, আপনি ও আপনার পার্টনারের স্যাটার্ডে-নাইট-ফিভারের উৎপাদিত বস্তুপিণ্ড হতে হয়েছে যারে, সে কি জেনে গেল যে না-জন্মিয়াও কত বিডিটি/জিবিপি/ইউএসডি/ইউরো কর্জিয়া বানাইয়া গেল আপনারে! আব্ তেরা ক্যায়া হো-গা রে কালিয়া! বাসান্তি কি ভিলেনের ডেরায় নেচেকুঁদে ট্যাগোরখপ্পর থেকে বের করে আনতে পারবে আপনারে, যেমন পেরেছিল ‘শোলে’ সিনেমায় গাব্বারের মহাকালিক গুণ্ডাগুহা থেকে একদা? আখেরে ট্যাগোরেরে গালিখিস্তি দিয়া ট্যাগোরের পিণ্ডি চটকায়া পার পাওয়া যাবে কি, নিজের মাকসাদ পুরা করা যাবে কি হে মারকুটে বাংলা কাব্যকল্কেযোগী, হে বেফিকির খিস্তিবিদগ্ধ কর্পূরতারুণ্যের সশস্ত্র কবি, বিষয়টা আপনারই বিবেচনাধীন রইল কত্তা! আইজ্ঞা।
কাজেই স্বীকার-অস্বীকারের তোয়াক্কা না-করেই আপনি গালাগালি চালায়ে যেতে পারেন, যেমন আমি ও আমার সমুন্ধি-ভায়রাভাই মিলিয়া চালাই নিজেদের অক্ষমতা-অনিরাপত্তাবোধ ধামা দিয়া চাপা দিতে স্বীয় বউদের সামনে। এখন, কথা হলো, কোথায় কি ও কতটা পাওনাগণ্ডা ধার-দেনা-পাওনা আছে আমার তা আমি নিজেই যদি না-জানি তাইলে গণপিটুনির আগে মহাকালের মশামাছিপিটুনি খাইয়া আমারে বেঘোরে পটল তুলিতে হইবে এইটা কনফার্ম। যত-যা-ই বিল্ডিং-ব্যবসা-ব্যালেন্স বাগায়েছিনু, পাওনাদার চিনিয়া নিত্যনতুন কৌশলে এদের চোখে ধুলা দিবার ম্যাকানিজম্ গড়ে তুলতে না-পারলে জীবদ্দশাতেই নিজের সহায়সম্পত্তি সিজ্ করবে এসে মর্টগেজওয়ালারা, ক্রোক্ করবে মালামাল যাবতীয়, গ্রামবাসীরে খামাখা একটা হয়রানিতে ফেলে ফেরার হতে হবে নিজেরে। একটু বুদ্ধিসুদ্ধি, একটু কমনসেন্স দিয়া পাওনাদারদের হ্যান্ডল্ করতে শেখা তো প্রতিভানদীতে-সাঁতরাতে-নামা তথাকথিত সৃজনশীলদের প্রাইমারি টাস্কগুলোর অন্যতম। চ-বর্গীয় ধ্বনিবিনিয়োগে তো কোনো স্রষ্টা লাগে না, ওইটা তো গিভেন্-কন্টেক্সট, তাইলে ক্যামনে ক্লেইম্ করবেন যে আপনি সৃজনমুর্গি, মুহূর্মুহূ আণ্ডাপাড়া সাহিত্যতরুণ? দুইতিনটা বুদ্ধিদীপ্ত বকাবাদ্যি-খিস্তিও তো কন্ট্রিবিউট করবেন অন্তত। যদি ত্রিকালপ্রাচীন বদু-খাঁ আমলের গালিক্রিয়ায় মেশিনল্যুম্ তথা প্রাণবয়নযন্ত্র তথা তাঁতকল চালাইয়া গেলেন, তো অশ্বডিম্ব, ওইটুকু দিয়া আমরা কোন আমড়াগাছে উঠব বলুন তো? লোকেরে কেমন করিয়া তাইলে রবির কাস্টোমার কেয়ার সেন্টারে যেতে নিবৃত্ত করব?
রবিনিন্দা সার্টেইনলি একটা নেসেসিটি, সেইটা দরকার অন্য জায়গায়, একটু অন্যভাবে সবসময়। নইলে এগোতে পারবেন না আপনে, কুঁড়ের সর্দার হয়ে খালি আণ্ডাই পেড়ে যাবেন জিন্দেগি ব্যাপিয়া; গালিওয়ালারা এবং গলাগলিওয়ালারা যেমনটা করিয়া থাকে, খালি গালি পাড়ে আর ইউরিন্ ও ইউরিয়া প্রোডিউস্ করিয়া যায়। যেমন ধরুন, আমরা প্রায়শ বলিয়া থাকি আলাপে-আড্ডায়, স্ট্যাটাস্-ক্যু ভাঙা দরকার; বলি, স্থিতাবস্থায় চিড় ধরানো দরকার; হ্যাঁ, এইটা খালি বাগ্মিতা প্রকাশের গরজে বলা না, এইটা সত্যিই দরকার। এখন, কোয়েশ্চন্ ইজ্, স্ট্র্যাটেজি কি হবে; কোন ইনস্ট্রুমেন্ট বা অ্যাপারেটাস্/ইনস্ট্রুমেন্টগুলা আপনি ইউটিলাইজ্ করবেন। প্রশ্নগুলো সহজ, ববি ডিলানের গানের ন্যায়, আর উত্তরও তো জানা। মানে, এনাব্লিং এস্টাব্লিশমেন্ট আর এক্সিস্টিং অ্যাজেন্সিস্ অফ ডোমিন্যান্স দেখে আপনি ডিসিশন্ নেবেন আপনার এনগেইজমেন্ট কেমন উপায়ে হবে, আপনি ইনভোল্ভড হবেন কোন পয়েন্ট স্ট্রাইক করে, আপনার উয়্যেপ্যন্ কি হবে, আপনার জোন্ অফ প্রোক্সিম্যাল্ ডেভেল্যপমেন্ট বজায় রেখে ব্যাটলশিপ-সার্কল্ কতটা বড় পরিধির রাখবেন, নাকি ডিফিউজ্ করে নিয়ে এগোবেন পরিধিরেখাগুলো, অথবা আপনার পোটেমকিন্/প্রোপ্যাগ্যান্ডা থাকবে কি না, আপনার ওয়ে অফ অ্যাটাকিং ডিউরিং ওয়ার কেমন হবে ইত্যাদি যাবতীয় চক্-আউট করবেন আপনি নিজের ফোর্ক্যাস্টিং ক্যাপাবিলিটি খাটিয়ে, এবং সেইসঙ্গে যুক্ত হবে আপনার প্রায়োর নলেজ্। এইগুলো ঘটবে মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে, কোয়ার্ক টাইমে, রক্তে যদি প্র্যাক্টিসটা জারিত থাকে আপনার তবেই। কিন্তু এ-ভিন্ন, এছাড়া, আদারোয়াইজ্, রবিবিদ্রোহীরা বড়জোর হাংরি কায়দা বারেবারে রিইন্ট্রোডিউস করবেন, বড়জোর কৃত্তিবাসী ট্রিক্স, বড়জোর সুনীল গাঙ্গুলি কি হুমায়ুন আজাদ। এর বেশি কিছু না। কিন্তু দরকার এর বেশি কিছু।
হুমায়ুন আজাদ আপনার মতো অত জ্ঞানী-সৃষ্টিবীর না-হলেও রবি অ্যাফেয়ার্স নিয়া জিন্দেগিভর কম গালাগালিক্রিটিক্ করেন নাই। আমরা তার ক্রিটিক্ পড়ে একটা বড় সময় ধরে একটু অন্যচোখে দেখার একটা কায়দা রপ্ত করেছি বলা বাহুল্য। অজস্র ফর্মা গালাগালি পেড়ে এন্ড-অফ-দি-ডে সহস্রাধিক পৃষ্ঠার প্রধানকবিতা! আমরা কি এই প্রাধান্য চেয়েছিলাম! এহেন রবিপ্রাধান্য! অথবা আমরা কি আগের ওই ক্রেইজসঞ্চারী রবিনিন্দা পড়ে বেহুদা টাইম্ কিল্ করে যৌবন ফিকে ও ভ্যাপসা বানাতে চেয়েছিলাম! তবে একটা কথা কি জানেন, সিক্সটিজের ট্রিক্স দিয়া আজকালকার ডেমোন্সট্রেশন্ বিলকুলই রিডিকিউলাস্। কেন, বলি। সিক্সটিজে হেথায় এবং হোথায়ও সোসাইটি ছিল নবোদিত ভদ্দরনোকেদের আনাগোনামুখর, কলকেত্তার বাবুমশাইরা সবাই বাঈজিবাড়ি-বলাকাবিলাস প্রভৃতির পয়সায় টান পড়ায় একটু চিপ্ রেটের ইকোনোমি ক্লাসের ক্লিনশেভড পুতুপুতু উত্তমকুমারপনা মারছিলেন, তখন গালিটা সাময়িকভাবে একটা মোক্ষম অস্ত্র হতে পেরেছিল বৈকি। ইদানীং তো সর্বত্র গালিবাংলাই জিন্দাবাদ ও জয়ধ্বনিযুক্ত। আমি নিজে একদণ্ডও তিষ্টোতে পারি না গালি ছাড়া। কাজেই