পণাতীর্থের মেলা || সুমনকুমার দাশ

পণাতীর্থের মেলা || সুমনকুমার দাশ

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা নদী জাদুকাটা। হাঁটছি সে-নদীতে জেগে-ওঠা বালুর চর ধরে। বর্ষায় যে-নদীতে উপচে-পড়া নীল পানি সারাক্ষণ থইথই করে, এখন সেখানে বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ধু-ধু বালুচর। সেই বালুচর দিয়ে পয়লা চৈত্রের এক খরতপ্ত দুপুরে হেঁটে চলার সময় বেজায় পানির তেষ্টা পায়। এক-আঁজলা পানি নদী থেকে পান করব কি না, ভাবছি। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘোলাপানি দেখে সেটা করতে মনে আর সায় দিল না। কাঠফাটা রোদে পানির তেষ্টা নিয়ে বালুকাময় চর ধরে হাঁটতে থাকি আপনমনে। নদীর পানিতে স্নানরত নারী-পুরুষ-শিশু। এই স্নানের আবার উদ্দেশ্যও রয়েছে। এটি মূলত তীর্থস্থান। নাম পণতীর্থ। তবে এটি লোকমুখে পণাতীর্থ হিসেবেই বেশি পরিচিত। এমন নামকরণের কারণ পাওয়া যায় ঈশান নাগর রচিত ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ (১৫৬৯) গ্রন্থে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের (১৪৩৪-১৫৫৯) মা নাভা দেবী এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন — তিনি বিভিন্ন তীর্থ জলে স্নান করছেন। সেই স্বপ্নের পর সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি এ বিষয়ে আনমনে চিন্তা করছিলেন। এ সময় তাঁর ছেলে অদ্বৈতাচার্য সেখানে এসে মাকে চিন্তিত দেখতে পেয়ে এর কারণ জানতে চান। নাভা দেবী ছেলেকে আগের রাতের স্বপ্নের কথা শোনান। মায়ের কথা শুনে অদ্বৈতাচার্য এখানেই সকল তীর্থের আবির্ভাব ঘটাবেন বলে ‘পণ’ করেন। অদ্বৈত দৈবশক্তির প্রভাবে তাঁর কথা রাখলেন। তৎকালীন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউড় পরগনার নবগ্রাম এলাকায় একটি পাথরের খণ্ডে ভারতবর্ষের সকল তীর্থকে স্থাপন করেন। সেই পাথরের খণ্ডে ঝরনা তীর্থরূপ পেয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই পানিতে অদ্বৈত-জননী স্নান করেন। প্রায় সোয়া পাঁচ শ বছর আগের এ ঘটনার পর থেকে স্থানটি তীর্থ হিসেবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরিচিতি অর্জন করে নেয়। নবগ্রামে যেখানটায় অদ্বৈতাচার্যের বসতভিটা ছিল, এটি এখন জাদুকাটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে নদীর পার ঘেঁষে রয়েছে শ্রীশ্রীপঞ্চতত্ত্ব মন্দির। পঞ্চতত্ত্ব মানে হচ্ছে পঞ্চদশ শতকে পৃথিবীতে আবির্ভূত শ্রীকৃষ্ণের পাঁচ অবতার। এঁরা হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, শ্রীনিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, শ্রীবাস ঠাকুর ও শ্রীগদাধর। মন্দিরে এই পাঁচজনের মূর্তি স্থান পেয়েছে। আর এই মন্দির ঘিরেই প্রতি চৈত্র মাসে পুণ্যার্থীরা এখানে আসেন এবং নির্দিষ্ট তিথি ও লগ্ন মেনে জাদুকাটা নদীতে স্নান করেন।

পণাতীর্থ ঘিরে নির্দিষ্ট দিনটিতে দেশবিদেশের ভক্ত-পুণ্যার্থীদের মিলনমেলা ঘটে। তবে নদীতে যেমন সবাই স্নান করে পুণ্যার্জনের চেষ্টা করেন, তেমনটি নদীর তীর ঘেঁষে বসে বারোয়ারি মেলা। পুণ্যস্নান আর মেলা, দুটো দেখতেই সেবার হাজির হই তাহিরপুরের লাউড়েরগড়ে। জাদুকাটা নদীর ঘোলা পানিতে পা ডুবিয়ে ধীরে ধীরে মেলাস্থলের দিকে রওয়ানা হই। বাঁশি ও ভেঁপুর শব্দ আর মানুষের হট্টগোল ভেদ করে মেলায় ঢুকে পড়ি। নানা বয়েসি হাজারো মানুষের ভিড়বাট্টা। নারী, পুরুষ, শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, কে না মেলায়! এককথায় লোকে লোকারণ্য। বাবা-কাকা-জেঠাদের কাঁধে চড়ে, মায়ের কোলে চেপে শিশুরাও মেলায় দিব্যি ঘুরছে।

