চারিদিকে এত সঙ্কট, বিপর্যয়, দুর্দিন আর দুঃসময়, তারমধ্যেই আইয়ুব বাচ্চু চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। অনেকদিন পর কারো মৃত্যুতে খুব ব্যথিত হলাম। বুকের ভেতর থেকে উঠে-আসা চাপা কান্নার ঢেউ গলার নিম্নভাগে থামিয়ে দিতে হলো। আহা! আমাদের কৈশোর ও তারুণ্যের সেইসব মাতাল দিনগুলো! আইয়ুব বাচ্চুর গানে গানে উন্মাতাল সেইসব দিনগুলোই তো আমাদের জীবনের দুর্ভাবনাহীন শ্রেষ্ঠ সময়! তারপর আমরা বড় হলাম, আর আইয়ুব বাচ্চুকে চলে যেতে হলো অসময়ে। হ্যাঁ, তিনি চলে গেলেন তার প্রিয় রূপালি গিটার ছেড়ে, দূরে, বহুদূরে। বিদায়ের দিনে চোখের অশ্রু গোপন রাখতে বলে গিয়েছিলেন তিনি তাঁর গানে। কিন্তু আমরা আমাদের অশ্রু আর সংবরণ করতে পারলাম কই?
যে-বছর আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ বের হলো, ’৮৫ সালে, সে-বছরই আমি জন্মগ্রহণ করি। তারও প্রায় দশ বছর পরে, যখন আমি ক্লাস ফাইভে, বের হলো বাচ্চুর একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। যতদূর মনে পড়ে, সে-বছরই নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে পাশের বাড়ির স্বপন ভাইদের ঘরে প্রথম শুনি ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ শিরোনামের গানটি। আক্ষরিক অর্থে ব্যান্ডমিউজিকের সাথে সেই প্রথম আমার পরিচয় ঘটে। তবে এটাকে যে ব্যান্ডগান বলে, সেটা বুঝে উঠতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল।
যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, মাদ্রাসায়, দুপুরে টিফিনের বিরতিতে বাজারে যেতাম পরোটা আর ডালভাজি খেতে। জনতা ব্যাংক মার্কেটে মা-মণি স্টুডিয়োতে বাজত ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি তাই তোমার কাছে ছুটে আসি’। স্টুডিয়োর পাশের একটা দোকানের বেঞ্চিতে বসে গান শুনতাম। গান শেষ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ পরে আবার একই গানের রিপিটেশন হতো। এই ব্যাপারটা আমার খুবই ভালো লাগত তখন। মনে মনে স্টুডিয়োওয়ালার সাথে একটা আন্তরিক হৃদ্যতা অনুভব করতাম। প্রতিদিন টিফিনের বিরতিতে দোকানটির পাশে এসে দাঁড়াতাম শুধু এই গানটি শোনার জন্য। প্রতিদিনই যে একই গান বাজত তেমন নয়, তবে প্রায়শই আইয়ুব বাচ্চুর গান বেজে উঠত। সেসব গানের কথা এখন আর মনে নেই। কিন্তু ভালো যে লাগত এটা ঠিকই মনে করতে পারি। তারপর একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই আমার বন্ধু সোহেলের বাড়িতে শুনি ‘কষ্ট’ অ্যালবামের সবগুলো গান।
এভাবে আমরা বড় হতে লাগলাম আর আমাদের কৈশোরবেলাকার নিরুপদ্রব দিনগুলোতে আমাদের চারপাশে বেজে চললো ‘রূপালি গিটার’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘সুখ’, ‘ঘুমভাঙা শহরে’-র মতো আরও কত কত গান। আমাদের অব্যক্ত সব প্রেমে, বিরহে ও বেদনায় ধীরে ধীরে আইয়ুব বাচ্চু হয়ে উঠলেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯৯৯ সালে বের হলো তার একক অ্যালবাম ‘একা’। ২০০২ সালে বের হলো ‘প্রেম তুমি কি’! এই সময়ে আমরা আইয়ুব বাচ্চুতে পুরোপুরি বুঁদ হয়ে রইলাম। ‘রূপালি গিটার’ আর ‘তারাভরা রাত’, ‘ফেরারী এ-মনটা আমার’ … দিনমান আমাদের কণ্ঠলগ্ন। এই গানগুলোতে আমরা বুঝতে পারলাম গিটারে তাঁর কী অসামান্য নিয়ন্ত্রণ আর দক্ষতা! গিটারে তাঁর নিজস্ব স্টাইল, প্লেয়িং ও থ্রোয়িং আমাদেরকে মুগ্ধ করে ফেলল।
আমাদের বেড়ে-ওঠার পুরো সময়টা জুড়ে আমরা তাকে এবং তার ব্যান্ডকে পেয়েছিলাম। সেই অর্থে আমরা হচ্ছি এলআরবিজেনারেশন। আমাদেরকে তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন, শক্তি জুগিয়েছেন এবং বাঁচতে শিখিয়েছেন তারুণ্যে এবং প্রেরণায়। সংগীতে আমাদের সময়ে খুব উল্লেখযোগ্য রকমের বা বড় মাপের লিজেন্ড যে আমরা পেয়েছি তেমন নয়। হাতে-গোনা যে দু-চারজন আছেন তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বাচ্চু তার সময়ের অন্যতম সেরা এবং বাংলা রক্ মিউজিকের কিংবদন্তি রকস্টার। তাকে হারানো মানে বাংলা রক্ মিউজিকের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাওয়া। তাকে হারানো মানে বাংলাদেশ হারালো বিশ্বমানের একজন লিড গিটারিস্টকে।
বিদায় প্রিয় রকস্টার! জেনো, অ্যা রকস্টার নেভার ডাইজ্। আমরা তোমার জন্য অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি ক-ফোঁটা। তোমার প্রিয় অ্যাকুইস্টিক গিটার সঙ্গে নিয়ে ওপারে ভালো থেকো, আর আকাশের তারা গুনতে গুনতে আমাদের অনন্তকাল গান শুনিয়ো। বিদায় লিজেন্ড! বিদায়!
… …
- রকস্টার নেভার ডাইজ্ || হাসান আহমদ - October 19, 2018
COMMENTS