সৃজনশীল আপনি কোন বরিশাইল্যা আমড়াটা ফলাইতেছেন উদয়াস্ত? এইটা একটামাত্র কোয়েশ্চন্, একমাত্র কোয়েশ্চন্ না। আমরা এই নিবন্ধমাথায় যে-এপিগ্রাফ ঝুলায়েছি, আদিম দেবতারা ও সন্ততিরা থেকে, সেইখানে হুমায়ুন আজাদের তিরিশিমুগ্ধতা ছাড়াও কতিপয় জিনিশ লক্ষণীয়; পরে সেসব লক্ষ করব। হুমায়ুন আজাদের তিরিশিমুগ্ধতা আগাগোড়াই ছিল, এই একটা জায়গায় তিনি নিজের পজিশন্ শিফ্ট করেন নাই, দেখেছি আমরা। এখন, দেখিয়াশুনিয়া মনে হয়, অর্বাচীন তো বটে এমনকি বুড়াহাবড়ারাও মম-বিবেচনাই-মহাবিবেচনা শ্লাঘাপূর্ণা ব্রাত্যসন্ততি, ঠিকমতো কোমরে কুলায় না তা-ও কোমর উঁচিয়ে ল্যাবগ্যাবে শোচনীয়ভাবে ব্রাত্যসন্ততি। কিন্তু প্রোলেতারিয়েত শব্দমাত্র-সম্বল-করা পাইক-বরকন্দাজের পুরানাকালীন বিপ্লবের প্রোব্লেমগুলা আমরা যদি মনে রাখি, বিশেষ উবগার পাওয়া যাইবে এক্ষেত্রে। একটা ব্যাপার তো অনস্বীকার্য, সমসাময়িক যাত্রাপালায় ভাঁড়ের ক্যারেক্টার একটাই কাফি, খুব বেশি হলে জেস্টার/ক্লাউনের এক/দুই কোম্প্যানিয়ন্ অ্যালাও করা যায় শিল্পসৌকর্য বজায় রেখে, এরচেয়ে বেশি ছিদ্রান্বেষী/বিদূষক যাত্রাপালার পক্ষে স্বাস্থ্যহানিকর। অথচ বত্তমানকালের চিত্তমনোহর ফচকে লেখুয়াদের সংখ্যায় এবং সম্মাননায় বাড়বাড়ন্ত দেখে আপনি নিঃসংশয়ে বেদনার সঙ্গে কবুল করতে বাধ্য হবেন যে প্রিন্সেসকবলিত হইয়া যাত্রাপালা এবং প্রিন্সপর্যুদস্ত বঙ্গজ কবিতাসাহিত্যের মতো দুই-দুইটা ফর্ম অক্কা পাইতে চলেছে অচিরেই। কী নিদারুণ নন্দিত অনুকারদের শিশুস্বর্গ লক্ষ করে দেখবেন আপনারে বেষ্টনী দিয়া বিরাজিছে, সাহিত্যে, সমাজে এবং অন্যান্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানপ্রকরণেই!
কিন্তু আর তো থাকা যায় না ঘরেতে; এইবার ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামন দরকার। রবিরে গালি না-দিয়া সান্ডে-মান্ডে ক্লোজ্ বা ওপেন্ কোনোটাই ঠিক জমে না। আর কাদম্বিনী যেম্নিভাবে মরিয়া প্রমাণ করিয়াছে যে সে মরে নাই, অনুরূপ আপনারেও রবির মরা বাপ-মা তুলিয়া গালি দিয়া বাঁচাইতে হবে রবিজিরে বারবার, দ্বিধা নাই বলতে যে এই পথে আপনি নিজেও নিজেরে যাইছেন বাঁচিয়ে; এবং গালি দিয়া আপনার তারুণ্যকার্ড নবায়ন করিয়া যাইতে হবে পুনঃপুনঃ; এবং গালিসমর্থক হইয়া, আজিব উদ্ভট হেতুশূন্য বকাবকিরে সমর্থন দিয়া, আপনারে প্রমাণ করিয়া যাইতে হইবে যে আপনি বুড়া হন নাই। লক্ষ করবেন, সিক্সটিজের এস্টাব্লিশমেন্ট গালি হজম করতে পারত না, খানিকটা হলেও গালিতে বালি-ইট-চুনসুরকি ঝুরঝুর ঝরে পড়ত তার রঙিলা দালানের, এখনকার প্রতিষ্ঠানের গালিই হজমবটিকা, গালিতেই তার পুঁজিপুষ্টির প্রচার-প্রসার, যত গালি তত শনৈ শনৈ বাড়বৃদ্ধি কর্পোরেট ক্যাপিট্যালের। গালি শুনলেই লোক জড়ো হয়, বানর নাচায় মাদারি, তালিয়া বাজায় তামিশকিরে; বেচাবিকি ভালো হয় মজমা আতরের, বিখাউজ আর দাঁদহাঁজা মলমের, তার থেকেই অর্জিতব্য পয়েন্ট জিরো জিরো জিরো জিরো জিরো জিরো জিরো জিরো পার্সেন্টের পুরস্কার। স্পোকেন্ অথবা আনস্পোকেন্, আটার্লি অথবা সাইলেন্ট, এইটাই ডিল্। ওকে, আব্বা, ডান্। আমারে উঠাইয়া দ্যাও। আপ্ বাঁচে-গা দেন্ বাপ, না, বাপ বাঁচে-গা তো আপ্। অথবা বাপ বাপের জায়গায়, আপ্ আপের জায়গায়, সেল্ফ-রিলায়েন্ট হওয়া। রাস্তা তো অগণন রয়েছে এগোবার। তবে পেছনপায়ে হেঁটে এগোবার হর্ষই আলাদা। আগাও, বাপ-বেটা দু-ভাই মিলে, ঘোড়ায় চড়িয়া মাদি ও মদ্দা হাঁটিয়া হাঁটিয়া! সাহিত্যের মায়েরে বাপ, নেক্সট এপিসোডে রবির।
৭
ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস — কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হইয়া ওঠে।
এই কথাটা জানেন তো সকলেই, হেথা উত্তোলিত এপিগ্রাফটুকু সুপরিচিত সকলেরই নিকট, এই উক্তিকীর্ণ রবিরচনাটা ছাপা হয়েছিল ভারতী পত্রিকায়। এখন তো বদলানো জমানা। ভারতী পত্রিকাটা বার হয় না আর, ভারতীয় পত্রিকা বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি ও অন্যান্য নানা বরন ভাষায় ছাপা হয় আজও। কাজেই এপিগ্রাফোক্ত বক্তব্যের বিস্তার ও উৎসের হদিস পেতে চাইলে তথা উৎপত্তিস্থল জানতে চাইলে এখন রবিরচনারাজ্যির যে-কোনো সমগ্রকিসিম বইপত্রের দ্বারস্থ হতে হবে। রবিমার্কেট অত্যন্ত রমরমা আজও। রবিসমগ্র ও অন্যান্য রবিবুক্স পাব্লিশ্ করতে কোম্প্যানিগুলো মুখিয়ে থাকে এখনও। প্রচুর ও বিচিত্র রকমের রবিরচনাভাণ্ডারী বাজারে পাওয়া যায়, যে-কোনো একটা হাতে নেয়া যেতেই পারে, কিন্তু অথেন্টিসিটি ও বানানসাম্য বা নানাবিধ মুদ্রণসৌকর্য প্রভৃতি বিবেচনায় একেকজনের কাছে একেক সম্পাদনা গ্রাহ্য হয়ে থাকে। যেনতেন প্রকারেণ সম্পাদনার বইপত্তরে বাজার সয়লাব। অনলাইন্ সোর্সগুলো এক্ষেত্রে অচিকিৎস্য বিষফোঁড়াবৎ বর্ধিষ্ণু। ফলে বেছে নেয়ার সক্ষমতা পাঠকেরে অর্জন করে নিতে হয় বৈকি। বাজার তো বারোজাতের বাহার ফলাবার জায়গাই। চিরদিনই ছিল, বর্তমানে রাষ্ট্র ও বাজারের নিগড় সর্বগ্রাসী, ভবিষ্যতের বাজারহাটের ইজারাদার কে হবেন তা জানেন আল্লাতালা।