অদ্বৈত প্রভুর মন্দিরে ঢোকার পূর্ব-মুহূর্তে যে পঞ্চাশোর্ধ্ব বাতাসা ও নকুলদানা-বিক্রেতা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখি কী এক বিষয় নিয়ে সমানতালে বাগবিতণ্ডা করে যাচ্ছেন এক মুখরা নারী। সামনে এগোতেই বুঝতে পারি, আসলে বাতাসার দরদাম থেকেই তাঁদের এ দ্বন্দ্ব। সেটি পাশ কাটিয়ে মন্দির-লাগোয়া সরু ধুলো-ওড়া পথটি ধরে সামনে এগোতে থাকি। মিনিট দশেক হাঁটতেই দেখি, এক লোক মাটিতে গামছা পেতে খিরা বিক্রি করছেন। খিরার অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়। খিরার আভরণ হলুদ হয়ে রয়েছে, দেখেই বোঝা যায় — খিরাগুলো পাকা! এরপরও পানির তৃষ্ণা নিবারণের জন্য খিরার বিকল্প তখন আর ছিল না। এক হালি ২০ টাকা। দুটো কিনে খিরার ওপর জমে-থাকা ধুলোর স্তর পাঞ্জাবিতে মুছে মুখে পুরলাম। খিরা চিবোতে চিবোতে সামনে এগোচ্ছি। বারোয়ারি মেলা। তামা-কাঁসা-পিতল থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা, বাসনকোসন, মাটি ও বাঁশ-বেতের কুটিরশিল্প — সব রয়েছে মেলায়। এছাড়া কাপড়চোপড়, প্রসাধনী, গৃহস্থালি সামগ্রী সহ নানা কিসিমের জিনিসপত্রও মেলায় দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। মেলায় যেমন পুণ্যার্থীরা রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাও। ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের ভিড়। যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথার প্রতিচ্ছবি, ‘উৎসব একলার নহে। মিলনের মধ্যেই সত্যের প্রকাশ — সেই মিলনের মধ্যেই সত্যকে অনুভব করা উৎসবের সম্পূর্ণতা।’

পণাতীর্থ স্নান ঘিরে চালু-হওয়া মেলাকে ঘিরেই মূলত নানা ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে ‘উৎসবের সম্পূর্ণতা’ হয়েছে। এই যেমন মধ্যবয়েসি বোরকাপরা এক নারীকে দেখলাম দোকানির সঙ্গে দরদামে ব্যস্ত। কাছে এগিয়ে তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করি। তিনি জানান, তাঁর নাম আমেনা বেগম। মেলার ঠিক পাশেরই একটি গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি পণাতীর্থের মেলায় আসছেন। এই মধ্যবয়সে এসেও ছোটবেলার সেই অভ্যেসের পরিবর্তন হয়নি। কেবল তিনি নন, স্বামী এবং সন্তানদের নিয়েও তিনি মেলায় এসেছেন। আরেকটু দূরে দেখা পেলাম কাসমির রেজার। তিনি পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি। বাড়ি তাহিরপুরের ঘাগটিয়া গ্রামে। চল্লিশ বছর বয়েসি কাসমির বললেন, ‘পণাতীর্থ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনটিতে যে মেলা এখানে হয়, এতে কিন্তু আমাদের (মুসলিম) ধর্মের মানুষও আনন্দচিত্তে অংশ নেন। এটাই এখানকার গ্রামীণ মানুষের রীতি। এটাই বাংলার লোকায়ত বৈচিত্র্য।’ পেশায় শিক্ষক কাসমির শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় ঘরের বাঁশের খুঁটিতে মেলার জন্য পয়সা জমাতাম। বছর শেষে যখন মেলার দিন আসত, তখন সে-খুঁটি কেটে জমানো পয়সা বের করে মেলায় যেতাম। ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত দেখে আসছি — মেলা উপলক্ষে দূরদুরান্ত থেকে আসা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আশপাশের প্রায় সবকটি মুসলিম গ্রাম ও পরিবারে রাতযাপন করছে। আমাদের বাড়িতে এমনটি হয়ে থাকে। এখানে হিন্দু-মুসলমান হাত ধরাধরি করেই মেলায় যান। মেলা উপলক্ষে এই যে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি, এটা গ্রামীণ মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধেরই পরিচয়কে উপস্থাপন করে।’

কাসমির রেজার সঙ্গে আলাপ শেষ হলে বাম দিক ধরে হাঁটতে থাকি। ভাবতে থাকি পণাতীর্থের স্নান উপলক্ষে আয়োজিত মেলার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে। ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পণাতীর্থ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য উল্লেখ রয়েছে। তা নিম্নরূপ —

