রক মিউজিক বিষয়ে একটি স্লিভ নোট || সালমান রুশদি

রক মিউজিক বিষয়ে একটি স্লিভ নোট || সালমান রুশদি

ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা তাদের ব্যান্ড ‘দ্য মাদার্স অফ ইনভেনশন’ নিয়ে একটা কন্সার্টে পার্ফোর্ম করছেন অ্যালবার্ট হ্যলে। এইটা আমার মনে হয় আর্লি সেভেন্টিসের ঘটনা। আরে, আমি যদি কাঁটায়-কাঁটায় দিনতারিখ বলে দিতে পারি তাইলে তো প্রমাণ হয় যে সেই কন্সার্টে আমি ছিলামই না সশরীর। লোকে বলে, ডেইট হুবহু বলে দেয় তারাই যাদের আদৌ ঘটনার সঙ্গে কোনো সংশ্রব নাই। কিন্তু কন্সার্টেই ছিলাম আমি। গিগ চলছে, এই ধরো অর্ধেকটা আগায়েছে, এমন সময় পেল্লায় গা-গতরের এক কালা আদমি তিনলাফে স্টেজে উঠে গেল; পরনে তার ঝকমকা পার্পলরঙা শার্ট; মনে করিয়ে দেই যে, সেই ইনোসেন্ট দিনগুলাতে নিরাপত্তাটত্তার বালাই ঠিক আজকের মতো অত কড়াকড়ি ছিল না; হাল্কাপাৎলা সিকিউরিটি দিয়া চালানো যাইত কন্সার্ট। তো, মঞ্চে যেয়ে সেই লোকটা বা-আদব ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপার কাছে আব্দার ধরল ব্যান্ডের সঙ্গে সে একটু বাজাইতে চায়, বাজাইয়া ধন্য হবে এমন একটা টোনে বলল আর-কি।

জিগাইলেন জ্যাপা, প্রায় সপ্রতিভ, গম্ভীর গলায়, “আ … আচ্ছা আচ্ছা … আপনি ঠিক কোন ইন্সট্রুমেন্টটা বাজাইতে চাইতেসেন বলেন তো?” উত্তর দিতে যেয়ে লোকটা প্রায় তোৎলায়, আমতা আমতা করে, তারপর বলে, “ভেঁপু।” হর্ন যন্ত্রটা বাজাইতে চায় সে, ভেঁপু বলা যায় জিনিশটা বা বলা যায় শিঙা। বিষাণও বলা যায় বাংলায়। তা, যা-ই হোক, পার্পলশার্ট গাই তার মনোবাঞ্ছা জানায়।

সালমান রুশদি“অ্যাই, উনারে একটা শিঙা আইনা দাও,” কম্যান্ড করলেন ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা। পার্পলজামার লোকটা যেই-মুহূর্তে শিঙায় দিলো ফুঁ, পয়লা নোটটাই পিলে-চমকানো, স্পষ্ট বুঝাইয়া দিলো যে এই শিঙাওয়ালার ফুঁৎকার থেকে সুর বাইরানো বহুদ্দুরে এখনও। ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও চট করে জ্যাপা সামলায়া নিলেন মনে হলো। থুৎনি বিলি কেটে একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা আওয়াজ দিলেন, “হুম্।” তারপর মাইকের কাছটায় গেলেন। “ভাবছিলাম,” স্বরগ্রামভারী শব্দে জ্যাপা আওড়ালেন, “উনারে অ্যাকোম্প্যানি দিতে পারে এমন একটা ইন্সট্রুমেন্ট কই পাই, শিঙাটা যেইভাবে উনি প্লে করতেসেন ওইটার জুড়ি ইন্সট্রুমেন্ট তো ঝট করে মেলানোও মুশকিল।” বলতে বলতেই কিছু-একটা পাওয়া গিয়েছে এমন ভঙ্গির ছদ্ম-উৎসাহব্যঞ্জক আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপার মুখ। “ও হ্যাঁ, অ্যালবার্ট হ্যলের পাইপ-অর্গ্যানটাই শিঙাবাদক আমাদের এই শিল্পী ভদ্রলোকেরে একমাত্র সঙ্গত্ করতে পারে।”

