সন্দীপন স্বল্পায়তন

সন্দীপন স্বল্পায়তন

শেয়ার করুন:

ধরা যাক, দু-একটা ইঁদুর নয়, লেখক সন্দীপনের কথা। বাবু সন্দীপন অবশ্য নিজেকে লেখক মনে করতেন না, সাক্ষাৎকারে এবং অজস্র না-কাহিনিমূলক রচনায় নিজেকে তিনি না-লেখক বলে উল্লেখ করেছেন। অ্যান্টি-অথার অর্থে না-লেখক, সো-ফার আই আন্ডার্স্টুড। নিজেকে না-লেখক বলার পেছনপট ও পরিপার্শ্ব বহুবার তিনি বিবৃত করেছেন, বহু জায়গায়, এবং সেইসব বলনভঙ্গি অননুকরণীয়। দ্য সন্দীপন স্টাইল। বলেছেন, কোনো-এক লেখায়, একদল লেখকের ভিড়ে একজন না-লেখক গর্দভদঙ্গলে বাঘ যথা। আর তার নখর দিয়ে ফালাফালা বাকল চিরে তিনি বের করে আনেন গাছকাণ্ডের সার, ফলের শাঁস, ফুলের নির্যাস। তৈরি করেন অতিকায়ত প্রজাপতি, আগ্নেয় ড্রাগন, মোহন ড্রাকুলা। ঠিক এই কথাগুলো নয় যদিও, সন্দীপনের চয়িত তুলনা-উপমা আরও ভয়ঙ্কর, শ্বাসরোধকারী, তীব্র কুঠার।

সন্দীপন পড়ার প্রাইমারি দিনগুলিতে কেমন যেন অস্বস্তি হতো পড়তে, সেইসময়-একপ্রকার-সাহিত্যনৈতিকতাশাসিত আমার মতো পাঠকের। মনে হতো, ওঁর লেখার প্রেরণাটা তাহলে কি ঈর্ষা? চারপাশের চেনা মানুষগুলোর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার? অসূয়া প্রকাশ আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে? সতীর্থের ছিদ্রান্বেষণ? অন্যের শ্রী দেখে বিদ্বেষ? অপরের সফলতায় ক্রূর চোখে তাকানো? শুধুই সিনিক বীক্ষণভঙ্গি? বিদ্রুপ, শ্লেষ, তিরস্কার আর উপহাস শুধু? অনিঃশেষ ঘৃণার ধারাবাহিকতা? বা, ঠিক এগুলোও নয়। হয়তো মুখ ও মুখোশ খুলে দেখাবার ওটা একটা তরিকা, সন্দীপনীয় তরিকা। বাবু সন্দীপন যত উপন্যাস লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, অথবা যা-কিছু ননফিকশন বা না-কাহিনি গিয়েছেন লিখে, সেসব লেখায় তাঁর বন্ধুবান্ধব, বন্ধুস্ত্রী, সতীর্থ কবিলেখকদের সকলে বেনামে-স্বনামে এসেছেন, সরাসরি প্রায়, শিল্পকুশলী কায়দায়, এবং ধৃত ঘটনাপুঞ্জের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে পরিচিত আমরা আগে থেকে—এমনসব ঘটনা বেছে নিতে দেখা যায় সন্দীপনকে, এবং সন্দীপনের বন্ধুদের না-চিনে তো বড় হবার উপায় ছিল না আমাদের। সেই ঘটনার কুশীলবরাও পরিচিত, ঘটনাও পরিচিত, শুধু ঘটনার বয়ান ও বর্ণনকৌশল নতুন, অভূতপূর্ব।

অবশ্য কৌশলটা তারা তখন একযোগে ব্যবহার করছিলেন, সন্দীপন একা নন, কয়েকজন আরও। জনপ্রিয়দের মধ্যে যেমন সুনীল। কৃত্তিবাসী লেখকগোষ্ঠীর তখনকার ধুন্ধুমার সৃজনমওসুমে নানাভাবেই নিরীক্ষা হচ্ছিল প্রকরণ-আঙ্গিক-কেতা ও কথনবস্তু নিয়ে। ব্যাপারটা হলো, রচয়িতা তাঁর প্রতিদিনের যাপন বা লিভিং লগ্নি করছেন তাঁর লেখায়। এইটা বাংলায় ছিল না আগে, এমনকি আজও নেই বললেই চলে। সেই ষাটের দশকে ব্যাপারটা ইংরেজিতে বিটপ্রজন্ম করছিল, জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ স্মর্তব্য, সন্দীপন-সুনীলরা বাংলায় শুরু করেছিলেন। সঙ্গে নাম নিতে হবে সমীর-মলয় ভ্রাতৃদ্বয় এবং হাংরি জেনারেশনের আরও অনেকের এবং শক্তিরও। অনবদ্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল, পাঠক হিশেবে, আমাদের। পরে এই কৌশল এস্তেমাল করে লেখার বেশ ধুম পড়ে যায়। কৃত্তিবাস আর হাংরির সঙ্গে বিটগোষ্ঠী তথা গিন্সবার্গদের যোগাযোগ তো ক্রমশ সর্বলোকেই জেনেছে। একসময় স্তিমিত হয়ে আসে, কৃত্তিবাস আর হাংরি বুলেটিন বেরোনো বন্ধ হয়ে যায়, নিরীক্ষা ফেলে রোজগেরে লেখায় মন দেন কৃত্তিবাসপাণ্ডারা।