প্রভু কহে আজি নিশায় আসিবে সর্ব্বতীর্থ;
কালি স্নান করি সিদ্ধ করিহ সব্বার্থ।
নাভা কহে এই কথা কে কহে প্রত্যয়;
প্রভু কহে এই কথা সত্য সত্য হয়।
তবে নিশাকালে প্রভু করিয়া মনন,
যোগে তীর্থগণে তবে কৈলা আকর্ষণ।
যৈছে লৌহগতি অয়স্তাস্ত আকর্ষণে
তৈছে তীর্থগণ আইলা ঈশ্বর স্মরণে।
মূর্ত্তিমতি শ্রীযমুনা গঙ্গা আদি তীর্থ,
প্রভুরে পূজিয়া সবে হইলা কৃতার্থ।

এতে আরও লেখা ছিল —

প্রভু কইল মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী যোগে,
সকলে আসিবা পণ করে মোর আগে।
তীর্থগম কহে মোর সত্য কৈলু পণ,
তব শ্রীমুখের আজ্ঞা না হবে লঙ্ঘন।
তদবধি পণাতীর্থ হৈল তার নাম।
পণাবগাহনে সিদ্ধ হয় মনস্কাম।।

‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থে আরও উল্লেখ রয়েছে —

প্রভু কহে — দেখ মাতা সদা জল ঝরে,
শঙ্খ আদি ধ্বনি কৈলে বহুজল পড়ে।
আশ্চর্য দেখিয়া মাতা নমস্কার কৈলা;
ভক্তি করি স্নান করি দানাদিক সমাপিলা।
তদবধি পণাতীর্থ হইল বিখ্যাত।

‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থে পণাতীর্থের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে মোটামুটি এ-ই ছিল তথ্য। তবে এই পণাতীর্থ স্নান শুরুর কয়েক বছর পর যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তীর্থটির নাম মুখে মুখে পরিচিতি পেতে থাকে, তখন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা নির্দিষ্ট তিথিতে এখানে স্নান করতে উপস্থিত হন। আর মানুষের এই মিলনমেলার সুযোগে এই স্থানটিকে ঘিরে আশপাশের এলাকায় মেলা বসে। আর স্নান যেমন কেবল হিন্দুদের ধর্মীয় রীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে-রকম মেলাও এখানে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। তাই তো মেলায় এখন প্রতিবছর যে লাখো মানুষের সমাগম হয়, সেখানে দুই ধর্মের মানুষের উপস্থিতি প্রায় সমান সমান বলেই জানালেন কাসমির রেজা।

আনমনে মেলায় কিছুটা ঘোরাঘুরি করে ফিরে আসি মন্দিরপ্রাঙ্গণে। দেখি, ডান দিকে একটি গাছের পাশে পাকামতন উঁচু স্থানের কাছে লালশালু কোমরে গুঁজে আর আরেকটি লালশালু দিয়ে তৈরি শার্ট গায়ে চাপিয়ে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়স ষাট থেকে পঁয়ষট্টি হবে। মাথায় অসংখ্য জটা, গলায় রুদ্রাক্ষ সহ নানা ধরনের মালা। এসব  মালার মধ্যে পাথর, তুলসীর মালাও রয়েছে। তাঁর কুঁচ-হয়ে-আসা পেটের চামড়া আর দুই হাতের দৃশ্যমান রগ চামড়া ভেদ করে যেন বেরিয়ে আসছে। কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করি। একটু আলাপ করতে না-করতেই তাঁর সঙ্গে ভাব জমেও যায়। জানতে পারি, তাঁর নাম ধনেশ্বর সাধু। মূল নাম ধনেশ্বর মজুমদার। এই নামের সঙ্গে তিনি আবার ‘পাগল’ শব্দটিও জুড়ে দিয়েছেন। বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। ৩০ থেকে ৩২ বছর আগে বাড়িঘর নদীর গর্ভে চলে গেছে। এখন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে থাকেন। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণের শ্রীশ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পৈতৃকভিটায় স্থাপিত মন্দিরের রাধামাধব মিশ্রের কাছে দীক্ষা নিয়েছেন ২২ বছর আগে। আর ২৫ বছর আগে থেকেই তাঁর গানে হাতেখড়ি হয়েছে চট্টগ্রামের একজন শিল্পীর কাছে।

ধনেশ্বর সাধুর এখন দেশের নানা অঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে সময় কাটে। প্রতি বছরই লাঙলবন্দ, সীতাকুণ্ডের মতো তীর্থ-এলাকায় বারণীতে যান, এমনকী কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের তিরোধান বার্ষিকীতেও যান। আবার ঠিক একই সময়ে পণাতীর্থের ঠিক পাশেই এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধানে শাহ আরেফিনের উরসও অনুষ্ঠিত হয়। পণাতীর্থের লগ্ন দিনের বেলা শেষ হলে ধনেশ্বর সাধু রাতের বেলা উরসে যান। সেখানে মেলায় ঘোরেন আর গান করেন এবং যে-কোনও ফকিরের ডেরায় বসে ফকিরিগানের আসর বসান। এই ঘোরাঘুরি প্রসঙ্গে ধনেশ্বর বলেন, ‘মাউলায় আমাকে ঘোরায়। এরা ঘোরায় বলে ঘুরি। মাবুতে না ঘোরালে কিছু নাই। রসুলে না ঘোরালে কিছু নাই। ঈশ্বর ঘোরায় তাই ঘুরি।’ তিনি জানান, ধর্মীয় উৎসবে আর মাজারে আয়োজিত উৎসব আর মেলায় আগতদের চাহিদা অনুযায়ী তিনি গান পরিবেশন করে থাকেন। কৃষ্ণভজনা, গুরুভজন, বিচ্ছেদ আর লোকগান গেয়ে থাকেন। লালন সাঁই ও শাহ আবদুল করিমের অসংখ্য গানও তাঁর ঠোঁটস্থ।