ঠাকুর যা-হোক স্বীকার করেছেন ‘অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগ’, এখনকার পরিস্থিতি হলে ঠাকুর স্বীকার করতেন কি না ভাবছিলাম। অম্লতা আম্রফলের অত্যন্ত দরকারি এক গুণ, শুধু অম্লতাশাসনেই আপত্তি। আমের মধ্যে কেবল অম্লরস থাকলেই তারে আম বলা অন্যায়, কেননা অম্ল গুণটা আম ছাড়াও ফলজগতে অন্যান্য ফলাদির ভিতরেও বিরাজে। এবং শুধু অম্লরস থাকলেই আম ভক্ষ্য হয়ে যায় না। এই সত্যটুকু রবি ট্যাগোর স্বীকার করছেন। এখন, এক্ষণে, এই একবিংশের দ্বিতীয় দশকে, ট্যাগোর সশরীর হাজির থাকলে এখনকার বুড়া আমবেপারীদের আচরণই করতেন ধরে নেয়া যায়। ধুমিয়ে গালিগালাজ করতেন, সমস্ত গালিগালাজ উঠে আসত মদের আসরে নজরানা বা পত্রিকাপাতায় ঈপ্সিত নজর না-পাবার খেদ থেকে, এবং এই গালিগালাজগুলোকেই চিল্লিয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য তথা চাঁপাইয়ের/মালদহের উমদা জাতের আম প্রচারিতে প্রণিপাত করিতেন নিজের জিন্দিগি-বন্দেগি।
এখন অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগটুকু কবি-লিখিয়েদের পাছায় লেপ্টে থাকে শেষনিঃশ্বাস অব্দি। ইম্যাচিউর থেকে-যাওয়াটা এখনকার ট্রেন্ড। অনিঃশেষ হট্টমেলায় হাঁউকাঁউ করিয়া যাওয়া হালফ্যাশন্ অধুনা। কাঁচা আম থাকাকালীন বারফট্টাই বা মাস্তানি এখন পঁয়ষট্টি বছর উমর অব্দি পিছু ধাওয়া করে লেখকদিগের। ফলে আমের বিভিন্ন পর্যায়ের রসটুকু ভোগ করার কপাল পুড়েছে এই বাজারের আমভোক্তাদের। রবিটাইমের অল্পবয়স আর তখনকার স্পর্ধাবেগের সঙ্গে এখনকার টাইমের অল্পবয়স-স্পর্ধাবেগের ফারাক স্পষ্ট। তখনকার খোঁচাখুঁচি ব্যাপারটা আবডাল তৈয়ার করার গরজে হলেও রসসঞ্চার ঘটাত, এখন উল্টো, রসভঙ্গ ঘটানো ছাড়া এখনকার রসাল ফলের করার কিছুই নাই যেন। ক্ষ্যামতা নাই কি না গাছেদের, এহেন সন্দিগ্ধ মন্তব্যও করতে দেখা যায় আমতৃষ্ণ ক্রেতাদিগেরে।
এখন শুধুই প্রতিক্রিয়া। পাতার পর পাতা প্রতিক্রিয়া। গাছে গাছে প্রতিক্রিয়ামালা শুধু। “অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হইয়া ওঠে।” — এখন অশীতিপরের কণ্ঠে তেরোবছরের বালবয়সী স্বর ও আচরণভঙ্গি। এখন একই গালি একই গলাগলি বয়স-নির্বিশেষে সকলের মুখে, মগজে, কলমের নিবডগায় এবং কিবোর্ডের নবে। প্রাণবৈচিত্র্য লোপ পেয়েছে আমদুনিয়ায়। স্বাদবৈচিত্র্য ফলে প্রায় নাই বিলকুলই। রিয়্যাকশন্ আফটার রিয়্যাকশন্। অতিকায় রিয়্যাকশনারি লিট্রেচারের ডোমেইন্ গড়ে উঠছে নৃত্যের তালে তালে, বিরাগ ও বীতরাগের রাগলহরীতে, গালি ও গলাগলির অমেয় গগনকোণে। এখনকার প্রেম থেকে, এখনকার অভিমান থেকে, এখনকার বিদ্রোহ থেকে, এখনকার তরুণ থেকে, এখনকার জইফি বৃদ্ধ বুড়ো প্রৌঢ় থেকে, এখনকার সৃজন থেকে, এখনকার সুজন থেকে, এখনকার দুর্জন থেকে, এখনকার ধ্বংস থেকে, এখনকার প্রতিবাদ থেকে, এখনকার ঈশ্বর থেকে, এখনকার নিরীশ্বর থেকে, এখনকার আস্তিক্য ও এখনকার নাস্তিক্য থেকে, এখনকার বিবাহ থেকে, এখনকার বিচ্ছেদ থেকে একটাই গন্ধ বেরোয়, এক ও অভিন্ন গন্ধ, প্রতিকার ও প্রতিবিধানের অতীত সেই গন্ধ। ঘৃণার গন্ধ। অসূয়ার বদরোশনাই। হিংসা আর প্রতিহিংসার ঝনঝন। অতিকায় ঘৃণা ছাড়া নাই কিছু আর। এ-ই আমাদের সগৌরবের অপরূপ ফজলি-ক্ষির্সাপাতি-গোপালভোগ-ল্যাংড়া আমবাগানের বাহার। সর্বক্ষণ ও সর্বত্র এই ঘৃণারই জয়জয়কার। এই ছিদ্রান্বেষণ। অপরিপক্ব গর্তান্বেষীদের গুঁতোগুঁতিতে গ্রস্ত ও আবিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার আকাশবাতাস। দুইটা বাং-ইং অক্ষরের ফোঁটা পেটে পড়তেই পোলাদের মুখে একচেটিয়া মাতান্ত-বাপান্ত!
কোটেশন্ টুকতে পারব না, তবে একটা ব্যাপার পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কোনো-এক রচনায়, সেইটা আলগোছে উদ্ধৃতিদিকচিহ্নহীন টোকা যায় এখানে। শ্লেষ, বক্রোক্তি, ব্যাজস্তুতি ইত্যাদি বাংলা রচনপ্রক্রিয়ায় নেসেসারি অর্নামেন্টবিশেষ। কোনোটাই ‘দি অর্নামেন্ট’ নয়, নিশ্চয়, কিন্তু সব-কয়টাই রপ্ত থাকা চাই রচয়িতার। সর্বাস্ত্রে পারদর্শী থাকা মানে এ নয় যে যখন-তখন যত্রতত্র অথবা খামখেয়ালে অস্ত্র উঁচিয়ে তেড়ে বেড়ানো। আবার একটামাত্র অস্ত্রে নির্ভর হয়ে উঠলেও মরণ অনিবার্য। অস্ত্রের নেসেসিটি আছে, ফের এইটাও সত্যি যে নিরস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দম ও কৌশলবুদ্ধিমত্তা থাকা দূরপাল্লার যোদ্ধার জন্য অত্যাবশ্যক। রবীন্দ্রনাথের কথা নয় এগুলোর একটাও। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, — উৎস মনে নেই বিধায় হদিস বলতে পারব না, কাজেই ডিরেক্ট উদ্ধারযতি কিংবা উক্তিচিহ্ন লটকানো থেকেও রইছি বিরত — বক্রোক্তি একটা অলঙ্কার নিশ্চয়, যেমন শ্লেষ বা জমক ইত্যাদি, এতে লেখার রসবৃদ্ধিও ঘটানো হয়। কিন্তু বক্রোক্তি বা শ্লেষের ভিতর ডুবে গেলেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী রচনার ও রচয়িতার। — এই কথাটায় নিহিত সত্যটুকুতে আস্থা রাখতে পারলে একটা আলো দেখা যাবে ফেরার। বোঝা যাবে এখনকার বিকট আয়তনের রচনারাজির বিপুলসংখ্যায় রচয়িতার অসারতা কোথায় এবং গলতির কারণটুকুও তখন সনাক্ত করা সম্ভব ও সহজ হয়ে আসবে। এত প্রতিক্রিয়াজান্তব রচনাভাঁগাড় দুনিয়ার কোনো গোলার্ধেই মিলবে না আর। দুনিয়াটা তো স্বচক্ষে স্বজিহ্বায় পায়ে হেঁটে হেঁটে চেখে দেখি নাই, নিশ্চয় দেখব ভবিষ্যতে কখনও, তবু অনবলোকনেও ওই-রকম মনে হয়।
৮