অ্যালবার্ট হ্যলের পাইপ-অর্গ্যানটা আদতে ইয়াব্বড় যন্ত্র একটা, আখাম্বা তার আওয়াজ, তা এতই বিরাটায়তন যে ব্যান্ডগুলোতে এইটা আঁটানো সম্ভব হয় না; কাজেই ডিক্লেয়ার করা আছে এক-প্রকারে যে এইটা ব্যান্ডে এস্তেমাল করার লায়েক না বা ব্যান্ডে ইনকর্পোরেট করার পক্ষে এইটা অতিকায়; কিন্তু এই-মুহূর্তে মাদার্সের একজন মেম্বার সেই বিরাটবপু শিঙাবাদ্যযন্ত্রের আখাম্বা পাইপ বেয়ে উপরে উঠছেন জ্যাপার নির্দেশ মান্য করতে যেয়ে, এক প্রকাণ্ড জন্তুপ্রতিম সেই বাদ্যযন্ত্র, ভেঁপুছিদ্রগুলোর নাটবল্টু খুলছেন হামাগুড়ি দিয়ে, ছ্যাঁদাগুলার প্রত্যেকটা মাথা খুলে এনে পাইপগুলা বাতাসপরিবাহী কি না তা পরখ করছেন; তোড়জোড় বেঁধে প্রস্তুতি সেরে যেই-না শিঙায় ফার্স্ট ফুঁ দেয়া হয়েছে, অ্যালবার্ট হ্যলের ঐতিহ্যবাহী বিশালায়ত ভবন গমগমিয়ে উঠল প্রথমে, এরপর আওয়াজের আওতা এমন হয়ে উঠল যে প্রেক্ষাকামরা আওয়াজতোড়ে ভেঙে পড়বার উপক্রম হলো। শ্রবণবধির আওয়াজ শুধু, লয়-তালের পরোয়া ছাড়া আওয়াজ, ভ্যা-ভ্যা-ভ্যা … ভ্যা-ভ্যুম …

ততক্ষণে স্টেজে সেই পার্পলশার্ট বাজনাশৌখিন লোকটা আনন্দে আত্মহারা, বাদ্যসুখে বিমোহিত, প্রায়-বিগলিত চরিতার্থতার আভাস তার চেহারায়, বেহেশ্তি শিহরণে সে বুঁদ, মনোবাঞ্ছা পুরাণোর ফুর্তিতে বাকরহিত; ওইদিকে জ্যাপা তার স্বভাবসুলভ শয়তানি কৌতুকে সপ্রতিভ।

সালমান রুশদিদুষ্টুমিপূর্ণ কৌতুক রক মিউজিকে দেখা যায় না সেভাবে, এই জিনিশটা — যারে আমরা উয়িট বলি — রকের সঙ্গে তেমন অ্যাসোসিয়্যাটেড না। তাই আমরা হামেশা দেখি যে রক মিউজিশিয়্যানরা স্টেজে উঠে মিউজিক করার ফাঁকে অডিয়েন্স-কানেক্ট-করা বাতচিত করতে যেয়ে কেবল ঘোঁতঘোঁত করেন, অডিয়েন্স তাদের প্রিয় রকারের সেই ঘোঁতঘোঁতি বিমলানন্দে অ্যাক্সেপ্ট ও অ্যাপ্রিশিয়্যাট করে। এই ঘোঁত-করা আওয়াজ, সুরেলা মাধুর্যের বাইরেকার যাবতীয় অচ্ছুৎপ্রায় আওয়াজও, রকের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। ধরুন, ‘স্পাইস গার্লস্’ ইত্যাদি কিছু রম্য অভিজ্ঞতা মনে রেখেও বলতে পারি যে, রক্-ন্-রল্ আগাগোড়া ভার্ব্যাল সাউন্ডগুলোও সংগীতের অধিভুক্ত করে নিতে চেয়েছে; এবং এই নিতে-চাওয়ার ক্ষেত্রে নৈপুণ্য ও পরিতৃপ্তি দুনোটাই রক্-ন্-রল্ হিস্ট্রিতে রয়েছে।

যেমন, এল্ভিসের কথাই ধরা যাক; মনে হয় যেন একটা ছালবাকলা-আঁশওয়ালা গাছের গতরে কেউ নখ দিয়া আঁচড়াচ্ছে।

লেননের কথা ভাবতে পারি, জন্ লেনন; — ওর গলায় এমন একটা ক্ষিপ্রতা, সাধারণ সোজাসাপ্টা সাধা গলায় এইটা আপনি মাথা খুঁড়ে মরলেও পাবেন না; ‘হাউ ডু ইয়্যু ফাইন্ড অ্যামেরিকা’, ‘টার্ন লেফট অ্যাট গ্রিনল্যান্ড’ স্মর্তব্য।