ধনেশ্বর সাধু যেখানটায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ঠিক পাশেই তিনি মাটিতে একটি ত্রিশূল গেঁথে রেখেছেন। এ ত্রিশূলে একটি রশির সাহায্যে সিঙা আর মহিষের শিং ঝোলানো। পাশেই পাকামতন উঁচু স্থানটিতে দেবী সরস্বতী, মহাদেব, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, মা কালীর বাঁধানো ছবি রাখা। এসব ছবির মাঝখানে রাখা শিবলিঙ্গ আর প্লাস্টিকের সাপ। এই সাপ নাকি কালী মায়ের শাখা, অর্থাৎ নাগমণি, জানালেন ধনেশ্বর সাধু। কেউ এসব মূর্তি ও দেব-দেবীর ছবির সামনে প্রণামি রাখলে ধনেশ্বর সাধু তাঁদের হাতে আশীর্বাদ হিসেবে ‘কাপড়ের লাল সুতো’ তুলে দিচ্ছেন। এভাবেই বিভিন্ন মন্দির, মাজার আর মেলায় মেলায় ঘুরে ঘুরে ‘আশীবার্দ’ বিলিয়ে তাঁর জীবন চলছে। আর সঙ্গী হিসেবে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সরলক্ষ্মী। তিনিই তাঁর সাধনসঙ্গিনী। তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়। সাধনসঙ্গিনী সার্বক্ষণিক তাঁর সঙ্গী হলেও ধনেশ্বর সাধু মনে করেন, দয়াল ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই। তাই দয়ালের সন্ধানেই এখানে-ওখানে ঘুরছেন।

কথায় কথায় বেলা বাড়ে। ধনেশ্বর সাধু আমার অনুরোধে গান ধরলেন —

ও আমার কে আনিল রে
কোথায় ছিল রে
মধুমাখা কৃষ্ণনাম
নদীয়া নগরে শচীমাতার ঘরে
উদয় হইল নিমাই চাঁদ রে
তোমরা নাম ভজো নাম করো
নাম করো সার
হরির নামে ভাসো তরি
হইয়ে যাবে পার
মুখে বলো হরি হরি
কানে জপো ভাই
যত পাপীতাপী
আছে রে ভাই
ভব এই সংসারে
হরির নামে তরে যাবে
সর্বপাপী মিলে।
হরির জলে ডুব দিলে
জুড়ায় মনপ্রাণ
নাম রাখছে কত সুধা
অমৃত সমান
বিজপ্রিয়স বলছে
হরির নাম ছাড়া গতি নাই
প্রেমানন্দে বাহু তোলো
হরি বলো ভাই।।

এই গান শেষ করার পরই ধনেশ্বর সাধু আরেকটি গান ধরেন। তাঁকে যেন নেশায় পেয়েছে। চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হয়ে তিনি গাইছেন —

টাকাপয়সা-বিল্ডিংবাড়ি
থাকবে ভাই রে পড়ে।
আমি একদিন যাব রে ভাই
লেংটা হয়ে।
আসছি লেংটা যাইব লেংটা
ওরে শ্মশানপুরে, অন্ধ শ্মশানঘাটে।
আর হবে না মানবজনম এই সংসারে।

এ গান শেষে ধনেশ্বর সাধু চোখ মেলে তাকালেন। বললেন, ‘আমি সিদ্ধিজগতের লোক। সিদ্ধি না-থাকলে সাধনজগতে থাকতে পারবা না। যে শিল্পী নেশা (সিদ্ধি) খাইব, সেই শিল্পীর জ্ঞান খুলে যাবে। তবে নেশা যেন আবার শিল্পীরে না খায়, সেইটা দেখতে হইব।’ এরপর তিনি পুনরায় গান ধরেন — ‘ও দয়াল ভাণ্ডারি / ভবে আইলাম একা, যাইবও একা / আত্মীয়স্বজন সবই ছাড়ি / যাইব অন্ধশালায়।’ এরপর তিনি আর আমার সঙ্গে কথা বলেন না। কেবল নিজের মতো করে লালশালু দিয়ে তৈরি শার্টটি খুলে ফেলেন। উদোম শরীরে সুতির ডোরাকাটা লাল গামছা বগলদাবা করে জাদুকাটা নদীর দিকে যাওয়া শুরু করেন। তাঁর ডান হাতে বিড়ি। সে-বিড়িতে গাঁজা ঢোকানো। আপনমনে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে তিনি নদীর দিকে যেতে থাকেন। আমার সঙ্গে আর কোনও কথাই বললেন না। কেবল যাওয়ার সময় একটি ‘কাপড়ের আশীর্বাদ’ আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। আর বললেন, ‘এটি রাখ তোর কাছে। রাখ। এটি মহাদেবের আশীর্বাদ।’ আমি তাঁর ছুড়ে-দেওয়া আশীর্বাদ অতি যত্নে পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে রাখি।