এখন, হেথাহোথা, চারপাশে, প্রত্যহ, বঙ্গীয় ও বঙ্গজ বিদ্যাজগতে এবং বিদ্যাজগতের বাইরে বিশাল ভুবনে, প্রচুর চিন্তাভাবনার সনে দেখা হয়, হররোজ, মুহূর্মুহূ দেখা হয়, উপর্যুপরি দেখা হয়, মন ও বুদ্ধি নিবেশ করে পড়ি যা-কিছুই মগজে জোটে, এবং পড়ে প্রশংসাও করি, বাউ-ডাউন্ হই, হ্যাটস্-অফ করি, কুর্নিশ করি সেইসব শক্তিশালী চিন্তাভাবনারাজিকে, সেইসব চিন্তাবীরদিগেরে মেমোরিতেও হয়তো-বা রাখি, কিন্তু কোথাও তবু কিছু বাকি রয়ে যায়, কিছু-একটা কাঁটা রয়ে যায়, একটা খচখচ রয়ে যায়, এক বিকট অস্বস্তিকর খাদ রয়ে যায়, এবং সেইটা আমি কখনো উচ্চারিয়া বলি না, আমরা উচ্চারিয়া বলি না তা, আমরা চেপেই যাই, কিংবা বলা ভালো সবসময় বুঝতেও পারি না আমরা হয়তো-বা। ব্যাপারটা হলো, সমস্ত চিন্তাভাবনা আর তার প্রকাশভঙ্গি ভীষণ অমানুষিক, বেশিরভাগ সময়েই তাই, কিন্তু শক্তিশালী চিন্তা সবই, যুগোপযোগী সবই, নিঃসন্দেহ, সন্দেহ করি না, কাজেও লাগে এবং খুব কাজেও বটে লাগাই, নিজে আমি সেইসব চিন্তায় লাইক্ ঠুকিয়া যাই, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, কমেন্ট ঠুকিয়া যাই, সঙ্গত কারণেই ঠুকি, কিংবা সঙ্গত-অসঙ্গত বোঝাবুঝির মতো অত সময় ব্যয় না-করিয়া যাই বিস্তর লাইক্ ঠুকিয়া, লাইক্ করি কমেন্ট করি, কিন্তু কাঁটাটা খোঁচায় ঠিকই, ইগ্নোর করে যাই, ওভার্ল্যুক্ করি, কিন্তু অমানুষিকতার যে-একটা কাঁটা সেইসব চিন্তায় থাকে সেগুলো টেইকেন্-ফর-গ্র্যান্টেড ধরে নিয়েই চিন্তাচর্চা করে চলি আমরা। চিন্তাজাগতিক পরিসরগুলোতে এখন এত কম্পার্টমেন্টালাইজেশন্, এত নির্মানুষ এত বিমানবিকতা, এত শোভিনিস্টিক্ অ্যাপ্রোচ্ দৃশ্যমান! আর বিপন্ন হয়ে দেখে যাই খালি ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিপাঠ্য যুক্তিবিদ্যা বইয়ের আরোহী-অবরোহী যুক্তি নিষ্পন্নকরণের ছাত্রসখা উদাহরণাবলি। ইনবক্সে যে-কথাটা প্রাইভেইটলি বলা বাঞ্ছনীয় হতো হয়তো, কমেন্টে এবং অন্যান্য ওপেন্ স্পেসগুলোতে সেইটা আমরা বান্ধববেষ্টিত হুহুঙ্কারে এমনভাবে এক্সপ্রেস্ করে যাই যে দেখেশুনে রতিবিগত বুড়া লাশের গতরেও হিক্কা ওঠে। যেইটা পাব্লিক্লি প্র্যাক্টিস্ করা দরকার, অবশ্যকর্তব্য যা-কিছু সক্কলে মিলে, সেইটা আমরা জানিই না যেন! বহু মানুষ কথা বলার স্কোপ্ পাবে এমনভাবে স্পেস্ বজায় রেখে লেখাটা/বাচনভঙ্গিটা আর্টিক্যুলেইট করা আমাদের নবজাগ্রত রচনাসৈনিকদের ট্রেইনিঙের অন্তর্ভূত নয় মনে হয়। এমনকিছু মানুষ আমি চিনি যারা ঠিক ডিজুস্ কালচারাল্ লিঙ্গুয়ার সঙ্গে পেরে উঠতে পারবেন না ভয়ে আমাদের এইসব রোজকার ফেসবুকিশ্ অ্যাক্টিভিটিতে পার্টিসিপেইট করেন না, অথচ তারা আমাদের সঙ্গে চায়ের টেবিলে আমাদেরই মতো ভাবেন ও রাগ-অনাস্থা-আক্রোশ প্রকাশ করেন, এদেরকে আমরা নজর করি না, এরা আমাদের মতো সশস্ত্র ভাষিক/ভাষাসৈনিক নন বলেই হয়তো। অভিজ্ঞতা আমাদিগেরে বলবে যে, পৃথিবীতে একটাও ভালো কবিতা বা আরও অন্যান্য পথ ও পন্থার শিল্পরচনা পাওয়া ভার যা আদ্বিজচণ্ডালে না-বোঝে। তেমনি জেন্যুইন্ চিন্তা সবসময় সহুজে, দেখলেই চেনা যায় যে এইখানে টাল্টিবাল্টি নাই, খেয়াঘাটের মাঝি থেকে শুরু করে স্পেসট্র্যাভেলার পর্যন্ত সকলেই কমিবেশি এর আঁচ পায়। কে বুঝল কতটুকু বা কারা না-বুঝিল ধর্তব্য নয়, আঁচটুকু তো পায়; এবং পায় বিকিরিত উত্তাপ ও আলোটুকু উদ্ভাসিত রচকচৈতন্যের।
৯
লেখা ব্যাপারটা, আমার মনে হয়, বিষয় কিংবা থিম্ কিংবা প্লট অথবা ইয়াব্বড় জ্ঞানবুদ্ধি-চিন্তাচেৎনা প্রভৃতিতে নাই, বিরাজ করে না, লেখা ফার্স্ট এবং লাস্টলি বিশেষ এক উজ্জীবন, উদ্দীপন, উজ্জীবিত/উদ্দীপিত/উন্মথিত মুহূর্ত। অন্তত বকাবকি কিংবা বাউলবৈষ্ণবসুফিগিরি ইত্যাদিতে লেখা দাঁড়ায় না। ব্যাপারটা আদৌ উপেক্ষণীয় নয় যে একেবারে লেস্-এক্সপেক্টেশন্ রেখে, গুড ফর নাথিং মনে করে স্রেফ নিজের তাগিদ ও গরজ থেকে, লেখার কাছে গেলে এবং কাছাকাছি লিভ-ইন্ করে যেতে পারলে লেখা আপনার অজান্তেই ক্রিয়া করবে তার টার্গেটেড অডিয়েন্সের ভিতরে। হেন অকহতব্য বকাবাদ্য পরখিয়া আজিকালি কী-হেতু জানি না খালি মনে হয় একটা-কোনো উজ্জীবিত মুহূর্তের অভাবে ভুগছি আমরা। মাইট বি।
ইন্ট্রেস্টিং। একটা ব্যাপার খেয়াল করবেন, রেস্পোন্স শব্দটার কোনো নিগ্যাটিভ কনোটেশন্ হয় না, যেখানে রিয়্যাকশন্ শব্দটার নিগ্যাটিভ কনোটেশন্ খুব প্রচলিত। যেমন আমরা বলে থাকি : লোকটা খুব রেস্পোন্সিবল্, লোকটা সাংঘাতিক রিয়্যাকশনারি … ইত্যাদি। কিন্তু কথাগুলো অলরেডি আমরা জানি যে, রেস্পোন্স ও রিয়্যাকশন্ উভয়েই কোনো প্রসঙ্গ অথবা অপ্রসঙ্গের সূত্র ধরে উত্তরদান তথা জবাব। উভয়েই উত্তর, তবে এই দুই উত্তরের মাঝে মাত্রাগত ও বৈশিষ্ট্যগত ফারাক বিস্তর। আমাদের সাম্প্রতিক দৈনন্দিন সোশ্যাল্ ইন্টারেকশনের ভার্চুয়্যাল্ স্পেসগুলোতে দেখবেন যে কমেন্ট-কাউন্টারকমেন্টগুলো অধিকাংশত রিয়্যাকশন্, রেস্পোন্স নয়, চেইন্ অফ রিয়্যাকশন্স দিয়াই আমরা আমাদের সান্ধ্যাহ্নিক-নমাজরোজা সারছি সক্কলে; এক-দুইটা ছাড়া বাকি সব-কয়টাই গুণগতভাবে রিয়্যাকশন্। অবশ্য প্রত্যেকটা বাহাসে গুটিকয়ের দেখা মেলে যেগুলোকে রেস্পোন্স বলিয়া সাব্যস্ত করা যায়। এছাড়া আছে দেখতেশুনতে ঠিক রিয়্যাকশনও নয়, একটু হেলাফেলার রেস্পোন্সই। সিউডোরেস্পোন্স বলা যাইতে পারে এদেরে। এগুলোর বেশিরভাগই আবার বুদ্ধিক্লিন্ন আমতাআমতা, যারা প্রাগুক্ত বাইমমাছেরই গোত্রীয় আখেরে, ছাই দিয়াও ধরা যায় না যাদিগেরে। রেস্পোন্স ভুল হতে পারে, কিন্তু তার ইন্টেনশন্ বা অভিপ্রায় সবসময় পোজিটিভ। অন্যদিকে রিয়্যাকশনে যে-জিনিশটা আমরা মিসিং দেখতে পাই তা হলো কমিটমেন্ট। লোভ হচ্ছে একটা উদাহরণ দিতে, দেই? ঠিক আছে। ফেসবুকের কিংবা ব্লগগুলোর চাপানউতোরে দেখবেন, যদি দেখেন খেয়াল করে, মেইনস্ট্রিমড টেন্ডেন্সি হচ্ছে রিয়্যাকশন্। কমেন্টগুলো খেয়াল করবেন, এমনকি লেখাগুলোও! টেক্সটের