ধরুন-না র‍্যান্ডি ন্যুম্যানের কথাই; শুনে দেখুন তার ‘স্যেইল অ্যাওয়ে’, একটা গান একইসঙ্গে কেমন করে অ্যান্থেমিক এবং স্যাটায়ারিক্যাল হতে পারে এই জিনিশটা আপনি এক্সপেরিয়েন্স করতে পারবেন এইখানটায়। “ইন অ্যামেরিকা, দ্যেয়ার ইজ্ প্লেন্টি ফ্যুড টু ইট / ডোন্ট হ্যাভ টু রান থ্রু দ্য জাঙ্গল অ্যান্ড স্কাফ আপ ইয়োর ফিট” ইত্যাদি।

কিংবা কানে নিন প্যল সাইমনের স্যুরিয়্যাল অনুষঙ্গভরা গানের লিরিকগুলো। “হোয়াই অ্যাম আই সফট ইন দ্য মিডল / হোয়েন দি রেস্ট অফ মাই লাইফ ইজ্ সো হার্ড” …

রয়েছে এন্তার ত্রুবাদুর আরও, খোপের ভিতরে যাদেরে আটকানো সম্ভব হয় না কোনোভাবেই। ইয়াদ করুন টম অয়্যেইটস, যখন তিনি কিসসার আদলে এক ভবঘুরের বিত্তান্ত বলে চলেছেন যেখানে কানাগলির বিলাই আর বাদলিদিনের জবুথবু কুত্তাটা জায়গা পাচ্ছে। “আই গ্যট দ্য কার্ডস্ বাট নট দ্য লাক / আই গ্যট দ্য হ্যুয়িল্স্ বাট নট দ্য ট্রাক / বাট হেহ্ আয়্যাম বিগ ইন জ্যাপান” প্রভৃতি।

জিনিশগুলোতে ব্যাপক উপাদান রয়েছে যেইসব নিয়া আমাদের সাহিত্যসমুজদার জনতা স্টাডি করতে পারে বা অ্যাডমায়ার করতে পারে। এইখানে জানায়া রাখি যে, গানশোনার ক্ষেত্রে গানের কথাগুলা যারা ভাবেন কবিতা, যারা মনে করেন গান মানে কাব্য, সেইসব কবিতান্ধ বোদ্ধা গানসমুজদারদের ভাবনার গ্রাহক আমি না। গানের কাছে কবিতা-হইয়া-উঠতে-হইবেক টাইপের আব্দার ধরাটা আমি রিডিক্যুলাস মনে করি, গানের কাছে যেয়ে কাব্যিকতা দাবি করাটা অলোয়েজ্ ওভারক্লেইম ছাড়া আর-কিছু মনে হয় না আমার। আমি নিশ্চিতভাবেই নিজের কাছে এই স্বীকারোক্তি দিই যে, এই-সমস্ত রকগানের যে-কোনো-একটা লিরিক যদি লিখতে পারতাম আমি তাইলে ভীষণ প্রাউড ফিল্ করতাম। ওই রাতে ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা অ্যালবার্ট হ্যল্ কন্সার্টে যে-ক্যারিজ্মা দেখায়েছেন, যে-কৌতুকনৈপুণ্য যে-হিউম্যর আর যে-একটা আশ্চর্যগতি স্পিড-অফ-থট দেখেছি তার মধ্যে, এইটাই হচ্ছে ট্যালেন্ট, এরেই বলে প্রতিভা। আমার মধ্যে এই মিউজিশিয়্যানদের প্রতিভার ছিঁটাটুকুও যদি থাকত তয় নিজেরে ধন্য মনে করতাম।

সালমান রুশদি

[রুশদির ননফিকশন গদ্যবই ‘স্টেপ অ্যাক্রস দিস্ লাইন’ থেকে গৃহীত, মূল নিবন্ধ ‘রক মিউজিক — অ্যা স্লিভ নোট’ শীর্ষক, গদ্যনিবন্ধটা সালমান রুশদি লিখেছেন ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে, বইয়ের ভিতরে এসেছে এরও দশকখানেক পরে, স্টেপ-অ্যাক্রসের ১০০-১০১ পৃষ্ঠাদুটো জুড়ে এইটা পাওয়া যায়। নিবন্ধটা বাংলায় বেশ ঢিলাঢালাভাবে ট্র্যান্সল্যাট করা হয়েছে। — জা. আ. ।। ট্র্যান্সল্যাটর, কন্ট্রিবিউটর, গানপার]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you