ধনেশ্বর সাধুর চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখি। ভাবি, একটু আগে বলা তাঁর কিছু কথা। দিনের বেলা যখন পণাতীর্থের স্নান চলে তখন একই সঙ্গে তিনি বৈষ্ণব ও শাক্ত সাধনায় মত্ত, আবার রাতের বেলা স্নানের লগ্ন শেষ হওয়ার পর শাহ আরেফিনের উরসে ফকিরিগানের জলসা বসান। ফকিরি গানে গানে তিনি পরম সত্তা অর্থাৎ আল্লাহ-বন্দনায় মশগুল থাকেন। যিনি ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু, অথচ আল্লাহ-ভগবান তাঁর কাছে মিলেমিশে একাকার। সে-প্রসঙ্গেও ধনেশ্বর সাধু বলেছিলেন, ‘সব এক। সব এক। মানুষই কেবল বিভাজন তৈরি করে। সবাই মানুষ। কেবল সৃষ্টিকর্তারে ডাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন নামে।’ ধনেশ্বর সাধুর এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে পড়ে যায় সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের মজলিশপুর এলাকার বাউলগানের শিল্পী বশিরউদ্দিন সরকারের কথা। চুয়ান্ন বছর বয়েসি বশিরউদ্দিন ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান, অথচ অদ্বৈতাচার্যের বন্দনাসূচক একাধিক গান রচনা করেছেন। যেসব গান আবার গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতে দীক্ষিতরা বশিরউদ্দিনের নামভণিতায়ই গাইছেন। লোকায়ত বাংলার অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির এ-এক চিরায়ত উদাহরণ। আমার মনে পড়ে বশিরউদ্দিনের লেখা অদ্বৈত মহাপ্রভুকে নিয়ে জনপ্রিয় সেই গান —

পণাতীর্থে যাব অদ্বৈত মহাপ্রভুর বাড়ি
আয় কে যাবে আয় রে, সবাই আয় তাড়াতাড়ি।।

পণাতীর্থে স্নান করিলে
পাপ নাশে গঙ্গাজলে
চলো সবাই দলে দলে পুরুষ-নারী।।

চৈত্র মাসের চৈতানীতে
আসে ভক্ত দিবারাতে
মাথায় জটা ত্রিশূল হাতে প্রেমভিখারি।।

এক নিয়তে যাবে যারা
অদ্বৈত মহাপ্রভুর দয়া পাবে তারা
বশিরউদ্দিন প্রেমের মরা, গায় নামের সারি।।

বশিরউদ্দিন সরকার পণাতীর্থ আর শাহ আরেফিনের উরস ঘিরে যে ধর্মীয় রীতিনীতি আর মেলার প্রচলন হয়েছে, যে দুই স্থানে হিন্দু-মুসলিম ধর্মের মানুষের অবাধ যাতায়াত, তা নিয়েও লিখেছেন সুদীর্ঘ এক গান। মেলার এক কোনায় বসে তাঁকে এ গানটি গাইতে দেখলাম। আহা, কী চমৎকার সমন্বয়ের প্রসঙ্গ এসেছে বশিরউদ্দিনে গানে —

