কানাডায় রাধারমণ ফোক/লোক ফেস্টিভ্যাল

কানাডায় রাধারমণ ফোক/লোক ফেস্টিভ্যাল

বাংলাদেশের এবং গোটা বাংলাভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চারণকবি ও সংগীতমহাজন বাউল রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ। শহর-বন্দর-গাঁয়ে-গঞ্জে দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই বাঙালি রয়েছে সেখানে রাধারমণপঙক্তি কান পাতলেই শোনা যাবে। লোকমুখে বয়ে-চলা বাংলা গানের একটা বড় অংশের ভাণ্ডারী এই লোকদার্শনিক মরমি কবিটি, লোকে যারে একশব্দে রাধারমণ নামেই চিনে ফেলে। গেল দুই-তিন দশকের বাংলাদেশের গানবাজারে স্টুডিয়োরেকর্ডিং অ্যালবামে যেসব গান ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ফোক মিউজিকের সুরের সঙ্গে ফিউশন ঘটানো হচ্ছে দুনিয়ার গাদাগুচ্ছের নানান জিনিশের, মোটাসোটা প্রফিট মার্জিন বাগানো হচ্ছে যেইসব গান ব্যবহার করে, সেসবের উল্লেখযোগ্য অংশ রাধারমণের বা আবদুল করিমের বা হাসন রাজার মতো লোককবিদের কাজ। অথচ মূলের মানুষটাকে সেই অর্থে ইয়াদ করছে কয়জন? রাধারমণের মতো জনপদাবলিকর্তারা বাংলা ল্যান্ডের সাউন্ড এবং মবফিলোসোফিটাকে যেই হিম্মতি কায়দায় ক্যাপ্চার করেছেন তা আবহমান অনুসরণ ও অনুমগনযোগ্য। খুব কম ভূখণ্ডবাসীর কপালে এমন জোটে যে একসঙ্গে এত লোককবি এবং যাদের প্রত্যেকেই নিজের মালসামান নিয়া স্বতন্ত্র হয়েও ভূমিবর্তী ও পরম্পরানিষ্ঠ।

২০১৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে এক শুভ শুক্রবারে কানাডায় রাধারমণ লোকোৎসব আয়োজন ও উনার নামাঙ্কিত উদযাপনের সূত্র ধরে উপরের কথাগুলো মনে এল। কানাডায় বাংলাদেশি ও বহির্বাংলাদেশি মিলিয়ে বেশ বৃহদায়তনের বাঙালির আবাস গড়ে উঠেছে। একজায়গায় নয়, কানাডার বিভিন্ন প্রদেশে এই বাংলাভাষাসূত্রে প্রণয়াবদ্ধ বাঙালিরা থাকেন ছড়ায়েছেটায়ে। এবং বাঙালি যেখানেই যায়, সেইখানেই মিনি বাংলাল্যান্ড গড়ে উঠতে দেরি হয় না। কানাডাবাংলায় চাদ্দিকে রঙিন রোদ্দুর আর ফেস্টের ভেঁপুমুখরিত লোকালয়টায়, মানে যেই ভেন্যুতে ফেস্ট সেইখানটায়, তিন-চারবার চক্কর কেটে দেখা গেল হোর্ডিং-বিলবোর্ড থেকে শুরু করে ফেস্টুনে-পোস্টারে-প্রচারপত্রে সর্বত্র বাংলার লোকমোটিফগুলার সযত্ন ব্যবহার। আবেগের সাজ সাজ রব চাদ্দিকে। এইটা তো বাংলাদেশ না যে সাপ্তাহিক ছুটির দিন কাটাবার ফাঁকে একটা ইভেন্ট করে ফেলা। ফ্রাইডেতে বেশিরভাগেরই ওয়ার্কিং ডে এবং তারপরও লোকে লটবহর নিয়ে ফ্যামিলি-ফ্রেন্ডস সহ উৎসবভেন্যুর কম্পাউন্ডে ঢুকছেন সাড়ম্বর ও সশব্দ। কোণায় কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেকটা জটলা, একেকটা আড্ডা, হাইহ্যালো-করমর্দন মুলাকাত-মুসাফা। ভালোই লাগে এই চিরাচরিত ফেস্টিভ্যালসিন্যারিয়ো।

