একাত্তরে যে জন্মায় নাই একাত্তর নিয়া তার মেমোয়ার

একাত্তরে যে জন্মায় নাই একাত্তর নিয়া তার মেমোয়ার

শেয়ার করুন:

একাত্তরের পর জন্মেছে এমন কেউ যদি ‘স্মৃতি একাত্তর’ টাইটেলের আন্ডারে ছবি আঁকে, পেইন্টিং করে, ক্যানভ্যাসে পেন্সিলেপেপারে, এচিং এনগ্রেইভিং স্কাল্পটিং করে, একক বা সম্মেলক, সোলো বা সিরিজ আকারে, সেইটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবা তুমি? আদৌ সম্ভব এইটা? ঘটনা সংঘটনের সময় যার জন্মও হয় নাই, তার আবার ওই ঘটনা নিয়া স্মৃতি!

কিন্তু তার আগে একটা জ্ঞাতব্য জরুরি, ডিসক্লোজার একপ্রকার, দিয়া আগাই। ঠিক কোনো চিত্রকরের কাজ দেখে এহেন চিন্তা চাগিয়েছে ভেতরে আমার, নট দ্যাট। যদ্দুর মনে পড়ে এই শিরোনামে, ‘স্মৃতি একাত্তর’, সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ দেখেছি। তিনি তো আমাদের এই ভূখণ্ডে, ছাপচিত্রী হিশেবে এন্টায়ার সাবকন্টিনেন্টে, মশহুর ও মায়েস্ত্রো পেইন্টার এক। বলা বাহুল্য হবে, একাত্তরে তিনি পুরোদস্তুর শিল্পী এবং অলমোস্ট ফেইমাস।

এইটা একটা ব্যাপার জানিয়ে রাখা গেল। তাছাড়া, চিন্তা কেন ও কখন ও কীভাবে চাগায়, কেমনধারায় আগায় চিন্তাক্রিয়া, চিন্তার শৃঙ্খলা, ব্যবস্থা ও প্রণালি, চিন্তার ঘরবাড়িনিসর্গ প্রভৃতি এতই জটিল ও রহস্যাবৃত ও অমীমাংসিত যে, এ নিয়া আলাদা শাস্ত্র গড়ে উঠেছে। এই শাস্ত্র না-জেনে না-বুঝে এস্তেমাল করি আমরা সবাই। কিংবা এই শাস্ত্রের চারিত্র্য এমনই যে, ব্যবহারকারীর অজান্তেই ক্রিয়া করে ভেতরে। এতে দোষের কিছু নাই। দোষঘাট হইলেও কেউ কয়েদ করতে আসে না, ভাগ্যিস, তাইলে এইমতো নোটের পর নোটে এত চোটপাট চালানো কবেই উঠত লাটে।

সে-যা-হোক, যা বলছিলাম, লেট’স্ গেট ব্যাক টু দ্য পয়েন্ট। বলছিলাম, একাত্তরে জন্মও হয় নাই এমন কারো পক্ষে একাত্তরস্মৃতি রোমন্থন করা আদৌ সম্ভব কি না।

হ্যাঁ, নিশ্চয়, সম্ভব। একাত্তরে জন্ম হয়নি এমন লেখক যদি গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ লিখতে পারেন, তো চিত্রকর কেন পারবেন না ছবি আঁকতে! স্মৃতি তো কেবল ব্যক্তিগত নয়, স্মৃতি তো নয় কেবল আমার একলার অঙ্গীভূত, আছে আরও কয়েক প্রকার। তার মধ্যে একটা হলো যৌথস্মৃতি, যূথস্মরণ, সমষ্টিস্মৃতি। সামষ্টিক স্মৃতি। সমাজের স্মৃতি, ইতিহাসের স্মৃতি, মৃত্তিকার স্মৃতি। ইয়ুং প্রমুখের পর যৌথ-অবচেতনা নামের একটা ধারণা এইখানে স্মরণ করা যায়।

কালেক্টিভ কনশাসনেস। সামষ্টিক স্মৃতিচেতনা। এইটা বাহিত হয় প্রজন্মান্তরে, ব্যক্তির যুক্ততা বা উপস্থিতি সরাসরি না-থাকলেও। এইটা আদি থেকেই মানুষের মিথ ও ধর্ম ইত্যাদিতেও বর্ণিত। জন্মপূর্ব সময়ের কথা জানতে পারা, মনে করে ওঠা নিজের জন্মের বহুকাল পূর্বের কোনো ঘটনা, একে তো আমরা জাতিস্মর বলি। সৃষ্টিশীল মানুষ তো এই জিনিশের কারণেই ডিফ্রেন্ট ফ্রম আদার্স, এই জাতিস্মর ব্যাপারটা তার মধ্যে সাধারণের তুলনায় বেশি ক্রিয়া করে বলেই তিনি লিখতে পারেন আঁকতে পারেন সিনেমা বানিয়ে উঠতে পারেন আদিম ও প্রাগৈতিহাসিক কোনো ঘটনার বেদনা ও বেদ নিয়া। তা না হলে তো গবেষকে গোঁৎ গোঁৎ করত আকাশবাতাস ও আসমুদ্রহিমাচল। বাঁচোয়া!

আমাদের শরীরী উপস্থিতির আগের সময়ের জরুরি স্মৃতিগুলা আমরা আহরণ ও ধারণ করি পরিবার থেকে। প্যারেন্টদের কাছ থেকে। গ্র্যান্ডপ্যারেন্টদের কাছ থেকে। গ্রেইট গ্র্যান্ডপ্যারেন্টদের কাছ থেকে। ফ্যামিলি থেকে। অ্যাইঞ্জেল ইভিল সেন্স তৈরি হয় এখান থেকেই। সিনেমা সাহিত্য বই ইত্যাদি বাহিত বোধ তর্কসাপেক্ষ, তর্কমুখর; পরিবার দ্বারা বাহিত বোধ তর্কোর্ধ্ব, তর্কাতীত। অধীত বিদ্যাশিক্ষা সাংস্কৃতিক সচেতনতা দিয়া আমরা আমাদের পরিবারবাহিত বোধটাকেই ইলাবোরেইট করি।

ফিজিক্যাল প্রেজেন্স জরুরি নয় শিল্পরচনায়, স্মৃতিচারণায়। একাত্তর যত দূরবর্তী, স্মৃতিচারণা আর্টরচনা তত সংহত, সন্নিবদ্ধ, সুবেদী, শীলিত, সম্পন্ন।

জাহেদ আহমদ ০২ নভেম্বর ২০১৩

ব্যানারে ব্যবহৃত ছবি / রিফিউজি অফ সেভেন্টিওয়ান, সফিউদ্দীন আহমেদ ওয়েবসাইট 

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you