সুনামগঞ্জ জেলা ধরে তাহিরপুর থানা
লাউড়ের গড় এলাকায় হজরত শাহ আরফিনের আস্তানা
জিন্দা ওলি বলিয়া সকলেই মানে
শাহ আরফিনের আস্তানা আছে বিভিন্ন স্থানে
ছোটবেলা আমার নানানানির সাথে
বাসনা হইল যাইতে মেলাতে
ভারত গোমাঘাটে আছে শাহ আরফিনের আসন
আগে সেথায় গিয়া পাহাড় বাইয়া সাত কুয়া করতাম দরশন
তখনকার সময় কোনও মোটরযান ছিল না
সুনামগঞ্জ থেকে সবাই হাঁটিয়া রওয়ানা
সেই সময় রাস্তা ছিল নল-খাগড়ার মাঝ দিয়া
একা যাইত না কেউ বাঘ ডরাইয়া
সম্মিলিত হয়ে যাইত দলবদ্ধভাবে
তখন এলাকায় কিছু লোক ছিল উগ্র স্বভাবে
রাস্তায় কেউ বসে খাবার খাচ্ছে কেউ নাস্তা পান-সুপারি
ভেদাভেদ নাই হিন্দু-মুসলিম পুরুষ কিবা নারী
একই সময়ে অদ্বৈত সাধুর আখড়া বাড়ি হয় পণাতীর্থস্নান
মানুষের ঢল দেখিলে জুড়ায় মনপ্রাণ
একই সময়ে বসে দুজনার দুই মেলা
মনানন্দে আশেক ভক্ত থাকে উতালা
মানুষে মানুষে দেখা ভ্রাতৃত্ব স্থাপন
বোঝা যায় একে অন্যের বড়ো আপন
যার যা তৌফিক মাফিক আস্তানা করে
হাজার হাজার নারী-পুরুষ বসে বালুচরে
শতশত মাইক বাজে হইতেছে ধ্বনি
কেউ গাইতেছে ভাবের গান কেউ উন্মাদিনী
অদ্বৈত সাধুর বাড়িতে বসে সাধুসন্তগণ
তারা সবাই মনানন্দে গাইছেন নাম-কীর্তন
পণ্ডিতেরা মনোযোগে করেন মন্ত্র পাঠ
বোঝা যায় এ যেন সত্য আজব প্রেমের হাট
তীর্থস্নান করার আগে তর্পণ করতে হয়
সেথায় রয়েছেন বসে ঠাকুর মহাশয়
প্রণামি দিয়ে সবাই করে পণাতীর্থস্নান
সাধু-ফকির বাউল যারা গায় তারা গান
বাংলা-ভারত থেকে আসে ভক্তজন
দর্শনার্থী হয়ে পুরায় মনের আকিঞ্চন
লালন সাঁইজির গানে আছে অদ্বৈত সাধুর কথা
তিন পাগলে হইল মেলা সে চয়নে গাঁথা
মানুষ যারা হয়ে গেলেন নাম মরে না
আধ্যাত্মিকতা যুগে যুগে তাদের হয় প্রচারণা
শাহ আরফিন আর অদ্বৈত সাধু
ভক্তগণকে বিলাইতেছেন অমৃত প্রেম মধু
অদ্বৈত সাধুর বাড়ির পশ্চিমপাড়ে ইসকনের মন্দির
নামকরা পণ্ডিত সেথায় হয় তখন হাজির
সারা রাত ভর চলছে ভক্তিমূলক গান
মনানন্দে গাইছে সবাই আকুলিত প্রাণ
গানের ভিতরে মিলে নিগূঢ় কথার তত্ত্ব
ভক্ত যে-জন শুনে সে-জন হইয়া মত্ত
মানুষের ভিতরে মানুষ করছে বিচরণ
গুরুচরণ না ভজিলে সবই অকারণ
দেবজীব গুরু ভক্তি জীবে দয়া করে
নামের গুণে কত পাপীতাপী গিয়াছে তরে
অদ্বৈতবাড়িতে শুধু নিরামিষ খাবার
ভক্তবৃন্দ খাইতে পারে অধিকার সবার
শাহ আরফিনের আস্তানায় আছে লঙ্গরখানার চল
সেখানে বসে খাবার খাচ্ছে কত আশেক পাগল
স্নান শেষে অনেকেই শাহ আরফিনের আস্তানায় যায়
আপন মনে ঘুরে ফিরে মন যাহা চায়
কেউ-বা রাঁধে কেউ-বা কাঁদে কেউ করে ঘুরাফেরা
বোঝা যায় সবাই যেন একই প্রেমে মরা
প্রেমনগরের বাসিন্দা যারা প্রেমবিলাসী
সবসময় আত্মহারা মন যে উদাসী
শাহ আরফিন আর অদ্বৈত সাধুর মেলা
দিনে দিনে হয়ে উঠবে আরও উজালা
মহামানব মহামানুষ তাঁরা কালের সাক্ষী
সত্য প্রতিফলিত হয় তাঁদের মুখের বাক্যি
সু-নজরে যদি তাঁরা কারো পানে চায়
ভবযন্ত্রণা রোগব্যাধি দূরেতে পালায়
মানুষে মানুষ বিরাজে বলছেন শাহ আবদুল করিম
পির আউলিয়া ফকির সাধুর ক্ষমতা অসীম
নাম ছাড়া ডাক রইয়াছে বলছেন ফকির দুর্বিন শাহ
সে-কথা না জানিলে সবই নিরাশা
গুরু বিনে সে আশা কি হইবে পূরণ
নিশ্চয় ভজিতে হবে গুরুর রাঙা চরণ
নাম বাতাইয়া দিবেন গুরু ভক্ত যেজন
কৃপা গুণে আঁধার কেটে পায় নবজীবন
নামের গুণে পাহাড় পুড়ে হয়ে গেল ছাই
নামবিহনে এ ভুবনে কোনও গতি নাই
গুরুবাদী মানুষ যারা বোঝে গুরুধর্ম
গুরু বিনে বোঝে না সে অন্য কোনও কর্ম
গুরুধর্ম গুরুকর্ম গুরুসত্য সার
গুরু বিনে কেমনে হইবে ভবসাগর পার
গুরু ভজিবারে আছে সকলের নির্দেশ
সত্যগুরু পরশমণি দিবেন উপদেশ
উপদেশ মোতাবেক যদি কাজ করিতে থাকি
খুলিয়া যাবে নিশ্চয় ভক্তের অন্ধ আঁখি
শাহ আরফিন ও সাধুর কথা কী বলিব আমি
নাই আমার ভাষাজ্ঞান নাই তো প্রণামি
নিজগুণে যদি তাঁরা দেন চরণছায়া
ধন্য হইবে আমার মাটির মানবকায়া
মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য শুধু বিনিময়
বিনিময় ছাড়া কি আর কোনও কিছু হয়
গুরুদক্ষিণা গুরুর প্রাপ্য ধন
যার কাছে করতে হয় আত্ম-সমর্পণ
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি এ চার
যুগে যুগে দেখি মানুষ অবতার
হিংসা অহংকার থাকলে মানুষ হওয়া যায় না
গুরু বিষয় সামান্য নয় গুরু ভক্তের মনের আয়না
গুরু মিলে ঘরে ঘরে শিষ্য মিলা দায়
নিজে শুদ্ধ না হইলে সবই বৃথা যায়
বাড়ির পাশে আরশিনগর থাকে পড়শি
আপন ভেবে নিতে হয় করে স্বদেশি
শাহ আরফিন-অদ্বৈত সাধুর এ মিলন বন্ধন
আশা রাখি অটুট থাকবে সারাটি জীবন
অক্ষয় অভয় অসাধারণ
বহুরূপধারী মনবিহারী তাঁরা দুইজন
চৈত্র মাসের চৈতানীতে আবার মেলা যখন আসে
আবার মেতে ওঠে সবাই আনন্দ-উল্লাসে
যখন আসে ভক্ত সবার বিদায়ের পালা
যাইতে চায় না কেহ রেখে মিলনমেলা
ধীরে ধীরে মেলার ঘটে অবসান
আগামীতে আসবে বলে থাকে মনের টান
এ ধারা অব্যাহত থাকবে চিরদিন
কালে কালে আসবে ভক্ত নবীন-প্রবীণ
এর বেশি কি বলিব আমি দীনহীন
বশিরউদ্দিন কয় চিরঞ্জীব অদ্বৈত-শাহ আরফিন
এ পর্যন্ত এখানে রাখিলাম বারণ
এ মিলন চির-অম্লান সত্য পরশ রতন।