ভূগোলবইয়ের তথ্য ভুল না হলে সৌরজগতের এই পৃথিবী নাম্নী প্ল্যানেটে একুশে জুন সবচেয়ে দীর্ঘ দিন। এই দিনে, ২১ জুনে, রাধারমণ ফোকফেস্ট ধার্য। সবকিছুই ঠিকঠাক এবং ভেন্যু নির্ধারণ থেকে ধরে ফেস্টম্যাটেরিয়্যাল সমস্তকিছুর স্ট্যান্ডার্ড আপ-টু-দ্য-মার্ক উন্নত। টরন্টো জনপদে সেটল্ড ননরেসিডেনশিয়্যাল বাঙালিরা আগ্রহভরে এই দিনটার জন্য ওয়েইট করছিলেন। মূলত গান, নাচ ও অন্যান্য ললিতকলার নির্বাচিত কতিপয় সৃজনী দিয়ে ফেস্টের পার্ফোমিং পার্টটা সাজানো হয়েছে। এছাড়া পারস্পরিক মুখদেখাদেখি-মিথস্ক্রিয়া আর ভাবিক বিনিময়-লেনদেনের চিন্তা মাথায় রেখে ফেস্টের সোশ্যালাইজেশনের পার্টটাকে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবস্থায়িত করা হয়েছে বলিয়া আগেই জানায়ে রেখেছিলেন অর্গ্যানাইজারদের পক্ষ থেকে উজ্জ্বল দাশ।

উৎসবদিনের কয়েকমাস আগে থেকেই শিল্পীরা রিহিয়ার্স করে নিজেদেরে প্রিপেয়ার করেছেন তিলে তিলে। ২১ জুন টরন্টোতে রাধারমণ ফোকফেস্টিভ্যালে গাইতে দেশ থেকে, মানে বাংলাদেশ থেকে ইনভাইটেড হয়ে, এসেছেন কণ্ঠশিল্পী চন্দনা মজুমদার, আশিক ও পিন্টু ঘোষ। চন্দনা মজুমদার বাংলাদেশের সংগীতসমুজদার সবার কাছে একনামে চেনা এবং সাধা গায়নের শিল্পী হিশেবেই মান্য। ‘মনপুরা’ ম্যুভি দিয়া ব্যাপকমাত্রায় তাঁর জনপ্রিয়তা প্রসারিত হলেও উনি কিরণচন্দ্র রায়ের সুযোগ্য সহধর্মিণী হিশেবেই বিটিভি ইত্যাদির সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রোতাদের লগে সংযোগ গড়ে তুলেছেন সুস্থায়ী এবং পাকাপাকিভাবে। ফেস্টে আগত দর্শকদের বৃহদাংশ চন্দনাজিকে সরাসরি শোনার ইচ্ছা পুষে এসেছেন দূরবর্তী স্টেটগুলা থেকে ব্যাপক হ্যাপা-গ্যাঞ্জাম সামলেসুমলে। পিন্টু ঘোষ অবশ্য অত পরিচিত নন, অত পরিচিতি অর্জনের সুযোগটাও বোধহয় পিন্টুবাবু হারিয়েছেন। ‘চিরকুট’ ব্যান্ডের পিন্টু হিশেবে যারা তারে চেনেজানে তারাও ব্যান্ড থেকে বেরোনোর পরে উনার উল্টাপাল্টা কালোয়াতি লয়-তালে ব্যক্তিত্বহীন পরিবেশনার কারণে উনারে ফালতু হিশেবে এরই মধ্যে বয়কট করবার পথে। রইলেন আশিক, উনারে এই পয়লা জানলাম। খুব ইম্প্রেসড হতে পারি নাই।

কিন্তু শুধু গানই তো নয়, রাধারমণ ফেস্টে ড্যান্স ছিল অন্যতম অ্যাট্র্যাকশন। নৃত্যমালা নিয়া হাজির হয়েছে একাধিক কানাডাবেইসড সোলো আর্টিস্ট ও ড্যান্সট্রুপ। উৎসবটা ‘গানপার’ রিভিয়্যু করবে বলে এর অবদায়ক প্রতিনিধি আগেভাগে ভেন্যু ভিজিট করেছেন এবং অর্গ্যানাইজার টিমের কন্সেন্ট সহ প্রয়োজনীয় প্রিপারেশন সেরে রেখেছিলেন উৎসবদিনের আগেই।