মূল সুর এসবক্ষেত্রে শতকরা সাতানব্বই ভাগ রিয়্যাকশন্ বলে দেখতে পাই আমরা, রেস্পোন্স খুব রেয়ার; যেই জিনিশটা ‘দায়িত্ব’ ও ‘থট’ প্রভৃতি নিয়া হাজির হতে পারত আপনার সামনে, সেইটা নাই কিংবা প্রায়শ গরহাজির। রিয়্যাকশন্ সবসময় চেইনের জন্ম দ্যায়, যে-চেইন্ অন্তহীন, যে-চেইন্ অমীমাংসিত রয়ে যায়। ফি-হপ্তায় আমাদের দৈনিকপত্রিকা ফান্-ম্যাগাজিনে যেসব মজাদার ভাঁড়ামি ছাপায়, সেইসব জায়গায় নিরীহ গোছের রিয়্যাকশনমার্কা উদাহরণ আমরা পাই, নেভার সুচিন্তিত রেস্পোন্স, অবশ্য ওখানে তা চাইও না নিশ্চয়। কিংবা আমাদের সকল পথের পথুয়া রাজনীতিক ছদ্মবাগ্মীদের গলা-ফাটানো বক্তৃতার প্রত্যেকটা বাক্যই সো-ফার ভয়ঙ্কর রিয়্যাকশনের নমুনা। কালেভদ্রে রেস্পোন্স। আর আমি এইখানে এই রবিসাপ্লিতে কমেন্ট-কনফারেন্সের সেশনে যা চালাইনু এতক্ষণ, তার নাম যদি জানতে চান, তা রিয়্যাকশন্ কি রেস্পোন্স কোনোটাই নয়, একে বলে মাশ্টারি, যা অলোয়েজ্ আননেসেসারি, যা পণ্ডিতির সর্বপ্রাইমারি ডিগ্রি। ইদানীং অকথ্য প্রবণতা আমাদের মধ্যে দেখবেন যে আমরা ভাবের ঘরে একটিবারের তরেও উঁকি না-দিয়া খালি শব্দ নিয়া ভাবি, কিংবা ভাবিও না আসলে শব্দাদি নিয়া, নিছক শব্দ নিয়া গা-ভাসানো ফচকেমো করি, শাঁস ফেলে শসা বা তরমুজের খোসা নিয়া কারবার করি, নিশ্চয় মন্দ নয় শব্দ নিয়া কের্দানি-মর্দানি, নিশ্চয় ভীষণবোদ্ধা তালেবরের কম্ম ভবকাণ্ড থুয়ে স্রেফ শব্দাদি নিয়া ভাবা।
আবার, কোনো কোনো অ্যাকশনই কিন্তু রিয়্যাকশনের বাইরে তেমনকিছু ডিজার্ভ করে না। যে-কোনো ফান্-আইটেম্ বিচার করে দেখলে এইটা হৃদয়ঙ্গম হবে। যেমন, উদাহরণ একটা বানাতে হচ্ছে, এখন ধরেন যদি এখানে এহেন একটি ইশ্যু তুলে কেউ আপনাকে আলোচনার জন্য আহ্বান করে — ভাজা এবং ভাজির মধ্যে পার্থক্য কি জানতে চেয়ে মনে করেন — সেইটি রিয়্যাকশনে আহ্বান ও উদ্বুদ্ধ করে রেদার রেস্পোন্স। অন্যদিকে রেস্পোন্সকম্ম কিন্তু ক্যুইজ্ নয় ইয়াদ রাখতে হবে। রেস্পোন্স প্রোভোক্ করার পক্ষে এইধারা ‘ভাজা-ভাজি’ পৃথকতানির্ণয়কারী ইশ্যুর মেরিট অত্যন্ত দুর্বল। এখন এই ইশ্যু নিয়া আলাপ জমাইতে গিয়া খুব কড়া কড়া দার্শনিক বোলচাল ডেলিভারি দিলে সেইটা রেস্পোন্সিভ হবে যতটা-না তারচেয়ে বেশি হবে ফার্স। বুড়ো শালিকদিগের ঘাড়ে এতই রোঁয়া আজকাল যে একটা আস্ত মনুষ্যজন্ম এরা পার করে দেয় স্রেফ তর্কতেজারতিমত্ততায়; এদের নিয়মিত খদ্দেরও সংখ্যায় বেশুমার, এবং এদেরে দেখে সেই পুরাকালের ইন্ডিয়ান-বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র একটা গান মনের গোড়ায় গোত্তা মারে যেখানে, সেই গানের লিরিকে, ফোটানো চরিত্রটা ‘আমি ডানদিকেও রই না আমি বামদিকেও রই না / আমি দুইদিকেতেই রই পরান জলাঞ্জলি দিয়া রে’ বলিয়া আত্মস্বীকারোক্তি দেয়। এইখানে আক্ষরিক অর্থে ডান-বাম যুগ্মপদ গ্রাহ্য হচ্ছে না বলা ভালো, বর্তমানের লেফট-রাইটে আমাদের কোনো মনোসংযোগ নাই বলা বাহুল্য, তবে এহেন ‘পরান জলাঞ্জলি দিয়া’ আমরণপণ গাছে এবং মাছে-মদে-মাৎসর্যে কোলাহল তোলা স্বাস্থ্যবান্ধব নয় নিশ্চয়।
রিয়্যাকশন্ সবসময়ই ডিফেন্সিভ। ব্যক্ত কোনো বিষয় বা বাচনের বিপরীতে অস্বস্তি কি অসহায় বোধ করলে পরে লোকে ইমিডিয়েটলি রিয়্যাক্ট করে। রিয়্যাকশনের ক্ষেত্রে ইমোশন্ তথা আবেগ সেন্ট্রাল রোল্ প্লে করে দেখতে পাই। রিয়্যাকশনকালীন স্বাভাবিক বিচার ও যুক্তিবুদ্ধি কাজ করে কম। অবশ্য কখনো কখনো, আপদকালীন, রিয়্যাকশন্ খুব কাঙ্ক্ষিত ও কার্যকর আয়ূধ। ধরা যাক, কেউ হামলা করল অকস্মাৎ, এখন ভিক্টিম্ যদি রেস্পোন্স করতে যাইয়া কালক্ষেপণ করে তাইলে তো অবস্থা গুরুচরণ হবার সমূহ আশঙ্কা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইন্টেনশন্যালি রিয়্যাকশন্ প্রদর্শন করা হয় টার্গেটেড কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের বেলায়। রিয়্যাকশনের বড় ডাউনসাইড হলো, যুক্তিবিবর্জিত আবেগের দাদাগিরি। রিয়্যাকশনকারী ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ পরিপ্রেক্ষিতের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে খুব দ্রুত। আর এর আপসাইড হলো প্যাশন্, কিন্তু প্যাশন্ যেন পার্পাস সেন্টার্ড থাকে এ-ব্যাপারে নজর রাখা চাই। প্যাশন্ যেন আনএক্সপেক্টেড আর আনপ্রোডাক্টিভ স্টিম্যুলাস্ হিশেবে ব্যবহৃত না হয়।
অন দ্য কন্ট্রারি, রেস্পোন্স সর্বদা থটফ্যুল্, রেস্পোন্স আবশ্যিকভাবেই রিজনিং দ্বারা প্রণোদিত। রেস্পোন্ডিং স্বভাবের দিক থেকে প্যাসিভ হয়ে থাকে, অথবা সিম্স্ টু বি প্যাসিভ, যেহেতু ক্রমিক অবস্থানগত দিক থেকে রেস্পোন্সকারী ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ সবসময় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকেন। যদিও কার্যত রেস্পোন্স অনেক বেশি অ্যাক্টিভ, কম্প্যায়ার্ড টু রিয়্যাকশন্, লঙ্গার লাস্টিং অ্যাজ্ ওয়েল্ অ্যাজ্ আইডিয়া জেনারেইটিং, এবং এটি কোনো-একটি ইন্টারেকশনের ডিরেকশন্ ঘুরিয়ে দিতে পারে ইতিবাচক উৎপাদনশীলতা সহ। রেস্পোন্ডিং গাইডেড হয় বেশিরভাগটুকু যুক্তি, বিবেচনাবোধ এবং স্বল্প মাত্রার আবেগ দ্বারা। এর আপসাইড হলো, এটি অত্যন্ত পজিটিভ ও সিভিল্ ওয়েতে অডিয়েন্সকে কনভার্সেশনে এনগেইজ্ করে রাখে। শেখার এবং বিকাশের স্পেইস্ এইখানে অনেক বেশি এবং সুগম।
১০