বশিরউদ্দিন সরকারের গান শেষ হলে পুনরায় মন্দির ফটকের সামনে ফিরে আসি। ততক্ষণে মেলা শেষের পথে। মানুষ কমতে শুরু করেছে। ভাঙা মেলা দেখতে দেখতে কেমন যেন খারাপ লাগছে মনের ভেতর। একটু আগেই এত মানুষের কোলাহল ছিল, এখন হুট করেই পুরো এলাকাটি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। একটু দূরে দেখি, কয়েকজন বিক্রেতা বাঁশের তৈরি টুকরি আর অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রেখে এখনও গুড় আর চিনির তৈরি বাতাসা ও নকুলদানা বিক্রি করে চলেছেন। তাঁদের দেখে এতক্ষণ কাজের কারণে চেপে থাকা ক্ষুধাটা নড়চড় করে। ভাবলাম, দু-একটা বাতাসা মুখে পুরে অন্তত ক্ষুধাটা সামলাই। সেখানে গিয়ে এক পোয়া বাতাসা কিনি। দু-একটি মুখে পুরে বাকিটা কাঁধে রাখা ঝোলায় ফেলি। মন্দিরে ব্রাহ্মণকে দিয়ে লুট না-দিয়েই আমার বাতাসা মুখে পুরে দেওয়ার বিষয়টি লক্ষ করলেন ওই বাতাসা-বিক্রেতা। বললেন, ‘মুসলমাননি?’ আমি না-সূচক জবাব দিলে তিনি যেন চমকে যান। চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে বলেন, ‘হিন্দু হইলে তো আগে বাতাসা কিনে মানুষ মন্দিরে গিয়ে লুট দেয়। এরপরও সেই বাতাসা প্রসাদ অই যায়। তখন মানুষ বাতাসা খায় আর বাড়ির জন্যও নিয়ে যায়।’