গীতিকবি রাধারমণ দত্তের অনন্য সৃষ্টি লোকগান ও তার জীবনদর্শন নিয়ে কানাডার টরন্টো শহরে আয়োজন করা হয়েছে যে-অনুষ্ঠান, ‘রাধারমণ ফোক-ফেস্টিভ্যাল ২০১৯’, সম্ভবত এমন বৃহৎ কলেবর ও পরিসরে এর আগে রাধারমণ ফেস্ট কানাডায় হয় নাই। আয়োজকরাও কথাপ্রসঙ্গে এই জিনিশটা জানায়া রাখলেন। পথিকৃতের বা পায়োনিয়্যরের তকমাটা তারা পাবেন সন্দেহ নাই। ২১ জুন শুক্রবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত আগাখান মিউজিয়াম মিলনায়তনে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎসবের আয়োজক প্রতিষ্ঠান ড্যানফোর্থ এক্সপ্রেস। আয়োজন-সহযোগী হিশেবে প্রেস্টিজিয়াস এই উৎসবে শরিক হয়েছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড বাংলাদেশ, জেএনআর লিগ্যাল সার্ভিসেস, রিয়েলেটর দেবব্রত দে, দেশে-বিদেশে টিভি, ঝঙ্কার টিভি ও সংস্কৃতিবিনোদন বিষয়ক অনলাইনপত্রিকা গানপার।

রাধারমণ লোক-উৎসবের অতিথি শিল্পী হিশেবে বাংলাদেশ থেকে যেই তিন শিল্পী কানাডায় পার্ফোর্ম করতে এসেছেন, বরেণ্য তিন কণ্ঠশিল্পী, তাদের নাম আগেই ঘোষণা করা হয়েছে, ফের বলা তবু দোষণীয় হবে না, তারা হলেন – চন্দনা মজুমদার, আশিক ও পিন্টু ঘোষ। শুধু এই তিনজনই নয়, গান গাইলেন অনেকে আরও। টরন্টো থেকে গাইলেন শিল্পী তমা পাল, তমা রায় ও সাবু শাহ। শুধু গান নয়, রাধারমণের নামাঙ্কিত উৎসব অপূর্ণ থাকিয়া যায় ধামাইল ছাড়া। ধামাইলসংগীতের প্রবর্তক রাধারমণ দত্তের অনবদ্য উদ্ভাবন ধামাইল নৃত্য। উৎসবে সুরের-গানের তালে তালে ধামাইলড্যান্স পরিবেশন করলেন স্থানীয় শিল্পী-নৃত্যকর্মীবৃন্দ। সুকন্যা নৃত্যাঙ্গন নামে কানাডার একটা ড্যান্সগ্রুপ পরিবেশন করেছে তাদের কাজ। অনবদ্য।

অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ পর্বে টরন্টো ও বাংলাদেশ থেকে আসা রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবী সহ সুধীজন মিলিত হন মিথস্ক্রিয়ায়। আলোচনা-আলাপচারিতায়। মিলনায়তনের প্রবেশদোর খোলা হয় ইভনিং সাড়ে-ছয়টায়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছিল বর্ণিল আয়োজনের রাধারমণ লোক-উৎসব। চন্দনা মজুমদার গেয়েছেন তার স্বভাবনৈপুণ্যের গানগুলা। রাধারমণের গান খুব বেশি কেউই গাইতে পেরেছেন বললে বেশি বলা হবে। চন্দনাও পারেন নাই। সেই সুযোগও হয়তো ছিল না। প্রস্তুতিরও ঘাটতি ছিল মনে হয়েছে। উনার মনপুরা পার্টের গানগুলা লোকে বেশি শুনতে চেয়েছে। পিন্টুও তথৈবচ। আশিকের ভাংড়া টাইপ ফোক মিলনায়তনের ভিতরে ক্যাওস তৈয়ার করেছে বেশ। লোকে এখন হয়তো শব্দের প্রাবল্য আর হাউমাউ গুঞ্জনমুখর পরিবেশ হলেই সেইটাকে মিউজিক ফেস্টিভ্যাল বলে। কে জানে। এরচে বেশি কিছু বলা বা জানা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না।