রবিনাথ নিয়া টানাহ্যাঁচড়া বাঙালির বছরওয়ারী প্রিয় প্যাস্টাইম্। ওইটা আজ থেকে নয়, ট্যাগোর নিয়া বাঙালির ইনফিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সজাত চর্চা সাক্ষাৎ ঠাকুরের আর্লি ডেইজ্ থেকেই বিরাজিছে, এর সিলসিলা বহোৎ লম্বি হ্যায়। এই চর্চার স্বরূপ বোঝা আরেক আয়াসসাধ্য ঘটনা। আমরা আলাপ গুটায়ে এনে ক্রমে ভেলা ভিড়াইতে চেষ্টা করছি ঘাটের নিকটে। এ-প্রসঙ্গে একটু ধর্তাই দিয়ে রেখে এগোনো যাক সমুখ তথা সমাপ্তির পানে। এই চর্চার একদিকে যেমন রয়েছে ব্যাপক-প্রকাণ্ড পূজাআচ্চা, আরেকদিকে ট্যাগোরের পটি নিয়া বাহাস-বাখানি, ট্যাগোর-ফাংশন্যারিজ্ নিয়া আলাপালোচনা কালেভদ্রে হলেও মেলে অবশ্য। অথচ দরকার গালাগালি ও গুণপনানির্ভর ট্যাগোরচর্চা হ্রাসকরণ। রবির ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যদর্শনের দোষ কিংবা গুণ কোনোটা জানিয়াই আজ আর আমার পোষায় না। আমার কামে রবিকে ব্যবহার করার স্ট্রেন্থ-উয়িক্নেস্-ওপোর্চুনিটি-থ্রেট অ্যান্যালিসিস্ করা আজকের ফর্য। রবির কবিতায় আমি নিঃসীম সুখ পাই, কিংবা পাই না, ইত্যাদি নিয়া বালখিল্য কথাগাড়ি চিলমারি বন্দরের পানে ঠেলে যাওয়ার মধ্যে এখন আর ফায়দা নাই। ইয়েলো জার্নালিস্টিক্ অ্যাপ্রোচে একটা পাপারাৎসিগোষ্ঠীর কসরৎ-অনুশীলনী চিরকাল জানি বিরাজিবে।
যে-রবীন্দ্রনাথ শুরুতে ছিলেন জীবন ও বাহ্যজগৎবিচ্ছিন্ন, তিনিই পরে নিয়ন্ত্রণ করেন একটি অঞ্চলের মানুষের বাস্তব ও স্বপ্নকে। রবীন্দ্রনাথ এখন হয়ে উঠেছেন এমন এক গ্রন্থের মতো, যা পাঠের প্রয়োজন হয় না; কিন্তু তার সহস্র বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে জীবনের স্তরে স্তরে।
ট্যাগোর নিয়া হালফিল পত্রিকাসাপ্লিগুলোর ইন্ডেক্স-কন্টেন্ট মোস্টলি চর্বিতচর্বণচোষণলেহন ছাড়া আর কিছু নয়। এবং, বলা বাহুল্য, কে না জানে যে বাংলাদশের ‘বুদ্ধিবৃত্তি’-সৃজনকম্ম জুম্মাবারেই চর্চানো হয়ে থাকে। এবং বছরশেষে একটা সালতামামি হয় ফেব্রুয়ারি-ডিউরিং বইমেলায়। এই জায়গাটা থেকে, এই স্থিতাবস্থা থেকে, বেরোনো দরকার। ঘাপলাটা ঘটে এইখানেই যে, এই বেরোতে যেয়ে একটা বাহন ব্যবহার করছি বাপভাই সবাই মিলে; সেই বাহনটা, বা বাহানাটা, গালাগালি। দৃষ্টি আকর্ষণের ইজিয়েস্ট ওয়ে। এতে আপত্তির কিছু নাই। কিন্তু খেয়াল রাখলে বেহতর হয় যে রবিরিবিউকিং লেখালেখির পরম্পরাও অনেক দীর্ঘ। মন্দ ও ভালো, হক্ ও না-হক্, দুই দিকেই রিবিউক্ করা হয়ে আসছে রবিকে উপভোগ্য ও অনুপভোগ্য উপায়ে। একটা আইডিয়া নিতে পারি চকিতে নিচের কোটেশন্ থেকে। দেখতে পারি নিছক প্যারোডিনির্মাতাদের স্ট্যাটাস্ আপডেট এবং তাদিগের সাকিনঠিকানা; খামাখাই নিন্দায়, গালিকীর্তিকলাপে, আমাদেরই তো নমস্য পূর্বজ তারা।
তাঁরা এখন স্মরণীয় হয়ে আছেন সূর্যের সাথে শত্রুতা করার সৌভাগ্যে। নইলে কে মনে রাখতো কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদকে, যিনি একটা পরিপূর্ণ সমাসবদ্ধ উপাধিতে ভূষিত হয়েও কবি নন? ১৮৮৮ অব্দে কালীপ্রসন্ন প্রকাশ করেন তাঁর প্যারোডি-কাব্যগ্রন্থ ‘মিঠে কড়া’। এটি রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’-এর কবিতাগুচ্ছের প্যারোডি ও রবীন্দ্রনিন্দুক পদ্যে পূর্ণ। ‘উড়িসনে রে পায়রা কবি / খোপের ভিতর থাক ঢাকা’ বলে তিরস্কার করেন তিনি রোম্যান্টিক তরুণ কবিকে, যাঁর ‘বকমবকম আর ফোঁসফোঁসানি / তাও কবিত্বের ভাব মাখা!’ জন্ম নিয়েছিলেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, — বিদ্যাসাগরের পৌত্র, ‘সাহিত্য’ নামক একটি ভালো পত্রিকার সম্পাদক। তিনি নিষ্ঠার সাথে আজীবন রবীন্দ্রনিন্দুকের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। এমনকি রবীন্দ্রজীবনের ঘটনাবলম্বনে কুৎসাপূর্ণ গল্পও রচিত হয়েছে। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ নামক এক বিস্মৃত গল্পকার ‘প্রণয়ের পরিণাম’ নামে লিখেছিলেন কুৎসাকাহিনী; আর তা প্রকাশ করেছিলেন, ১৮৯৯-এ, সমাজপতি। ভালো কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। ‘আনন্দ বিদায়’-এ তিনি ‘এখন করো গৃহে গমন নিয়ে আমার কাব্য / আমি আমার তপোবনে এখন একটু ভাববো’ বলে পরিহাসে উপহাসে জর্জরিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। জর্জরিত হয়েছিলেন নিজেও। তিনি ‘চিত্রাঙ্গদা’ ভিত্তি করে তুলেছিলেন অশ্লীলতার অভিযোগ।
ব্যক্তিজৈবনিক কুৎসা আজও চলছে। ‘মেশিন চলবে’ নিশ্চয়, কার সাধ্যি আটকায়, কিংবা কার ঠেকা পড়েছে যে আটকাইতে যায়! ফেঁপেফুলে কুৎসাকাণ্ড সহস্র সর্গের সীমানা ছাড়াইছে বাঙালির রোজকার হরকিসিমের মাইফেলে। কেবল রবিজৈবনিক কুৎসাই নয়, খেয়াল না-করলেও বোঝা যায় এখন বর্তমানে কুৎসা বিনা কানু নাই, গীতবাদ্যও ন্যাচারালিই নাই, আর্গ্যুমেন্ট্যাটিভ বাঙালির বর্তমান যুক্তিতক্কগপ্পো কুৎসাবিপণীতেই পাওয়া যায়। এর সমাজনৃতাত্ত্বিক একটা ব্যাখ্যা আছে নিশ্চয়? হ্যাঁ, তা আছে নিশ্চয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে, এই নিবন্ধকের বাইরে কোনো যোগ্যজনের হাতে। এইসব গালাগালি থেকে একটা সাময়িক ফায়দা এসেছে এ-ই যে, রবিভক্তি কিছুটা ম্লান হয়েছে; এবং, বলা বাহুল্য, রবিমুক্তি কিছুটা হলেও জলপানি পেয়েছে লগিবৈঠার হালে।