আমি চিরায়ত প্রথার এমন ধরন জানি বলে তাঁকে আশস্ত করি। এরপর কথাপ্রসঙ্গে তাঁর নাম-পরিচয় জেনে নিই। তিনি বললেন, তাঁর নাম মো. জাকির হোসেন। বয়স ৩৫। বাড়ি পাশর্^বর্তী বিশম্ভরপুর উপজেলার জলিলপুর গ্রামে। ৭ থেকে ৮ বছর ধরে তিনি এখানে বাতাসা ও নকুলদানা বিক্রি করে আসছেন। এবার আমি তাঁকে বলি, ‘হিন্দুদের তীর্থস্নান হচ্ছে। আর আপনার কাছ থেকেই প্রসাদের জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাতাসা কিনছেন এবং মন্দিরে নিয়ে ব্রাহ্মণের হাতে প্রসাদ হিসেবে লুট দেওয়ার জন্য তুলে দিচ্ছেন।’

জাকির আমার কথার পর বলেন, ‘এটা বিষয় না। এই মেলায় আমার বাপ-চাচারাও বাতাসা-নকুলদানা বিক্রি করেছেন। সেসব সামগ্রী আগেকার দিনেও হিন্দু মানুষজন কিনে মন্দিরে প্রসাদ দিয়েছেন। কে হিন্দু, কে মুসলিম — এটা এখানে কেউ ভাবে না। আসল কথা হলো, ধর্মীয় অনুষ্ঠানটা কেবল হিন্দুদের, আর উৎসবটা সবার। আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও বিপরীত ঘটনা ঘটে।’

গ্রামের এক নিরক্ষর মানুষের কাছ থেকে মানবতার অমর পাঠ নিয়ে আরেকটু সামনে এগোই। জাকিরের ঠিক পাশেই বসেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আরেক ব্যক্তি। তাঁর নাম মো. সুদন মিয়া। তিনিও জলিলপুর গ্রামের বাসিন্দা। সুদন জানালেন, প্রতি বছর পণাতীর্থে লাখো মানুষের সমাগম হয়। এবার স্নানের লগ্নের যথাযথ সময়ক্ষণ পুণ্যার্থীদের কাছে ভালোভাবে পৌঁছেনি। সে কারণে মানুষের উপস্থিতি কম হয়েছে। সবমিলিয়ে ৫০ হাজারের মতো মানুষ মেলায় এসেছে বলে তাঁর ধারণা। সুদন মিয়ার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন বাতাসা বিক্রি করতে করতেই কাছে ডেকে নেন পাশে ব্যবসারত নূর হোসেন নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তাঁর বয়স ৬৫। বাড়ি তাহিরপুর উপজেলার রাজারগাঁও গ্রামে। তিনি বলেন, ‘এতক্ষণ ভিড়ের মধ্যে আপনাদের কথা শুনছিলাম। তাই ডাকলাম। শোনেন, হিন্দু আর মুসলমান কোনও ভেদাভেদ নাই। সবাই মানুষ। শরীর কাটলে সবার রক্তই লাল। কোনটা মুসলমানের রক্ত আর কোনটা হিন্দুর রক্ত, সেটা তো আর রক্ত দেখে বোঝা যায় না। তাই জাত-ধর্ম নিয়া কথা না-বলাই ভালো। আর গ্রামে এসব বিষয় নিয়ে কেউ ভাবেও না। তাই ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা কেবল ধর্মীয় রীতিটুকু ছাড়া বাদবাকি সব কাজে অংশ নেন।’

এবার ব্যবসা কেমন হচ্ছে, নূর হোসেনকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা খুবই মন্দা। বেচাকেনা নেই। আগের বছর বন্যায় এলাকার একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার প্রভাব মেলায় পড়েছে। আগের বছর মেলায় ১২০ টাকা কেজি দরে বাতাসা ও নকুলদানা বিক্রি হলেও এবার একই পরিমাণ মাত্র ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মেলায় গত বছরের চেয়ে মানুষের উপস্থিতি অর্ধেকেরও কম।’

নূর হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বিকেল গড়িয়ে যায়। একটু দূরে দেখি, বসে বসে তখনও মহাতীর্থ সিঁদুর বিক্রি করছেন এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। পাশেই টুপি পরিহিত লম্বা দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি উকড়া (মিষ্টি খই), মুড়ি আর মাঠা বিক্রি করছেন। এসব দেখতে দেখতে মেলাস্থল পেরিয়ে জাদুকাটা নদীর পারে উঠি। তখনও সন্ধ্যা নামেনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার কেবল প্রস্তুতি চলছে। নদীর পার ধরে আমি হেঁটে চলি। হেঁটে চলার কারণে রাস্তার ধুলোতে আমার দু-পা একাকার। কালো জুতা ধুলোয় ধূসর। সেই ধুলোওড়া রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে এবার যাত্রা শুরু করি শাহ আরেফিন উরসে। কারণ, সেখানেও যে বসেছে মেলা। ভাবছি, পুরো রাতটা উরসে ফকিরিগানের জলসা আর মেলা দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দেবো।

[metaslider id=”8137″]
(প্রদর্শিত স্থিরচিত্রগুলো লেখকের সৌজন্যে পাওয়া)

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you