রাধারমণ লোক/ফোক-উৎসবের এই বিপুল বর্ণাঢ্য তোড়জোড়ের আহ্বায়ক সুদীপ সোম রিংকু। উৎসবের প্ল্যানপ্রোগ্র্যাম-প্রস্তুতি ইত্যাদি নিয়া আলাপের একপর্যায়ে সুদীপ সোম বলেন, এই উৎসবে বাংলাদেশবরেণ্য শিল্পীরা আবহমান বাংলা গানের ভাবগভীর গীতিকবি রাধারমণ দত্তের গান করবেন। এই সাধক কবিকে নিয়ে কানাডায় প্রথমবারের মতো আয়োজন, তথ্যটি শ্রী সোমের কাছ থেকে জানা গেল। উৎসবকে সফল করে তুলতে তিনি সকলের প্রেজেন্স ও স্পন্টেইনিয়াস সাপোর্ট চেয়েছেন। ভবিষ্যতেও উৎসব আয়োজনের ধারা জারি থাকবে কি না জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ খুব-একটা সার্টেইন রিপ্লাই দিতে পারেন নাই।

কিন্তু নয়া জেনারেশনের সংগীতচাহিদা আর তাদের ট্রেন্ড বিবেচনায় রেখে ফেস্ট আয়োজন করতে না পারলে আল্টিমেইটলি ইন-ভেইন যাবে সবকিছুই, এই কথার লগে একমত হলেন আয়োজনকারী কর্মকদলের একজন উজ্জ্বল দাশ। তিনিও মনে করেন ভবিষ্যতে ফেস্ট আয়োজনে আরও যত্নশীল হওয়া ছাড়া বিকল্প নাই। ইম্প্যাক্ট রাখতে চাইলে ইনপুটের দিকে কেয়ারিং হতেই হবে। এদিক থেকে ফেস্ট প্রথমবারের ভুলচুকগুলা থেকে লেসন নিয়া সামনের দিনগুলায় আরও মননশীল গ্রন্থনা হাজির করবে এমন আশা করা ন্যায্য। শুধু কয়েকটা আখড়াই বা হাফ-আখড়াই বিটের পরিবেশনা দিয়া ক্ল্যাপ্স কুড়াইবার জন্য তো উৎসব আয়োজন করা লাগে না। রাস্তার মোড়ে মলমবিক্রেতা মজমা-ক্যানভ্যাসাররা তা আরও চমৎকার পারে। ফেস্টে যেই চিন্তাশীল চর্যা হাজির থাকা লাগে, সেই প্রমাণ এই ফেস্টে পাওয়া যায় নাই। শুধু এইটায় কেন, সব ফেস্টেই ইদানীং তা গরহাজির।

ইউটিউব ইত্যাদির অবারিত সংগীতচর্চার এই দিনে এমন লাইভ অডিয়েন্স সম্বলিত অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে আরও আঁটঘাট বেঁধে প্রেজেন্টেশন করতে না পারলে ইন-ফিউচার বাংলা গানবাজনা-বিনোদনের খত্রা বাড়বে বৈ কমবে না। আমাদের নবপ্রজন্ম এমনিতেই পিছু হটছে এইসব অনুষ্ঠানে যেয়ে লেসন গেইন করা থেকে, এন্টার্টেইনমেন্ট জিনিশটা আজকাল অনেক স্পাইরাল হয়ে গেছে, মেট্রোট্রেনে বা বাসায় বসে সেলফোনে যখন দুনিয়ার সেরা গান শ্রেষ্ঠ পরিবেশনা শোনা যায়, আমি পঞ্চাশ ডলার খর্চা করে টিকেট কেটে ব্যাপক হুজ্জতি হাঙ্গামা করে ক্যাকোফোনি শুনতে বেরোব কোন শখে? এবং রাধারমণ কোমেমোরেইটিং ফেস্টে তারে নিয়া খালি দুইটা নাচাগানা দিয়া তারে আস্ত উপস্থাপনের ক্লেইম করা যাবে না নিশ্চয়। সেক্ষেত্রে এই ত্রুবাদুরের সৃজনবৈচিত্র্য, দুনিয়ার নানাবিধ ফোকের লগে আমাদেরটার তুল্যমূল্য, নয়া হাজিরায় বাংলার লোকসম্পদ দুনিয়ার সামনে কেমন করে নেব ইত্যাদি জিনিশ মাথায় এবং শামিয়ানার তলায় না নিয়া আগামীর দিনগুলায় লাইভে ফেস্ট করা মুশকিলেরই হবার কথা।

গানপার ফিচার ডেস্ক

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you