যে-উদ্ধৃতিনিচয় এই এপিসোডে নেয়া যাচ্ছে, এই ফাঁকে সেগুলোর উৎস বলিয়া রাখি। ‘মুগ্ধ ও মুক্ত দৃষ্টির রবীন্দ্রবিতর্ক’ শীর্ষক এক সংকলন বেরিয়েছিল ১৯৮৭ সনে, এক নয় দুই নয় আজি হতে তিরিশ বর্ষ পূর্বে, যেখানে চারজন লেখকের পাঁচটা বিতর্কসঞ্চারী রচনা গৃহীত হয়েছে, এর সংকলক হিশেবে নাম পাওয়া যাচ্ছে মুস্তাফা মজিদ এবং বইটা ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের ‘ডানা প্রকাশনী’ থেকে, সেই বইয়ের একটা প্রাণস্ফূর্ত ভূমিকা লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ; আমরা ড. আজাদের ভূমিকাবাক্যের কয়েকগোছা মাত্র নটেগাছ মুড়িয়ে নেবার প্রাক্কালে একবার দেখে নিচ্ছি। ধৃত রচনাপঞ্চকের লেখকবর্গ যথাক্রমে আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সুভো ঠাকুর এবং নারায়ণ চৌধুরী। বইয়ের শুরু ও শেষের রচনাদ্বয়ের রচয়িতা আহমদ শরীফ, সাময়িকপত্রে এ-দুটো প্রকাশের অব্যবহিত পরে ব্যাপক নিন্দাবন্দনা জুটিয়েছিল, ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ এবং ‘রবীন্দ্রসাহিত্য ও গণমানব’ রচনাদ্বয়ের শিরোনাম। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্নিগ্ধশান্ত মনন ব্যয় করে ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তার’ ত্রুটিগুলো অবলোকনকেন্দ্রে এনেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন, জমিদারি টিকিয়ে রাখার সামন্তব্যবস্থার চিরস্থায়িত্ব চেয়েছেন, ড. ইসলামের প্রাবন্ধিক যুক্তিচারণায় হেন উপপাদ্য জোরালোভাবেই অঙ্কিত। রবির ভাই হেমেন্দ্রনাথের ছেলে সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভো ঠাকুর হিশেবেই উনার পরিচিতি, ‘বিস্মৃতিচারণা’ শীর্ষক দীর্ঘ উপন্যাসোপম পারিবারিক কেচ্ছাকাহন উদ্ঘাটনমূলক প্রবন্ধাখ্যানে যে-কাণ্ড করেছেন, তৎকালে এইটা ব্যাপকভাবে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল রবিভক্তকূলেরে। ‘আবাল্য সুভো ঠাকুর বেড়েছেন রবীন্দ্রভক্তি ও বিরোধিতার মধ্যে। এ-রচনাটিতে সে-বিরোধিতা বিষাক্তরূপে প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে স্বার্থপ্রণোদিত মানুষ ছিলেন, এ রচনাটি তা-ই জ্ঞাপন করে।’ এইটা, এই বইটা, একটা ছোট্ট নমুনা রাবীন্দ্রিক ভক্তিমার্গের বাইরে রবীন্দ্রানুশীলনের। এ-রকম অসংখ্য বইপত্র রয়েছে বাংলায়। এবং ভূমিকাভাষ্য প্রণয়নকালে হুমায়ুন আজাদ নিজস্ব ঢঙে একটা আস্ত প্রবন্ধই লিখে উঠেছেন ইনডিড। রবীন্দ্রনাথ পড়ার প্রচুর দিশারী রিমার্কস্ সুলভ ভূমিকাটায়। এবং রয়েছে রবীন্দ্রপঠনের চালু প্রবণতাগুলোর দিকে আজাদের তীক্ষ্ণ ও সুবেদী অঙ্গুলিনির্দেশ, যা কিনা আজও সমান প্রাসঙ্গিক, উত্তরোত্তর বেড়েছে বৈ উবে যায়নি প্রবণতাগুলো।
সমকালীন বাঙালি অবশ্য শিল্প ও শোভায় মুগ্ধ নয়। সৌন্দর্য তাকে আলোড়িত করে না, সুর তাকে মোহিত করে না। রূপ তাকে সম্মোহিত করে না। রবীন্দ্রানুরাগীরাও রবীন্দ্রনাথের কবিতার শোভায়, আবেগে, উপমা-চিত্রকল্পে, ও তার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া অনির্বচনীয় শিহরণে আলোড়িত হন না। … … … যে-রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদী বা আন্তর্জাতিকতাবাদী, যিনি মানুষ ও সভ্যতার কথা ভাবেন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তিত হন ও সে-সম্পর্কে ব্যক্ত করেন নিজের মত, তাঁর দিকেই বাঙালির চোখ নিবদ্ধ এখন। কবি রবীন্দ্রনাথ এখন গৌণ। তাঁর কবিতা পাঠের সময়ও কবিতা আহরণ না করে উদ্যোগী হই ওই কবিতার বিষয়সংগ্রহে, যাকে এলিয়ট তুলনা করেছিলেন কুকুরের দিকে ছুঁড়ে দেয়া মাংসের সাথে।
হ্যাঁ, সেইটাই, হালফিল বাঙালি ইউনিভার্সের বিষয়সংগ্রহকর্মের ঠিকা লইয়াছে মনে হয় ভাবগতিক দেখে। এত সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে হেন ভুবনগেঁয়ো যোগীদের মাধুকরী! নিছক মাংশলোলুপ মদ্দামো। এলিয়টকথিত কুকুরভক্ষ্য ছাড়াও এলিয়ট কল্পনাও করেন নাই এমনতর মাংশেরও তল্লাশকারী আমরা! খালি হিংসা, কুৎসা, অসূয়া। ব্যক্তিক বদখাসলতগুলোর বীরত্বব্যঞ্জিত প্রচার ও প্রোজেকশন্ পুনঃপুনঃ। যদিও রবির ক্ষেত্রে ‘বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ব্যক্তিগত নিন্দা কমতে থাকে, দেখা দেয় ভাবনা-চিন্তা-তত্ত্বগতবিরোধিতা’, হালফিল লিখিয়েদের মধ্যে এই জিনিশ ইহজন্মে দেখতে পাবার সম্ভাবনা আদৌ আছে? ঠেরো, বৎস্য, রোসো!
রবীন্দ্রনাথের সবকিছুই গ্রাহ্য হবে, গৃহীত হবে, বাস্তবায়িত হবে; — এটা হতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কেউ জন্মে নি, জন্ম নেবে না, যে সর্বাংশে গৃহীত। শুধু তাঁর চিন্তা ও মত সম্পর্কেই দ্বিমত থাকবে না; তাঁর বহু কবিতাও আবেদনশূন্য হয়ে পড়বে, যেগুলোকে মনে হবে নিতান্তই পদ্য; এবং এর মাঝে তা হয়েও গেছে। থাকবে তাঁর অনুরাগীরা, যারা আন্তর ও স্বার্থিক কারণে উপভোগ করবে তাঁকে, স্তব করবে তাঁর; স্তাবকতাও করবে। বিরোধীরাও থাকবে, যারা জন্মগত কারণে ও স্বার্থবশত বিরোধিতা করবে রবীন্দ্রনাথের। এবং থাকবে একটি ছোট গোত্র, যারা অনুরাগী বা বিরাগী নয়; যারা তাঁর সৃষ্টি নিরাসক্ত নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ব্যাখ্যা করবে; প্রতিভার রহস্য উদ্ঘাটন করবে।
এখন যদিও সর্ববিদ্যায় পাপারাৎসিদেরই দাপট ও দৌরাত্ম্য, সমাজে এবং রাষ্ট্রে এবং রবিনিন্দনবন্দন ও সার্বভৌম ব্লগে-ফেসবুকে, তবে এই দিন নিশ্চয় নিকটবর্তী দিনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে আমাদেরে। এইটা আশাবাদ, এবং ‘ফালতু’, শুধুই? তা, আজাদের ন্যায় হাই-ব্রু উন্নাসিক পণ্ডিত ব্যক্তিও যদি বিরল এই আশা ব্যক্ত করেন, অন্তত শেষোক্ত গোত্রের ব্যাপারে, আমরা তাহলে কেনই-বা না হব?