তারপরও সুনীল অনেক লিখেছেন এই ধারায়, তার অভিষেক-উপন্যাস ও শুরুর সময়ের কনফেশন্যাল কবিতাগুলি ইয়াদ হয়, এর মধ্যে সর্বমহলে পরিচিতি পেয়েছে একটা, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ফিল্ম হবার সুবাদে, তা-ও হয়েছিল আরেক বাহাদুরের হাতে, সত্যজিৎ রায় নাম তাঁর, নিশ্চয়ই বিস্মৃত হই নাই আমরা। আর শক্তির যে-কয়টা আখ্যান, সবই তো আত্মজীবন উপজীব্য করে লেখা, উন্নত ও অন্যরকম শক্তিমত্তার বাংলা গদ্যনমুনা সব, ‘কুয়োতলা’ আমাদের অনেকেরই একসময়ের ঘুমহরণিয়া।

এদের সকলেই একসময় যার যার অর্জিত ও চর্চিত স্টাইল কব্জিতে বেঁধে মাথা ঝুঁকিয়েছেন প্রথাগত লেখার প্রকাণ্ড রাক্ষুসে টেবিলে। এবং লিখেছেন, লিখে গেছেন, বাজার ভুলিয়ে মাতিয়ে অবিরাম প্রচুর পরিমাণে। একজন শুধু রয়ে গেছেন কঠিনেরে ভালোবেসে, একেকটা মিতায়তন আখ্যানে নিজের যাপন ব্যবহার করেছেন তাক-লাগানো সুষমা জুতে, এবং সেইজন বাবু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।

এখন পর্যন্ত বঙ্গেতে জন্ম কথাসাহিত্যিক যারা, তারা মনে করেন কবিতায় নিজেকে নিয়ে লেখা যায়, এবং নিজেকে দেখার ভেতর দিয়ে জগৎ দেখা আল্টিমেইটলি কবিতার একচ্ছত্র ও অনন্য কাজ, মনে করেন প্রাতস্মরণীয়-রাতস্মরণীয় সুসাহিত্যিক সকলেই। কিন্তু কথাসাহিত্যের জন্য বাহির পানে তাকানো ব্যতীত গত্যন্তর নাই। এই মহাজ্ঞানের প্রভাবে বাংলাসাহিত্যে উপন্যাস-গল্প বলতেই বোধহয় কথিত গরিবমানুষের কান্নাকাটি। কিংবা ইতিহাসাশ্রিত পিরিয়ডিক ম্যুভিসিনেমা। বাবু সন্দীপন চট্টো কোনোদিন একমুহূর্তের তরেও এইসব অসুখে ভোগেন নাই। দুর্দান্তভাবেই তিনি, দুর্ধর্ষ ভাষা ও ভঙ্গিতে, লিখে গেলেন আমৃত্যু আজীবন বাংলা আখ্যান ও অন্য নানাবিধ গদ্য।

নিজের ও বন্ধুবলয়ের ঘটনা-বাঁদরামি-বদমায়েশি-ঊনমানুষী নিয়ে তুখোড় সব থিম্যাটিক ট্রিটমেন্ট প্রেজেন্ট করেছেন সন্দীপন উপর্যুপরি। নিজের শ্রেণি নিয়ে লেখা, আয়নায় নিজের ব্রণ ও খোসপাঁচড়া দেখার ও সেইটা চাছাছোলাভাবে প্রকাশের সাহস বঙ্গজ লেখককুলে বিরল লভ্য। অথবা সাহসের দোষ নাই বস্তুত, ওই জিনিশ তো হঠকারি রকমেই বেশি আমাদের মধ্যে, বলা যাবে হয়তো হিম্মত অথবা মুরোদ অথবা মাথার ভিতরে কিছু-একটার অভাব। নিজের শ্রেণি নিয়ে লেখায় নিযুক্ত লেখক আমাদের নাই বললেই হইত, শুধু অল্পবিদ্বান হবার কারণে এই নিবন্ধকারের পক্ষে ঠিক কনফিডেন্টলি বলা গেল না। বাবু সন্দীপনে এইসব ভুয়া বিনয় একফোঁটা পরিমাণেও পাওয়া যাবে না, ভাবালুতা আর যৌনতাহীন হবু জায়া ও পতির পিরিতিপ্রেম এই এক লেখকে একটাবারের জন্যও আসে নাই মনে হয়। এইখানে সর্বার্থে সাবালক বাংলা আখ্যানভূমি পেয়েছে বৈধ অস্তিত্ব ও অবস্থান। সন্দীপনের ইডেন গার্ডেনে একটা বাক্যও অযৌন নয়, এমন ফিজিক্যালি ও ইন্টেলেকচ্যুয়ালি সাউন্ড আখ্যানভাগ বাংলায় অলমোস্ট নতুন। সমস্তই অবশ্য অল্পবিদ্বান এই নিবন্ধকের সাক্ষিসাবুদহীন মনে-হওয়া বৈ কিছু নয়।

