শেখ সুরাইয়া || রাখাল রাহা

শেখ সুরাইয়া || রাখাল রাহা

কাহিনিটা পড়ে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। নায়িকা হিসাবে বোম্বেতে তিনিই প্রথম এক লাখ রুপি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন। সে-সময়ের সকল নায়ক-নায়িকার চেয়ে তা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। ওস্তাদ ধরে গান শেখেননি, কিন্তু চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই নায়িকা-গায়িকা হিসাবে ছিলেন অপরিহার্য।

তখনও তাঁর কিশোর বয়স পার হয়নি। ব্যাগে করে চকোলেট নিয়ে আসতেন, আর সবাইকে বিলোতেন। বাবার বয়সী নায়ককে শ্যুটিঙের বাইরে ডাকতেন পাপা বলে। সায়গল তাঁর সাথে রিহার্সেলের সময় মজা করে লিনডাউন হয়ে থাকতেন মাইক্রোফোনে মুখের সমতা আনার জন্য। সুরকার তাঁকে টুল এগিয়ে দিতেন দাঁড়ানোর জন্য। বিখ্যাত সকল সুরকারের গান তিনি করেছেন, বিখ্যাত সকল পরিচালকের ছবিতে তিনি কাজ করেছেন। কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছিলেন তাঁর এক নায়ককে। নায়কের সাথে শ্যুটিঙের ফাঁকে বাড়তি সময় কাটানোর জন্য তাঁর গানগুলোও তিনি অনেক সময় লতাকে গাইতে দিতে বলতেন, যখন লতা প্রতি গানের জন্য পারিশ্রমিক পেতেন এক-দুশো রুপি আর তিনি পেতেন এক হাজার রুপি।

Sheikh Suraiya

শ্রোতা-দর্শক তাঁর সুর, অভিনয় আর গ্ল্যামারের জন্য এমন পাগল ছিল যে এক পর্যায়ে তাঁর বাড়ির বাইরে ভিড় সামলাতে পুলিশ নিয়োগ করতে হয়। অথচ আমাদের ছোটবেলায় শোনা গানের মধ্যে লতা-শামসাদের ভিড়ে তাঁর নাম বা কণ্ঠ আলাদা করে চিনতাম না। মধুবালা-বৈজয়ন্তীমালা-নার্গিস-সুচিত্রার মাঝে তাঁর গ্লামারও আলাদা করে চোখে পড়েনি।

তিনি ‘বৈজু বাওরা’, ‘দেবদাস’ বা ‘আনারকলি’ সিনেমারও নায়িকা হতে পারতেন। পারেননি তাঁর নানির কারণে। সে অবিশ্বাস্য রকমের পারিশ্রমিক হেঁকেছিল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই নাতনীর উপর ছিল তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। তাই তাঁর ভালোবাসার মানুষের দেওয়া হীরার আংটি সে সাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলেছিল। কারণ পাত্রটি হিন্দু আর সে তখনও সিনেমায় মাটি খুঁজছে, আর তার নাতনী সুপারস্টার। শ্যুটিঙে কখনো যেন তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষের সাথে মিশতে না পারেন সেজন্য সে সবসময় তাঁর সাথে থাকত।

কোনোভাবেই ভালোবাসাকে পরিণতির দিকে নিতে না পেরে ক্রমশ তিনি গান, অভিনয় আর গ্ল্যামারের আড়ালে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। শেষে সিনেমা থেকে বিদায় নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলেন সেই ষাটের দশকের প্রায় শুরুতেই, যখন তাঁর বয়স তিরিশ পার হয়েছে মাত্র। আর আজীবন অবিবাহিত থেকে চিরবিদায় নিলেন তাও প্রায় এক যুগের বেশি হয়ে গেছে।

https://youtu.be/K2W0DBwOpjE

একবার কোনো এক জরুরি কাজে তাঁর নানিকে শ্যুটিং স্পট থেকে বাড়ি যেতে হওয়ায় আধাঘণ্টার জন্য তাঁর মেকাপরুমে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যান নায়ক। পরবর্তী জীবনে তিনি বলেছেন সেই আধাঘণ্টা অন্তরঙ্গ সময়টুকুই ছিল তাঁর জীবনের সুন্দরতম ক্ষণ। আহা! তিনি শেখ সুরাইয়া (Sheikh Suraiya)।

আধাঘণ্টা সুন্দরতম ক্ষণের জন্য মানুষ আজিও বছরের পর বছর অপেক্ষা করে।

পৃথিবীতে সমাজ, ধর্ম, সম্পদ, রাষ্ট্র — আরো কতকাল মানুষের ভালোবাসার প্রতিবন্ধক হয়ে থাকবে?

… … 

রাখাল রাহা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you