মাজারে রেইনি দিনের মৌতাত

মাজারে রেইনি দিনের মৌতাত

বৃষ্টির সময় বাবার মাজারে যেয়ে চাতালের একটা-কোনো কর্নার বেছে নিয়ে বসে থাকতে পারলেই হলো। দেখবেন যে বিচিত্র-সব মানুষজন বৃষ্টিবিঘ্নিত অলস-তন্দ্রাশান্ত দোয়াদুরুদ পড়ছে, কেউ-বা পাশের জনের সঙ্গে গল্পগুজব করছে, অদূরের শিন্নিবিতরণের আঙিনা থেকে ভেজা ও উচ্ছিষ্ট অন্নগন্ধ-লোবানঘ্রাণ মিলেমিশে জট-পাকানো অদ্ভুত মৌতাত। দূর থেকে দেখতে পাওয়া পুকুরের পেটে রেইনচিহ্ন, বর্ণমালায় যেমন হসন্ত তেমনি উপর্যুপরি অজস্র হসন্তপাত ভারি বিস্ময়বিমুগ্ধ করে ফেলবে আপনাকে এক-লহমায়, সাইন অফ রেইন ওনলি, উইদাউট অ্যানি সাউন্ড, ঘুমের মতন ঝুমঝুম সাইলেন্সের আবহশব্দ শুধু। মাজারের কোণাকানাচি ব্রিক-বিল্ট, মোজাইককৃত, ফলে রেইন হয় কিন্তু অশব্দ, মিউট রেইনফল। তবুও মাজারের একটা আপন গমগম সবসময় থাকেই, কিংবা পাতকুয়োর মুখে কান পাতলে যেই ঘুঘুপৈখের কুবকুব ধ্বনি, ঠিক ওই সাউন্ডেফেক্ট মাজারে পাঁচওয়াক্তই পাবেন। গোরস্থানের দিকটাতে গেলে অবশ্য শব্দ লভ্য, পৌরাণিক কোনো সময়ের শব্দ বলেই ভ্রম হবে আপনার, লোকালয়ে এই ভ্যারাইটি অফ সাউন্ড আপনি কোথাও সহজে পাবেন না। আর সাইটস্ অ্যান্ড সাউন্ডস্ বেটার কোয়ালিটির জন্য আপনাকে সাজেস্ট করা যাচ্ছে টু গ্য টু দি আউটস্কার্ট, ভালো হয় শাহপরানের মাজারে গেলে। শাহজালাল শহুরে হওয়ায় রেইন হলেও অত ব্রেইনব্লাস্ট ইম্প্যাক্ট হয় না, আর-দশটা জায়গার রেইনি এফেক্টের সঙ্গে এর ভিন্নতাও গোচরে আসে না এর আর্বেইন সেটাপের জন্য। শাহপরান বরঞ্চ অনেক প্যাস্টোরাল ইমেইজারি নিয়া আশেকানদের মজিয়ে রাখেন। ওখানকার নৈশ সংগীতধুন ও ধোঁয়া মানবৈভবপূর্ণ অনেক বেশি। অ্যানিওয়ে। বাবার দেশ তোয়াফ করে যেতে পাসপোর্ট বা পয়সাকড়ি লাগে না, আমন্ত্রণ-অনুমতি কিংবা কারো সম্মতি তো লাগেই না, লাগে নিয়ৎ। পাবন্দ লোকেদের নিয়তেই কামিয়াবি, বাবা কারো মনোবাঞ্চা অপূর্ণা রাখেন না। যেমন অনেকেই সন্তানলাভের আশায় দোয়াখায়ের করে দরগায় বাত্তি জ্বালিয়ে, ডেকচিতে টাকাপয়সা নজরানা দিয়ে বা মাগুরের মুখে মুড়ি ছিটিয়ে, গ্যারান্টি দেয়া না-গেলেও সফল ব্যক্তিদের ইন্টার্ভিয়্যু করে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। এতদঞ্চলে চেরাপুঞ্জির ঘনগন্ধা বারিপাত হয়, এই ইনফো সকলেই জ্ঞাত। তবে বৃষ্টিঋতুতে এখানে এসে কোথায় যেয়ে সবচেয়ে বেশি নিবিড়ভাবে রেইনপাত উপভোগ করা যায়, এ নিয়া কালান্তরের ইবনে বতুতা তথা পর্যটকদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে অনেক। কমন অপিনিয়ন হচ্ছে যে বিগস্ক্রিন বিউটি বৃষ্টি দেখতে হলে য়্যু মাস্ট গ্য অ্যান্ড গেট অ্যা প্লেইস টু দি টিগার্ডেন অ্যারিয়াস অথবা হাওরের মাঝখানে নৌকোছৈয়ের ভিতর শুয়ে-বসে দেখতে পারেন বৃষ্টি। কিন্তু অফবিটের বৃষ্টি পেতে চাইলে এইসব পর্যটকপসন্দ প্লেইসগুলোর বাইরে রয়েছে প্রচুর প্লেইসেস। মাজারগুলো অফবিট বৃষ্টি উপভোগের জন্য স্যুইটেবল খুবই।

২.
সিলেটে শাহজালালের সহচর ৩৬০ আউলিয়া ছাড়াও প্রচুর পির-ফকিরের মোকাম-মঞ্জিল রয়েছে, যে-কারণে চটজলদি নির্ণয় করে ওঠা প্রায়শ দুরূহ হয় অনেকেরই হোয়্যারঅ্যাবাউটস। শুধু সিটি কর্পোরেশন আওতাভুক্ত অ্যারিয়াতেই স্ট্রিটসাইড অলিগলিগুলায় আছে এন্তার মাজার। এর মধ্যে একটা যেমন জিন্দা পিরের মাজার ও খানকা। তারপর ধরেন মধুশহিদ এলাকায় আছে মধুপিরের মাজার, ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে যাবার পথিমধ্যে পড়ে। এই শহরের প্রাণকেন্দ্র, হার্ট অফ দি সিটি, জিন্দাবাজার এলাকাটা যে-পিরের নামে সেই তিনিই জিন্দাপির। কাজেই জিন্দাপিরের মাজার আসলে একেবারে অ্যাভেন্যুঘেঁষা ছোট্ট সমাধি আর তার চারধারে অপরিসর একচিলতে জায়গা। লোকসমাগম খুব-একটা হয় না এই মাজারে। তবে যাওয়া-আসার পথের ধারে দেখতে পাই লোকজন মোমবাতি-ধূপকাঠি ইত্যাদি জ্বালিয়ে নিজেদের মনস্কাম জানায়া অ্যাডভোকেইট নিয়োগ করছে জিন্দাপিরকে। এই মাজারটা কাজেই কাজী ইলিয়াস আবাসিক এলাকার গলিতে ঢোকার আগে, কাজী ম্যানশনের গা-লাগোয়া, একদম পথিপার্শ্বস্থ কোণে অবস্থিত। চৌদিকে কেবলই বিপণিবিতান। মধুশহিদ রোডের মাজারটা সেদিক থেকে বড় জমি জুড়ে, সুপরিসর ও প্রশস্ত টিলার ওপর, গাছপালাঘন নৈসর্গিক নয়নাভিরাম মাজার। তেমনি শহরসংলগ্ন মানিকপিরের মাজার সত্যি দর্শনীয় জায়গা একটা। অনেক উঁচুতে এর মূল মাজারগৃহ। বড় আয়তনের টিলার চারদিক ঘেরা গ্রেইভিয়ার্ড। খুব নিরিবিলি আর ধ্যানমগ্ন সমাহিতির একটা ভাব আসে এর শতাধিক সিঁড়িধাপ বেয়ে একদম চূড়ায় যেয়ে মাজারের প্রাঙ্গনে বসতে পারলে। বেশিরভাগ নিউকামার যারা শর্টকাটে শ্রীহট্টের চার্ম পেতে চান তাদেরকে এই গোরস্থানে যেতে প্রেস্ক্রাইব করি। বৃষ্টিদিনে এই মাজারের লালমাটি আর শ্যাওলাপ্যাঁচানো বৃক্ষকাণ্ডের রূপ খুলে যায় যেন। অবশ্য চাষনিপিরের মাজারটাও মন্দ নয়। এক-সময় নিট-অ্যান্ড-ক্লিন ছিল পরিবেশ, মেইন্টিনেন্স ভালো ছিল, এখন বানরগুলোর ময়লা-করে-ফেলা বাসস্থান পরিচ্ছন্ন করা হয় না সেভাবে, মেসি হয়া থাকে প্রায় সারাবছর। তবু ভালো লাগে। বাচ্চারা ভারি মজা পায় এখানে গেলে। একদম শহরের ভিতরে এত বানর বসবাস করে দেখে বড়রাও অবাক হন নিশ্চয়। কেউ কেউ নিজেদেরকেই দেখতে পান আয়নাবিহীন, এখানে গেলে, জনসমক্ষে সস্ফুট স্বীকার করবেন না যদিও।

৩.
বৃষ্টির দিন বুঝি ক্রমে ফুরায়া আসছে জীবন থেকে আমাদের, হায়, এল বুঝি ভূমিকম্পঋতু!

জাহেদ আহমদ / মে ২০১৫

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you