কখনো কখনো মনে হয়েছে এমনও যে, এইরকম কন্টেম্পোরারি রিসেন্ট ফেনোমেনা আর রিয়্যাল লাইফ প্লট তুলে এনে উপন্যাসে-আখ্যানে হাজির করার মধ্যে একটা অন্য জটিলতাও কি দেখা দেয় না? বাস্তবকে একপ্রকার টেম্পারিং? এই ধারার কাজে তো মুহূর্তের বিচার ক্রিয়াশীল থাকে, সেই আশঙ্কা থাকে, এবং বীক্ষণ দোষগ্রস্ত হয়ে ওঠে, ওঠে না? আশঙ্কা থাকেই তো। অথবা বিচারও নয় সেই-অর্থে, কেবল কিছু-একটা বানিয়ে দেখাবার কৌশল হিশেবে, একপ্রকার ভোজবাজি প্রদর্শন, হাতযশ প্রমাণের মোহ, কিছু-একটা বানিয়ে দেখাবার গরজে বানানো…হতে পারে না এমন? সন্দীপনের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে তা বলছি না, এ-ধারার লেখায় এইরকম কিছু বিপদ বিরাজ করে কি না তা-ই বলছিলাম। সন্দীপনের ব্যাপারটা, আমার মনে হয়েছে, এইদিক থেকে সেইফ। তিনি ঘটনা বা ঘটনার অংশ ব্যবহার করেন লেখায় কেবল উয়েপন হিশেবে, একটা অস্ত্র ও উপায়, একটা টুল হিশেবে, লেখাটাকে এগিয়ে নেয়ার একটা উপায়। তাঁর আখ্যান দাবি করে হার্মেন্যুটিক্স লেভেলের পাঠ, এবং অলোয়েজ তা-ই।

কিন্তু, কথা সংক্ষেপ করি, সন্দীপনী আখ্যানকৌশলে আমরা তো অভ্যস্ত ছিলাম না আসলে। এই পথ ও পন্থাটা আগে ছিল না, পরেও ওইভাবে দেখা যাবে না, আজও নয় অন্তত। অভ্যস্ত ছিলাম না আমরা, ওইভাবে দেখার পন্থায়। তিনি দেখানোর পর মনে পড়ল, আরে, এইভাবেও তো বেশ দেখা যায়! সন্দীপন প্রথানুবর্তী প্রেম-ভালোবাসা আর বাংলাস্টাইল পারিবারিক-ধার্মিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সেন্টিমেন্টাল মেলোড্রামা ইত্যাদি নিয়া জাবর না-কেটে বেশ তো লিখে দেখিয়ে গেলেন! সবই পাওয়া গেল অল্পবিস্তর, জগৎসংসারের সঙ্কট ও সংঘর্ষ সব, পাওয়া গেল অনেক বেশি দাগ-কাটার মতো করে। অস্তিত্বের অবহ অনটন অনেক বেশি ও তুলনারহিত উজ্জ্বলভাবে সন্দীপনে এসে পেলাম আমরা।

যারা লেখালেখি কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সন্দীপন মনে করেন, দেখতেশুনতে সবাই তারা একরকম অবিকল হলেও সকলেই লেখক নয়। এরা ব্যতিক্রমহীনভাবে বেশিরভাগই ভেড়া। আরও মনে করেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, একদঙ্গল ভেড়ার ভিড়ে লেখক সর্বদা বাঘ। ঘূর্ণমান শ্বেতচক্রের ওপর একজন লেখক বিপজ্জনকভাবে, দুর্ধর্ষভাবে, হলুদ ও ডোরাকাটা ঝাঁপ দেয়, প্রণয়নখরে গিঁথে তাকে স্তব্ধ করে।

জাহেদ আহমদ নভেম্বর ২০১৩ ব্যানারে ব্যবহৃত প্রতিকৃতির চিত্রী  দেবব্রত ঘোষ

গানপারে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
জাহেদ আহমদ রচনারাশি

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you