১১
রবি নিয়া ভালো-মন্দ রচনা/চাপান-উতোর চলবে অ্যাট লিস্ট আরও কয়েক বছর। ক্যাল্কুলেশনটা, আরও কয়েক বছরের মাত্র-পয়দা-হওয়া ম্যাথমেটিক্স, কীভাবে কষা হলো? সোজা এবং সিম্পল্ ম্যাথ। ধরেই নিচ্ছি উভয়ত বাংলাদেশী এবং ব্রহ্মাণ্ডদেশী বাঙালি আরও কয়েক বছর টিকিয়া যাবে এই চমৎকার কলরোলের ভুবনগাঁয়ে। সেহেতু অন্তত আরেকটা সার্ধশত জন্মবর্ষের উদযাপনঘটনা অ্যারেঞ্জ করার মওকা বাংলাদেশরাষ্ট্রীয় কোনো ইভেন্ট-ম্যানেজমেন্ট কোম্প্যানি পেয়ে যাবে এহেন সম্ভাবনা জোরালো। মহাকালের মা আমাদের প্লাস্টিকবৈশিষ্ট্যবহ মুখের বিস্তর প্রশংসা পেলেও উনারে দেখানো, মহাকালের মায়ের হাজিরা জাহির করা, বর্তমানে বেসম্ভব। রবির ভবিষ্যৎ আমরা জানি না। বাংলার ভবিষ্যৎ কোনোকালে জানা গেলে রবি সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা সুসমাচার সম্প্রচার করা যাইত। তবে এইখানে, এই জীবিত কলম/কিবোর্ডজীবীদের চোয়ালে চাপাতিকোপানোর সহিংস গর্বিতা বাংলাদেশে, গেল কয়েক বছরে যেই হারে নাথসাহিত্যসমগ্র/রবিরচনাগ্রন্থ প্রকাশের হিড়িক লক্ষ করা যাচ্ছে বেনিয়া ম্যাগ্নেট পাব্লিশারদিগের মধ্যে, কেউ যদি ইচ্ছা করেন তো গ্রস্ একটা আইডিয়া পাবেন রবিফিউচার সম্পর্কে। একেবারেই আন্দাজ করতে ব্যর্থ হইলে অবশ্য রবি-প্রোমোটিং প্রতিষ্ঠানাদি বিস্তর রয়েছে দেশে, যাদিগের হাইপোথিসিস্ শুরু-মধ্য-অন্ত ভরে কেবল মহাকালের রবরবা মাতম ও মজমা, অ্যাকাডেমিয়া বা নন্যাকাডেমিক্ এহেন কোনো প্রতিষ্ঠানের বা পুরোহিতের দ্বারস্থ হলেই পিস্ অ্যান্ড হ্যাপিনেস্ পাওয়া যাবে।
যেভাবেই আগাই কি পিছাই অসুবিধা নাই, কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারে একপদের কনশেনশাস্ থাকা চাই আজকের রবিকর্ম প্রসারকারী কিংবা নস্যাৎকারীদিগের অ্যাকশন্-রিফ্লেকশনগুলোতে। এক হচ্ছে যে, ট্যাগোরের প্রসার ও প্রচারক্রিয়ায় যেহেতু দশাসই প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং তা আঙুলগুন্তির মতো অল্পসংখ্যক তো নয়ই, কাজেই ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল্ লেভেলে রবিকীর্তকদের থোড়-বড়ি-খাড়া সালাম-আদাব-শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের নিবন্ধ পয়দানোর পরিশ্রমে নিজেরে পণ্ড করবার কোনো অর্থ হয় না আদৌ। দুই হচ্ছে যে, ব্যাপক শক্তিমত্তা নিয়া ট্যাগোরের জীবন ও সাহিত্য লইয়া আইকোনোক্লাস্ট লেখাপত্রাদিও কম নয় বাংলায়, খোদ রবিজীবদ্দশাতেই সূত্রপাত হয়েছিল রবিমূর্তিবিধ্বংসী লিখনপ্রচেষ্টার এবং আমরা তা দিয়া ব্যাপক উপকৃতও হচ্ছি নিত্য, নবযুগের কাস্তে যেন পূর্বজ কোদালের চেয়ে শার্প হয়। কেবল গালিগালাজ যদি নিজের ক্যাথার্সিস্ ঘটাইবার গরজে হয়, সেখানে যেন ব্যক্তিক বেদনাটা হাজির থাকে, যেন রবির উপর ভর দিয়া ব্যক্তিগত লিখনশৈলীর বাদামপাহাড়টাকে একটু হলেও অগ্রসর করে নিতে পারি, কিছুটা সাফসুতরো করে নিতে পারি যেন নতুন ভাষা ও ভঙ্গিমাটাকে। বেদনা ছাড়া বেদ প্রণয়ন স্বর্ণের প্রস্তরঘট বৈ কিছু নয়। বেদনাটা থাকে যেন, ভঙ্গিমাতেই লীন হয়ে যেন মরে-পচে হেঁজে না যাই। কিংবা গালিগালাজকালে খেয়াল রাখি যেন যে আমার আজিকার রবিরিবিউকিং থেকে আমার সন্তান যেন তার মা-বাপের বোধবুদ্ধি-সৃজনবৃত্তির দৌড় বুঝতে পারে, শেষে যেন এমন শুনতে না-হয় চিতায় চড়ে বা কব্বরে শুয়ে যে শালা আমার বাপে খালি খিস্তি দিয়া মাস্তানি করেছে, ঢেঁকি একটা আকাইম্মার, একটাও উর্দু চুল ছিঁড়তে পারে নাই রবির, নিজে তো মাকুন্দাই ছিল বলিয়া দাড়িগোঁফটা দেখাইতে পারে নাই, দেখাইবে কেমনে, গজায়ই তো নাই। বিপ্লবী তো হইতে পারলই না আখেরে, প্রেমাংশু হইয়া বালের পদক-পুরস্কারটাও জুটাইবার মুরদ হলো না একুশের। খালি খিস্তিমৈথুন করে গেল, বস্তুবিজ্ঞান বুঝিল না। আর এই-সমস্ত কন্সেনশাস্ কালেক্টিভলি নিতে গেলে একফোঁটা ফায়দা নাই, বিপদ বরঞ্চ অধিকতর ঘনায় তাতে, ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল্ কনশেনশাসের মামলা এইগুলা।
আর স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি, স্বীকার আর অস্বীকার, গ্রহণ আর বর্জন, তারিফ আর খারিজ, প্রশংসা আর নিন্দা … প্রাগৈতিহাসিক এই-সমস্ত যুগ্ম গুণবৈপরীত্যের বাইরে বেরিয়ে দেখতে না-জানা পর্যন্ত রবির নতুন উদ্ভাস ও উড্ডয়ন যেমন সম্ভব হবে না, আমাদেরও হবে না আগুয়ানো সমুখের পানে। এগোতে হলে ম্যাচিয়োরিটি আসা চাই নিত্য। ক্রমশ উৎকর্ষ পরিপক্বতার এই পথে। শেইক্সপিয়্যর নিয়া আলোচনায়, কিংবা গ্যোয়েটে, ভার্জিল বা হোমার নিয়া আলাপে যেমন একটা স্ট্যান্ডার্ডের নিচে নামে না তাদের যার যার ভাষাগোষ্ঠী, খামাখা টাইম্ কিল্ করে না গালাগালি দিয়া তাদেরে, তেমনি বৃথা বেহদ্দ গলাগলিও সমান পরিত্যাজ্য মনে করে, মৃত শরীরের কৃমি ঘেঁটে অমৃত মন্থনের কিমিয়া তারা কার্যক্ষেত্রে অ্যাপ্লাই করে না, খামাখা নিজেদের যাত্রানাস্তি/বিলম্ব ঘটায় না জাহাজের পাটাতনকাঠে কেলি করে, রবি কিংবা কাজী/জীবন নিয়া আলাপালোচনায় এই দিকগুলো মনে ও মাথায় রাখলে নিজেদের সমুদ্রাভিযাত্রা আমরা আরও বড় বড় পতাকাসাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারব। সমুখে সুবিশাল জলরাশির পানে অর্জুনদৃষ্টি নিয়া তাকানো চাই, জাহাজডেকের তক্তায় কৃশ নখের খামচানি দিয়া শ্লাঘার লম্ফঝম্প নয়, টু দ্যাট এন্ড জাহাজের মাস্তুল-পাল ও অন্যান্য দড়িদড়া টাইটফিট বাঁধাছাদার কাজে মধু-রবি-কাজী-জীবন প্রমুখ প্রাক-নাবিকদিগেরে এস্তেমাল করা ছাড়া খামাখা গালাগালিবিলাস ইজ্ হাইলি এক্সপেন্সিভ আমাদের জন্য। যতই বলি না কেন হাজার বছরের বাংলা, হাজার বছরের হ্যানত্যান, আমাদের লেখা সাহিত্যের বনেদ তো ‘ওই দেখা যায় তালগাছ ওই আমাদের গাঁ’, মানে বেশি দূরের কারবার নয়, আর কানাবগির ছায়ের ন্যায় আমরা তালগুঁড়িতেই খুঁটছি পোকা আজও। ‘খুলি হাল, তুলি পাল’, সেই লক্ষ্যেই রিগিং ইত্যাদি, ‘ওই তরী চলল’ কি না তা-ও খোঁজপাত্তা চালাব পিরিয়োডিক্যালি নিশ্চয়, কিন্তু ‘খুকু চোখ খুলল’ কি না তার উপরেই ডিপেন্ড করছে বেবাক বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও অন্যান্য মহানাক্ষত্রিক ফেসবুকিশ্ কলাকৈবল্যকলাপ।
রচনাকাল ২০১৫
… …
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS